এনক্লোজার কী

এনক্লোজার কী

অথবা, বেষ্টনী পদ্ধতি বলতে কী বোঝো

এনক্লোজার কী
এনক্লোজার কী

এনক্লোজার বা বেষ্টনী পদ্ধতি

পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে ইউরোপের পশ্চিম অংশের দেশগুলিতে ম্যানর ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। আলোচ্য পর্ব থেকে ইউরোপীয় কৃষিক্ষেত্রে আসে ব্যাপক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল ইংল্যান্ডের বেষ্টনী পদ্ধতি বা এনক্লোজার ব্যবস্থা (Encloser System) 

(1) ধারণা: বেষ্টনী পদ্ধতি হল ইংল্যান্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিসংস্কার প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতিতে জমিকে বেড়া দিয়ে বেষ্টন করে ভেড়া প্রতিপালন করা হত।

(2) কারণ বা উদ্দেশ্যসমূহ: বেষ্টনী পদ্ধতি প্রবর্তনের পশ্চাতে বিভিন্ন কারণ বা উদ্দেশ্য ছিল। সেগুলি হল-

  • জনসংখ্যার হ্রাস: টিউডর যুগের বহু পূর্বেই এই বেষ্টনী বা ঘেরাও পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছিল। আসলে যুদ্ধ, প্লেগ ও মহামারির কারণে জনসংখ্যার যে হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটেছিল, তাতে বহু জমি পতিত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ভূস্বামীরা মেষপালনের দিকে নজর দেন।
  • উলের চাহিদা বৃদ্ধি: ষোড়শ শতক নাগাদ উল বা পশমজাত বস্ত্রের চাহিদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে মেষপালন করে যে পশম পাওয়া যেত, তা বিক্রি এবং বিভিন্ন দেশ-বিদেশে রফতানির মাধ্যমে মুনাফালাভের সুযোগ ছিল।
  • কম শ্রমশক্তি: জমিতে কৃষিজাত ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শ্রমশক্তির প্রয়োজন হত। কিন্তু এর ১/৪ শতাংশ শ্রমশক্তি দিয়ে ভেড়া প্রতিপালন করা যেত। ফলে এই বিষয়টি জমি মালিকদের ভাবাতে থাকে। 
  • জমির উপর সুনিশ্চিত অধিকার: আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জমির উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে তথা সম্পত্তির উপর অধিকার সুনিশ্চিত করতে জমিদার ও কৃষকেরা জমি ঘেরাও করার প্রয়াস নেন।

(3) বেষ্টনী নীতির সংস্কার: বেষ্টনী প্রথার ফলে কৃষিজমির সংকোচন ঘটে, খাদ্যশস্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনবিদ ও লেখক টমাস মুর (Thomas More) আশঙ্কা করেছিলেন যে, এই ভেড়া প্রতিপালন কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস করে কৃষক ও কৃষিপণ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ফলে ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে এনক্লোজার ব্যবস্থার কিছু সংস্কারসাধন করা হয়। ঠিক করা হয় যে, একই জমিতে বদলে বদলে মেষপালন ও চাষের কাজ করা হবে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে পশুপালন ও শস্যোৎপাদনের মধ্যে একটি পরস্পর নির্ভর সম্পর্ক গঠিত হয়। একে বলা হয় ‘Up and Down Husbandry’. এই ব্যবস্থায় চাষের জমিকে চারণভূমিতে রূপান্তরিত করা হলেও পরে এই ভূমিতে পুনরায় কৃষিকাজ করার সম্ভাবনা থাকত। আবার পশুপালনের কারণে জমিও হয়ে উঠত উর্বর।

(4) জমিদারদের ভূমিকা: Encloser বা বেষ্টনী ব্যবস্থার প্রবর্তনে জমিদার শ্রেণি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। মূল্যবিপ্লবের ফলে ভূস্বামীদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। জমি থেকে তাদের প্রকৃত আয় গিয়েছিল কমে। কৃষি থেকে যা আয় হত, তার বেশিরভাগই কৃষকের পক্ষেই চলে যেত।  এমতাবস্থায় ভূস্বামীগণ জমিগুলিকে অধিক রাজস্বের বিনিময়ে ঘিরে সেগুলিকে লিজে দিতেন।  অবশ্য এই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কৃষকেরাও এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। বাজার এবং চাহিদা সম্পর্কে ইংল্যান্ডের গ্রামীণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছিল এভাবেই।

(5) প্রভাব: বেষ্টনী প্রথার প্রভাবগুলি হল-

  • কৃষিকাজে উন্নতি: বেষ্টনী প্রথার ফলে বড়ো আকারের খামার ও কার্যকর কৃষি পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। এটি ইংল্যান্ডের কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।
  • গ্রামীণ জনসংখ্যা হ্রাস: এই প্রথার দরুন সাধারণ দরিদ্র কৃষক জমি হারায়। তারা জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়।
  • কৃষিতে পুঁজির লগ্নি: এই পদ্ধতির মাধ্যমে অতি অল্প শ্রমে অনেক বেশি ভেড়া পালনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ উল সংগ্রহ করে ইউরোপ, আমেরিকা ও প্রাচ্যের দেশগুলিতে তা রফতানি করা সম্ভব হয়। এইভাবে ইংল্যান্ডের কৃষিতে পুঁজির আমদানি ঘটে। অন্যান্য দেশেও এই প্রথা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উদ্ভব ঘটে কৃষি-পুঁজি লগ্নিকারী (Agrarian Capitalist) গোষ্ঠীর।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment