অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু লেখো

অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু লেখো

অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু লেখো
অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু লেখো

অর্থশাস্ত্রের সংজ্ঞা

প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল, কৌটিল্য বা চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্র। অর্থশাস্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, এই সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কামন্দকের নীতিসার-এ বলা হয়েছে যে, সাফল্যের সঙ্গে রাজ্যের সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ করার জন্য যেসকল কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেই সকল কৌশল সংবলিত শাস্ত্রই হল অর্থশাস্ত্র। অন্যদিকে শুক্রনীতিসারের ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, সম্পদ সংগ্রহ ও রাজ্যশাসন সম্পর্কিত নির্দেশাবলি রাজাকে প্রদান করা হয়েছে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে। এ ছাড়া কৌটিল্যের কোনও কোনও পূর্বসূরি এমনও বলেছেন যে, প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত জমির সদ্ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং মানুষের প্রয়োজনে তা প্রয়োগ করার জন্য যে শাস্ত্র রচনা করা হয়, তাকে বলা হয় অর্থশাস্ত্র।

অর্থশাস্ত্রের ধারণা প্রসঙ্গে কৌটিল্য তন্ত্রযুক্তি (পঞ্চদশ অধিকরণ)-তে উল্লেখ করেছেন- “মনুষ্যের বৃত্তি বা জীবিকাকে ‘অর্থ’ বলা যায়। মনুষ্যযুক্ত ভূমির নামও ‘অর্থ’ হয়। যে শাস্ত্র সেই পৃথিবীর লাভ ও পালনের উপায় নিরূপণ করে, তাহার নাম অর্থশাস্ত্র”F [মনুষ্যনাং বৃত্তিরর্থঃ মনুষ্যবতী ভূমিরিত্যথঃ। তস্যাঃ পৃথিব্যা লাভ পালনোপায়ঃ শাস্ত্রমর্থ শাস্ত্রমিতি।]। অর্থাৎ, কৌটিল্যের মতে, অর্থ হল মানুষের জীবিকানির্বাহের অবলম্বন স্বরূপ একটি বৃত্তি। আবার পৃথিবী, যা মানুষকে ধারণ করে আছে, তা হল সম্পদ বা অর্থ। এই ভূমি বা পৃথিবী অর্জন এবং সংরক্ষণ বিদ্যাই হল অর্থশাস্ত্র। আর পি কাঙ্গলে (RP Kangle) ‘The Kautiliya Arthasastra’ শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে- “Arthasastra is the science which is the means of the acquisition and protection of the earth.”

অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু

কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তাকে একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ রূপ দিয়েছেন। অর্থশাস্ত্রের আলোচনার প্রকৃতিও বস্তুনিষ্ঠ, ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক। ১৫টি অধিকরণ ও ১৫০টি অধ্যায়ে বিভক্ত সমগ্র অর্থশাস্ত্রে মোট ১৮০টি প্রকরণ ও ৬ হাজার শ্লোক আছে।  প্রতিটি শ্লোকেই রাষ্ট্রতত্ত্ব ও প্রশাসন পরিচালনার খুঁটিনাটি বিবরণ উপস্থিত। অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম অধিকরণে বলা হয়েছে- ‘কৌটিল্যেন কৃতং শাস্ত্রং বিমুক্ত গ্রন্থ বিস্তরম্’, আর গ্রন্থের শেষে বলা হয়েছে ‘শাস্ত্রঞ্চ শাস্ত্রও নন্দরাজগতা চ ভূঃ।’ এই গ্রন্থের বিভিন্ন অধিকরণের বিষয়বস্তুগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-

(i) প্রথম অধিকরণ

অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধিকরণ বিনয়াধিকারিক (রাজার বিনয় ও বিদ্যাশিক্ষার বিষয় সংবলিত) নামে পরিচিত। এতে মোট ১৮টি প্রকরণ ও ২১টি অধ্যায় আছে। এখানে শাসন পরিচালনায় রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য, রাজ্যের নিরাপত্তা, মন্ত্রী ও গুপ্তচর নিয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে।

(ii) দ্বিতীয় অধিকরণ

৩৮টি প্রকরণ ও ৩৬টি অধ্যায় নিয়ে গঠিত দ্বিতীয় অধিকরণে জনপদ নির্মাণে রাজার ভূমিকা, শাসনকার্যে অধ্যক্ষদের নিয়োগ, সম্পত্তির সুরক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এর অপর নাম অধ্যক্ষ প্রচার।

(iii) তৃতীয় অধিকরণ

অর্থশাস্ত্রের তৃতীয় অধিকরণটি ধর্মস্বীয় নামে পরিচিত। এতে রয়েছে মোট ১৯টি প্রকরণ ও ২০টি অধ্যায়। দেওয়ানি আদালত বিষয়ক ব্যবহারবিধি, রাষ্ট্রের আইনকানুন ও বিচার সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে এই অধিকরণে।

(iv) চতুর্থ অধিকরণ

অর্থশাস্ত্রের চতুর্থ অধিকরণ অর্থাৎ, কণ্টকশোধন-এ ফৌজদারি আদালতের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার, রাষ্ট্রবিরোধীদের অপরাধ শনাক্ত করা, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের বিভিন্ন প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া অসৎ বৈদ্য এবং ব্যবসায়ীদের থেকে সাবধান হওয়ার কথাও এতে উল্লিখিত আছে। ১৩টি প্রকরণ ও ১৩টি অধ্যায় চতুর্থ অধিকরণে রয়েছে।

(v) পঞ্চম অধিকরণ

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের পঞ্চম অধিকরণটি হল যোগবৃত্ত। এখানে মোট ৭টি প্রকরণ ও ৬টি অধ্যায়ে বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কর্মচারীদের বেতন সংক্রান্ত নিয়মকানুন, দণ্ডবিধি বিষয়ক নীতি প্রবর্তন, গুপ্তহত্যা দ্বারা শত্রুর বিনাশ করা প্রভৃতি বিষয়ে বক্তব্য স্থান পেয়েছে এই অধিকরণে।

(vi) ষষ্ঠ অধিকরণ

যষ্ঠ অধিকরণ অর্থাৎ, মণ্ডলযোনি হল অর্থশাস্ত্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধিকরণ। এখানে রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে ২টি অধ্যায় ও ২টি প্রকরণ উপস্থিত।

(vii) সপ্তম অধিকরণ

২৯টি প্রকরণ ও ১৮টি অধ্যায় নিয়ে গঠিত ষাড়গুণ বা ষাড়গুণ্য নামে পরিচিত সপ্তম অধিকরণে মূলত পরাক্রান্ত রাজার শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভের পদ্ধতি, সন্ধির মাধ্যমে প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে রাজার সম্পর্ক স্থাপন প্রভৃতি বিষয়বস্তু স্থান পেয়েছে। সন্ধি, বিগ্রহ, আসন, যান, সংশ্রয় ও দ্বৈধীভাব-এগুলিই হল ষাড়গুণ্য বা ছয়টি গুণ।

(viii) অষ্টম অধিকরণ

অর্থশাস্ত্রের অষ্টম অধিকরণ অর্থাৎ, ব্যসনাধিকারিক-এর মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে অপরাধীদের দ্বারা সৃষ্ট বিপদ, অসৎ ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য স্থান লাভ করেছে। অষ্টম অধিকরণে ৮টি প্রকরণ ও ৫টি অধ্যায় রয়েছে।

(ix) নবম অধিকরণ

নবম অধিকরণ অর্থাৎ, অভিযাস্যৎকর্ম ১২টি প্রকরণ ও ৭টি অধ্যায় নিয়ে গঠিত। এতে যুদ্ধ এবং সামরিক অভিযানে উদ্যোগী রাজাদের কর্তব্য সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে।

(x) দশম অধিকরণ

দশম অধিকরণ বা সাংগ্রামিক-এ যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব, সৈন্যবাহিনী গঠন প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এতে মোট ১৩টি প্রকরণ ও ৬টি অধ্যায় রয়েছে।

(xi) একাদশ অধিকরণ

একাদশ অধিকরণটি পরিচিত সংঘবৃত্ত নামে। এখানে মোট প্রকরণের সংখ্যা ২টি, অধ্যায়ের সংখ্যা ১টি। এই অধিকরণে রাজার আচরণবিধি এবং অভিজাততান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংঘ ও নিগম সম্পর্কিত নীতি বিষয়ে উল্লেখ আছে।

(xii) দ্বাদশ অধিকরণ

আবলীয়স নামে পরিচিত দ্বাদশ অধিকরণে দুর্বল রাজা কীভাবে বিপদমুক্ত হবেন, সেই সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধিকরণে ৯টি প্রকরণ ও ৫টি অধ্যায় উপস্থিত।

(xiii) ত্রয়োদশ অধিকরণ

ত্রয়োদশ অধিকরণ বা দুর্গলম্ভোপায়-এ শত্রুবাহিনীর দুর্গ দখল সংক্রান্ত উপায় সম্পর্কে আলোচনা স্থান পেয়েছে। এখানে প্রকরণ ৬টি ও ৫টি অধ্যায় রয়েছে।

(xiv) চতুর্দশ অধিকরণ

ঔপনিষদিক বা চতুর্দশ অধিকরণে মন্ত্র, ঔষধি ও বশীকরণ দ্বারা শত্রুরাজ্য দখলের উপায় বর্ণিত হয়েছে। উক্ত অধিকরণে ৩টি প্রকরণ ও ৪টি অধ্যায় উপস্থিত।

(xv) পঞ্চদশ অধিকরণ

তন্ত্রযুক্তি নামক পঞ্চদশ এই অধিকরণে কৌটিল্যের পরিচয় ও ‘অর্থশাস্ত্র‘ নামকরণের ব্যাখ্যা আলোচিত হয়েছে। সর্বশেষ এই অধিকরণটিতে ১টি প্রকরণ ও ১টি অধ্যায় রয়েছে।

আরও পড়ুন – গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

Leave a Comment