![]() |
একটি নদীর আত্মকথা রচনা
|
ভূমিকা
আমার বুকের উপর দিয়ে হাঁটু জলে কে হেঁটে চলেছ গো ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে? কোনো পশুপ্রাণী? নাকি মানুষ? এখন তো আমি মৃতপ্রায়, তাই দৃষ্টি গিয়েছে। এখন আর কিছু দেখতে পাই না গো। কিন্তু অনুভূতির একটু-আধটু এখনও আছে। সেই অনুভূতি দিয়ে যেটুকু বুঝতে পারছি, তাতে অবশ্য তোমাকে একজন মানুষই মনে হচ্ছে। ঠিক বলছি তো? তা ছাড়া তুমি এই প্রথম আমার বুকে পা রাখলে, তাই না? কী বলছ? কে আমি? নাম বললে চিনতে পারবে? অবশ্য দিল্লির যমুনাকে চিনলে আমাকে চেনাও অসম্ভব কিছু নয়। আমি হলাম পশ্চিমবঙ্গের যমুনা নদী। না, না, আমার বুক থেকে এখন জল প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে বলে ভেবো না চিরটাকাল এমনই ছিলাম। একদিন আমার সবই ছিল, স-অ-অব। আজ হারিয়ে গিয়েছে সেসব কিছু। সেই স্মৃতি মনে পড়লে বারবারই আমার দু-চোখ জলে ভরে আসে। তুমি শুনলে তোমারও এই অবস্থা হবে নির্ঘাৎ। শুনবে সেসব কথা?
জন্মবৃত্তান্ত
অনেকেই ভাবে উত্তর ভারতের যমুনা নদীই বুঝি আমি। বাস্তবে কিন্তু সেই যমুনার সঙ্গে আমার কোনো যোগই নেই। যেমন যোগ ছিল না বৈদিক যুগে পশ্চিম ভারতে অবস্থিত সরস্বতী নদীর সঙ্গে বাংলার সরস্বতী নদীর। আসলে উত্তর ভারতের যমুনা নদীর সঙ্গে রাধাকৃয়ের লীলার একটা যোগ ছিল। ছিল বলেই বোধহয় এককালে বৈল্পব সমাজ নদিয়ার কাছে চূর্ণি নদী থেকে জন্ম নেওয়া এই আমাকে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন যমুনা।
যাত্রাপথের বিস্তার
এমন একদিন ছিল, যখন নদীগর্ভ ভরে কুলকুল শব্দে বইয়ে দিতাম বিপুল জলরাশি। বিস্তৃতিও নেহাত কম ছিল না। কতশত যে নৌকা চলত আমার বুক দিয়ে। মাঝিমাল্লারা বইঠা টেনে নৌকা নিয়ে যেতে যেতে এইতো, কয়েক বছর আগেও গান গাইত-
তাদের সবাইকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দিতাম আমি। নদিয়া থেকে গাইঘাটা-নকপুল-গোবরডাঙা-চারঘাট হয়ে তারা পৌঁছে যেত ইছামতী নদীতে। কেননা, ওই পথে বইতে বইতে চারঘাটের নিকটবর্তী টিপি গ্রামের কাছে পৌঁছে আমি ইছামতী নদীতে মিশে গিয়েছিলাম যে।
কিছু সুখ স্মৃতি
আগের সে জীবন নেই ঠিকই, তা বলে তো অতীতের সব কথা ভুলে গিয়েছি, তা তো নয়। মনে আছে গো, অনেক কিছুই মনে আছে। আমারই বুকে নৌবহর ভাসিয়ে এসে বাংলার বারো ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া প্রতাপাদিত্য রায় এক কান্ড ঘটিয়েছিলেন। শলকা নামক একটা জায়গায় আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। বিখ্যাত সেই বাঙালি বীরের জন্যে আজও আমার গর্ব হয়। তাই কি শুধু? চারঘাটের কাছে দিয়াড়ায় যে যমুনামেলা হয়, তা তো আমাকে কেন্দ্র করেই। কত যে ভিড় হয় সেই মেলায়। আমারই পাড়ে আছে ঠাকুরবর পির সাহেবের দরগা। আছে গোবরডাঙা মহাশ্মশান। আমার পাড়ে অবস্থিত গোবরডাঙা একদিন সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল।
কিছু দুঃখের স্মৃতি
শুধু কি সুখেরই স্মৃতি আমার মনে? দুঃখও তো কম পাইনি। এককালে আমারই বানের তোড়ে কত ঘর যে ভেঙেছে। এখনও বর্ষাকালে আগের মতো সব ভাসাই। একবার হয়েছিল কী-বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা মেয়ে সাঁতার কাটতে এসে… না, থাক, সেসব দুঃখের স্মৃতি আর না-ই বা তুলে আনলাম। কেননা, দুঃখ যত চাপা থাকে, ততই ভালো।
শেষকথা
রূপসী বাংলার পুজারি কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন-‘সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ’লে যেতে হয়’। আজ আমারও সেই অবস্থা। হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর মতো, অন্য অনেক নদীর মতো জলের যোগান কমে যাওয়া, প্লাস্টিক, বাতিল টায়ার ইত্যাদি বর্জ্য জমা, পলি জমা প্রভৃতি কারণে বাংলার মাটি থেকে দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছি আমি। কোথাও কোথাও তো আমার বুকে চাষবাসও করে মানুষজন-এমনটাই জল কমে গিয়েছে। কী জানো বন্ধু, আগে বুঝতাম না, কিন্তু এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি, একদিন ঠিক পৌঁছে যাব অদৃশ্য একজনের কাছে-