আইন বলতে কী বোঝ? আইনের প্রকৃতি আলোচনা করো

আইন বলতে কী বোঝ? আইনের প্রকৃতি আলোচনা করো।
আইন বলতে কী বোঝ? আইনের প্রকৃতি আলোচনা করো।

আইন

আইনের অর্থ অনুসারে আইনকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। ব্যাপক অর্থে আইন এবং সংকীর্ণ অর্থে আইন।

ব্যাপক অর্থে আইন

ব্যাপক অর্থে আইন বলতে প্রাকৃতিক, নৈতিক ও সামাজিক প্রভৃতি আইনকে বোঝায়। প্রথমত, প্রাকৃতিক আইন বলতে সেইসব আইনকে বোঝায় যার দ্বারা প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে সংঘটিত কার্যকারণের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষিত হয় এবং কার্যকর করে। দ্বিতীয়ত, নৈতিক আইন হল সেইসব আইন যা মানুষের আচার- আচরণ, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত প্রভৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং এইসব বিষয়ে সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সৃষ্ট নিয়মকানুনসমূহ। তৃতীয়ত, আবার সমাজ জীবনের ক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়ে তোলার জন্য সৃষ্ট প্রয়োজনীয় নিয়মকানুনকে বলা হয় সামাজিক আইন।

সংকীর্ণ অর্থে আইন

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘আইন’ শব্দটিকে সংকীর্ণ অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। মানুষের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও মতাদর্শ প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনকে আইন বলা হয়। এইসব আইন সার্বভৌম শক্তির দ্বারা সমর্থিত ও প্রযুক্ত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গৃহীত ‘আইন’-এর ধারণাটির সঙ্গে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন জড়িত।

আইনের অন্যান্য সংজ্ঞা

হবক্স, বোঁদা, হল্যান্ড, জন অস্টিন প্রমুখ আইনকে সার্বভৌমের আদেশ বলে মনে করেছেন। হল্যান্ড বলেছেন যে, সার্বভৌম মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা যেসব নিয়মকানুন প্রয়োগ করে তাকে বলা হয় আইন। অপরদিকে হেনরি মেইন, মেটল্যান্ড প্রমুখ চিন্তাবিদ আইনকে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বলতে চাননি। উইলসন আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, আইন বলতে মানুষের আচরণ ও চিন্তার সেইসব অংশকে বোঝায় যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং যা সুস্পষ্ট, সরকার দ্বারা সমর্থিত। আবার বাকার বলেছেন, আইন হল এমন একটি বিষয় যার মধ্যে বৈধতা এবং নৈতিক মূল্য অবশ্যই থাকতে হবে।

মার্কসবাদীদের অভিমত

মার্কসবাদীরা অনাভাবে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। ভিশিনব্ধি বলেছেন যে, আইন বলতে সেইসব আচরণবিধিকে বোঝায় যাতে সমাজের প্রতিপত্তিশালী শ্রেণির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। ল্যাঙ্কি অনুরূপভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আইন বলতে বোঝায় সমাজের অধিকারভোগী শ্রেণির স্বার্থবহনকারী কতকগুলি নিয়মকানুনের সমষ্টিকে।

আইনের প্রকৃতি

আইনের এইসব সংজ্ঞা থেকে আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে যে বিষয়গুলি নির্ণয় করা যায় তা হল-
[1] রাষ্ট্রের আইন স্থিতিশীল নয়। সময়ের এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনও গতিশীল ও পরিবর্তনশীলসম্পন্ন। 
[2] আইন বলতে ব্যক্তির আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণমূলক একটি বিষয়কে বোঝায়। আইন যেমন কোনো ব্যক্তির বাহ্যিক আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি বাক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রভৃতি ক্ষেয়েও আইন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। 
[3] আইন যেমন মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি অনুমোদনও করে। এর ফলে আইন জনকল্যাণ তথা সমাজকল্যাণের কাজে ব্রতী হয়। 
[4] আইন হল সর্বজনীন। কোনো বাক্তির একার উপরই আইন প্রযুক্ত হয় না। সমাজের সকলের উপরে আইন সমানভাবে প্রযুক্ত হয় বলে আইনের সর্বজনীনতা স্পষ্ট। 
[5] বাকার আইনকে ন্যায়পরায়ণ ও মূল্যবোধসম্পন্ন বলে উল্লেখ করেছেন। আইন কেবল বৈধ হলেই চলে না। 
[6] সার্বভৌম শক্তি আইনকে অনুমোদিত করে। আইন এই জনা সকলের উর্ধ্বে অবস্থান করে।
[7] আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। 
[৪] আইন সার্বভৌম শক্তি দ্বারা প্রযুক্ত হয় এবং আইনভঙ্গাকারীকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। 
[9] আইন সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং সর্বজনীন বিষয়। 
[10] সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা যাতে বজায় থাকে তার জন্য আইন অবশ্যই প্রয়োজন। যদি আইন জনকল্যাণকর হয়, তাহলে তা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে। 
[11] সমাজে প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, লোকাচার প্রভৃতি একসময় আইনের মর্যাদা পায়। 
[12] আইনের উপযোগিতা আছে বলেই আইন মেনে চলা হয়।
আইন সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মার্কসবাদ অনুসারে আইন হল সমাজের উপরিকাঠামোর মধ্যে একটি। ল্যাঙ্কি বলেছেন যে, আইন বলতে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্য স্বার্থবহনকারী নিয়মকানুনকে বোঝায়।

Leave a Comment