ক্রুসেড কী? এর ফলাফলগুলি লেখো

ক্রুসেড কী? এর ফলাফলগুলি লেখো

অথবা, ক্রুসেডের প্রভাব বা তাৎপর্য আলোচনা করো

ক্রুসেড কী? এর ফলাফলগুলি লেখো
ক্রুসেড কী? এর ফলাফলগুলি লেখো

খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত প্রায় দুশো বছর ব্যপী খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জেরুজালেম দখলকে কেন্দ্র করে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল, তা ইতিহাসে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত।

ক্রুসেডের ফলাফল বা প্রভাব

প্রায় দুশো বছর ব্যাপী খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্রভূমি জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের  বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী আটটি ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা শেষপর্যন্ত জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। তা সত্ত্বেও মধ্যযুগের ইউরোপের ধর্মীয়, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ক্রুসেডের ফলাফল বা প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

(1) পোপের প্রভাব ও মর্যাদা বৃদ্ধি: খ্রিস্টানরা ধর্মযুদ্ধের দ্বারা জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করতে না-পারলেও পোপের প্রভাব ও মর্যাদা কিন্তু বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কারণ পোপের আহ্বান ও উদ্যোগেই লাখ লাখ ধর্মযোদ্ধারা ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করেছিল। তাই ধর্মযুদ্ধের সূত্রে পোপ হয়ে উঠেছিলেন খ্রিস্টান জগতের প্রধান নেতা।

(2) চার্চের সম্পদ বৃদ্ধি: ক্রুসেডের ফলে চার্চের সম্পত্তির পরিমাণ আগের তুলনায় বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কারণ ক্রুসেডে যোগদানকারী বহু ধনী ও সাধারণ ধর্মযোদ্ধারা সামান্য অর্থের বিনিময়ে চার্চকে তাঁদের সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আবার ক্রুসেডে অংশগ্রহণকারী সামন্তপ্রভু বা ভূস্বামীদের অনেকেই ঈশ্বরের আর্শীবাদ লাভের কামনায় তাঁদের বহু সম্পত্তি দান করে দিয়েছিলেন।

(3) ব্যাবসাবাণিজ্য ও নগরের বিকাশ: ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। ক্রুসেডের সময় থেকেই ভেনিস, পিসা, বার্সেলোনা, মার্সেই প্রভৃতি ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বন্দরগুলির সমৃদ্ধি ঘটে। শিল্প ও ব্যাবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ইউরোপে বহু শহর বা নগরের প্রতিষ্ঠা হয়।

(4) সামন্ততন্ত্রের ভাঙন: ক্রুসেডের ফলে সামন্ততন্ত্রের কাঠামোয় ভাঙন ধরে। ক্রুসেড যাত্রার আগে অর্থ সংগ্রহের জন্য বহু সামন্তপ্রভু তাদের সম্পত্তি বিক্রি কিংবা বন্ধক দিয়ে দিয়েছিলেন। ধর্মযুদ্ধে যেমন বহু সামন্তপ্রভুর মৃত্যু হয়েছিল, পাশাপাশি অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। এইভাবে সামন্ততন্ত্রের ভাঙন শুরু হয়।

(5) সামাজিক জীবনে প্রভাব: ইউরোপের সমাজজীবনেও ক্রুসেডের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ক্রুসেডের সূত্রে বহু সার্ফ বা ভূমিদাস মুক্তিলাভ করেছিল। ইউরোপে ব্যাবসাবাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশের ফলে নতুন বণিক ও শ্রমিক শ্রেণির উত্থান ঘটে। সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

(6) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সম্পর্কস্থাপন: ক্রুসেডের সর্বাপেক্ষা ইতিবাচক ফল হল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সম্পর্কস্থাপন। ইউরোপীয়রা দীর্ঘকাল ইসলামের সংস্পর্শে থাকার ফলে তাদের মধ্যে ইসলামীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুদ্ধ ও কারিগরি কৌশল এবং ভৌগোলিক জ্ঞানের প্রসার ঘটে। তাই ঐতিহাসিক টয়েনবি বলেছেন-“ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলেই আধুনিক ইউরোপ জন্মলাভ করেছে।”

মূল্যায়ন 

ক্রুসেডের বিভিন্ন ইতিবাচক ফলাফলের পাশাপাশি সর্বাপেক্ষা নেতিবাচক ফলাফল হল হাজার হাজার ধর্মযোদ্ধার মৃত্যু ও ব্যাপক ধ্বংসলীলা। এজন্যই ব্রিটিশ লেখক উইলসন ক্রুসেডগুলিকে মধ্যযুগের ধর্মান্ধতা ও নির্বুদ্ধিতার প্রতিফলন বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment