অধিকারের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করো। |
অধিকারের প্রকৃতি/স্বরূপ
গ্রিনের বক্তব্য
গ্রিন মনে করেন যে, মানুষ তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলেই তার অধিকারের অস্তিত্ব বজায় থাকে। মানুষের অধিকারের অস্তিত্ব অনুভবের মধ্যে তার নৈতিক ধারণাটি সংশ্লিষ্ট। তিনি চুক্তিবাদী দার্শনিকদের সমালোচনা করে বলেন যে, প্রাক্-রাজনৈতিক অবস্থায় মানুষের কাছে অধিকার ছিল একটি অস্পষ্ট ধারণা এবং সকলেই এই অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিল না। তবে প্রাকৃতিক অধিকারের ধারণাটি প্রাক্ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিমজ্জিত ছিল। সেক্ষেত্রে ‘লক্ষ্য’ (end) চরিতার্থ করার ব্যাপারে অধিকার ছিল একটি ‘উপায়’ (means) মাত্র। যেখানে প্রতিফলিত হয় সর্বসাধারণের মঙ্গলের আদর্শ। প্লেটো ও অ্যারিস্টলকে অনুসরণ করে গ্রিন বলেছেন যে, ব্যক্তি তার সুন্দরতম জীবন লাভ করতে পারে বা পরিপূর্ণ জীবনের বিকাশ ঘটাতে পারে রাষ্ট্রের মধ্যে। গ্রিন বাক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটা সমন্বয়সাধনের কথা বলেছেন, কারণ রাষ্ট্র প্রতিটি ব্যক্তি-নাগরিকের মঙ্গলের জন্য সচেষ্ট-রাষ্ট্রের একটা নৈতিক ভিত্তি আছে বলেই তা সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
বার্কারের বক্তব্য
বাকার মনে করেন, অধিকার হল ‘ন্যায় ব্যবস্থার ফল’, তিনি সমগ্র সমাজব্যবস্থা থেকে অধিকারকে আলাদা করে চিন্তা করেননি। রাষ্ট্রের মধ্যে সকল নাগরিকই অধিকার ভোগ করে। রাষ্ট্র বা সরকার আইন প্রণয়ন করে অধিকারসমূহকে সংরক্ষণ করে। স্বাধীনতা, সাম্য ও সহযোগিতার নীতির মধ্য দিয়ে অধিকার বঞ্চিত ও সংরক্ষিত হয়ে থাকে। আইন বাত্তিকে দেয় অধিকার এবং এইসব প্রদত্ত অধিকারসমূহ সংরক্ষিত হয় আইন দ্বারা। এক্ষেত্রে বাকার বৈধ বাক্তিত্বের কথা বলেছেন যা নৈতিক বাক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে পূর্বশত হিসেবে কাজ করে। বাকার ওখানে বৈধ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েছেন। বাকারের মতে, অধিকারের দুটি উৎস বিদ্যমান-একটি হল নৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং অপরটি হল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন। অর্থাৎ তিনি অধিকারের প্রকৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের শতকে যেন দেখিয়েছেন, তেমনই আইনের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণকেও দেখিয়েছেন। এই কারণে তাঁর দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় আইন যেসব অধিকারকে সংরক্ষণ করেনি, সেগুলি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও আইন ব্যতীত অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেহেতু রাষ্ট্র আইনের দ্বারা অধিকারকে বাস্তবায়িত করে তাই অধিকার আইনের মধ্যেই নিহিত এবং আইনই এক্ষেত্রে অধিকার হিসেবে বিদ্যমান থাকে। অতএব দেখা যায় যে বাকার তাঁর অধিকার তত্বে রাষ্ট্র, আইন ও অধিকারকে একল্পবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
ল্যাস্কির বক্তব্য
ল্যাঙ্গি মনে করেন, অধিকার হল সমাজজীবনের এমন কতকগুলি গর্ত যার দ্বারা ব্যক্তি সাধারণভাবে তার ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ বিকাশে সচেষ্ট হতে পারে। অধিকারগুলিকে সংরক্ষণ করতে গিয়ে গষ্ট্রি তার উদ্দেশাকে চরিতার্থ করতে পারে। ল্যাফির অধিকারের ধারণাটি গড়ে উঠেছে তাঁর রাষ্ট্রতত্বের ওপর ভিত্তি করে। এক্ষেত্রে তিনি গ্রিনের তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ল্যান্তি অবাধ অধিকারের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। ল্যাঙ্কি মনে করেন যে, রাষ্ট্রের একটি অন্যতম দায়িত্ব হল জনকল্যাণমূলক আদর্শকে কার্যকর করা। এই আদর্শকে কার্যকর করার মধ্যে নিহিত থাকে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের বাধ্য-বাধকতার বিষয় এবং তার দ্বারাই ব্যক্তি তার অধিকারকে অর্জন করতে পারে। রাষ্ট্র ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে অধিকার সম্পর্কিত দাবিসমূহকে স্বীকার করে নেয়। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে অধিকার দানে ব্যর্থ হলে ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারে। অর্থাৎ অধিকার থেকে বঞ্চিত ব্যক্তি রাষ্ট্রকে তার আনুগত্য জানাতে চাইবে না। এক্ষেতে ল্যাঙ্কি দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল নাগরিকের কল্যাণসাধন। এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে ও তা প্রয়োগ করে এবং অধিকার এই উদ্দেশ্যকে সাফল্য দান করে। তাই ল্যাঙ্কি মনে করেন অধিকার হল সমাজজীবনের এমন সব শর্ত যা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করে। অধ্যাপক ল্যাঙ্কি মনে করেন একটি রাষ্ট্রের প্রকৃতি যথাযথভাবে নির্ধারণ করতে গেলে দেখতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটি তার নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগসুবিধা দিয়েছে কি না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সুযোগসুবিধা দান এবং নাগরিক কল্যাণ। রাষ্ট্র তার এই উদ্দেশ্যকে সাফল্য দানের জন্য আইন প্রণয়ন করে ও তা প্রয়োগ করে। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, 1789 খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব এবং 1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মঙ্গলময় জীবনধারণের বিষয়টি পরিস্ফুটিত হয়েছে। রাষ্ট্র যাদের ওপর তাদের আইন প্রয়োগ করছে তারাই বিচার করবে তাদের অধিকার রাষ্ট্র দ্বারা কতখানি সুরক্ষিত ও মঙ্গলময় হয়ে উঠেছে।
মার্কসবাদীদের বক্তব্য
অধিকার সম্পকে মার্কসের ধারণা দুটি বিষয়ের দ্বারা আচ্ছন্ন-একটি হল রাষ্ট্র এবং অপরটি হল আইন। কার্ল মার্কস বলেছেন যে, রাষ্ট্র অর্থনীতির ওপর ভিত্তি (base) করে গড়ে ওঠা উপরিকাঠামো (supertructure), যেখানে মানুষ সামাজিক উৎপাদনকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে কতকগুলি সম্পর্ককে মেনে নিয়েছে। মার্কসবাদ অনুসারে, কোনো সমাজে অর্থনৈতিক অবস্থা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ছাপিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অর্থাৎ অধিকারকে মেনে নিতে হয় সমাজের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গণ্ডিকে। কারণ অধিকার তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র যেহেতু একটি ‘শ্রেণি শোষণের যন্ত্র’, সেহেতু তার হাতিয়ার হিসেবে সে আইন রচনা করে শোষিত শ্রেণিকে তার অধিকার থেকে বস্তুিত করে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। কাজেই দেখা যায় যে, দাস সমাজে সকল অধিকার ভোগ করত দাস। মালিকরা, দাসরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, সামন্ত সমাজে সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাসদের বঞ্চিত করে সকল অধিকার ভোগ করত এবং ধনতান্ত্রিক সমাজে মালিক শ্রেণি শ্রমিক শ্রেণিকে অধিকার চ্যুত করে সকল ক্ষমতা ভোগ করে। ধনতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিক শ্রেণিকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেও তারা শ্রেণিস্বার্থের কথা মনে রেখে সমাজকে কিছুটা অধিকার প্রদান করে অধিকারতত্ত্ব গড়ে তোলে। মার্কসবাদ অনুসারে এইসব অধিকার হল রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার-অর্থনৈতিক অধিকার নয়। অর্থনৈতিক অধিকার ব্যতীত কোনো অধিকারই মূল্যবান হতে পারে না।