![]() |
চার্বাকদের সুখবাদের বিরুদ্ধে আপত্তিগুলি কী |
চার্বাকদের সুখবাদের বিরুদ্ধে আপত্তি
দর্শনতত্ত্বের ক্ষেত্রে চার্বাকগণ যে সুখবাদ-এর অবতরণ করেছেন, তা ভারতীয় দর্শনের সমস্ত সম্প্রদায় কর্তৃক অত্যন্ত কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছে। চার্বাক সম্প্রদায় ছাড়া ভারতীয় দর্শনে আর যে-সমস্ত সম্প্রদায়গুলির পরিচয় পাওয়া যায়, তাদের সবগুলিই চার্বাকদের সমালোচনা করেছে। এই সমস্ত সমালোচনাগুলি হল-
নির্জন দ্বীপের একক অধিবাসী রূপে চার্বাক সুখবাদ
চার্বাকদের সুখবাদ সম্পর্কিত আলোচনা ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে যেন এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হয়। কারণ, একমাত্র চার্বাকগণই মানব জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হিসেবে স্থূল সুখভোগের কথা বলেছেন। চার্বাক ছাড়া আর অন্য কোন সম্প্রদায়ই এরূপ মতবাদে বিশ্বাসী নন। সুখবাদ সম্পর্কে চার্বাকগণ তাই নির্জন দ্বীপের একক অধিবাসী স্বরূপ।
দুঃখ সম্পৃক্ত সুখে সন্দেহ
চার্বাকগণ দাবি করেছেন যে, সুখ হল সর্বসময় দুঃখ সম্পৃক্ত। অর্থাৎ, সুখের মধ্যেই দুঃখ নিহিত আছে। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা দুঃখকে পরিহার করেই সুখ লাভ করে থাকেন। কিন্তু এ সম্পর্কে ন্যায়বার্ত্তিক টীকায় উদ্যোৎকর উল্লেখ করেছেন যে, সুখ সবসময় দুঃখ সম্পৃক্ত কি না-তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তিনি বলেন সুখ স্বরূপতই সুখ রূপে গণ্য। কারণ তা প্রত্যেকেই অনুভব করতে সক্ষম। সুতরাং চার্বাকগণ যে দুঃখমিশ্রিত সুখের কথা বলেছেন, তা কিন্তু মানা যায় না। অবশ্য বিশুদ্ধ সুখের কথা যে বলা হয়, তা-ও তিনি অস্বীকার করেছেন।
ধর্মের ব্যাখ্যায় অচল অবস্থায় চার্বাক সুখবাদ
মীমাংসা দর্শনের কুমারিল ভাট্ট তাঁর শ্লোকবার্ত্তিক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, চার্বাকদের সুখবাদ সম্পর্কিত মতবাদটি আদৌ যথার্থ নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, অনুগ্রহ কখনোই ধর্মের এবং পীড়া কখনোই অধর্মের লক্ষণ হতে পারে না। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, নৈতিকতার মানদণ্ড যদি এরূপ হয়, তাহলে জপ, ধ্যান, নেশা প্রভৃতিকেও আর অধর্ম বলা যায় না। তা ছাড়াও বলা যায় যে, ইন্দ্রিয় সুখের দ্বারাই যদি ধর্ম অর্জিত হয় তাহলে কাম বা ক্রোশ বশত গুরুপত্নীর প্রতি অভিগমনও ধর্মরূপে বিবেচিত হয়। কিন্তু তা কখনোই যথার্থ নয়। সে কারণেই চার্বাকদের মতবাদ গ্রাহ্য হতে পারে না।
দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিতে চার্বাক সুখবাদ অচল
বিজ্ঞানভিক্ষু তাঁর সাংখ্যপ্রবচন ভাষ্য-এ বিভিন্ন যুক্তিতে চার্বাক সুখবাদকে খণ্ডন করেছেন। তাঁর মতে, পার্থিব স্থূল সুখ কখনোই স্থায়ী আনন্দ দিতে পারে না। আবার পার্থিব সুখের দ্বারা যে-সমস্ত আনন্দ লাভ করা যায়, সেগুলিও কিন্তু কালের বিবর্তনে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ, বলা যায় যে, জাগতিক বা পার্থিব সুখের দ্বারা কখনোই দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে না। ঘুরে ফিরে সেই আবার দুঃখের আবর্তেই আবর্তিত হতে হয়। সুতরাং সুখবাদ সম্পর্কিত চার্বাকদের মতটি কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
মোক্ষের অস্বীকৃতিতে চার্বাক সুখবাদ
উল্লেখ করা যায় যে, চার্বাকদের কাছে মোক্ষের কোনো গুরুত্বই নেই। কারণ, তাঁরা স্থূল সুখবাদের মতো বিষয়টিকে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং সুখের বিষয়গুলিকে এ জীবনেই ভোগ করার কথা বলেছেন। পরজন্মের বিষয়ে চার্বাকরা নাস্তিক বলে, মোক্ষের প্রশ্নগুলি এখানে অবান্তর হয়েছে। ‘মোক্ষ’ নামক চরম ও পরম পুরুষার্থকে তারা অস্বীকার করেছেন। স্থূল ইন্দ্রিয় সুখকে তারা চরম পুরুষার্থ রূপে গণ্য করায় শুধু কাম-এর বিষয়টিই এখানে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং মোক্ষের ধারণাটি বর্জিত হয়েছে। এরফলে চার্বাকদের সুখবাদ একটি অত্যন্ত সংকীর্ণ মতবাদে পরিণত হয়েছে।