চিনের ‘ম্যান্ডারিন’ ব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান লেখো

চিনের ‘ম্যান্ডারিন’ ব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান লেখো

অথবা, ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার বিবরণ দাও

চিনের 'ম্যান্ডারিন' ব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান লেখো
চিনের ‘ম্যান্ডারিন’ ব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান লেখো

ভূমিকা

প্রাচীন কাল থেকেই অন্যান্য দেশের ন্যায় চিনেও রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চিনা সম্রাট ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। চিনাদের কাছে তিনি ছিলেন ‘স্বর্গের সন্তান’ এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবেই তিনি প্রজাদের শাসন করেন। তিনি স্বর্গীয় অনুশাসন (Mandate of Heaven) এবং রাজবংশের দীর্ঘকাল প্রচলিত আইন অনুসারেই তাঁর শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি পদস্থ সরকারি কর্মচারী বা আমলাদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন। চিনা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত এইসকল উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী বা আমলাদের বলা হত ম্যান্ডারিন।

(1) অর্থ: পোর্তুগিজ ‘ম্যান্ডারিম’ (Mandarim) শব্দ থেকে ইংরেজি ‘ম্যান্ডারিন’ (Mandarin) শব্দটির  উৎপত্তি। ইংরেজি ‘ম্যান্ডারিন’ শব্দের আধুনিক অর্থ হল উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী বা আমলা বা প্রাদেশিক কর্তা। প্রকৃতপক্ষে ম্যান্ডারিনরা ছিলেন চিনের পণ্ডিত শ্রেণির আমলা বা পদস্থ সরকারি কর্মচারী।

(2) উত্থান: চিনের মতো বিশালায়তন দেশে সম্রাটের একার পক্ষে দেশ শাসন করা সম্ভব ছিল না। তাই দীর্ঘকাল ধরে নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চিনে একটি আমলাতান্ত্রিক শাসনকাঠামো গড়ে ওঠে। মূলত তাং বংশের শাসনকালে (৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) চিনে একটি নতুন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই নতুন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনে আমলা বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। এইসকল পদস্থ সরকারি কর্মচারী বা আমলাদের বলা হত ম্যান্ডারিন। পরবর্তীকালে মিং এবং মাঞ্জু রাজবংশের শাসনকালে প্রদেশ থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগে ম্যান্ডারিনরা নানা প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব পালন করতেন।

(3) যোগ্যতার পরীক্ষা: ম্যান্ডারিন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পদপ্রার্থীদের নানা যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় পাস করতে হত। যথা-

  • কনফুসীয় আদর্শ, কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান কতটুকু, তা যাচাই করা হত।
  • এই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্পত্তি বা বংশকৌলীন্য নয়, উচ্চশিক্ষা, সততা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি অগ্রাধিকার পেত।
  • অপরাধী বা আসামি, ভিক্ষুক, ক্রীতদাস, শ্রমিক, পাহারাদার, অভিনেতা প্রমুখরা এই পরীক্ষায় বসতে পারতেন না। যোগ্যতার পরীক্ষা পাস করার পর দরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশক্রমে তাঁদের নিয়োগ করা হত। তবে সম্রাট অনেক সময় নিজের পছন্দমতো উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনদের নিয়োগ করতে কিংবা পদচ্যুত করতে পারতেন।

(4) স্তরবিন্যাস ও সামাজিক মর্যাদা: চিনা প্রশাসনে ম্যান্ডারিনদের বিভিন্ন স্তর ছিল। এই স্তরবিন্যাস গড়ে উঠেছিল পদমর্যাদার ওপর ভিত্তি করে। যদিও সমাজে সকল স্তরের ম্যান্ডারিনরাই ছিলেন যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী।

(5) জীবনযাত্রা ও মর্যাদাসূচক পোশাক: ম্যান্ডারিনদের জীবনযাত্রা ছিল বেশ বিলাসবহুল। তাঁরা বহু মূল্যবান রত্নখোচিত পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করতেন। পোশাকের সামনে ও পিছনের দিকে চতুর্ভুজ আকৃতির প্রতীক চিহ্ন অলংকরণ করা থাকত। পদমর্যাদার প্রতীক চিহ্নগুলিকে বলা হত ম্যান্ডারিন স্কোয়ার (Mandarin Square)। তাঁরা বহু মূল্যবান ধাতু ও রত্নখোচিত টুপি ব্যবহার করতেন।

(6) কার্যাবলি : ম্যান্ডারিনদের নানা প্রশাসনিক কাজকর্ম করতে হত। যথা-

  • কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনরা সম্রাটকে নানাকাজে সাহায্য করতেন।
  • মধ্য ও নিম্নস্তরের ম্যান্ডারিনরা প্রদেশ বা আঞ্চলিক স্তরে রাজস্বসংগ্রহ, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি কাজের তদারকি করতেন।
  • প্রশাসনিক কাজকর্মের পাশাপাশি তাঁদের ব্যাবসাবাণিজ্য, প্রদেশ ও আঞ্চলিক স্তরে নিরাপত্তা রক্ষা প্রভৃতি দায়দায়িত্ব পালন করতে হত।

(7) ত্রুটি: ম্যান্ডারিন ব্যবস্থায় কতকগুলি ত্রুটি ছিল। যথা-

  • ম্যান্ডারিনরা ভোর বা রাত অবধি কঠোর পরিশ্রম করলেও সেই তুলনায় তাঁদের বেতন ছিল কম। তাই তাঁরা একসময় আর্থিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
  • উচ্চপদস্থ আমলাদের স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি ছিল এই ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি।
  • অনেকক্ষেত্রে ম্যান্ডারিনরা জনগণকে গোপনে উৎপীড়ন করে অর্থ আদায় করে তাঁর ঊর্ধ্বতনকে খুশি করার জন্য নানা উপহার দিতেন। ফলে ম্যান্ডারিনদের সঙ্গে সে অর্থে জনগণের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।

(8) গুরুত্ব : নানা ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও চিনা প্রশাসনে ম্যান্ডারিনদের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যথা-

  • ম্যান্ডারিনরা চিনের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনের মধ্যে যোগসূত্র পরক্ষা করতেন।
  • ম্যান্ডারিনরা কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা চিনের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কর্মীজী গতিশীল করেছিলেন।
  • প্রাদেশিক শাসক হিসেবে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা রক্ষা কারও ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তাঁদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।

মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায় যে, ম্যান্ডারিনরা ছিলেন চিনা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। চিনা সম্রাটরা এই আমলা বা সরকারি কর্মচারীদের সাহায্যে একটি সুদক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক জ্যাক গ্রে সহ অনেকেই মনে করেন আমলাতন্ত্রের মধ্যে স্বজনপোষণ ও আর্থিক দুর্নীতি এই ব্যবস্থার অবসানকে অনিবার্য করে তোলে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনে কিং বংশের পতনের পর ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment