![]() |
কুসংস্কার প্রতিরোধে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা রচনা |
ভূমিকা
আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের সুফলের প্রেক্ষিতেও মানুষ পুরোপুরি কুসংস্কার মুক্ত হতে পারেনি, আপামর মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি বিজ্ঞান চেতনার। তাই বিজ্ঞান চেতনার প্রসারে তথা কুসংস্কার দূরীকরণে আগামী দিনের পথপ্রদর্শক ছাত্র-ছাত্রীদের গঠনমূলক ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় কুসংস্কার সমাজ শাসন তথা শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। মানুষও কুসংস্কারে অভ্যস্ত হত উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে, মানসিক দিক থেকে কূপমণ্ডুকতার কারণে। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে মানুষের মনে যখন যুক্তি প্রাধান্য স্থান পেল তখন ধীরে ধীরে সংস্কারের জগদ্দল পাথর সরে যেতে থাকল। সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ প্রথা আর সমাজে মৌরসী পাট্টা বিস্তার করে থাকতে পারল না।
কুসংস্কার কী
কুসংস্কার হল সংস্কারের বিকৃত রূপ। অবৈজ্ঞানিক যুক্তিরহিত অন্ধবিশ্বাস-এর নাম কুসংস্কার। এই কুসংস্কার ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং তা কূপমণ্ডুকতার লক্ষণ।
আধুনিক জীবনে বিজ্ঞানচেতনা ও কুসংস্কার
আধুনিক জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য যুক্তিপ্রধান মনোভাব যা বিজ্ঞানের অবদান। কেননা গাছ থেকে আপেল পড়া কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, তা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব। এই যুক্তি চিন্তায় ও চেতনায় এলে সেই মানুষ আধুনিক মানুষ হয়ে ওঠে। সেজন্য মানুষ তার বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে অরণ্য থেকে সভ্যতা গড়ে তুলেছে। কিন্তু সেই সভ্যতাকে বিজ্ঞান আধুনিক করে তুলেছে। আধুনিক মানুষ তাই যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক। বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তির কাছে কুসংস্কারের অন্ধকার দূরীভূত হয়, ভ্রান্ত ধারণার খোলস খসে যায়। তখন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে কার্যকারণ যোগসূত্রে অর্জিত জ্ঞান ও সত্যরূপ বিজ্ঞান-সচেতন মানুষের কাছে প্রতিভাত হয়। তখন প্রচলিত প্রথা-প্রকরণের অসারত্ব ধরা পড়ে যায় আর বিনষ্ট হয় কুসংস্কারের যুক্তিহীন দাসত্ব। তাই আধুনিক জীবনে কুসংস্কার থাকা উচিত নয়। কারণ বিজ্ঞান ও কুসংস্কার আসলে তেল আর জল-যা কখনো একসঙ্গে মিশ্রিত হয় না।
কুসংস্কারের উদাহরণ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অচলায়তন’ নাটকে আধুনিক জীবনের কুসংস্কারের রূপ-কে তীক্ষ্ণ শ্লেষে কশাঘাত করেছেন। অচলায়তনের বালক সুভদ্র তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল ঘুচিয়ে উত্তর দিকের জানালা খুলে দিয়েছে যা-আয়তনের সংবিধান অনুযায়ী পাপকর্ম হলেও পঞ্চক সুভদ্রর এই কাজ সমর্থন করে। কারণ সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়, বরং আয়তনের বিভিন্ন সংস্কারকে সে ভাঙতে চায়। সেখানের একটি কুসংস্কারের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, পূর্বফল্গুনী নক্ষত্রে কাকিনী সরোবরের নৈঋত কোণে ঢোঁড়াসাপের খোলস খুঁজে, সেই খোলস কালো রঙের ঘোড়ার লেজের সাতগাছি চুল দিয়ে বেঁধে পুড়িয়ে ধোঁয়া করলে সেই ধোঁয়া পিতৃপুরুষেরা ঘ্রাণ নিতে আসেন। এতে পুণ্য হয়। এই কুসংস্কার আয়তনের সবাই বিশ্বাস করলেও পঞ্চক বিশ্বাস করে না। কারণ সে বিজ্ঞানমনস্ক, তাই যুক্তি দিয়ে সে এ সব ঘটনা বিচার করে, বিচার করে তথাকথিত পাপ-পুণ্যবোধের।
কুসংস্কারের স্বরূপ ও আধুনিক জীবন
কুসংস্কারের মাহাত্ম্যে কী না হয়? বোম্বাইতে সমুদ্রের নোনা জল মিষ্টি হয়ে যায়, গণেশ ঠাকুর দুধ খায়, কমপ্ল্যানও খায়; পীরবাবা ও গুরুজীর মন্ত্রে যাপনীয় ব্যাধি নির্মূল হয়, গুরুবাবার পচাগলা মৃতদেহও রেখে দেওয়া হয় তিনি আবার বেঁচে উঠবেন ভেবে, সাপে কামড়ানো রোগীর পুনর্জন্ম হয় ওঝার ঝাড়ফুঁকে। আবার কিছু মানুষের কোপে পড়লে সাধারণ নারীও ‘ডাইনী’তে পরিণত হয়, তাই তাকে পিটিয়ে মারতে হয়। এমন ঘটনা আধুনিক জীবনে প্রায়ই ঘটে থাকে। শুধু কি তাই, আধুনিক মানুষ মুখে ইংরেজি বলছেন, পরনে ও চাল-চলনে তথাকথিত আধুনিকতার কোনো ত্রুটি নেই, কিন্তু তিনিই আবার দুহাতের দশ আঙুলে গ্রহের ফেরের জন্য আংটি পরিবৃত হয়ে রয়েছেন। আবার ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোক নিজের মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছেন, ড্যাডি-মাম্মিতে মেয়েকে অভ্যস্ত করিয়েছেন, ইংরেজিতে কথা বলা ও আধুনিক কায়দা-কানুন শিখিয়েছেন কিন্তু তিনিই আবার মেয়ের বিয়ের সময় করকোষ্ঠী গণনা করাচ্ছেন। এমন অষ্টাবক্র রূপ আধুনিক সমাজে প্রায়ই লক্ষ করা যায়। এমনকি আধুনিক মানুষ নিজের গাড়িতে স্ত্রীকে বাম পাশে বসিয়ে ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছেন, কালো বিড়ালকে রাস্তা পার হতে দেখে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে বসে থাচ্ছেন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে কুসংস্কার আধুনিক সমাজে এখনো বদ্ধমূল।
ছাত্রদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য
ছাত্রদের করণীয়
পড়াশোনার বাইরেও ছাত্রছাত্রীদের একটি নিজস্ব জগৎ তৈরি করতে হবে। দেশের নাগরিক হিসেবে, জাতীয় জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলিকে তাদের ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তাদের চারপাশের মানুষজনকে। কুসংস্কার দূরীকরণে ও বিজ্ঞান চেতনার সম্প্রসারণে তাদের ভূমিকা হবে গঠনমূলক। যেমন, (ক) নিজেদের সংস্কারমুক্ত হতে হবে, হতে হবে যুক্তিবাদী। উপলব্ধি করতে হবে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে গেলে ঠাকুর দেবতা বা আংটি, কবচের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের পড়াশোনা নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে। এই শ্রম ও নিষ্ঠা আনবে আত্মবিশ্বাস-যা সংস্কার দূরীকরণে সাহায্য করবে। (খ) নিজেদের চারপাশের মানুষদের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণে তাদের উৎসের সন্ধান করতে হবে। কি কারণে তাদের সেই বিশ্বাস তা জেনে উৎসমুখে তা বন্ধ করার জন্য প্রয়াসী হতে হবে। (গ) স্কুলে ও নিজস্ব বাসস্থানের কাছে সচেতনতামূলক শিবির গড়ে বিভিন্ন মনীষীদের আদর্শ ও জীবনকথা প্রচার করতে হবে জনমানসে। (ঘ) কুসংস্কারে যারা বিশ্বাসী তাদের বিরুদ্ধে এবং কুসংস্কারজনিত কোন ঘটনা দেখলেই কয়েকজন সম-মনোভাবাপন্ন বন্ধুবান্ধব মিলে তার প্রতিবাদ করতে হবে এবং তাদেরকে যুক্তিবাদী হতে হবে।
উপসংহার
ছাত্রছাত্রীদের এ ধরনের প্রয়াস সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বা তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকদের প্রশ্রয় লাভ করলে বিশেষ ফলপ্রসূ হতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের মিলিত শক্তি, উদ্যম, কর্মনিষ্ঠা ও ত্যাগের মনোভাব এই ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে যে বিশেষ কার্যকর হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।