অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য বর্ণিত রাষ্ট্রতত্ত্ব বা ‘সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব’ আলোচনা করো
অথবা, কৌটিল্যের ‘সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব’ সংক্ষেপে লেখো
কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটির ষষ্ঠ অধিকরণ মণ্ডলযোনি-তে রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাষ্ট্রপরিচালনার যেসকল নিয়মনীতি সম্পর্কে আলোচনা উপস্থিত, তার মধ্যে সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব-এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব অনুযায়ী, কৌটিল্য রাষ্ট্রকে একটি সক্রিয় জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একটি জীবদেহের যেমন বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে, তেমনই রাষ্ট্রপরিচালনার বিভিন্ন অঙ্গগুলি হল- স্বামী বা রাজা, অমাত্য, দুর্গ, জনপদ, কোশ, দণ্ড ও মিত্র। এগুলি একত্রে সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব নামে পরিচিত।
কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব
কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের ব্যাখ্যা নিম্নে আলোচনা করা হল-
(i) স্বামী বা রাজা
সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের প্রধান অঙ্গ স্বামী বা রাজা হলেন জীবদেহের মাথার সঙ্গে তুলনীয় এবং এখানে স্বামী শব্দটি প্রধান বা প্রভু অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রপ্রধান হবেন উচ্চগুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি হবেন অভিজাত বংশীয় এবং অধিক জ্ঞানসম্পন্ন। তবে তাঁকে অবশ্যই ষড়রিপুর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, রাজা হলেন সকল ক্ষমতার উৎস এবং সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভরকেন্দ্র। তাঁর চারটি গুণ থাকা অবশ্যই প্রয়োজন, যথা- অভিগামিক গুণ (ধর্মপরায়ণতা, নম্রতা, বিচক্ষণতা ইত্যাদি), প্রজ্ঞাগুণ (ধীশক্তি, অনুধাবন শক্তি ইত্যাদি), উত্থান বা উৎসাহ গুণ (সাহস এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজ শেষ করার ক্ষমতা) এবং আত্মসম্পদ গুণ (বাগ্মিতা, সংকটকালে অবিচলিত থাকা, শত্রুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপনের দক্ষতা ইত্যাদি)। কৌটিল্য রাজাকে সর্বদা শাস্ত্রনির্দিষ্ট পথে ও সংযত হয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রজাপালন ও প্রজাদের রক্ষা করা রাজার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।
(ii) অমাত্য
অমাত্য হল সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের দ্বিতীয় অঙ্গ। এটিকে জীবদেহের চক্ষুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সাধারণত অমাত্য বলতে মন্ত্রীদের বোঝায়, কিন্তু সপ্তাঙ্গ তত্ত্বে অমাত্য বলতে মন্ত্রী, কর্মসচিব বা উচ্চ রাজকর্মচারীদেরকেও বোঝানো হয়েছে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে অমাত্যদের নিয়োগ, কর্তব্য এবং দায়িত্বের বিষয়ে সবিশেষ আলোচনা করেছেন। এমনকি মন্ত্রী বা অমাত্য হিসেবে নিয়োগের পরে তাদের আরও বেশকিছু কঠিন পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অমাত্যরা নানান পদে নিযুক্ত হতেন, যেমন- পুরোহিত, সমাহর্তা, সন্নিধাতা, কোশাধ্যক্ষ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারক, রাজদূত, বিভিন্ন দফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রমুখ। এ ছাড়া কৌটিল্য উল্লেখ করেছেন যে, রাজাকে মন্ত্রণা বা পরামর্শদানে যারা সাহায্য করবেন, তারা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হবে। অমাত্যদের প্রধান কর্তব্যই হল, রাজকার্য পরিচালনায় রাজাকে সঠিকভাবে সাহায্য করা।
(iii) জনপদ
সপ্তাঙ্গ তত্ত্বে জনপদকে জীবদেহের পা-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য জনপদ শব্দটি জনসমষ্টি ও নির্দিষ্ট ভূখণ্ড উভয় অর্থেই ব্যবহার করেছেন। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী জনপদের বৈশিষ্ট্য হবে, সুজলা-সুফলা যেখানে কৃষকেরা অতি সহজেই ফসল উৎপাদন করতে পারবে এবং উৎপন্ন ফসলের একাংশ রাজাকে কর হিসেবে প্রদান করবে। এ ধরনের ভূখণ্ডে থাকবেন বিচক্ষণ প্রভু ও বিপুলসংখ্যক নিম্নশ্রেণিভুক্ত জনগণ। কৌটিল্য রাষ্ট্রের জনবল বাড়ানোর জন্য রাজাকে নতুন নতুন জনপদ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, জনপদের কোনও জমিই রাজা ফেলে রাখবেন না। যেসকল জমি কৃষিকাজের পক্ষে অনুপযুক্ত, সেখানে গবাদিপশুদের বাসস্থান বা রাজার জন্য মৃগবন নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের রক্ষা করে রাজা জনপদের শান্তি বজায় রাখবেন বলেও উল্লেখ করা হয়।
কৌটিল্যের মতে, জনপদের আয়তন এমন হতে হবে যাতে তা স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে পারে। তাঁর মতে, ১০০ থেকে ৫০০ পরিবার নিয়ে এক-একটি গ্রাম গড়ে উঠবে। তাছাড়া অর্থশাস্ত্রে স্থানীয়কে জনপদের অন্তর্গত বৃহত্তম এককরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। ৮০০টি গ্রাম নিয়ে এরকম একক গড়ে উঠবে।
(iv) দুর্গ
সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের চতুর্থ অঙ্গ হল দুর্গ বা পুর, যা জীবদেহের হাতের সঙ্গে তুলনীয়। শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান হিসেবে কৌটিল্য দুর্গ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্গের গঠন, পরিখা, প্রাচীর প্রভৃতি নানান বিষয়ে অর্থশাস্ত্রে বিশদ আলোচনা উপস্থিত। অর্থশাস্ত্রের দ্বিতীয় অধিকরণে দুর্গবিধান অধ্যায়ে কৌটিল্য চার প্রকার দুর্গের কথা বলেছেন, যথা- জলদুর্গ (ঔদক দুর্গ), পার্বত্য দুর্গ (পার্ব্বত দুর্গ), মরূদুর্গ (ধাম্বন দুর্গ) এবং বনদুর্গ।
জলদুর্গ: এরূপ দুর্গ চারপাশে জলবেষ্টিত এলাকা নিয়ে গড়ে উঠত।
পার্বত্য দুর্গ: চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত অথবা পাহাড়ের মধ্যে গড়ে ওঠা দুর্গ ছিল পার্বত্য দুর্গ।
মরুদুর্গ: মরু এলাকায় গড়ে ওঠা দুর্গ ছিল মরূদুর্গ।
বনদুর্গ: এই ধরনের দুর্গ বনাঞ্চলে নির্মাণ করা হত। এ ছাড়া যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য কৌটিল্য রাজাকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র মজুত রাখার কথাও বলেছেন।
(v) কোশ
সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের পঞ্চম উপাদান কোশ হল মূলত রাজকোশ। একে জীবদেহের মুখের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কৌটিল্যের মতানুযায়ী, সৎ এবং ন্যায়সম্মতভাবে যে অর্থ অর্জন করা হয়েছে তাকে রাজা সঞ্চয় করে রাখবেন। কেননা, আপৎকালীন পরিস্থিতি (দুর্ভিক্ষ, মহামারি, আক্রমণ কিংবা এরূপ কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি) মোকাবিলার জন্য মূল্যবান ধাতু কিংবা নগদ অর্থের প্রয়োজন, যা তিনি রাজকোশ থেকে ব্যয় করতে পারবেন। তাছাড়া, কোশ এবং সামরিক শক্তির সম্পর্ক নিবিড়, রাজকোশে অর্থ না থাকলে স্থায়ী সেনাবাহিনী টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কোশে অর্থের জোগান বৃদ্ধির জন্য কৌটিল্য নানারকম কর আদায়ের কথা বলেছেন। যেমন- প্রজাদের উপর আরোপিত ভূমিরাজস্ব, কৃষকদের থেকে প্রাপ্ত শস্যকর, সেচকর, ব্যবসায়ীদের থেকে সংগৃহীত পণ্যকর ইত্যাদি।
(vi) দন্ড
দণ্ড বলতে বোঝায় দমনমূলক ক্ষমতাকে। সাধারণভাবে সেনাবাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্ষমতার কথা বলা হয়। সৈন্যবাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী, রথারোহী ও হস্তিবাহিনী থাকবে। অর্থশাস্ত্রের আলোচনা অনুসারে সেনারা হবে মূলত বংশানুক্রমিক এবং অনুগত। সেনাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কৌটিল্য বলেছেন যে, সৈন্যরা হবে দক্ষ, ধৈর্যশীল এবং অবশ্যই রাজার আজ্ঞাবহ। এই সকল সৈন্য ও তাদের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব থাকবে রাষ্ট্রের হাতে। সেনাবাহিনীতে কৌটিল্য ক্ষত্রিয়দের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে বৈশ্য ও শূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত যোগ্য ব্যক্তিরাও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে।
(vii) মিত্র
রাষ্ট্রের সপ্তম অঙ্গ বা উপাদান যা জীবদেহের কর্ণের সঙ্গে তুলনীয়, তা হল মিত্র বা সুহৃদ। সকল প্রয়োজনে যে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকে এবং যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে না- সে হল মিত্র। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে বন্ধু রাজা বা মিত্র থাকা আবশ্যিক। কৌটিল্যের মতানুযায়ী, রাষ্ট্রের প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্বভাবশত্রু এবং তার ঠিক পাশের রাষ্ট্র প্রথম রাষ্ট্রের স্বাভাবিক মিত্র। কোনও মিত্র একবার পরিত্যাগ করে আবার ফিরে এলে তাকে গ্রহণ করা উচিত নয়।
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে যে সাতটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন, সেই সবকটি উপাদান তথা অঙ্গগুলিই একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পকযুক্ত। রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং তাকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিটি অঙ্গেরই সক্রিয়তা একান্ত প্রয়োজন।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর