![]() |
একটি শহরের আত্মকথা রচনা
|
ভূমিকা
ওগো, কে আছ পথিক, শোনো। একটু দাঁড়াবে কিছুক্ষণের জন্যে? জানি তোমার সামনে এখন হাজার ব্যস্ততা। তবু যদি একটু সময় করে শোনো আমার জীবনকাহিনি, তাহলে হয়তো একরাশ দুঃখের মধ্যেও একটু হলেও সান্ত্বনা পাবে আমার মন। স্বস্তিও পাব কিছুটা। কারণ অনেকদিন থেকেই-
এতদিন বাদে হলেও তুমি রাজি হলে ভাবব, থাক, কেউ-না-কেউ তো অন্তত শুনতে চেয়েছে। আমাকে নিয়ে অবশ্য অসংখ্য বই লেখা হয়েছে। সেগুলো পড়ে অনেকেই ভাবে, কলকাতা সম্পর্কে অনেককিছু জেনে ফেলেছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমি তিনশো বছরেরও বেশি প্রাচীন শহর কলকাতা। বিখ্যাত শহরগুলোর একটি, তা বলে কি আমার দুঃখ নেই? কান্না নেই? হাসি নেই? তার খোঁজ বইওয়ালাগুলো কোথায় পাবে? শুনবে সেসব কাহিনি? বলব গো, তোমাকেই বলব।
জন্মের কাহিনি
আমার জন্ম হয়েছিল জোব চার্ণকের ধুরন্ধর ব্যবসায়িক বুদ্ধির ফলে। জোব চার্নক ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রথমবার এবং শায়েস্তা খাঁ-এর সঙ্গে শান্তি-চুক্তির পর দ্বিতীয়বার সুতানুটি-ঘাটে আসেন, তখনই বুঝেছিলেন এখানে বাণিজ্য-সম্ভাবনা আছে। সেই কারণে সুতানুটি এবং তার আশেপাশের দুটি গ্রাম কলিকাতা এবং গোবিন্দপুরকে কেন্দ্র করে একটি বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেই উদ্দেশ্যে তখনকার বাংলার সুবাদার আজিম উত্থানকে ইংরেজ দূত খাজা সরহাদ মারফত ১৬০০০ টাকা নজরানা পাঠিয়ে জোব চার্ণক সুনানুটি, কলিকাতা এবং গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটি কেনার অনুমতি আদায় করে নেন। তারপর এই তিনটি গ্রামের মালিক বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরি পরিবারের জমিদার বিধ্যাধর রায়ের কাছ থেকে মাত্র তেরোশো টাকায় ইজারা নেন গ্রাম তিনটিকে। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট তৃতীয়বারের জন্য সুতানুটিতে ফিরে আসেন জোব চার্নক। ধরে নিতে পারো, তখনই শহর হিসাবে গোড়াপত্তন ঘটে আমার।
কিছু স্মৃতিকথা
সূচনাপর্ব থেকে কতই না ঘটনা ঘটে গিয়েছে আমার বুকে। সৃষ্টি হয়েছে বহু ইতিহাস। কত কিছু যে দেখেছি আমি। দেখেছি ফোর্ট উইলিয়ামের প্রতিষ্ঠা, দেখেছি ইংরেজ কথিত অন্ধকূপ হত্যা, নবাবের সৈন্যের সঙ্গে ইংরেজদের লড়াই, লর্ড ক্লাইভের দাপট, গভর্নর ও ভাইসরয়দের শাসন কিংবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, ভারতীয় বিপ্লবীদের আনাগোনাসহ আরও কতকিছু। দেখেছি ইংরেজদের অত্যাচার, বিপ্লবীদের ফাঁসি, অলিন্দ যুদ্ধের মতো ঘটনাও। সেসবের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনাই বেশ দুঃখের। অবশ্য কিছু সুখের স্মৃতিও আছে আমার মনের কোঠায়।
বিস্তার ও সাজসজ্জা
একদিন যে আমি ছিলাম বনজঙ্গল, বাঘ, ভালুক, সাপ ও ডাকাতে ভরা তিনটি গ্রামের সমষ্টি, কালে কালে সেই আমিই বাড়তে বাড়তে আজ পৌঁছে গিয়েছি অনেক দূরে। কলিকাতা থেকে কোলকাতা তারপর কলকাতা হয়েছি, গায়েগতরে বেড়েছি, সৌন্দর্যে বেড়েছি, আমার বুকের ওপরে এখন গড়ে উঠেছে কংক্রিটের জঙ্গল। আঁকা-বাঁকা অলিগলি-রাস্তা, মেট্রোরেল, চক্ররেল, অজস্র গাড়িঘোড়া, ঝলমলে দোকানপাঠ, শপিংমল, সিনেমাহল- কী নেই বলো তো? তবে প্রথম দিকের আর বেশি কিছু নেই এখন। এ যেন জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতার মতো-
জানি, এখানেই থেমে থাকব না। দিন যত যাবে, আরও হয়তো পালটাব। কিন্তু এভাবে কতদিন? জানি না, আমি সত্যি জানি না সেটা।
শেষকথা
আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে অনেকের সঙ্গেই আমার জানাশোনা হয়ে গিয়েছে। কেননা আমার বুকে অনেকেরই তো নিত্য যাতায়াত। রোজ রোজ অনেকেই যে কাজের সন্ধানে আসে কলকাতায়। এভাবে-
এখন অনেকেই আমার বেশ কাছের। কিন্তু বিশ্বাস করো, কারও হাতেই যেন সময় বেশি নেই। শুধু তুমিই ধৈর্য ধরে শুনলে আমার কথা, আত্মকথা। তাই তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব বন্ধু।