কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কী ছিল
অথবা, রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে কৌটিল্যের বক্তব্য সংক্ষেপে লেখো
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণা
(i) রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজাকে রাজতন্ত্রের প্রতীকরূপে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের মধ্যে রাজা হলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাজার নির্দেশ কেউ অমান্য করতে পারবে না। কৌটিল্য মনে করতেন যে, প্রজাদের মঙ্গলসাধনের জন্য যেমন রাজার হাতে ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, ঠিক তেমনই কোনও কারণে রাজার বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহের পথে পা বাড়ালে, তা দমনের জন্যও রাজার হাতে ক্ষমতা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
(ii) রাজার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ
অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজা কখনোই শাসনব্যবস্থাকে ব্যবহার করতে পারবেন না। এ ছাড়া রাজার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠুভাবে যাবতীয় কর্তব্যপালনের উদ্দেশ্যে কৌটিল্য রাজাকে মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ নিয়ে প্রশাসন পরিচালনার কথা বলেছেন। কৌটিল্যের মতানুযায়ী, রাজার স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ সীমাবদ্ধ ছিল।
(iii) বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র
কৌটিল্য ছিলেন বংশানুক্রমিক ও উচ্চবংশজাত রাজতন্ত্রের সমর্থক। তাঁর মতে, উচ্চবংশজাত কোনও রাজা যদি বংশানুক্রমিকভাবে রাজ্য শাসন করেন, তাহলে রাজার প্রতি প্রজাদের আনুগত্য বজায় থাকবে। কৌটিল্য মনে করতেন, ক্ষমতাশালী উচ্চ রাজবংশের রাজা শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্ষম না হলেও রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের অনুগামী হন। তাই তিনি প্রজাদের স্বাভাবিক আনুগত্য অর্জন করেন।
(iv) রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য
রাজতন্ত্রের অপর গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, প্রজাদের প্রতি রাজার দায়িত্বপালন। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশরক্ষা, জনসাধারণের জীবন ও সম্পত্তিরক্ষা প্রভৃতি হল রাজার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত ধারণা
কৌটিল্য ও রচিত অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রকে সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী এবং একচেটিয়া অধিকারভোগী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যে বিষয়গুলির ব্যাখ্যা অর্থশাস্ত্রে করা হয়েছে, সেগুলি হল-
(i) সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব
রাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে অর্থশাস্ত্রে সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌটিল্য রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে এর সাতটি অঙ্গের উল্লেখ করেছেন, যথা- স্বামী, অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোশ, দণ্ড ও মিত্র।
(ii) রাষ্ট্রের আয়তন
একটি আদর্শ রাষ্ট্রের আকার-আয়তন কেমন হওয়া উচিত সে প্রসঙ্গে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে সঠিকভাবে বোঝা না গেলেও অনেকেই বলেন যে, কৌটিল্য বৃহদায়তন রাষ্ট্রের পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ, রাষ্ট্র বৃহৎ হলে অনেক বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে ও এর দ্বারা শক্তিশালী রাজকোশ এবং দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা যাবে। তবে বিরুদ্ধবাদীদের মতে, কৌটিল্য সুশাসিত, সুশৃঙ্খল এবং জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। রাষ্ট্রের আকার যদি বড়ো হয় তাহলে এইসব সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এঁদের মতে, সম্ভবত মাঝারি আকারের রাষ্ট্রের উপর কৌটিল্য প্রাধান্য দিয়েছেন।
(iii) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র
কৌটিল্য রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রনীতির মূলকথা হবে রাষ্ট্রের প্রয়োজন। কোনও বিশেষ ধর্মভাবনা বা ধর্মগুরুদের দ্বারা রাজা চালিত হবেন না। এই আদর্শ কার্যকর করার জন্য তিনি কিছু পরামর্শও দিয়েছেন। যথা- (a) কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যার জন্য রাজা পুরোহিতের পরামর্শ শুনবেন। কিন্তু রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেবেন রাজা স্বয়ং। (b) রাষ্ট্র পুরোহিততান্ত্রিক (Theocratic) হবে না। পুরোহিত বা ধর্মগুরু অপরাধী হলে সাধারণের মতোই চরম শাস্তি পাবেন। (c) রাজকর্মচারীরা ধর্মগুরু বা পুরোহিতের অনুগত হবেন না। কর্মচারীদের আনুগত্য থাকবে কেবল রাজার প্রতি। সাধারণ প্রশাসন ও বিচার বিভাগ- উভয়ক্ষেত্রেই এই ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ পালন করতে হবে।
(iv) জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র
জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা সৃষ্টির ব্যাপারে কৌটিল্যের ভূমিকা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে প্রজাবর্গের কল্যাণসাধন, সমাজসেবামূলক কাজকর্মের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। অনেকেই কৌটিল্যের এই জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণাকে যোগক্ষেম নামে অভিহিত করেছেন। এই ধারণা (যোগক্ষেম) অনুযায়ী জনসাধারণের কল্যাণসাধন করাই হল রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ। কৌটিল্যের জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দুটি দায়িত্ব হল- সামাজিক নিরাপত্তামূলক কাজ অর্থাৎ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ-মহামারির সময়ে দুর্গতদের সাহায্য করা এবং জনসেবামূলক কাজকর্ম, যেমন- অসাধু ব্যক্তিদের শাস্তিপ্রদান, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সমাজের কল্যাণ করা।
(v) পররাষ্ট্রনীতি বা বিদেশনীতি
পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কৌটিল্যের একটি দৃষ্টান্তমূলক পরামর্শ হল ‘রাজমণ্ডল তত্ত্ব’। ‘রাজমণ্ডল’ হল ১২ জন রাজার একটি চক্রাকার অবস্থান। এই বারোজন হলেন- বিজিগীষু রাজা স্বয়ং, তাঁর সম্মুখভাগে ৫ জন রাজা, তাঁর পশ্চাদ্ভাগে ৪ জন রাজা এবং মধ্যম ও উদাসীন রাজা। এই রাজমণ্ডলের কেন্দ্রে বিজিগীষু রাজার অবস্থান। তাঁর কাজ হল, সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে অবশিষ্ট রাজন্যবর্গের সঙ্গে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করা।
(vi) রাজার গুণাবলি
রাষ্ট্রের রক্ষক হলেন রাজা। তাঁকে হতে হবে সংযমী, দায়িত্ববান, প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন, কঠোর পরিশ্রমী। কৌটিল্য বলেছেন, রাজা হবেন দূরদর্শী কূটনীতিপরায়ণ। তাঁর মতে, তিনিই হবেন রাষ্ট্রের একমাত্র সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তাঁর নির্দেশেই রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম সুচারুরূপে পরিচালিত হবে।
(vii) মন্ত্রীপরিষদ
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত আলোচনায় রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সঠিকভাবে চালানোর জন্য মন্ত্রীপরিষদ গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। রাজা মন্ত্রী ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রীপরিষদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন বলে উল্লেখ করা হয়।
(viii) রাজতন্ত্র শাসিত
অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্র রাজতন্ত্র শাসিত। তবে এই রাজতন্ত্রের প্রকৃতি স্বৈরাচারীসম্পন্ন ছিল কি না, এ নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক রয়েছে। কেননা, রাজাকে ‘পোরান পকিতি’ বা প্রাকৃতিক নিয়ম ও দেশাচার মেনে চলতে হত। তবে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা স্বীকার করা হয়নি।
(ix) গুপ্তচর নিয়োগ
শাসকের অবস্থান সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে এবং রাষ্ট্রশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের গুপ্তচর নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। যুবরাজ, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের উপর গুপ্তচরবৃত্তি, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও মতামত জানতে রাজাকে সাহায্য করত। অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচরদের বলা হয়েছে গূঢ়পুরুষ। কৌটিল্য এদের মূলত দুভাগে ভাগ করেছেন- স্থান থেকে খবর সংগ্রহ করবেন এবং সমস্থা অর্থাৎ, যারা নির্দিষ্ট সঞ্চরা অর্থাৎ, যারা রাজ্যের নানাস্থান পরিভ্রমণ করে সংবাদ সংগ্রহ করবেন।
(x) আইনের তত্ত্বাবধান ও রাজস্বনীতি নির্ধারণ
অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত আলোচনায় রাজকীয় অনুশাসনকে আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎসরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে রাজার নৈতিক দায়িত্ব হল আইনের যথাযথ প্রয়োগ, দোষীদের উপযুক্ত শাস্তিবিধান ও নিরপরাধকে পুরষ্কার প্রদান করা। কৌটিল্যের মতে, রাজা হলেন রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার প্রধান। তাছাড়া প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের মাধ্যমে রাজকোশাগার পূর্ণ রাখার নির্দেশও কৌটিল্য প্রদান করেছেন, যা প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কৌটিল্যের চিন্তাধারা পরবর্তী প্রজন্মকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তাঁর রাষ্ট্রনীতি এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে, তা বর্তমানেও সমান প্রাসঙ্গিক হিসেবেই বিবেচিত হয়।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর