আইনের উৎসগুলি কী কী আলোচনা করো।

আইনের উৎসগুলি কী কী আলোচনা করো।
আইনের উৎসগুলি কী কী আলোচনা করো।

আইনের উৎসসমূহ

আইন হঠাৎ-ই রাষ্ট্র শস্তির দ্বারা গড়ে ওঠেনি। আবার কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি আইন স্বেচ্ছাকৃতভাবে গড়ে তোলেননি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইন প্রণীত হয়েছে। আইনের ইতিহাস ও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আইনের গঠনপ্রকৃতি দেখে মনে হয় যে, আইনের উৎস হল 6টি। যেমন- [1] প্রথা, [2] ধর্ম, [3] আদালতের সিদ্ধান্ত, [4] বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, (5) ন্যায়নীতি, [6] আইনসভা। সার্বিক দিক থেকে এগুলির আলোচনা করা হল-

[1] প্রথা (Custom): 

আইনের প্রাচীনতম উৎস হল প্রথা। প্রথা বলতে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিকে বোঝায়। প্রচলিত প্রথাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করতে পারে না। রাষ্ট্র প্রথাকে স্বীকৃতি দিলে তা ‘আইন’-এর মর্যাদা লাভ করে। রাষ্ট্র যখনই আইন প্রণয়ন করে প্রথাকে বাদ দিয়ে তা করতে পারে না। প্রথাকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র কোনো আইন প্রণয়ন করলে জনরোষের মধ্যে পড়তে হয়। তাই আইন রচনার সময় সমস্ত রাষ্ট্রই প্রথাকে অনুসরণ করে। সকল দেশেই প্রথার ওপর ভিত্তি করে আইন প্রতিষ্ঠিত হয়।

[2] ধর্ম (Religion): 

ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে প্রাচীন সমাজব্যবস্থা শাসিত ও পরিচালিত হত। আইন ও ধর্মকে তখন অভিন্ন বলে মনে করা হত। ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারাই প্রাচীনকালে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হত এবং সমাজের ঐক্য বজায় রাখা হত। সমাজে কোনো অহন না থাকায়, অথবা বলা যায় আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় ধর্মকে সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সামাজিক মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হত। পরবর্তীকালে রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি-এই সময় রাষ্ট্র ঈশ্বরকে মান্য করার জন্য রাজাকে মেনে চলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে অলক্ষে আইনকে কার্যকর করার চেষ্টা করে। গ্রিস ও রোমে প্রাচীনকালের বেশিরভাগ আইনই ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। অতএব বলা যায় যে, ধর্ম, আইন সৃজনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

[3] আদালতের সিদ্ধান্ত (Judicial Decision): 

প্রাচীনকালে সমাজে যখন নানা কারণে মানুষের মধ্যে জটিলতা বাড়তে থাকে তখন উপস্থিত হয় নানা রকমের দ্বন্দ্ব ও বিবাদ। এইসব দ্বন্দ্ব ও বিবাদের শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে না পারলে সমাজে নেমে আসবে ঘোর অশান্তি। যার হাত থেকে কখনও মানুষ নিষ্কৃতি পাবে না। এই অশান্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য গোষ্ঠীপতি, দলপতি, রাজা, সমাজের জ্ঞানী ব্যক্তিরা যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এগিয়ে আসেন তার ফলে বিচার ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। বিচারব্যবস্থায় নিযুক্ত বিচারপতিরা যেসব বিচার কাজ করতেন তা প্রথা বা ধর্মীয় অনুশাসন থেকে আসত। এইসব প্রথা বা ধর্মীয় অনুশাসন বিচারের পক্ষে পরিপূরক না থাকায় তারা নিজেরাই নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নিত। তাদের এইসব সিদ্ধান্তই আদালতের সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিচিত হয় এবং আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে।

[4] বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা (Scientific Discussion): 

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনেরও পরিবর্তন ঘটে। আইন কোনো স্থিতিশীল বিষয় নয়। অন্যদিকে আইনের মধ্যে নিহিত আছে কতকগুলি যুক্তিসম্মত শব্দ। যুগের তথা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে যদি আইনের পরিবর্তন ঘটানো না যায় তাহলে তা সমাজের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে পারবে না। এই কারণে আইন শাস্ত্রে পারদর্শী বিভিন্ন পন্ডিত ও লেখকদের রচনায় আইন সম্পর্কিত বিভিন্ন ভাষ্য, আলোচনায় তাঁরা তাঁদের যুক্তিসম্পন্ন যেসব মতামত ব্যক্ত করে তা আইন রচনার ক্ষেত্রে খুবই সহায়ক হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ব্রিটেনের ব্ল্যাকস্টোন, ডাইসি, জেনিংস, কোক; যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট, স্টোরি প্রমুখ আইনবিদদের যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত অভিমতকে আইন রচনার সময় স্মরণ করা হয়।

[5] ন্যায়নীতি (Equity): 

হেনরি মেইন বলেছেন যে, ন্যায়নীতি হল এমন এক আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি যার দ্বারা সততা ও সমতার আচরণের ওপর ভিত্তি করে নতুন আইন রচনা এবং প্রচলিত আইনের পরিবর্তন সাধন করা। বিচারপতিদের বিচারকার্য সম্পাদনই একমাত্র কাজ নয়, তাঁরা দেখেন ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার দ্বারা সমাজব্যবস্থা যাতে সুখ ও পরিপূর্ণতায় ভরে যেতে পারে। আইনবিভাগ আইন প্রণয়ন করলেও বিচার বিভাগ সেইসব আইনের বৈধতা বিচার করে। যেসব আইন জনকল্যাণের বিরোধী বলে বিচার বিভাগ মনে করে সেই আইনকে বাতিল করে দেয়। অতএব, বিচারকগণ সমাজের পরিবর্তনের দিকে লক্ষ রেখে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে থাকেন এবং নতুন আইন সৃষ্টিতে সহায়ক হন।

[6] আইনসভা (Legislative): 

ওপেনহাইম, গিলক্রাইস্ট হল প্রমুখ মনে করেন যে, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গিল ক্রাইস্ট বলেছেন যে, আধুনিক রাষ্ট্রে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনসভা জনমতকে উপেক্ষা করে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। বর্তমানে তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যেভাবে প্রসার ঘটেছে, ঠিক অনুরূপভাবে আইনসভা দ্বারা প্রণীত আইনের প্রসার ঘটেছে।

উপসংহার: 

এইসব কারণে বলা যায় যে, আইনের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে প্রথা, ধর্ম, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত, ন্যায়নীতি কখন ও কীভাবে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে তা যথাযথভাবে বলা যায় না। কিন্তু উৎসগুলিকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগিয়ে তা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।

Leave a Comment