ইউরোপে আধুনিক মুদ্রণশিল্পের উদ্ভব কীভাবে ঘটে

ভূমিকা
মধ্যযুগের ইউরোপে ‘বই’ বা ‘পুস্তক’ অচেনা ছিল না, কিন্তু তার রূপ ছিল লিখিত পুথি। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে নতুন ধরনের ‘বই’-এর উদ্ভব হয়। এই বই দেখতে পুরোনো পুথির থেকে খুব আলাদা না-হলেও, এগুলি কাগজ বা ভেলাস-এর (পশুর চামড়া থেকে তৈরি) উপরে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র দ্বারা নতুন ধাতব টাইপ ব্যবহার করে ছাপা হয়েছিল। মুদ্রণশিল্পের এই পরিবর্তনের পিছনে দীর্ঘকালের অনেক মানুষের প্রচেষ্টা ছিল। আধুনিক মুদ্রণশিল্পের উদ্ভবকে সমকালীন কিছু পরিস্থিতিও অনিবার্য করে তুলেছিল।
(1) কাগজের প্রচলন: খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে চিনে কাগজ তৈরির যে কৌশল আবিষ্কৃত হয় তা অষ্টম শতকে আরবে পৌঁছোয়। আরবদের থেকে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে স্পেনে কাগজ তৈরির কৌশল পৌঁছোয়। ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে প্রথম কাগজের কারখানা স্থাপিত হয়। পরবর্তী দুই শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে কাগজের কল স্থাপিত হয়। ইটালি, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে আগেকার পার্চমেন্টের বদলে কাগজের উপর বই ছাপা হতে শুরু করে। ফলে ইউরোপে বই ছাপার কাজ ও খরচ দুই-ই কমে যায়। কারণ আগেকার পার্চমেন্ট ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একটি বাইবেল মুদ্রণের জন্য প্রয়োজনীয় পার্চমেন্ট তৈরির জন্য ৩০০টি ভেড়া ও ১৪০টি বাছুরের চামড়ার প্রয়োজন হত। কিন্তু কাগজে মুদ্রণের ফলে খরচ প্রায় ১/৬ অংশে নেমে আসে।
(2) নতুন ধরনের টাইপ উদ্ভাবন: মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব হয়েছিল নতুন ধরনের টাইপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে। কোনো খোদাই করা ব্লক থেকে নয়, নতুন আলাদা অক্ষরের টাইপ দিয়ে ছাপার কাজ শুরু হয় পঞ্চদশ শতকের শুরু থেকে। বিভিন্ন পেশায় যুক্ত দক্ষ কারিগররা, বিশেষ করে স্বর্ণকাররা খুব ছোটো জিনিসের ওপর সূক্ষ্ম খোদাই করতে পারতেন। তাদের এই দক্ষতাই নতুন টাইপ তৈরিতে কাজে লেগেছিল। এসময় ধাতুবিদ্যার উন্নতিও নতুন ধরনের টাইপ তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল।
(3) তেল মিশ্রিত রং ও কালির ব্যবহার: নতুন ধরনের কালির প্রচলনও মুদ্রণশিল্পের বিকাশের সহায়ক ছিল। এই সময়ে শিল্পীরা তেল মিশ্রিত রং দিয়ে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন। এই তেল মিশ্রিত রং-এর ব্যবহার ছাপাখানার পক্ষে উপযুক্ত ছিল। আগেকার জল মিশ্রিত কালি দিয়ে ছাপার চেয়ে তেল মিশ্রিত কালি অনেক বেশি স্পষ্ট ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
(4) বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা: গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন শহরে কারিগরেরা নতুন ধরনের টাইপ, কালি বা মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। আন্দ্রিয়াস ড্রিটজেহেন ও আন্দ্রিয়াস হেইলম্যান ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষায় গুটেনবার্গের সঙ্গী ছিলেন। এ ছাড়া ফ্রান্সের প্রোকোপিয়াস ওয়াডভোগেল, নেদারল্যান্ডের লরেন্স জ্যান্সজুন ধাতব চলমান টাইপ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সমগ্র প্রক্রিয়াকে একসঙ্গে গেঁথে মুদ্রণব্যবস্থাকে একটি সংগঠিত প্রক্রিয়া ও শিল্পে পরিণত করার কৃতিত্ব গুটেনবার্গ, পিটার শোফার ও জোহান ফুস্ট-এর।
(5) মুদ্রণযন্ত্র তৈরি: জার্মানির জোহানেস গুটেনবার্গ তাঁর পেশা স্বর্ণশিল্পের খোদাই-এর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন চলমান পুনর্ব্যবহারযোগ্য টাইপ তৈরি করেন। তিনিই প্রথম সিসা, টিন ও অ্যান্টিমনির সংকর ধাতু দ্বারা টাইপ তৈরি করেন। ‘মুদ্রকের ধাতু’ Printers metal) নামে পরিচিত হওয়া এই ধাতু দ্বারা তৈরি টাইপগুলি ছিল মজবুত ও স্পষ্ট ছাপ তুলতে সক্ষম। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জার্মানির মেইন্জ শহরে গুটেনবার্গ তাঁর সমস্ত আবিষ্কার ও পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়ে প্রথম আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সহযোগী ছিলেন য়োহান ফুস্ট ও পিটার শোফার।
(6) প্রথম মুদ্রণ : গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রে প্রথম ছাপা হয় জার্মান ভাষায় একটি কবিতা। এই যন্ত্রে ছাপা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই হল ৪২ লাইনের বাইবেল বা গুটেনবার্গ বাইবেল। ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই যন্ত্রে প্রায় ১৮০ কপি গুটেনবার্গ বাইবেল ছাপা হয়।
(7) মুদ্রণযন্ত্র ও মুদ্রণ পদ্ধতির দ্রুত প্রসার: জার্মানির বিভিন্ন শহর থেকে গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র ও প্রযুক্তি অতি দ্রুত ইউরোপের সর্বত্র পৌঁছে যায়। ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভেনিসে প্রথম মুদ্রণযন্ত্র বসে; ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সেখানে ৪০৭টি মুদ্রণযন্ত্র ছিল। ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে, ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্ল্যান্ডার-এ, ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা শুরু হয়। এইভাবে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র ইউরোপের বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে ৬০ লক্ষেরও বেশি বই ছাপা হয়। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছাপা এই সমস্ত বইগুলিকে ইনকিউনাবুলা (incunabula) বলা হয়।
মূল্যায়ন
মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ও ব্যবহার বই-এর চরিত্র সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। ছাপানো বই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সহযোগী হয়েছিল। শিক্ষিত পাঠকদের বাইরেও বৃহত্তর সমাজের ওপরে ছাপা বই-এর প্রভাব সদর্থক দিকনির্দেশ করেছিল। এই কারণে ইতিহাসবিদ ইউজিন রাইস (Eugine Rice) পঞ্চদশ শতকের মুদ্রণ বিপ্লবকে বর্তমান কালের কম্পিউটার বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর