ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE

Table of Contents

ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE

ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্ন : ছোটোগল্প হিসেবে ‘ছুটি’ গল্পটি কতটা সার্থক হয়ে উঠেছে, তা আলোচনা করো।

ভূমিকা: বাংলা ছোটোগল্পের সার্থক স্রষ্টা হলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিই প্রথম ‘ছোটোগল্প’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ছোটোগল্প কেবল ভাবাশ্রয়ী- কল্পনামুখ্য নয়, বরং জীবননির্ভর এবং এতে রয়েছে খণ্ড কাহিনির ব্যবহার।

ছোটোগল্পকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘বর্ষা যাপন’ কবিতায় বলেছিলেন,

"নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা, 
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে 
শেষ হয়ে হইল না শেষ।"

ব্যাখ্যা: ‘ছুটি’ গল্পটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে প্রাকৃতিক বর্ণনা ব্যতীত কোনো ঘটনা বর্ণনার আতিশয্য এতে নেই। প্লট-এর বাহুল্য নেই, গ্রাম ও শহরের মধ্যেই গল্পটি ঘোরাফেরা করে। ফটিকের বেড়ে ওঠার গ্রাম্য প্রকৃতি থেকে উৎখাত হয়ে নাগরিক যান্ত্রিকতার মধ্যে এসে পড়ার চরম পরিবর্তন ছাড়া আর তেমন কোনো পরিবর্তন এই গল্পে নেই, শেষেও ফটিকের কী হল তার সুস্পষ্ট ধারণা আমরা পাই না-অতৃপ্তি নিয়েই গল্পটি শেষ হয়। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্যগুলি পুনরায় লক্ষ করা প্রয়োজন।

ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য: পূর্বোক্ত ‘বর্ষা যাপন’ কবিতায় কবিগুরু ছোটোগল্পের আরও একটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন-

“ছোটো প্রাণ ছোটো ব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখ কথা”

জীবনের চলমান স্রোত থেকে খন্ড খন্ড প্রতীতি আহরণ করবেন গল্পকার। এখানে বিন্দুতে হবে সিধু দর্শন।

  • তত্ত্বকথা বা উপদেশ থাকবে না।
  • একমুখিতা হবে এই গল্পের বৈশিষ্ট্য।
  • বৃহত্তর সত্য, স্বল্পতম ব্যাপ্তির মধ্যে প্রতিফলিত হবে।
  • “অন্তরে অতৃপ্তি রবে/সাঙ্গ করি মনে হবে/শেষ হয়ে হইল না শেষ”
  • একটি মাত্র মহামুহূর্ত থাকবে এবং সমগ্র গল্পের উৎকণ্ঠা এর উপর নিবদ্ধ থাকবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘ছুটি’ গল্পটি বিবেচ্য।

ছোটোগল্পরূপে সার্থকতা: গল্পকার আলোচ্য গল্পে ফটিকের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় বন্ধন ও পরে বিচ্ছেদ-এই মূলভাব ও প্রতীতিকে নিয়ে গল্পের কাঠামো গড়ে তুলেছেন। ফলে ছোটোগল্পের একমুখিতার আদর্শ এখানে রক্ষিত হয়েছে। তবে পার্শ্ব উপকরণ হিসেবে গল্পে চিত্রিত হয়েছে ফটিকের কলকাতায় থাকাকালীন জীবনযাপনের কিছু খন্ড চিত্র। মামির উদাসীনতা ও নিষ্ঠুরতা, স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের প্রহার, বই হারিয়ে ফেলা, মামাতো ভাইদের উপেক্ষা ইত্যাদি ফটিকের বেদনাকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। সমগ্র গল্পে উৎকণ্ঠা দানা বেঁধেছে এই বিশেষ মুহূর্তটিতে- “যে অকূল সমুদ্রে যাত্রা করিতেছে, বালক রশি ফেলিয়া কোথাও তাহার তল পাইতেছে না।” ফটিকের এই মৃত্যুবর্ণনা গল্পকারের সংযত ভাষানৈপুণ্যের পরিচায়ক। এ ছাড়া দুর্যোগপূর্ণ বর্ষণমুখরিত সেই রাত্রির অশান্ত পরিবেশে ফটিকের মানসিক বিপর্যয়কে গল্পকার ব্যঞ্জনাময় ও আবেদনস্পর্শী করে তুলেছেন।

উপসংহার: ‘ছুটি’ গল্পের মহৎ সত্য হল প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত মানবসত্তা প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হলে, সেই সত্তার অপমৃত্যু ঘটে। তাই গল্পের শেষে কোনো চমক নেই, আছে শাশ্বত জীবনসত্যের ধীর বিশ্বাস। ফলে ‘ছুটি’ গল্পটি যে একটি আদর্শ ছোটোগল্প হিসেবে বিবেচিত হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হল- ফটিক। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ছোটোগল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে, প্রকৃতির রং তুলি দিয়ে এক কিশোরের মানসিক যন্ত্রণাকে প্রতিবিম্বিত করেছেন।

প্রকৃতির সন্তান: প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তান ফটিক কলকাতায় মামা ও মামির আশ্রয়ে এসে প্রথম উপলব্ধি করে, নাগরিক জীবনে সে কতটা অবাঞ্ছিত। ফটিকের গ্রামে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা শুধু মায়ের জন্য নয়, তার অন্তরাত্মার সঙ্গে প্রকৃতির এক নিবিড় একাত্মতার কারণে। শিশুর শিক্ষালাভে যান্ত্রিক পরিবেশ যে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ, সেই মনোভাবই আশ্চর্য সহানুভূতির সঙ্গে গল্পকার এখানে উন্মোচিত করেছেন।

দলের নেতা: ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক ফটিক তার দলবল নিয়ে উন্মুক্ত প্রকৃতির বুকে ছিল স্বচ্ছন্দবিহারী এক কিশোর। ঘুড়ি ওড়ানো, নদীতে সাঁতার কাটা, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ বলে ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে তার মন আনন্দরসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত।

সত্যের পূজারি: সত্যের পূজারি ফটিক তার ভাই মাখনলালের গালে চড় মেরে ভাইয়ের মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। কিন্তু অপরদিকে ভ্রাতৃস্নেহে আর্দ্র ফটিক কলকাতা যাত্রার পূর্বে খেলার ঘুড়ি, লাটাই, ছিপ ভাইকে সমর্পণ করে তা সম্পূর্ণ ভোগের অধিকার দিয়ে যায়।

অভিমানী: ফটিক ভীষণ অভিমানী। খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে মাখন যখন তাকে মেরে বাড়ি চলে গিয়েছে, তখন অভিমানে সে আনমনে বসে থেকেছে। মাখনের মিথ্যে অভিযোগে মা যখন তাকে প্রহার করেছে, সেই মুহূর্তে মৃদু প্রতিবাদ করলেও মায়ের উপর তার অভিমান হয়েছে। আপাত মাতৃস্নেহবিহীন গৃহ পরিবেশে উপেক্ষিত ফটিক তাই মামার প্রস্তাবে সহজেই কলকাতা যেতে রাজি হয়ে গিয়েছে। আবার কলকাতা গিয়ে মামির হৃদয়হীন আচরণে অভিমান করে সে বাড়ি ছেড়েছে। এই অভিমান থেকেই ক্রমে প্রাণোচ্ছল ফটিক নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এবং শেষপর্যন্ত মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয়েছে।

স্নেহকাতর: ফটিক স্নেহের কাঙাল। গল্পে দেখা যায়, পিতৃহীন ফটিক তার মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। সে বোঝে তার মায়ের হৃদয়ের অধিকাংশটাই জুড়ে রয়েছে ভাই মাখন। তাই মামা বিশ্বম্ভরবাবুর সস্নেহ প্রস্তাবে রাজি হয়ে সে কলকাতা চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে মামির স্নেহহীন সান্নিধ্য তাকে পীড়িত করে। তাই স্নেহবুভুক্ষু ফটিক শেষপর্যন্ত মামারবাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যায় জর্জরিত: বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থায় নানা ব্যর্থতা কিশোর-কিশোরীদের অন্তরকে পীড়িত করে। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের প্রতি মামির রূঢ় আচরণ, শিক্ষকের প্রহার, বই হারিয়ে ফেলা, বন্ধুত্বহীন নিঃসঙ্গ জীবন ইত্যাদি ঘটনার ফলে মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত ফটিকের অন্তরাত্মা। বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বুঝতে না পারার অক্ষমতাই তাকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছে।

উপসংহার: আসলে রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য গল্পে ফটিকের জীবনে আলো ফেলে কিশোর মনের সমস্যার সংকটটিকে যেমন আলোকিত করতে চেয়েছেন, তেমনই দেখিয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে যার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছেদে তার বৌদ্ধিক মৃত্যু অনিবার্য। তবে, অনুভূতিশীল ফটিক মুমূর্ষু অবস্থাতেও উপলব্ধি করেছে তার ছুটি হয়েছে। রবীন্দ্রসাহিত্যে ‘ছুটি’-র ফটিক তাই একটি অনন্য চরিত্র হয়ে আজও জীবন্ত হয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের মামির চরিত্রো।

ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামি চরিত্রটি কাহিনির করুণ পরিণতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গল্পে তাঁর উপস্থিতি খুব বেশি নয়। ফটিক যখন তার অবাধ-অগাধ স্বাধীনতা ছেড়ে মামার সঙ্গে কলকাতা এসেছে, তখনই পাঠক প্রথম পরিচিত হয়েছে এই হৃদয়হীন মামির সঙ্গে। ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালীন মর্মব্যথাকে আরও দুঃসহ করে তোলার ক্ষেত্রে এই মামির ভূমিকা অপরিসীম।

বিরূপ মনোভাবাপন্ন: প্রথমেই দেখা গিয়েছে স্বামীর সিদ্ধান্তকে তিনি ভালো মনে গ্রহণ করেননি। বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে নিজদায়িত্বে কলকাতায় নিয়ে এলে ফটিকের মামি তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। ফটিকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, ফটিকের আগমনে তিনি খুশি নন। ফটিককে সাদর সম্ভাষণ জানানো তো দূরের কথা, সামান্য প্রীতি বা সৌহার্দ্য বিনিময় করতেও দেখা যায়নি তাঁকে।

হৃদয়হীন-নিষ্ঠুর আচরণ: গল্পে জানা যায়, তাঁর মামি তিন সন্তানকে নিয়ে নিজের নিয়মে সংসার পরিচালনা করেন। তাই একটি তেরো-চোদ্দো বছর বয়সি অপরিণত, অশিক্ষিত গ্রামের ছেলেকে তাঁর গ্রহণ করতে অসুবিধা হয়েছে। বিশ্বম্ভরবাবুর সিদ্ধান্তকে বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও কখনোই ফটিকের সঙ্গে তিনি স্নেহপূর্ণ আচরণ করেননি। বরং তাঁর হৃদয়হীন সান্নিধ্যই ফটিককে ঠেলে দিয়েছে গভীর অবসাদে। মামির কাছে নিজেকে দুর্গ্রহ মনে হয়েছে ফটিকের। শরীর খারাপ হলে মামির সংসারে নিজেকে উপদ্রব বলে মনে করেছে সে। তাই বাড়ি ছেড়েছে ফটিক। ফটিকের বাড়ি ছাড়ার পিছনে মামির এই হৃদয়হীনতা অনেকখানি দায়ী।

মমতাহীন মাতৃত্ব: মামির তিনটি সন্তান থাকলেও ফটিকের প্রতি তাঁর মমত্ব বা মাতৃত্ববোধের লেশমাত্র প্রকট হতে দেখা যায়নি। ফটিক মামির কাছে মাতৃস্নেহে প্রতিপালিত হতে পারত কিন্তু মামির কাছে তার প্রাপ্তি ছিল চরম অপমান।

প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা এই অসংস্কৃত বালক ফটিকের স্নেহপ্রত্যাশী মনকে মামি অবদমিত করেছেন, তার উৎসাহকেও প্রতিমুহূর্তে দমিয়ে রেখেছেন তিনি। এমনকি, ফটিক অসুস্থ হয়ে পড়লেও মামির মধ্যে কোনও তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। গল্পে ফটিকের মর্মান্তিক পরিণতিতে মামির বড়ো ভূমিকার কথা অনুভূতিশীল পাঠকমাত্রই অনুভব করতে পারেন।

বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যায় অনুঘটক: ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যায় অনুঘটকের কাজ করেছেন মামি। ফটিক তাঁর ননদের ছেলে, সন্তানতুল্য। কিন্তু মামির কাছ থেকে পাওয়া অপমান, উপেক্ষা ও স্নেহবঞ্চনা ফটিকের অন্তরকে পীড়িত করেছে। ফটিকের অসুস্থতায় মামির প্রতিক্রিয়া-“পরের ছেলেকে নিয়ে কেন এ কর্মভোগ।” এই ঘটনাগুলি ফটিকের মনের মধ্যে – অপরাধবোধের মাত্রাকে তীব্রতর করেছে। এর পরেই এই মুক্তিপিপাসু বালক – বিশ্বপ্রকৃতির অনন্ত রহস্যের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছে।

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ এমনই এক স্বার্থান্বেষী মামির চরিত্রকে গড়ে তুলেছেন যা ফটিককে তার মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্প অবলম্বনে বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্রটির পরিচয় দাও।

ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র তথা নায়ক ফটিক চক্রবর্তীর মামা বিশ্বম্ভরবাবু। গল্পের শুরুতেই একটি মজাদার খেলা আবিষ্কার করেও যখন মাখনের দুষ্ট জেদের কারণে খেলা ভঙ্গ হয়ে যায়, তখন ফটিক উদাস হয়ে নদীঘাটে একটি অর্ধনিমগ্ন নৌকার গলুইয়ের উপর বসে থাকে। সেইসময় একটি বিদেশি নৌকায় এক অপরিচিত ব্যক্তির আগমন ঘটে। পরে জানা যায় তিনিই বিশ্বম্ভরবাবু। গল্পকার প্রথমেই জানিয়ে দেন বিশ্বম্ভরবাবু মাঝবয়সি। তাঁর চুলগুলি পাকা হলেও গোঁফ কাঁচা। তিনি নদীঘাটে ফটিকের কাছে চক্রবর্তীদের বাড়ির ঠিকানা জানতে চান এবং ফটিকের ইশারায় সঠিক দিশা না পেয়ে চলে যান। বাড়িতে যখন ফটিক-মাখন-মায়ের বিবাদ তুঙ্গে, ঠিক তখনই সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বিশ্বম্ভরবাবু প্রবেশ করেন এবং বলেন, ‘কী হচ্ছে তোমাদের!’ বিবাদ সেই সময়ের জন্য থামে। জানা যায়, বিশ্বম্ভরবাবু পশ্চিমে কাজ করতে গিয়েছিলেন অনেকদিন। দেশে ফিরে বোনের খবর নিতে এসেছেন।

স্নেহশীল: বিশ্বম্ভরবাবু বোনের প্রতি যেমন ছিলেন স্নেহপরায়ণ তেমনই তিনি সংবেদনশীল এক মানবিক চরিত্র। তিনি পশ্চিমে কর্মে লিপ্ত ছিলেন বলে বোনের পতি বিয়োগের সময় আসতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই স্নেহের আকর্ষণে বোনকে দেখতে আসেন।

কর্তব্যপরায়ণ: বিশ্বম্ভরবাবুর এই আগমনে তাঁর দায়িত্ববোধ তথা কর্তব্যপরায়ণতার দিকটি খেয়াল করা যায়। তিনি বোনের সঙ্গে কথা বলে ভাগনেদের পড়াশোনা এবং মানসিক উন্নতির কথা জানতে চান। ফটিকের উচ্ছৃঙ্খলতা ও পড়াশোনায় অমনোযোগের কথা শুনে এবং বিধবা বোনের অসহায়তা বুঝে ফটিককে কলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন।

অবিবেচক: ফটিক কলকাতার নাগরিক পরিবেশে থাকাকালীন যে দুঃসহ ব্যথা অন্তরে বহন করেছিল, তার শরিক হতে পারেননি বিশ্বম্ভরবাবু। স্নেহ, মায়া, মমতা ও সহানুভূতির বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ফটিকের জন্য তিনি তার সহৃদয়তারও কোনো পরিচয় দেননি। এমনকি ফটিকের মামির নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ না করে তিনি নীরব দর্শক হয়েই থেকেছেন।

বাস্তবজ্ঞানহীন: বিশ্বম্ভরবাবু ছিলেন এক বাস্তববোধহীন মানুষ। কারণ তাঁর নিজের তিনটি সন্তান থাকা সত্ত্বেও ভাগনে ফটিকের শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব নিয়ে তিনি সংসারে এক মহাসংকট ডেকে আনেন। বিশ্বম্ভরবাবুর বাস্তবজ্ঞানহীনতার জন্যই কার্যত সহজসরল, মুক্ত প্রকৃতির লালিত সন্তান ফটিককে জীবনাহুতি দিতে হয়েছে।

মানবদরদি: গল্পের শেষে বিশ্বম্ভরবাবুকে আবার মানবিক হতে দেখা যায়। ফটিক বাড়ি থেকে পলায়ন করলে তিনি পুলিশকে খবর দেন। অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ ফটিককে ধরে আনলে তিনি তাকে কোলে করে অন্তঃপুরে নিয়ে যান। ফটিকের জ্বর বাড়লে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তার ডাকেন এবং ফটিকের মাকে আনতে পাঠান। গল্পে তিনি যেটুকু উপস্থিত থেকেছেন, তাতে তাঁর কর্তব্যপরায়ণতা, স্নেহশীলতা যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর মানবিক হৃদয়বৃত্তিগুলিও।

উপসংহার: সবশেষে বলা যায় যে, ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্রটি যাবতীয় মানবিক গুণসম্পন্ন হয়েও ফটিকের জীবনকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে এক ব্যর্থ কারিগররূপেই চিত্রিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে চিত্রিত ফটিকের মায়ের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের গড়ে ওঠা ও করুণ পরিণতির নেপথ্যে গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার মায়ের চরিত্রটি। এই গল্পে মা খুব স্বল্পপরিসরজুড়ে থাকলেও ফটিক চরিত্রটিকে অবলম্বন করে গল্পের সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছেন। ফটিকের কলকাতা যাত্রার পূর্বে ও পরবর্তীতে মায়ের চরিত্রটিকে দু-বার এই গল্পে আবিষ্কার করা যায়। যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ‘ছুটি’ গল্পে ‘ফটিকের মা’ চরিত্রটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে, সেগুলি নিম্নরূপ-

আত্মনির্ভরশীল: ফটিকের মা একজন বিধবা একাকী রমণী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দুই ছেলে, মাখন ও ফটিককে একার প্রচেষ্টায় বড়ো করতে দেখা গিয়েছে। লক্ষণীয়, তিনি কিন্তু কারোর সাহায্যপ্রার্থী হননি। দীর্ঘদিন যোগাযোগবিচ্ছিন্ন দাদা বিশ্বম্ভর হঠাৎই বোনের বাড়ি এসে উপস্থিত হলে বোনের দুরবস্থার কথা জানতে পারেন। বিধবা মা আত্মনির্ভরশীলতার জোরেই দুই সন্তানকে একা সামলেছেন।

সন্তানদের ভবিষ্যৎচিন্তায় সদাতৎপর: ফটিকের মা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বদা সচেতন ছিলেন। তিনি দুই ছেলেকেই লেখাপড়া শেখাতে আগ্রহী। দাদা বিশ্বম্ভরের কাছে তিনি কনিষ্ঠ পুত্র মাখনলালের বিদ্যানুরাগ নিয়ে প্রশংসা করেন। ফটিকের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত ও নিরাপদ করতেই একবাক্যে তাকে কলকাতায় পাঠাতে রাজি হয়ে যান। সন্তানদের শুভকামনায় সর্বদা তাঁকে বিচলিত হতে দেখা গিয়েছে।

কঠিনে-কোমলে: দুই সন্তান এবং সর্বোপরি ফটিকের মতো দুরন্ত এক ছেলেকে সামলাতে গিয়ে মাকে প্রয়োজনে কঠোর হতে ও শাসন করতে দেখা গিয়েছে। মাখনের কথায় বিশ্বাস করে ফটিককে প্রহার করার বিষয়টি আপাতভাবে তাঁর নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী রূপ বলে মনে হলেও তাঁর অপত্যস্নেহের দিকটিও বিচার্য। ফটিকের দৌরাত্ম্যে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে তাকে প্রহার করেন, কারণ সেই মুহূর্তে ফটিককে শাসন করাই তাঁর উচিত বলে মনে হয়েছিল। আবার, ফটিক মামার কথায় কলকাতা যাত্রার ব্যাপারে সহজেই স্বীকৃত হলে মাকে মনঃক্ষুণ্ণ হতেও দেখা যায়।

ফটিকের মা: গল্পে মা চরিত্রটিকে মাখনের প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীল ও ফটিকের প্রতি রুষ্ট হতে দেখা গেলেও গল্পে রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্রটিকে আদ্যন্ত ‘ফটিকের মা’ বলেই নির্দেশ করেছেন। দুরন্ত ছেলেটির প্রতি মায়ের পরোক্ষ অথচ অধিকতর উদ্বেগকেই এখানে দেখাতে চেয়েছেন গল্পকার। মাখনকে কোনোদিন ফটিক জলে ফেলে দিতে পারে বা গুরুতরভাবে আঘাত করতে পারে- এই বিষয়ে ‘ফটিকের মা’-র আশঙ্কা থাকায় তিনি দাদা বিশ্বম্ভরের সঙ্গে তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দিতে চান। উল্লেখ্য, দাদা বিশ্বম্ভরকে তিনি যথেষ্ট ভরসা করতেন, তাই সুরক্ষিত হাতেই তিনি ফটিককে অর্পণ করেছেন। ফটিকের শুভচিন্তা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বার্থেই তাকে দূরে পাঠাতে কুণ্ঠিত হয়নি এই মাতৃহৃদয়, তথাপি ফটিক একবাক্যে শহরে যেতে রাজি হয়ে গেলে তিনি কষ্টই পান। অর্থাৎ ছেলে, মায়ের কাছে থেকে যাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ না করে স্বেচ্ছায় তার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে-যা এই স্নেহময়ী মা সহজে মেনে নিতে পারেননি।

আবার দেখা যায়, রোগশয্যায় ফটিক মায়ের কাছেই যেতে চেয়েছে, বয়ঃসন্ধির টানাপোড়েনেও তার মা-ই হতে পারতেন আশ্রয়। অর্থাৎ নাগরিক জীবন থেকে মাকেই মুক্তির অবলম্বন করতে চেয়েছে সে এবং শেষেও মাকেই সে বলে-“মা, আমার ছুটি হয়েছে মা” অর্থাৎ মা-ই ফটিক ও প্রকৃতির এক যোগসূত্র হয়ে উঠেছে। অবাধ্য, দুষ্ট সন্তানটিকে আপাতচক্ষে মায়ের উপদ্রব বলে মনে হলেও সে-ই মায়ের অন্তরের সবচেয়ে কাছের ধন। আর মায়ের এই ভালোবাসা ঘোষিত হয়েছে ‘ফটিকের মা’ সম্বোধনের মধ্য দিয়েই।

উপসংহার: উল্লেখ্য, ফটিক নগরে চলে গেলে মায়ের জন্য তার মন বারবার কেঁদে ওঠার কথা গল্পে আছে কিন্তু একই সময়ে মায়ের মনোভাব গল্পে ব্যক্ত হয়নি। কেবল গল্পের শেষপ্রান্তে এসে ফটিকের অসুস্থতার খবর শুনে শোকাতুর হয়ে তাঁর আগমনের ছবিটুকুই পাওয়া যায়। ফটিক তাঁর ছুটি হওয়ার তথা মুক্তি পাওয়ার ভাবটি মাকেই প্রথম বলে, অর্থাৎ মা ও ফটিকের হৃদয়ের যোগ ছিলই, কিন্তু ফটিক চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে তুলতে মায়ের চরিত্রটি আড়ালেই থেকে গিয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, ফটিকের মা-এর আপাতকঠোর, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী প্রতিকৃতির আড়ালে একজন স্নেহময়ী, শুভাকাঙ্ক্ষী, কর্তব্যপরায়ণ, সন্তানের চিন্তায় মগ্ন মাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

‘ছুটি’ গল্পে প্রকৃতির প্রভাব আলোচনা করো।

অথবা, ‘ছুটি’ গল্পের মর্মান্তিক পরিণতির পিছনে প্রকৃতির প্রভাব কতখানি, তা আলোচনা করো।

ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন- “আমার – শিশুকালেই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আমার খুব একটা সহজ ও নিবিড় যোগ – ছিল।” হ্যাঁ, শিশুকাল থেকেই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সংযোগ। • প্রকৃতিকে তিনি যেমন ভালোবেসেছিলেন, প্রকৃতিও তাঁকে আপন করে নিয়েছিল শিশুকালেই। রবীন্দ্রমানসের কল্পনারসে জারিত হয়ে বিশ্বপ্রকৃতি স্থান করে নিয়েছে সর্বত্র- ‘ছুটি’ গল্পটিও যার ব্যতিক্রম নয়।

প্রকৃতির প্রভাব: নাগরিক জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে পৌঁছে যেতে হয়েছিল পদ্মাতীরবর্তী পল্লিবাংলার বিস্তীর্ণ সমভূমি শিলাইদহে। প্রকৃতির অসীম রহস্যময় সৌন্দর্য এবং প্রকৃতিলগ্ন মানুষের সহজসরল জীবনযাপন তাঁকে আপ্লুত করেছিল। এই শিলাইদহ পর্বে লেখা ‘ছুটি’ গল্পটিতে তাই প্রকৃতির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ গল্পের নায়ক কিশোর ফটিক বড়ো হয়ে উঠেছে পল্লিবাংলার উদার-উন্মুক্ত পরিবেশে। খোলা আকাশ, নীচে দিগন্তজোড়া মাঠ, সীমাহীন নদীতীর আর একদল দামাল ছেলের নামহীন সাম্রাজ্যের রাজা সে। মায়ের ভর্ৎসনায় অভিমানী হয়ে, বয়ঃসন্ধির সময়ে নিজেকে বোঝা-না-বোঝার দ্বন্দ্বজটিলতায় মামার প্রস্তাবে রাজি হয়ে অসীম কৌতূহল নিয়ে সে পাড়ি দেয় কলকাতায়। সেখানে চারদেয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে গিয়ে মামির স্নেহশূন্য সংসারে সে হারিয়ে ফ্যালে জীবনের সহজ চাপল্য। এই বন্দিদশার আগল ভেঙে মুক্তমনের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে ফিরে যেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তার অন্তর আদিগন্ত প্রকৃতির কাছে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে।

উপসংহার: আলোচ্য গল্পে আমরা দেখি খাঁচায় বন্দি বনের পাখির মতো অসহ্য যন্ত্রণা ফটিককে মুক্তির জন্য ব্যাকুল করে তুলেছে। সে বাড়ি ফিরতে চেয়েছে, ফিরে যেতে চেয়েছে প্রকৃতিলগ্ন জীবনের কাছে। ঘুড়ি ওড়ানোর বিস্তৃত মাঠ, সাঁতার কাটার সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী, অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানোর সীমাহীন নদীতীরটির প্রতি সে আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করেছে। অবাধ-অগাধ স্বাধীনজীবনে ফেরার জন্য তার ব্যাকুলতা প্রকাশিত হয়েছে। মায়ের স্নেহাজ্বল এবং প্রকৃতির শ্যামলাঞ্চল-বঞ্চিত কিশোর ফটিক মায়া- মমতা-স্নেহ-ভালোবাসাহীন শহুরে পরিবেশ থেকে শেষে ছুটি নিয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রী ফটিক মাকে বলেছে-“মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।” ফটিকের এই ব্যঞ্জনাবাহী উক্তিতে রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার করেছেন, প্রকৃতির সঙ্গে যে সত্তা অভিন্ন, প্রকৃতির থেকে বিচ্ছেদে তার মৃত্যু অনিবার্য-সে মৃত্যু কায়িক অথবা মানসিক। ‘ছুটি’ গল্পের এই মর্মান্তিক পরিণতির পিছনে তাই প্রকৃতির প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় থাকে না।

‘ছুটি’ গল্পে গ্রাম ও শহরের দ্বন্দ্ব কীভাবে ফুটে উঠেছে, তা আলোচনা করো।

ভূমিকা: ব্যক্তিজীবনে চোখে দেখা একটি সামান্য ঘটনাকে কল্পনার রসে জারিত করে অভিজ্ঞতা আর অনুভবের যথাযথ মেলবন্ধনে রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করেছেন ‘ছুটি’ গল্পটি। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ নগর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করার সুবাদে প্রত্যক্ষ করেছেন নাগরিক মনের সংকীর্ণতা। অন্যদিকে, জমিদারি দেখাশোনার কাজে পল্লিবাংলার প্রকৃতিলগ্ন পরিবেশে অগণিত সহজসরল মানুষের সান্নিধ্য তাঁর মধ্যে গড়ে তুলেছিল অন্য অনুভবের জগৎ। ‘ছুটি’ গল্পের কাহিনিবৃত্তটিকে রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেছেন গ্রাম-শহরের সেই দ্বান্দ্বিক পটভূমিতে। গ্রামে থাকাকালীন গ্রামীণ মুক্তি ফটিক আলাদা করে উপলব্ধি করতে পারেনি। প্রকৃতি সান্নিধ্যের মর্ম বুঝে ওঠার আগেই মায়ের ভর্ৎসনায়, বয়ঃসন্ধির দ্বন্দ্বে কাতর ফটিক স্বেচ্ছায় শহরে চলে আসতে চায়। তবে শহরে তার সর্বসুখপ্রাপ্তির স্বপ্নভঙ্গ হয় নিমেষেই। মামাবাড়িতে এসেই সে বুঝতে পারে মামির সংসারে তার উপস্থিতি উপদ্রব ছাড়া আর কিছু না। গ্রামের মুক্তাঙ্গনে বিচরণকারী ফটিক এক লহমায় শহরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে নিজের স্বতঃস্ফূর্ততা, সহজ চাপল্য হারিয়ে ফেলে। ক্ষতবিক্ষত অন্তর নিয়ে সে বুঁদ হয়ে থাকে গ্রামের কল্পনায়।

গ্রাম ও শহরের দ্বন্দ্ব: ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক কিশোর ফটিক বড়ো হয়ে উঠেছে পল্লিবাংলার উদার-উন্মুক্ত পরিবেশে। শহরের বন্দিজীবন থেকে ফটিক ঘুড়ি ওড়ানোর বিস্তৃত মাঠ, সাঁতার কাটার সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী, অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানোর সীমাহীন নদীতীরটির প্রতি আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করেছে। সে গ্রামে নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। যদিও দুর্ভাগ্যবশত তার আর গ্রামে ফেরা হয়নি, তবু মৃত্যুপথযাত্রী ফটিক হৃদয়হীন শহর থেকে ছুটি নিতে চেয়েছে চিরতরে। গ্রাম ও শহরের এই দ্বান্দ্বিক পটভূমিতেই ফটিকের মর্মান্তিক পরিণতি একটি চিরকালীন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

“এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল।”-কোন প্রস্তাব, কে অনুমোদন করল? উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য নিরূপণ করো।

প্রস্তাব: প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্প থেকে গৃহীত। এখানে নদীর ধারে খেলায় রত বালকদের কথা বলা হয়েছে। ছেলেদের দলের সর্দার ফটিক চক্রবর্তী খেলতে খেলতে প্রস্তাব করে যে, নদীর ধারে একটা শাল গাছের গুঁড়ি, যা মাস্তুলে পরিণত হওয়ার জন্য অপেক্ষারত ছিল; সেটিকে তারা গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

অনুমোদনকারী: এরকমটা করা হলে, এটি যে ব্যক্তির প্রয়োজনের কাঠ তিনি কাঠটিকে স্বস্থানে দেখতে না পেয়ে যে ভীষণ বিব্রত হবেন; তা কল্পনা করেই বালকদল, ফটিকের প্রস্তাবকে সম্পূর্ণভাবে অনুমোদন করেছিল।

তাৎপর্য: ফটিক পিতৃহারা সন্তান। তাই যথোচিত শাসনের বালাই তার প্রতি ছিল না। মায়ের অনাদর ও উপেক্ষা উভয়ই তার মনে দাগ কেটেছিল। কিশোরবয়সী এই ছেলেটি অন্যান্য ছেলেদের মতো বা তাদের চেয়েও দুষ্টুমিতে পারদর্শী। খেলতে গিয়ে বড়ো গাছের গুঁড়িটাকে অন্যত্র সরিয়ে দিলে প্রয়োজনে মালিক বিব্রত বোধ করবে, সেটা খুঁজে বেড়াবে-এই আনন্দেই সে মশগুল ছিল। তার এইরূপ ভাবধারায় ভাবিত ছিল, খেলার সকল সঙ্গীরাও। নিজেদের খেলার মাধ্যমে একজন বড়ো মানুষকে বিরক্ত করতে পারার অসীম আনন্দের কথাই বর্ণিত হয়েছে গল্পের এই অংশে।

“এইরূপ উদার ঔদাসীন্য দেখিয়া কিছু বিমর্ষ হইয়া গেল”- কে বিমর্ষ হয়ে গেল এবং কার ঔদাসীন্যের কথাই বা বলা হয়েছে? উদ্ধৃতাংশের নিরিখে বিষয়টি পরিস্ফুট করো।

যে বিমর্ষ হয়ে গেল: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডের অন্তর্গত আমাদের পাঠ্য ‘ছুটি’ গল্পটি থেকে উদ্ধৃতাংশটি গৃহীত হয়েছে। উক্ত অংশে ক্রীড়ায় মত্ত ছেলের দলের বিমর্ষ হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

উদাসীন যে: আলোচ্য অংশে ফটিকের ছোটোভাই মাখনলালের ঔদাসীন্যের কথা বলা হয়েছে।

প্রতিপাদ্য বিষয়: ফটিকের অভিনব দুষ্টুমি: নদীর ধারে ছেলের দলের সর্দার ফটিক ও তার সঙ্গীরা খেলায় মত্ত ছিল। এমতাবস্থায় শুকনো বড়ো শাল গাছের গুঁড়ি তাদের নজরে পড়ামাত্র ফটিকের মনে নতুন ভাবনার উদয় হয়। তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সেটিকে সকলে মিলে গড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

মাখনলালের প্রবেশ ও খেলাভঙ্কা: শাল কাঠটিকে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার আনন্দ অপেক্ষা সেই কাঠের মালিককে বিব্রত করার আনন্দই তাদের কাছে বেশি। যে মুহূর্তে তারা; তাদের সেই চিন্তাকে বাস্তবায়িত করার পথে অগ্রসর হয়, ঠিক সেইসময় ফটিকের কনিষ্ঠ মাখনলাল সেই গুঁড়ির উপর গিয়ে বসে পড়ে। তার এই কাণ্ড দেখে ছেলের দল প্রাথমিকভাবে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়ে কারণ তারা মাখনলালের আসার অনেক আগে থেকেই সেখানে খেলাধুলা করছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুমতি ছাড়াই মাখনলাল তাদের খেলায় ব্যাঘাত ঘটাল, সেই ভেবেই বালকদল কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল।

“সেই অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব সকল প্রকার ক্রীড়ার অসারতা সম্বন্ধে চিন্তা করিতে লাগিল-এখানে কাকে ‘অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব’ বলা হয়েছে তা সমগ্র বিষয় অবলম্বনে নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো।

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের ভাই মাখনকেই ‘অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব’ বলা হয়েছে।

ব্যাখ্যা: প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ শীর্ষক রচনাংশ থেকে গৃহীত হয়েছে। নদীর ধারে ফটিক এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা মিলে একটি কাঠের গুঁড়িকে অন্যত্র সরানোর চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। তা গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার আনন্দ এবং তার সঙ্গে মালিকের আসন্ন বিরক্তি-এসব মিলিয়ে তারা যখন ব্যস্ত, এমন সময় ফটিকের ছোটোভাই মাখনলাল সেখানে প্রবেশ করে এবং নির্দ্বিধায় সেই গাছের গুঁড়িটি দখল করে বসে পড়ে। এতে ছেলের দল প্রাথমিকভাবে মুষড়ে পড়লেও নতুন খেলার ভাবনায় তারা সকলে খুব উজ্জ্বল ও উচ্ছল হয়ে ওঠে। মাখনকে সরানোর জন্য একটু ঠেলেও দেয়। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। মাখন সেখান থেকে না নেমে আরও চেপে বসে। শিশুসুলভ কোনো আচরণ তার মধ্যে থাকে না, খেলার নির্মল আনন্দও সে উপভোগ করে না। এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও মাখনের এটা মনে হয় না যে, যদি এরপর সেই গুঁড়িটা সজোরে ঠেলে দেওয়া হয় তবে সে আহতও হতে পারে। মাখনের মনোজগতের এই নির্বিকার হৃদয়ভাবনা প্রসঙ্গে লেখক এই প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছেন।

“তাহাতে আর একটু বেশি মজা আছে।”-প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করে ‘বেশি মজা’-টি কীরূপ, তার পরিচয় দাও।

ব্যাখ্যা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ শীর্ষক রচনাংশে ফটিক এবং তার খেলার সঙ্গীরা একটা শাল গাছের গুঁড়িকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার – অভিপ্রায়ে অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়। শুধু তাই নয়, এই কাজে ওই গুঁড়ির • মালিককে বিব্রত করার বাসনায় তারা মজা পেল। সেই অনুযায়ী তাদের ও খেলার প্রক্রিয়া চালু হয়। ইতিমধ্যেই কোনোরকম সংশয় প্রকাশ না করে ফটিকের ভাই মাখন সেই গুঁড়িটা দখল করে। তাকে একটু-আধটু ঠেলে দিয়ে সেই ছেলের দল, গুঁড়ি থেকে নামানোর চেষ্টা করে মাখনকে। কিন্তু সে তো নামেই না, বরং নড়েচড়ে আরও চেপে বসে।

‘বেশি মজা’-টির পরিচয়: মাখনের এহেন কীর্তিকলাপে অত্যন্ত রাগান্বিত হওয়া সত্ত্বেও ভাইকে মারতে পারে না ফটিক। বরং ভাইকে জব্দ করার জন্য সে অন্য কৌশল অবলম্বন করে। আশু বিপদের কোনো সম্ভাবনার কথা বিবেচনা না করেই সে বলে ওঠে-মাখনকে সুদ্ধ ওই কাঠ গড়ানো আরম্ভ করা যেতে পারে। যেহেতু একটু-আধটু ঠেলা খেয়েও মাখন সেই গুঁড়ি থেকে নেমে যায়নি, তাই কিছুটা ক্রোধান্বিত হয়েই ফটিক এই সিদ্ধান্ত নেয়। তার মনে হয় এই বিষয়টা তাদের আরও বেশি আনন্দ দেবে। সেই প্রসঙ্গেই উক্তিটি করেছেন কথক।

“আনুষঙ্গিক যে বিপদের সম্ভাবনাও আছে, তাহা তাহার কিংবা আর-কাহারও মনে উদয় হয় নাই।”-কোন্ বিপদের কথা বলা হয়েছে? উদ্ধৃতিটির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি পরিস্ফুট করো।

আসন্ন বিপদ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে দেখা যায় মাখন যথাসময়ে নদীর ধারে গাছের গুঁড়ি দখল করে নেওয়ায় রাগান্বিত হয়ে নিজের ভাইকে সেখান থেকে সরানোর জন্য ফাঁদ তৈরি করে ফটিক। কিন্তু তার ফলস্বরূপ সে যে আঘাত পেতে পারে, সে-কথা কারও মাথায় আসেনি। মাখনের আঘাত পাওয়াকেই এখানে বিপদ বলা হয়েছে।

প্রতিপাদ্য বিষয়:

মাখনের একগুঁয়েমি স্বভাব: গাছের গুঁড়িটি যখন মাখন নিজের কুক্ষিগত করে নেয়, সেইসময় তাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য একজন কিশোর আস্তে করে গাছের গুঁড়িটিকে ঠেলে দেয়। সকলে ভেবেছিল হয়তো মাখন ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যাবে কিন্তু একদমই তা হয়না, বরং সে- “আরো একটু নড়িয়া চড়িয়া আসনটি বেশ স্থায়ীরূপে দখল করিয়া লইল” আনুষঙ্গিক বিপদের কথা না ভেবে বালকদের নির্বুদ্ধিতার পরিচয়: ভাইকে জব্দ করার লক্ষ্যে ফটিক অন্য কৌশল অবলম্বন করে। আসন্ন বিপদের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা না করেই সিদ্ধান্ত নেয়, মাখনকে সুদ্ধ ওই কাঠ গড়িয়ে নিয়ে চলবে তারা। শুধুমাত্র খেলার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় ছেলের দল। আশু বিপদের সম্ভাবনা সম্পর্কে কোনোরূপ স্বচ্ছ ধারণাই তৈরি হয় না ফটিক বা তার সঙ্গীদের। তাদের এইরূপ মানসিক পরিস্থিতি ও নির্বুদ্ধিতার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক উদ্ধৃত মন্তব্যটি উল্লেখ করেছেন।

“খেলার আরম্ভেই এইরূপ আশাতীত ফল লাভ করিয়া অন্যান্য বালকেরা বিশেষ দৃষ্ট হইয়া উঠিল,”কোন্ খেলার কথা বলা হয়েছে? বিশেষ দৃষ্ট হওয়ার কারণটি কী তা পাঠ্যাংশ অনুসরণে ব্যক্ত করো।

যে খেলা: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে নদীর ধারে পড়ে থাকা প্রকাণ্ড একটা শাল কাঠকে, স্বস্থান থেকে গড়িয়ে নিয়ে গিয়ে গুঁড়িটির মালিককে বিব্রত করার যে খেলাটি ফটিকের মাথায় এসেছিল, সেই খেলার কথা বলা হয়েছে।

আশাতীত ফল ও সৃষ্ট হওয়ার কারণ: বালকদিগের খেলায় ভঙ্গ দিতে ফটিকের কনিষ্ঠ মাখন, শালের গুঁড়িটির উপর এসে বসে পড়ে। তাকে একটু-আধটু ঠেলা হলেও সে না উঠলে ফটিকের মাথায় আরও মজার একটি খেলার চিন্তা আসে। মাখনকে সুদ্ধই সে গুঁড়িটি গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। ফটিক সর্দারের কথামতোই সকলে মিলে গুঁড়িটি ঠেলতে শুরু করলে মাখন মাটিতে পড়ে যায়, এটিই ছিল আশাতীত ফল।

সকলে মাখনকে শায়েস্তা করার জন্যই গুঁড়িটি ঠেলা শুরু করে। এর ফলে যে মাখনের গাম্ভীর্য চূর্ণ হয়ে সে এরূপ জব্দ হবে, তা কেউ আশা করেনি। তথাপি মাখনের এই দুরবস্থা দেখে ফটিক ব্যতীত আর সকল বালকই মনে মনে তৃষ্ট হয়েছিল।

“খেলা ভাঙিয়া গেল”- কোন্ খেলা, কেন ভেঙে গেল?

খেলাটির বর্ণনা: প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্প থেকে। আলোচ্য গল্পে নদীতীরে পড়ে থাকা প্রকান্ড শাল কাঠের গুঁড়িটিকে সকলে মিলে ঠেলে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার যে খেলাটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেই খেলাটি ভেঙে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

খেলা ডাঙার কারণ: ‘ছুটি’ গল্পের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, নদীতীরে পড়ে থাকা একটি শাল কাঠের বিশালাকৃতির গুঁড়িকে সকলে মিলে ঠেলে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে গল্পের নায়ক ফটিক চক্রবর্তী। কিশোর ফটিকই বালকদের দলের অধিনায়ক তথা সর্দার। সুতরাং তার পরিকল্পিত খেলায় অংশগ্রহণ করতে উপস্থিত সকলে সানন্দে সম্মত হয়। বাধ সাধে ফটিকের ছোটোভাই মাখন। সে গম্ভীরভাবে সেই গুঁড়িটির উপর গিয়ে চড়ে বসে। ফলে অন্যান্য বালকেরাও হতোদ্যম হয়ে পড়ে।

মাখনকে গুঁড়ির উপর থেকে নামাতে দু-একজন চেষ্টা করে। ফটিক এসে বলে ‘দেখ, মার খাবি। এইবেলা ওঠ।’ কিন্তু মাখন কোনোভাবেই সেখান থেকে নামতে সম্মত হয় না। সর্বোপরি, সে কারও কথাতেই কর্ণপাত করে না। ফটিক প্রথমে ভীষণ রেগে গিয়ে ভাইকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু তাতে বাড়ি ফিরে অশান্তি হতে পারে ভেবে নিজেকে সংযত করে নেয়। পরক্ষণেই নতুন একটি পরিকল্পনার কথা তার মাথায় আসে।

ফটিকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাখনের বসে থাকা অবস্থাতেই গুঁড়িটিকে সকলে মিলে ঠেলতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই মাখন মাটিতে পড়ে যায়। মাখনের এই পরিণতিতে অন্য ছেলেরা আনন্দ পেলেও ফটিক শশব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে ভাইয়ের কাছে। ঘটনার আকস্মিকতায় খানিক হতভম্ব হলেও পরক্ষণেই মাখন ফটিকের উপর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ফটিককে সে অন্ধভাবে মারতে থাকে এবং তার নাকে-মুখে আঁচড়ে দিয়ে মাখন বাড়ি চলে যায়। আনন্দের আয়োজন করতে গিয়ে হঠাৎই এমন বেদনাদায়ক পরিস্থিতি তৈরি হলে খেলাটি বন্ধ হয়ে যায়।

“ফটিক নিষ্ফল আক্রোশে হাত পা ছুঁড়িতে লাগিল।”- ফটিকের এরূপ অবস্থার কারণ কী, ব্যাখ্যা করো।

নিষ্ফল আক্রোশে হাত-পা ছোড়ার কারণ: প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ শীর্ষক রচনার অন্তর্গত। ফটিক গ্রাম্য তথা প্রকৃতিপ্রেমিক কিশোর চরিত্র। পড়াশোনা তার অত্যন্ত অপ্রিয়। সারাদিন খেলাধুলা করেই দিন কাটাতে চায় সে। একদিন নদীর ধারে প্রকাণ্ড একটা গাছের গুঁড়িকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় রত হলে, সেখানে তার ছোটো ভাই মাখন প্রবেশ করে এবং গাছের গুঁড়িটিতে একাধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টা করলে, ফটিক ও তার বন্ধুরা তাকে সুদ্ধই সজোরে গুঁড়িটিকে ঠেলতে শুরু করে এবং স্বাভাবিক নিয়মেই মাখন পড়ে যায়।

মাখনের পড়ে যাওয়ার ঘটনায় ফটিক অপেক্ষা তার অন্যান্য সঙ্গীরা অনেক বেশি আনন্দিত হয়। ফটিক কিন্তু তৎক্ষণাৎ মাখনকে সাহায্য করতেই এগিয়ে যায় কিন্তু গৌরব অর্জনের ব্যর্থ চেষ্টায় লজ্জা পেয়ে মাখন ফটিককে মারধোর শুরু করে। এই অব্যবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় যথারীতি খেলা ভেঙে যায়। ব্যথা ও লজ্জায় মাখন বাড়ির পথে পা বাড়ায় এবং মাকে গিয়ে – ফটিকের নামে নালিশ জানায়। ফটিকের কৃতকর্মে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি – বাঘা বাগদিকে বলেন, ফটিককে যে-কোনো প্রকারে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। এতেই বিপত্তি বাড়ে। ফটিক বাড়ি যেতে অস্বীকার করলে, বাঘা বাগদি তাকে বলপূর্বক আড়কোলা করে তুলে নিয়ে যেতে চাইলে ফটিক নিষ্ফল আক্রোশে হাত-পা ছুড়তে থাকে এবং বলাই বাহুল্য যে, তাতে কোনো লাভ হয় না।

“ফের মিথ্যে কথা বলছিস!”-বক্তা কে এবং কাকে উদ্দেশ্য করে সে কী মিথ্যে কথা বলেছিল? প্রকৃত সত্যই বা কী?

বক্তা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্প থেকে সংকলিত প্রশ্নোদ্ভূত অংশের বক্তা হলেন ফটিকের মা।

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: ফটিককে উদ্দেশ করে ফটিকের মা কথাটি বলেছেন। মিথ্যে কথা: মাখন তার মাকে এসে ফটিকের নামে নালিশ করে যে, ফটিক তাকে মেরেছে। কিন্তু মা জিজ্ঞাসাবাদ করলে ফটিক মাখনের অপবাদ অস্বীকার করে জানায় যে, সে মাখনকে মারেনি। মায়ের কাছে এটিই ছিল মিথ্যে কথা।

প্রকৃত সত্য: মাখন হঠাৎই নদীর তীরে খেলায় রত বালকদের খেলা ভঙ্গ করতে সচেষ্ট হয়ে পড়ে। শাল কাঠের গুঁড়ির উপরে বসে পড়ে সেটি গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার খেলায় বাধা দেয় সে, নেমে যেতে বললেও নামে না। তাকে নামানোর বৃথা চেষ্টার পর আরও বেশি মজার সন্ধানে মাখনকে সুদ্ধ গুঁড়িটি ঠেলা শুরু করে তারা। ফলস্বরূপ, মাখন পড়ে যেতেই ফটিক শশব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং গাম্ভীর্য ও গর্ব ধূলিসাৎ হওয়ায় মাখনই ফটিককে আক্রমণ করে-এটিই প্রকৃত সত্য।

“এমন সময়ে সেই কাঁচাপাকা বাবুটি ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, “কী হচ্ছে তোমাদের।””-বাবুটির পরিচয় দাও। এখানে কাদের, কী হওয়ার কথা বলা হয়েছে?

বাবুটির পরিচয়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে নেওয়া প্রশ্নোদৃত অংশে বাবুটি হলেন গল্পের নায়ক ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু। মাঝবয়সি এই ভদ্রলোকের গোঁফটি কাঁচা কিন্তু চুলগুলি পাকা। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ পশ্চিমে কর্মরত ছিলেন। বহুদিন পর দেশে ফিরে বোনকে দেখতে এসেছেন।

ব্যাখ্যা: বিশ্বম্ভরবাবু যখন ফটিকদের ঘরে প্রবেশ করেন তখন ফটিক আর তার মায়ের বিবাদ তুঙ্গে। বিবাদের কারণ হল ভাই মাখনের অর্ধসত্য অভিযোগ। আলোচ্য গল্পে আমরা দেখি, ফটিকের পরিকল্পনায় একদল বালক নদীর পাড়ে পড়ে থাকা শাল কাঠের একটি গুঁড়িকে ঠেলে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে, মাখন তার উপর চড়ে বসে। দু-একজন তাকে নেমে যেতে বলে। ফটিক ভাইকে ভয় দেখালেও অশান্তির ভয়ে নিজেকে সংযত করে নেয়। আবার তার পরিকল্পনাতেই মাখনকে সুদ্ধ গুঁড়িটিকে ঠেলা দিতেই মাখন পড়ে যায় এবং দাদার উপর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। বাড়িতে এসে মাখন মায়ের কাছে রং চড়িয়ে ফটিকের নামে নালিশ করে।

মা বাঘা বাগদিকে দিয়ে ফটিককে বাড়িতে ডেকে পাঠান। বাঘা ফটিককে আড়কোলা করে তুলে বাড়ি নিয়ে এলে মা অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। মাখনের অভিযোগকে বিশ্বাস করে ফটিককে ধমক দেন, শাসন করেন। ফটিক অত্যন্ত রেগে গিয়ে মাখনকে চড় মারলে, মা-ও তৎক্ষণাৎ ফটিককে মারতে শুরু করেন। ফটিক তখন মাকে ঠেলে দেয়। ফটিকের এই আচরণে ততোধিক বুষ্ট হয়ে ‘তুই আমার গায়ে হাত তুলিস’ বলে মা চিৎকার করে ওঠেন। এমনই এক বিবাদময় উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ফটিকদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হন বিশ্বম্ভরবাবু।

“বিধবা এ প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন।”-বিধবাটি কে এবং তাঁর প্রস্তাবটি কী ছিল? তিনি এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন কেন?

বিধবার পরিচয়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছুটি’ গল্পে কিশোর ফটিকের মানসলোকের নানান বৈচিত্র্যকে মনস্তাত্ত্বিকের মতো তুলে ধরেছেন। এই গল্পে বিধবাটি হলেন সেই কিশোর ফটিকের মা। অকাল বিধবা এই রমণী দুই সন্তানকে নিয়ে অতি কষ্টে জীবন যাপন করতেন।

প্রস্তাব: ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবুর ছিল তার বোনের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ ও ঐকান্তিক ভালোবাসা। তাই দুর্মূল্যের বাজারে নিজের পরিবারে তিনটি সন্তান থাকা সত্ত্বেও ভাগনে ফটিককে কলকাতায় লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন বলে বোনের কাছে প্রস্তাব দেন তিনি।

প্রস্তাবে রাজি হওয়ার কারণ: বিশ্বম্ভরবাবু বোনের প্রতি যেমন ছিলেন স্নেহপরায়ণ তেমনই ছিলেন একজন সংবেদনশীল মানুষ। তিনি একসময় পশ্চিমে কর্মে লিপ্ত ছিলেন। ফলে অকাল বিধবা বোনের প্রতি কোনো কর্তব্যই পালন করতে পারেননি। তাই দেশে ফিরেই সেই কর্তব্যপালনের জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বোনের বাড়িতে আসেন। ফটিকদের বাড়িতে কয়েকটা দিন কাটানোর পর অবশেষে ফিরে যাওয়ার দু-একদিন আগে বোনের দুই সন্তান তথা তাঁর দুই ভাগনের পড়াশোনা ও মানসিক উন্নতিবিধানের সংবাদ নেন। তিনি বোনের কাছে জানতে পারেন যে, মাখন সুশীল স্বভাববিশিষ্ট, বিদ্যানুরাগী ও মায়ের অনুগত সন্তান। অপরদিকে, ফটিক অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল ও বিদ্যাভ্যাসে অমনোযোগী এক দুরন্ত কিশোর। ফটিকের মা তার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত বুষ্ট। তাই দাদার কাছে অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন-“ফটিক আমার হাড় জ্বালাতন করিয়াছে।” বৈধব্য জীবনের শূন্যতা এবং পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে তাঁর দৈন্যদশা ছিল প্রবল। ফলে বিধবার পক্ষে ফটিকের মতো দুরন্ত, পাঠে অমনোযোগী ও অকর্মণ্য ছেলেকে প্রতিপালন ও পরিচর্যা করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও ফটিকের মায়ের আশঙ্কা ছিল যে, তার কনিষ্ঠ সন্তান মাখনকে ফটিক শারীরিকভাবে আঘাত করে বড়ো একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। তাই সন্তানপালনে অক্ষমতার কথা ভেবে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই ফটিকের মা, বিশ্বম্ভরবাবুর প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন।

“যদিও ফটিককে বিদায় করিতে তাহার মায়ের আপত্তি ছিল না”-ফটিককে কোথায় বিদায় করার কথা বলা হয়েছে-তাতে তার মায়ের আপত্তি ছিল না কেন?

বিদায় করার স্থান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে নেওয়া প্রশ্নোদ্ভূত অংশে ফটিককে তার মামা বিশ্বম্ভরবাবুর কলকাতার বাড়িতে বিদায় করার কথা বলা হয়েছে।

আপত্তি না থাকার কারণ: আলোচ্য গল্পে দেখা যায়, ফটিকের মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা কনিষ্ঠ ছেলে মাখনের জন্য যতটা প্রকট হয়েছে; আপাতভাবে ফটিকের প্রতি ততটা প্রকাশিত হয়নি। ফটিকের দৌরাত্ম্যে তিনি ধৈর্য হারিয়ে তাকে প্রহারও করেছেন, ফটিকের এই দুরন্তপনা তার মনে বড়ো বিপদের আশঙ্কা জাগিয়েছে সর্বদাই। ফটিকের মা ভাবতেন যে, তার দস্যি ছেলে ফটিক কোনোদিন ভাই মাখনকে ঠেলে জলে ফেলে দেবে বা আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেবে। তাই কলকাতা নিবাসী দাদা বিশ্বম্ভর ফটিককে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে, ফটিকের মায়ের এতে কোনো আপত্তি ছিল না। দুই সন্তানের সুরক্ষার কথা ভেবেই ফটিকের মা কার্যত ফটিককে বিদায় করতে রাজি হয়েছিলেন। মাখনের প্রতি তাঁর মন যে অধিক দুর্বল ছিল, এ কথা সত্য। কিন্তু মাখন ও ফটিক দুজনের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যও ফটিকের মা তাকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করার এই কঠোর সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন এবং এতে তার কোনো আপত্তি ছিল না বলে মনে করা হয়।

“বিশেষত, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।”- এ কথা কার সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং এ কথার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

যার সম্পর্কে এ কথা: ছোটোগল্পের সার্থক স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক তথা প্রকৃতিলালিত সন্তান ফটিক চক্রবর্তী সম্পর্কে এ কথা বলেছেন।

তাৎপর্য: মানবজীবনের বয়ঃসন্ধিকালকে মনোবিদরা ‘ঝড়ঝঞ্ঝার কাল’ বলে চিহ্নিত করেছেন। কারণ এই সময়ে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিজনিত আবেগ-অনুভূতির প্রভূত পরিবর্তন ঘটে। গল্পকার, ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থার নিপুণ চিত্র ‘ছুটি’ গল্পে চিত্রায়িত করতে গিয়ে তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলের স্বভাববৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন। শৈশবের লালিত্যময় দেহকান্তি এই সময়ে দৃষ্টিগোচর হয় না। কণ্ঠের মিষ্টতা হঠাৎ করে অন্তর্হিত হয় এবং তাদের সঙ্গসুখও কেউ প্রার্থনা করে না। এই সময়ের আচরণ শিশুসুলভ নয়, আবার তাদের যৌবনের মর্যাদাও দেওয়া যায় না। তাই তাদের ছোটোদের মতো ব্যবহারকে ন্যাকামি আর বড়োদের মতো পরিণত বুদ্ধিকে এঁচোড়ে পাকা বলে মনে হয়। হঠাৎ করে এই বেড়ে ওঠা লোকচক্ষুতে বেমানান ঠেকে। গল্পকারের ভাষায়-“এই সময়ে কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।”

এ গল্পে দেখা যায় শারীরিক পরিবর্তনের ফলে ফটিকের মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হীনম্মন্যতাবোধ, অপরাধবোধ, লজ্জা, ভয়-এই বয়সের বিশিষ্ট লক্ষণ এবং এগুলি চরম সমস্যারূপে কিশোরদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। ফটিক নাগরিক জীবনে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে হীনম্মন্যতার শিকার হয়। মামির চোখে সে ছিল দুর্গহ, আবার কোনো কাজে অধিক উৎসাহী হলে মামি তার উৎসাহকে অবদমন করে বলেছেন-‘ঢের হয়েছে’। স্কুলেও ফটিক ছিল নিঃসঙ্গ, সহপাঠীহীন এক নির্বোধ বালক।

উপসংহার: পরিশেষে তাই বলা যায়, স্নেহবঞ্চিত ও প্রকৃতির কোল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ক্ষতবিক্ষত ফটিকের এই প্রাণকেই রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর ‘বালাই’ বলে অভিহিত করেছেন।

“এই বয়সে সাধারণত নারীজাতিকে কোনো-এক শ্রেষ্ঠ স্বর্গলোকের দুর্লভ জীব বলিয়া মনে ধারণা হইতে আরম্ভ হয়, অতএব তাঁহাদের নিকট হইতে উপেক্ষা অত্যন্ত দুঃসহ বোধ হয়।”- ‘এই বয়সে’ বলতে কোন্ বয়সের কথা বলা হয়েছে এবং এটি কার মনের ভাবনা? এমন ভাবনার কারণই বা কী?

‘এই বয়সে-র অর্থ: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক ছিল তেরো-চোদ্দো বছরের এক বালক, অর্থাৎ তার বয়ঃসন্ধি আগত। গল্পে ‘এই বয়সে’ বলতে বয়ঃসন্ধির সময়কেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

ভাবনাটি যার: গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিক, অর্থাৎ প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন এক বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরের মনে প্রশ্নোদ্ভূত ভাবনাটির উদয় হয়েছে।

ভাবনার সূত্রপাত: দুরন্ত ফটিক সেই অর্থে মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা পায়নি, একপ্রকার স্নেহকাতর হয়েই সে গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে নগরে এসে পড়েছিল। এমন এক দোদুল্যমান, টানাপোড়েনের সময়ে এই বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরটির অন্তরাত্মাকে পুনরায় সজীব করে তুলতে প্রয়োজন ছিল একজন নারীর স্নেহ, যত্ন, মাতৃত্ব ও নারীর হৃদয়নিঃসৃত পর্যাপ্ত বাৎসল্যরস। মায়ের কাছে থাকাকালীন যেসকল অতৃপ্তি তাকে গ্রাস করেছিল, সেই সব কিছুই সে পরিপূর্ণ করে পেতে চেয়েছিল মামির কাছে। তাই মায়ের অনুপস্থিতিতে ফটিকের কাছে জননীস্বরূপা মামি ছিলেন স্নেহ-বাৎসল্যের প্রতিমূর্তি স্বর্গলোকের দেবী। ফটিকের কাছে সেই বয়সকাল অবধি নারী বলতে মা এবং মামি এই দুজনই ছিলেন। তাই নারীজাতির যাবতীয় ভাবমূর্তি তাদের মধ্যেই সে খুঁজেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল বারবার। বয়ঃসন্ধিকালের এই কিশোরটি নারীর মমতাময়ী সান্নিধ্য ও যত্নই প্রত্যাশা করেছিল, তাই তা না পাওয়ায় দুঃসহ বোধ হয়েছিল তার। নারী মাত্রেই যে মাতৃত্ব ও মমতার আধার নয়, এই উপলব্ধি তার হয়েছিল কলকাতায় আসার পরেই। ফলত, নারীকে স্বর্গলোকবাসিনী অধরা মাধুরী বলেই কেবল ভাবতে পেরেছিল ফটিক।

“মামীর স্নেহহীন চক্ষে সে যে একটা দুগ্রহের মতো প্রতিভাত হইতেছে, এইটে ফটিকের সব চেয়ে বাজিত।” -ফটিকের এমন মনে হওয়ার কারণ কী?

মনে হওয়ার কারণ: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে কিশোর ফটিকের জীবনের মর্মান্তিক পরিণতির কথা ফুটে উঠেছে। আলোচ্য গল্পের নায়ক ফটিকের বয়স তেরো-চোদ্দো বছর। রবীন্দ্রনাথ এ গল্পেই উল্লেখ করেছেন, এই বয়সটিতে পরিবারে-সমাজে নানান কারণেই কিশোররা উপেক্ষিত হয়। ‘ছুটি’ গল্পেও দেখা গিয়েছে ফটিক তার নিজের বাড়িতে মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। তার মায়ের প্রহার ও তিরস্কারে সে প্রবল দুঃখ পেয়েছে। অবহেলিত ফটিক তাই মামার সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার প্রস্তাবে সাগ্রহে রাজি হয়ে যায়।

কলকাতায় মামার বাড়িতে পৌঁছে মামির সঙ্গে প্রথম আলাপেই সে বুঝেছে, তার আগমনকে মামি উদার মনে গ্রহণ করেননি। মামি তিন সন্তান নিয়ে নিজের নিয়মে সংসার পরিচালনা করেন। সেখানে ফটিকের মতো অপরিচিত, অশিক্ষিত পাড়াগাঁয়ের একটি কিশোরের উপস্থিতিতে বিব্রত হয়েছেন এই মহিলা। ফটিকের সঙ্গে এক অদ্ভুত হৃদয়হীন আচরণ করেছেন তিনি বরাবর। স্নেহবুভুক্ষু ফটিক অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে মামিকে কোনো সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করতে এলে তিনি নিদারুণ নিষ্ঠুরতায় তার উৎসাহ দমন করে, সেই কাজ থেকে নিষ্কৃতি অব্যাহতি দিতেন। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মামির এই নির্দয় আচরণে ফটিকের মনে অপরাধবোধ জাগে এবং সে তার অবাঞ্ছিত উপস্থিতিতে লজ্জিত বোধ করে। তাই মামির স্নেহহীন চোখে সে নিজেকে একটি দুগ্রহ বলে মনে করে মর্মাহত হয়।

ছুটি’ গল্পে মামাবাড়িতে গিয়ে ফটিকের যে দুরবস্থা হয়েছিল তা নিজের ভাষায় লেখো।

অথবা, “দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়িয়া কেবলই তাহার সেই গ্রামের কথা মনে পড়িত।”-কার, কী কারণে গ্রামের কথা মনে পড়ত?

যার মনে পড়ত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে নেওয়া উদ্ধৃত অংশে গ্রামের কথা মনে পড়েছে গল্পের প্রধান চরিত্র তথা নায়ক ফটিকের।

কারণ: আলোচ্য গল্পে আমরা দেখি কিশোর ফটিক গ্রামের প্রকৃতিলগ্ন উদার-উন্মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে বড়ো হয়ে উঠেছে। কিন্তু পরিবারে সে মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা থেকে আপাতভাবে বঞ্চিত থেকেছে। মায়ের তিরস্কার, ভর্ৎসনা আর বয়ঃসন্ধিকালে নিজের প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে না পারার কারণে সে তার মামার সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় মামার বাড়িতে এসে মামির হৃদয়হীন আচরণে, মামাতো ভাইদের অবজ্ঞায়, শহরের চারদেয়ালের বন্দিজীবনে অল্পদিনেই সে হাঁফিয়ে উঠেছে।

একদিকে কিশোর মনের স্নেহবুভুক্ষা, অন্যদিকে মামাবাড়ির অপরিচিত পরিমণ্ডলে সীমাহীন অনাদর ফটিককে মর্মাহত করেছে। গ্রামজীবনের সেই উদার-উন্মুক্ত প্রকৃতিলগ্ন জীবনের প্রতি ফটিক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করেছে। শহরজীবনের অপরিসীম অবজ্ঞা আর নির্মমতা থেকে সেই মুহূর্তে তার ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে নিজের সাম্রাজ্যে- যেখানে রয়েছে ঘুড়ি ওড়ানোর উন্মুক্ত আকাশ, সাঁতার কাটার সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী, অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানোর সেই আদিগন্ত মাঠ, সীমাহীন নদীতীর। এমনকি ‘অত্যাচারিণী’, ‘অবিচারিণী’ মায়ের স্মৃতিও সেই ক্ষণে -তার বন্দিজীবনে একটুখানি মুক্তির বাতাস বয়ে এনেছে। রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য গল্পে দেখিয়েছেন, প্রকৃতির সঙ্গে যার গভীর সংযোগ; প্রকৃতি যার সত্তার গঠনে বড়ো ভূমিকা পালন করেছে-তাকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করলে পরিণতি মর্মান্তিক হতে পারে। মামাবাড়িতে এসে তাই ফটিকের অবস্থা হয়েছিল মাতৃহীন এক দুগ্রহ বৎসের মতো।

“জন্তুর মতো একপ্রকার অবুঝ ভালোবাসা”- উদ্ধৃতাংশটির অর্থ পরিস্ফুট করো।

উদ্ধৃতাংশের অর্থ: রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘ছুটি’ শীর্ষক গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের বিষয়ে এই মন্তব্যটি করেছেন কথক।

মামির তাচ্ছিল্য: ভবিষ্যতে যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার লক্ষ্যে মামার সঙ্গে ফটিক পাড়ি দেয় কলকাতার উদ্দেশে, সেখানে প্রতিনিয়ত মামির কটূক্তি ও মামাতো ভাইদের উদাসীনতায় তার হৃদয় ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মামির স্নেহহীন চোখে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজে উৎসাহী হয়ে পড়ত। কিন্তু তাতেও মামির ‘ঢের হয়েছে’ নিরুৎসাহব্যঞ্জক বাক্যে দমে যেত ফটিক।

স্মৃতিরোমন্ধন: এহেন অবস্থায় তার মা, তার সেই ফেলে আসা গ্রাম, গ্রামে কাটানো সব মুহূর্তের কথা মনে করে কষ্ট পেত ফটিক। অনেক বড়ো একটা ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো, নিজের মনের মতো সুর করে গান করা, নদীর তীর, সংকীর্ণ স্রোতস্বিনীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সদলবলে স্নানের আনন্দ, উচ্ছ্বাস, সাঁতার কাটা, সর্বোপরি মায়ের উপর জোরজুলুম, আবদার-এই বিষয়গুলি প্রতিমুহূর্তে মনে করে যন্ত্রণা পেত সে। মামার বাড়িতে অযত্নে, তিরস্কারে, অসহায়তায় সে নিজের মা, গ্রাম, গ্রামের প্রতিটি সদস্যকে সর্বদা মনে করেছে।

জন্তুর ন্যায় বদ্ধ জীবন ও মুক্তি প্রত্যাশা: একে নগরের যান্ত্রিক পরিবেশ তার উপর মামির অনাদর-সবমিলিয়ে হাঁফ ছাড়ার অবকাশ ছিল না ফটিকের। তবে ভালোবাসার সঠিক অনুভূতি মনুষ্যেতর প্রাণীরাও বুঝতে পারে। আর ফটিক তো স্নেহকাতর, ঘরছাড়া এক উচ্ছল প্রাণ। তাই যে-কোনো প্রাণীর মতোই ভালোবাসা-যত্নের প্রত্যাশায় অবুঝ ও কাতর হয়ে ওঠে তার মন। ভালোবাসার গভীরতা প্রসঙ্গে গল্পকার প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি উল্লেখ করেছেন।

স্কুলে এত বড়ো নির্বোধ এবং অমনোযোগী বালক আর ছিল না-এখানে কাকে, কেন নির্বোধ’ ও ‘অমনোযোগী বালক বলা হয়েছে?

যার কথা বলা হয়েছে: রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছুটি’ গল্পে ফটিককেই নির্বোধ’ ও ‘অমনোযোগী’ বালকরূপে নির্দেশ করেছেন।

নির্বোধ ও অমনোযোগী বলার কারণ: গল্পকার কিশোর ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালীন মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপের পরিচয় এখানে উদ্‌ঘাটিত করেছেন। সে প্রকৃতিলালিত সন্তান, সেই প্রকৃতিই হল তার জীবনীশক্তি। অথচ গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই বালককে তার নিজের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে নাগরিক জীবনে উপস্থাপিত করে পরিস্থিতি। তাই প্রত্যক্ষ জীবনের অন্তরালে রয়েছে কিশোর ফটিকের মুক্তির আকুতি। প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতায় ফটিকের হৃদয়ে শুধুই বেদনার চিহ্ন। ফলে নাগরিক জীবনের অধিবাসীরা ফটিকের মনোজগতের আলোড়ন ও মর্মান্তিক বিচ্ছেদকে বুঝতে সক্ষম হয়নি। বিদ্যালয় শিক্ষায় শিশুর বড়ো শিক্ষক হল প্রকৃতি। প্রকৃতির মধ্যেই শিশুর সকল সত্তার বিকাশ ঘটে। ফটিকের অনুরাগ, চাহিদা, প্রবণতা ও প্রবৃত্তি অনুযায়ী নাগরিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষা দিতে পারেননি বলেই ফটিকের সেই শিক্ষা ফলপ্রসূ হয়নি। সেই অর্থে নাগরিক সমাজের বিদ্যালয়ে সে নির্বোধ বালকরূপেই চিহ্নিত। আর যেখানে প্রকৃতির স্পর্শ নেই সেখানে ফটিকের মনোযোগ না থাকাই ছিল তার স্বাভাবিক স্বভাববৈশিষ্ট্য, তাই ফটিক অমনোযোগী।

এই নাগরিক জটিলতা ও ততোধিক জটিল শিক্ষাব্যবস্থা ফটিকের বোধগম্য হয়নি। তাই পড়ায় অমনোযোগী সে, আর পড়ায় মন বসে না বলেই নির্বোধের মতো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মাস্টারমশায়ের অপমান- তিরস্কার-প্রহার সহ্য করে। প্রত্যুত্তরহীন এই বালক কেবল দূরের বাড়ির ছাদগুলো পর্যবেক্ষণ করে একাকী। নগরের দমবন্ধ জীবন তাকে স্তব্ধ করে দেয়, তাই সে নির্বোধ।

উপসংহার: বস্তুত, এই গল্পে ফটিককে স্কুলের ‘নির্বোধ’ ও ‘অমনোযোগী’ বালক বলার মধ্য দিয়ে মুক্ত পরিবেশ ও প্রকৃতিবিহীন বিদ্যালয়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপের ইঙ্গিত ফুটে ওঠে।

“তখন তাহার চিত্ত অধীর হইয়া উঠিত।” কার কথা বলা হয়েছে এবং তার চিত্ত অধীর হয়ে উঠত কেন, তা আলোচনা করো।

যার কথা: প্রশ্নোদৃত অংশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিকের কথা বলা হয়েছে।

চিত্তের অধীরতার কারণ: গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা ফটিক তার মামার পরামর্শে এবং মা ও মামার ইচ্ছায় গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে পড়াশোনা ও সহবত অর্থাৎ ভদ্রতা বা শিষ্টাচার শিখতে। অবশ্য শহরে আসার ব্যাপারে তার নিজের আগ্রহও কিছু কম ছিল না। শহরে এসে দিন দিন সে বুঝতে পারে তার নিজের অস্তিত্বের ক্ষেত্রটিকে। আপাত উপেক্ষা, তিরস্কারের আড়ালেও মায়ের কাছে যে প্রতিনিয়ত আবদার করেছে, মায়ের স্নেহ আঁচলের সান্নিধ্য পেয়েছে। সে-ই যখন মামির উপেক্ষা, মামাতো ভাইদের উদাসীনতা এবং অবহেলা পেয়েছে-তখন তার নিজের মায়ের কথা মনে হয়েছে।

স্কুলের প্রতিকূল পরিবেশে অস্থির মন: স্কুলে প্রতিনিয়ত হেনস্থা হতে হয়েছে তাকে। স্কুলে সে ‘নির্বোধ’ ও ‘অমনোযোগী’ প্রতিপন্ন হয়েছে। ছেলেদের যখন খেলার ছুটি হত তখন সে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দূরের বাড়িগুলির ছাদ পর্যবেক্ষণ করত। সেসব ছাদে দুপুরবেলা দু-একটি ছেলেমেয়ে কিছু একটা খেলার ছলে ক্ষণিকের জন্য দেখা দিয়ে গেলে তার মন চঞ্চল হয়ে উঠত। সেই প্রসঙ্গে লেখক প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছেন।

ইহার কোনো অপমানে তাহারা অন্যান্য বালকের চেয়েও যেন বলপূর্বক বেশি করিয়া আমোদ প্রকাশ করিত।”- ‘ইহার’ বলতে কার কথা বলা হয়েছে এবং ‘তাহারা’ই বা কারা? ‘আমোদ’ শব্দের অর্থ কী, তাদের এই ‘আমোদ’-এর কারণ কী?

ইহার: আলোচ্য উদ্ধৃতাংশে ‘ইহার’ বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের কথা বলা হয়েছে।

তাহারা: আলোচ্য গল্পে বিশ্বম্ভরবাবুর তিনটি ছেলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ‘তাহারা’ বলতে ফটিকের সেই তিন মামাতো ভাইদের কথাই বলেছেন কথক।

আমোদ-এর কারণ: ফটিকের তিন মামাতো ভাই পরিবারে তাদের মতো করেই বড়ো হচ্ছিল। ভালো স্কুলে পড়াশোনাও শিখছিল। কিন্তু তাদের মা, তাদেরকে মানুষ হওয়ার যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারেননি। ফটিক গ্রাম্য, সহজসরল, তার উপরে শহুরে পরিবেশে সে একেবারে নতুন। এর উপর মামির দুর্ব্যবহার তাকে দিশেহারা করে তুলেছিল। হয়তো বা মামাবাবু ফটিককে সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে আসায় মামাতো ভাইদের কোথাও একটা ঈর্ষাবোধ জন্ম নেয়। এ ছাড়াও স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের কাছে নিয়মিত প্রহার আর অপমানও সহ্য করতে হত ফটিককে।

একে তো ফটিকের প্রতি মামির বিরূপ আচরণ, সেইসঙ্গে ফটিকের প্রতি স্কুল শিক্ষকের ক্ষোভ-এসব দেখে মামাতো ভাইদের মধ্যে ফটিককে নিয়ে একটা সংশয় ও লজ্জাবোধ তৈরি হয়, তাতে মিশে ছিল ঈর্ষাও। তাই স্কুলে যখন অন্য কোনো ছেলেরা ফটিককে অপমান করত তখন মামাতো ভাইয়েরা এর কোনোরকম বিরোধিতা তো করেইনি বরং যেন একটু বেশিই আগ্রহ নিয়ে, বলাবাহুল্য খানিক জোর করেই ফটিকের অপমানে আমোদ প্রকাশ করত। এমনকি ফটিককে তাদের ভাই বলে পরিচয়ও দিত না কখনও-তাদের এই চারিত্রিক দুর্মতিই প্রশ্নোদ্ভূত অংশটির মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে।

আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারি নে।”-এখানে ‘আমি’ কে এবং আলোচ্য উক্তির মধ্য দিয়ে বক্তার চরিত্রের কোন্ দিকটি প্রকাশিত হয়েছে?

বক্তা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্প থেকে নেওয়া প্রশ্নোদ্ভূত অংশের ‘আমি’ হল, ফটিকের মামি তথা বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী।

মামির তিরস্কার ও নির্মমতা: মামাবাড়ির অযত্নে, অনাদরে আর স্কুলের অপমানে, তাড়নায় পিষ্ট হয়ে ফটিক আর কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে • নিতান্ত অপরাধীর মতো মামিকে জানায়- “বই হারিয়ে ফেলেছি।” ফটিকের এই কথাটি শুনেই অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে মামি প্রত্যুত্তর দেন- “আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারি নে।”

মামি নিজের ছেলেদের অপেক্ষা ফটিকের সঙ্গে যে বিরুদ্ধাচরণ করেন, তার স্পষ্ট ছবি এই উদ্ধৃতিটিতে ফুটে উঠেছে। ফটিককে পালন করার ক্ষেত্রে চিরকালই খানিক ছদ্ম দারিদ্র্যের পথ অবলম্বন করেছেন মামি। তিনি চাইলেই তার আর তিন সন্তানের সঙ্গে ফটিককেও যত্নে লালন করতে পারতেন কিন্তু তা করেননি। ফটিকের বই হারিয়ে যাওয়ায়, স্কুলে তার অসুবিধা হওয়ার বিষয়টি চিন্তা না করেই তাকে পাঁচবার বই কিনে দেওয়ার খোঁটা দিয়ে অসহায় বালকটিকে তিরস্কার করার মধ্য দিয়ে মামির মমতাহীন, নিষ্ঠুর এক স্বার্থপর সত্তাই প্রকাশিত হয়েছে।

নিজের হীনতা এবং দৈন্য তাহাকে মাটির সহিত মিশাইয়া ফেলিল”- উল্লিখিত চরিত্রের ‘হীনতা’ ও ‘দৈন্য’-এর পরিচয় দাও।

হীনতা ও দৈন্যের পরিচয়: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের পরিস্থিতি ব্যক্ত করতে উদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন গল্পকার।

নতুন পরিবেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা: সুশিক্ষা ও যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার অভিপ্রায়ে ফটিকের মামা ফটিককে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসেন। তাকে যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য যে স্কুলে তার সন্তানেরা শিক্ষা নিচ্ছিল, সেখানেই নির্বিবাদে ভরতি করে দেন ফটিককেও। কিন্তু প্রতিমুহূর্তে মামির উপেক্ষা ও বকুনি ফটিককে বিদ্ধ করে। একে তো নতুন পরিবেশ, তার উপর বহুদিন মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়ায় মন ভেঙে যেতে লাগল তার। অবশেষে অনেক সাহস জুগিয়ে মামার কাছে গ্রামে যাওয়ার অভিপ্রায় জানালে মামা স্পষ্টতই জানিয়ে দেন, কেবল পুজোর সময় সে বাড়ি যেতে পারবে- এতে যেন আরও মর্মাহত হল ফটিক।

মামির তিরস্কার: ইতিমধ্যেই ফটিক বই হারিয়ে ফেলায় স্কুলে শাস্তি ও হেনস্থায় বাধ্য হয়ে মামিকে বইয়ের কথা জানিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মামির চরম তিরস্কার তাকে নিজের চোখেই অপরাধী করে তোলে।

ব্যথিত হৃদয়ের ‘হীনতা ও ‘দৈন্য: এইসকল বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ফটিকের মন অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে ওঠে এই ভেবে যে, সে অন্যের পয়সা অনর্থক নষ্ট করছে। তাই মায়ের উপর অত্যন্ত অভিমান হয়-কেন তাকে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন মা। এইরূপ নানা চিন্তাভাবনায় জর্জরিত ফটিকের ব্যথিত বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখক ‘হীনতা’ ও ‘দৈন্য’ শব্দ দুটির ব্যবহার করেছেন।

তাহাকে মাটির সহিত মিশাইয়া ফেলিল।”-কোন্ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতিটি এসেছে? ফটিক মাটিতে মিশে গিয়েছিল কেন?

প্রসঙ্গ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে নেওয়া প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি নায়ক ফটিকের আত্মগ্লানি প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। আলোচ্য গল্পে দেখা যায় কিশোর ফটিক খুবই অভিমানী। তার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। প্রকৃতিলগ্ন গ্রামজীবনের উদার-উন্মুক্ত স্বাধীনতার মধ্যে সে বেড়ে উঠলেও মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা থেকে আপাতভাবে বঞ্চিত ছিল। অত্যাচারিণী, অবিচারিণী মায়ের উপর অভিমান করেই সে কলকাতায় মামার বাড়িতে চলে এসেছিল সানন্দে। কিন্তু সেখানে এসেও মামির স্নেহহীন আচরণে সে পীড়িত হয়। মামার বাড়িতেও সে যে অপাঙ্ক্তেয়, তা অল্প দিনেই বুঝে যায় ফটিক। ফলে এক অদ্ভুত অবসাদ গ্রাস করে তাকে।

ব্যাখ্যা: কার্যত এইসকল কারণেই পড়াশোনায় ফটিক অমনোযোগী হয়ে পড়ে, মাস্টারমশাইয়ের প্রহার নীরবে সহ্য করে এবং মামাতো ভাইদের অবজ্ঞা নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। শহরের হৃদয়হীন পরিবেশে তার দমবন্ধ হয়ে আসে। গ্রামজীবনের কথা মনে পড়ে তার, সে ফিরে যেতে চায় সেই উদার-উন্মুক্ত শান্তির জগতে, তার নিজের সাম্রাজ্যে। মামাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, কার্তিক মাসের পুজোর ছুটিতে সে বাড়ি যেতে পারবে। ইতিমধ্যে স্কুলে ফটিক বই হারিয়ে আসে এবং নিরুপায় হয়ে মামির কাছে নিজের অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করলে চরম তিরস্কৃত হয়। মামি অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলেন “বেশ করেছ। আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারি নে।” সে যে মামির কাছে দুর্গ্রহস্বরূপ তা ফটিক আগেই জানত। মামির নির্দয় আচরণে সে আবারও মায়ের উপর অভিমানী হয়ে পড়ে। লজ্জিত ফটিকের নিজের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে আত্মগ্লানি হয়। তার এই দৈন্য এবং হীনতা তাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফ্যালে।

“বোগের সময় এই অকর্মণ্য অদ্ভুত নির্বোধ বালক পৃথিবীতে নিজের মা ছাড়া আর-কাহারও কাছে সেবা পাইতে পারে, এরূপ প্রত্যাশা করিতে তাহার লজ্জা বোধ হইতে লাগিল”- নির্বোধ বালক কাকে বলা হয়েছে এবং সেই বালকের এরূপ ভাবনার কারণ কী?

নির্বোধ বালক: গল্পকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছুটি’ গল্পে বালকদের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীকেই এখানে নির্বোধ বালক বলে অভিহিত করেছেন।

ভাবনার কারণ: সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ-বাৎসল্য ও মমত্ববোধ বিশ্বব্যাপী অভিনন্দিত হয়। ফটিকের বিরুদ্ধে তার মায়ের অভিযোগ ছিল যে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে এই সন্তানটি অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কিন্তু মায়ের গভীর স্নেহ-বাৎসল্যের ফল্গুধারাটি তার অন্তরে সতত প্রবাহিত ছিল। তা ছাড়া প্রকৃতিপ্রেমিক ফটিক উপলব্ধি করেছে, মায়ের স্নেহ- প্রীতিহীন বিচ্ছিন্ন জীবন তার কাছে দুর্বিষহ। স্কুলে শিক্ষকের প্রহার, বই হারানোর ফলে মামির অপমান, মামাতো ভাইদের উপেক্ষা ইত্যাদি বিষয় তার অন্তরের পীড়াকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। ফলে জ্বরে আক্রান্ত ফটিক একদিন মামার বাড়ি থেকে পলায়ন করে। কারণ স্নেহহীন মামার বাড়ি ছিল তার কাছে নরকযন্ত্রণার শামিল। মায়ের উন্ন স্পর্শ পেতে সে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে, মায়ের যত্নই তার মহৌষধ হতে পারে এমনটাই বোধ করে ফটিক। তার মান-অভিমান, অপমান, হীনম্মন্যতাবোধ, লজ্জা- এসব কিছুই বিস্মৃত হয়ে মায়ের সান্নিধ্যে মন অফুরন্ত স্নেহধারায় ভরে উঠবে। রোগজ্বালায় কাতর ফটিকের এমনটাই মনে হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ কৈশোরের মানসিক উদ্দীপনা বা চঞ্চলতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য স্নেহবিচ্যুত আত্মার এই নির্বোধ ক্রন্দনধ্বনি ফটিক চরিত্রে রূপায়িত করেছেন।

“এরূপ প্রত্যাশা করিতে তাহার লজ্জা বোধ হইতে লাগিল।”- ‘তাহার’ বলতে কার কথা বলা হয়েছে এবং কোন্ ‘প্রত্যাশা’-কে লজ্জাবোধের স্বরূপ মনে করা হয়েছে-পাঠ্যাংশ অনুসরণে বিবৃত করো।

‘তাহার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ শীর্ষক ছোটোগল্পে ‘তাহার’ বলতে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের কথাই বলা হয়েছে।

প্রত্যাশা: মানুষ মাত্রেই কিছু-না-কিছুর জন্য প্রত্যাশী। ‘প্রত্যাশা’ শব্দটি আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেখানে ফটিক মাত্র তেরো-চোদ্দো বছরের কিশোর-প্রত্যাশা তো তার থাকবেই। ফটিকও মামার বাড়িতে এসেছিল একটা সুন্দর, স্নেহময় জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে, কিন্তু নগরে ‘মানুষ’ হতে এসে ফটিকের সেই প্রত্যাশা ‘লজ্জাবোধ’-এ পরিণত হয়।

ফটিকের আত্মোপলব্ধি: একদিকে মামির অনাদর ও উপেক্ষা অন্যদিকে মামাতো ভাইদের উদাসীনতা, স্কুলে ‘ভারাক্রান্ত গদর্ভ’ উপাধি সবমিলিয়ে তার নিরবচ্ছিন্ন জীবনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। একমাত্র মা বা মায়ের বয়সি কেউ হয়তো তার বেদনা বুঝতে পারত। কিন্তু মামাবাড়িতে মাকে সে কোথাও পায় না, আর মামি তো প্রথম থেকেই বিরূপ। তাই স্কুল থেকে ফিরে যেদিন মাথাব্যথার সঙ্গে গা শিরশির করে জ্বর আসতে লাগল, সেই মুহূর্ত থেকে সে নিজেই বিব্রত হয়ে পড়ল এই ভেবে যে; কাকে একথা জানাবে, কারণ মামি তার অসুস্থতাকেও অকারণ, অনাবশ্যকরূপে দেখবেন।

নিজেকে নিয়ে বিব্রত, প্রত্যাশাহীন, সংশয়ী কিশোর: শুধুমাত্র মা-ই পারে যে-কোনো পরিস্থিতিতে সন্তানকে কোলে টেনে নিতে। কিন্তু ফটিকের মা-ই তার কাছে নেই-মায়ের সেবাবঞ্চিত কিশোর ফটিক তাই মামির কাছ থেকে সেবা প্রত্যাশাকে লজ্জার বিষয় বলে মনে করে-মামিও যে মায়ের মতোই মমতা ও সেবা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে পারে-এই বিষয়টিই ফটিকের কাছে অবিশ্বাস্য হয়ে উঠেছিল। এইরূপ নানাবিধ চিন্তায় ভারাক্রান্ত ফটিকের গভীর মননের ভাবধারাটি প্রকাশ করতেই লেখক প্রশ্নোক্ত অংশটি ব্যবহার করেছেন।

পরদিন প্রাতঃকালে ফটিককে আর দেখা গেল না।”- পাঠ্যাংশ অবলম্বনে পূর্বাপর ঘটনাসমূহের বিবরণ দাও।

আলোচ্য ঘটনা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ ছোটোগল্পে ফটিক তার বাড়ির উদ্দেশে তথা নিজগ্রামে, মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিল। পরে ফটিককে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশের লোক খোঁজাখুঁজি করে তাঁকে পুনরায় তার মামার বাড়িতে ধরে নিয়ে এসেছিল।

অসহনীয় যন্ত্রণা: মামাবাড়ি, শহরের পরিবেশ দিন দিন ফটিকের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। মামির অনাদর, মামাতো ভাইদের অসহযোগিতা- সবমিলিয়ে যখন সে ব্যর্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাইল তখন মামা স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন-পুজোর ছুটিতে তিনি নিয়ে যাবেন। কিন্তু সে তো অনেক দেরি। ফটিকের কাছে ততদিন অপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তারপর তার শরীরের অসুস্থতার কথা জানতে পারলে মামির প্রতিক্রিয়া কীরূপ হবে-সেই কল্পনা থেকে সে নিজেই জ্বর গায়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

ফটিকের প্রত্যাবর্তন: নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ-ফটিকের হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে মামা পুলিশে খবর দিলে, পুলিশ সমস্ত দিনের পর সন্ধ্যায় ফটিককে উদ্ধার করে আনে তখন তার শরীর আপাদমস্তক ভেজা। সারা গায়ে কাদা, চোখ-মুখ রক্তের মতো লাল এবং সে জ্বরে থরথর করে কাঁপছে। বিশ্বম্ভরবাবু চলচ্ছক্তিহীন ফটিককে প্রায় কোলে করে নিজের ঘরের ভিতরে নিয়ে যান।

পরদিন প্রাতঃকালে ফটিককে আর দেখা গেল না।”- কেন দেখা গেল না? তার পরের ঘটনা সংক্ষেপে লেখো।

দেখা না যাওয়ার কারণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে দেখা যায় নায়ক ফটিকের মামাবাড়িতে থাকাকালীন অবস্থায় তার জ্বর এলে সে নির্দয় মামিকে জ্বালাতন করতে চায়নি, তাই বর্ষণমুখর রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়েছিল নিজগ্রামে চলে যাওয়ার উদ্দেশে। সেই কারণেই পরদিন সকালে তাকে দেখা যায়নি। ফটিক আসলে আর কারও জীবনের উপদ্রব হতে চায়নি।

ঘটনার বর্ণনা: স্কুল থেকে ফিরে ফটিকের জ্বর আসে। ততদিনে সে উপলব্ধি করেছে তার মামি স্নেহশূন্য হৃদয়ে তাকে দুগ্রহ বলে মনে করে। সুতরাং অভিমানী ফটিক রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে মামিকে অকারণ, অনাবশ্যক জ্বালাতন করতে চায় না। পরদিন সকালে তার খোঁজ পড়ে। প্রথমে প্রতিবেশীদের ঘরে, পরে পুলিশের সাহায্যে সারাদিন ধরে ফটিককে খুঁজতে তৎপর হন মামা বিশ্বম্ভরবাবু। সন্ধ্যার সময় পুলিশ ফটিককে খুঁজে নিয়ে এসে বিশ্বম্ভরবাবুর হাতে তুলে দেন। দিনভর বৃষ্টিতে ভিজে তার জ্বর তখন আরও বেড়ে গিয়েছে। ফটিক বলে, সে তার মায়ের কাছে যাচ্ছিল। বিশ্বম্ভরবাবু চরম তৎপরতায় ফটিকের জন্য ডাক্তার ডাকেন, সারাক্ষণ নিজের হাতে ভাগনের সেবা করেন। কিন্তু তাতে ফটিকের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয় না। সে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে। বিশ্বম্ভরবাবু ফটিকের মাকে আনতে পাঠান। মুমূর্ষু ফটিক জ্বরের ঘোরে স্টিমারের খালাসিদের জল মাপতে দেখার অভিজ্ঞতাটি অবচেতনে উচ্চারণ করতে থাকে-“এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ না”। সে নিজেও যেন অকূল সমুদ্রে যাত্রা করছে, রশি ফেলে যার তল খুঁজে পাচ্ছে না অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতায় ডুবে যেতে থাকে ফটিক। তার মা এসে উপস্থিত হন। কান্নায় ভেঙে পড়েন ছেলের এই অবস্থা দেখে। ডাক্তার জানিয়ে দেন ফটিকের শারীরিক অবস্থার উন্নতির আশা নেই। মৃত্যুপথযাত্রী ফটিক সেই আচ্ছন্নতায় ডুবে যেতে যেতে বলে-“মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি” ফটিকের এই ব্যঞ্জনাবাহী উক্তিটির মধ্য দিয়ে গল্পের ইতি টানেন রবীন্দ্রনাথ।

“কেন বাপু, পরের ছেলেকে নিয়ে কেন এ কর্মভোেগ। দাও ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও।”- এখানে ‘কর্মভোগ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বক্তার চরিত্রের পরিচয় দাও।

‘কর্মভোগ’-এর পরিচয়: আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্পের অন্তর্গত। উল্লিখিত বক্তব্যটি ফটিকের মামি ফটিক সম্বন্ধে ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে যে ফটিক সর্বদাই নিশ্চিন্ত আনন্দে মেতে ছিল, সেই ফটিককেই নিশ্চল, একলা করে দেওয়া হল নাগরিক জীবনের বন্দিশালায় নিয়ে এসে। ফলত, বয়ঃসন্ধিকালীন কৈশোরের হীনতা, দৈন্য, অভিমান, উপেক্ষা তাকে অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে ফেলেছে। অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে পথে নামতে হয়েছে তাকে। এই পথ ফটিককে মুক্তির দিশা দেখায়, তাই সে সবার অলক্ষ্যে মামাবাড়ি থেকে পলায়ন করে। ফটিকের এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য আদতে পুনরায় গ্রাম্য প্রকৃতির সংস্পর্শে যাওয়া, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আগ্রহে। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ রাত্রিতে ফটিকের পলায়নের ফলে বিশ্বম্ভরবাবুকে তার খোঁজে উদ্ভ্রান্তের মতো বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়াতে হয়েছে, প্রতিবেশীদেরকেও অনর্থক বৃষ্টিতে ভিজে হয়রান হতে হয়েছে এবং শেষে পুলিশকে খবর দিয়েছেন বিশ্বম্ভরবাবু। এমতাবস্থায় ফটিকের মামি ও তার ছেলেদের আহার করা হয়নি, ছেলেদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বও হয়েছে। এত কিছু ঘটনা ঘটার পর দিনান্তে আপাদমস্তক ভেজা দ্বন্দ্বও হয়েছে। এত কিছু ঘটনা ঘটার পর দিনান্তে আপাদমস্তক ভেজা, সর্বাঙ্গে কাদামাখা, রক্তবর্ণ চোখ ও জ্বরে কম্পমান অবস্থায় ফটিককে উদ্ধার করে পুলিশ তাকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে যায়। এমন এক দুর্যোগের দিনে ফটিককে নিয়ে সারাদিনের এই মানসিক দুর্ভোগকেই ফটিকের মামি ‘কর্মভোগ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বক্তার চরিত্র: স্নেহ-বাৎসল্যের আধাররূপে নারীজাতি সমগ্র বিশ্বে বন্দিত। মামি ফটিকের মাতৃতুল্য, তাই ফটিক মামির কাছে চেয়েছিল খানিক অপত্যস্নেহ বা মায়ের মতো যত্ন কিন্তু বিনিময়ে সে পেয়েছে অনাদর, তিরস্কার আর গঞ্জনা। মামি তাকে আপন করে নেয়নি কখনোই, কারণ মামির দৃষ্টিতে ফটিক হল-‘পরের ছেলে’। তা ছাড়াও, কোনো মানুষ অসুস্থ হলে আত্মীয় পরিজনদের মানবিক হওয়াটা কর্তব্য। কিন্তু অসুস্থতার সময়ে অমানবিকের ন্যায় ফটিককে বাড়ি পাঠানোর আদেশ দেওয়া মামির চরম নিষ্ঠুরতার নিদর্শন। বলা যেতে পারে, মামির দায়িত্বজ্ঞানহীন, স্বার্থান্বেষী ও অমানবিক রূপটি এই সংলাপের আলোকে পরিস্ফুট হয়েছে।

“সমস্ত রাত্রি প্রলাপ বকিতে লাগিল।”-এখানে কার কথা বলা হয়েছে এবং তার এরূপ অবস্থার কারণ কী?

যার কথা: প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশে একদা বালকদলের সর্দার ফটিকের কথা বলা হয়েছে।

এরূপ অবস্থার কারণ: কলকাতায় আগমন ও আত্মোপলব্ধি: যথার্থ মানুষ হওয়া ও সার্বিক শিক্ষায় – শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে ফটিকের মামা ফটিককে কলকাতায় তার নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। ক্রমশ সেখান থেকে মামির কটূক্তি ও মামাতো ভাইদের বিরূপতায় সে সংকুচিত হয়ে যেতে থাকে। এরপর সে আর সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ফিরে যেতে চাইলে মামা জানিয়ে দেন পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার কথা। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করা ফটিকের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।

মাতৃভূমির প্রতি অমোঘ টান: ইতিমধ্যে নিজের অসুস্থতার কথা মামিকে জানালে মামির আচরণ বিষয়ে সন্দিহান কিশোর কোনোরূপ চিন্তাভাবনা না করেই বাড়ির পথে পা বাড়ায়। শহরের তিক্ত অভিজ্ঞতা, দমবন্ধ অবস্থা, যত্নহীন চারপাশ তাকে তার আবেগপ্রবণ, সবুজে ঘেরা ছোট্ট গ্রামটির মর্ম বুঝিয়ে দেয়।

অসুস্থ ফটিককে উদ্ধার ও তার প্রলাপ: একে তো দুর্যোগের রাত, তার উপর জ্বর-সবমিলিয়ে ফটিকের দুর্দশা অবর্ণনীয় হয়ে ওঠে। তাই সে শহর থেকে পালায়। কিন্তু পুলিশ তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনে তার ছেড়ে যাওয়া প্রাণহীন যক্ষ্মপুরীতেই। জ্বরে তখন প্রায় অচৈতন্য অবস্থা তার। হয়তো গ্রামে ফিরতে পারলে, প্রকৃতির স্পর্শ পেলে তার প্রাণ শ্বাসবায়ুতে ভরে উঠতে পারত। কিন্তু এখানে সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং শেষপর্যন্ত জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকা শুরু করে ফটিক।

“মা, আমাকে মারিস নে মা। সত্যি বলছি, আমি কোনো দোষ করিনি।”-এখানে বক্তা কে এবং বক্তা কোন্ পরিস্থিতিতে ও কেন এরূপ উক্তি করেছে?

বক্তা: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকই প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছে।

পরিস্থিতি: গল্পের শুরু থেকে ফটিকের দৌরাত্ম্যের পরিচয় দিয়েছেন গল্পকার। ফটিক বালকদের সর্দার, অত্যধিক দুরন্ত। তাই তার মায়েরও এমনটাই ধারণা যে, সব গণ্ডগোলের মূলে রয়েছে সে-ই। এই দুরন্ত বালকটি কারোর কাছে সহজে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি, বরং তাকে দোষারোপই করা হয়েছে সর্বত্র। কনিষ্ঠ মাখনকে মারার জন্য ফটিককেই দোষারোপ করেন তার মা। পাঁচ জনের সংসারে অযাচিত হয়ে আগমনের জন্য তাকে অনবরত ভর্ৎসনা করেন তার মামি, স্কুলে তাকে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে হয় অমনোযোগিতার কারণে। এইসব তিক্ততার মধ্যে যেন হাঁফিয়ে উঠেছিল ছোট্ট এই প্রাণটি, অসুস্থও হয়ে পড়ে সে। অসুস্থতায় মামিকে বিব্রত না করার অভিপ্রায়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য, গ্রামের পথে পাড়ি দেয় ফটিক।

উক্তির কারণ: ফটিক কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছাড়ায় মামা-মামি-সহ সকলকেই যে দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয় তার জন্যও দায়ী করা হয় ফটিককেই। রোগে, অপমানে, অযত্নে সে তখন চলচ্ছক্তিহীন। শয্যাশায়ী, জ্বরে আক্রান্ত ফটিক সেই অবস্থায় প্রলাপ বকতে বকতে বলেছিল-“মা, আমাকে মারিস নে মা।” আজীবন যে দোষারোপ সে সহ্য করেছে, সেই সব কিছুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে অসহায়, অপরাধবোধে বিধ্বস্ত, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বালকটি যেন শেষবারের মতো আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে ওঠে “সত্যি বলছি, আমি কোনো দোষ করিনি।” এই উক্তিটি ফটিকের চরম অসহায়তার প্রমাণ।

“নিরাশ হইয়া আবার নীরবে দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল”- কার কথা বলা হয়েছে এবং তার এরূপ অবস্থার কারণ কী?

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের কথা বলা হয়েছে।

অবস্থার কারণ: নিজের গ্রামে ফেরার অমোঘ আকর্ষণ: মামার বাড়িতে প্রতিনিয়ত মামির কটূক্তি ও মামাতো ভাইদের উদাসীনতায় ক্লান্ত-বিধ্বস্ত ফটিক বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল। সেইসঙ্গে স্কুলেও তার শান্তি ছিল না। তাই মনে মনে সে খুবই কষ্ট পাচ্ছিল। এরমধ্যেই নিজের শরীর খারাপে হতচকিত হয়ে পড়ল সে। কারণ ইতিমধ্যেই মামা জানিয়ে দিয়েছিলেন, পুজোর ছুটির আগে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। তাই কাউকে কিছু না বলে জ্বর জ্বর গা, মাথাব্যথা নিয়েই বাড়ি ছেড়ে গ্রামের উদ্দেশে পা বাড়ায় ফটিক। এদিকে বাড়িতে তাকে খুঁজে না পেয়ে ব্যস্ত মামা পুলিশে খবর দিলে, পুলিশই ফটিককে পুনরায় মামাবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে-যা মোটেও তার কাঙ্ক্ষিত ছিল না। বৃষ্টিতে ভিজে তার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, হাঁটাচলার শক্তিও ছিল না ফটিকের।

ফিরতে না পারার নৈরাশ্য: পরিস্থিতি ভালো নয় বুঝে ডাক্তার ডেকে আনলে বিশ্বম্ভরবাবু জানতে পারেন যে, ফটিকের অবস্থা সংকটজনক। এমতাবস্থায়, ফটিকের মাকে তলব করেন বিশ্বম্ভর আর এরই মধ্যে ফটিকের অবস্থার আরও অবনতি হয়, সারারাত সে প্রলাপ বকে। কেবল দিনের বেলা একবার চেতনা ফিরলে সচেতন হয়ে সে মাকেই খোঁজে। মায়ের অন্বেষণে ব্যর্থ হয়ে ফটিক নীরবে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে। তার এই মুখ ফেরানো যেন সমস্ত বিশ্বসংসার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থ বহন করে। ঘরে ফিরতে না পারার ও মাকে না দেখতে পাওয়ার নৈরাশ্যই ছিল – এই নীরব প্রতিক্রিয়ার প্রত্যক্ষ কারণ।

ফটিক, তোর মাকে আনতে পাঠিয়েছি”-আলোচ্য অংশে বক্তা কোন্ প্রেক্ষিতে উক্ত কথাটি বলেছেন? ব্যাখ্যা করো।

প্রেক্ষিত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশের বক্তা হলেন ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু।

মায়ের সান্নিধ্যহীন ফটিক: গল্পে বিধবা মা একা, মাখন ও দুরন্ত ফটিককে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন, ফটিককে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা ছিল বেশি। এই টালমাটাল সময়ে মুশকিল আসান হয়ে এলেন ফটিকের মামা বিশ্বম্ভর। অবাধ্য সন্তানকে সুপথে আনা ও সুশিক্ষা দানের অভিপ্রায়ে তাকে কলকাতা পাঠাতে রাজি হয়ে গেলেন মা। প্রকৃতির মুক্ত স্নেহচ্ছায়ায় লালিত ফটিক শহরের গণ্ডিবদ্ধ জীবনে এসে পড়ে। ফটিকের মামা ফটিককে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার মনের ভাব বা প্রকৃতি বুঝতে পারেননি। তেরো-চোদ্দো বছরের বালকটি নগরের পরিবেশের সঙ্গে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারেনি।

মা ও মাতৃভূমির কাছে ফিরতে ব্যাকুল ফটিক: এমতাবস্থায় ফটিক তার দুরন্ত শৈশবে কাটানো দিনগুলিতে ফিরে যেতে চাইছিল। মামির স্নেহহীন আচরণ ও চারদেয়ালের গণ্ডিবদ্ধ জীবন-এই দুইয়ের মাঝে পড়ে যেন পিষ্ট হচ্ছিল ফটিক। সে মুক্তির জন্য ছুটির অপেক্ষা করছিল, কারণ ‘ছুটি’ হলেই সে ফিরতে পারবে মায়ের কাছে, ফিরে যেতে পারবে অবাধ মুক্তির স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ জীবনে। তাই সে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের উদ্দেশে। তবে তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয় বন্ধ সেই যক্ষ্মপুরীতে। ফটিকের অবস্থা তখন খুবই সংকটজনক। চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে সে জ্বরের ঘোরে সমস্ত রাত প্রলাপ বকে। চিকিৎসকও জানিয়ে দেন, ফটিকের অবস্থা ভালো নয়। ফটিক তখন অচৈতন্যপ্রায়। প্রলাপে সে মাকেই কাছে পেতে চাইছে কেবল। ফটিকের শরীর ও মনের অবস্থা বিবেচনা করে বিশ্বম্ভরবাবু তার মাকে তলব করেন। কারণ এই ঘোর অসুস্থতায় মা-ই ছিলেন ফটিকের শ্রেষ্ঠ ও শেষ আশ্রয়। তাই তাকে ভরসা জোগাতেই মাকে আনিয়ে দেওয়ার বিষয়টি মামা, ফটিককে জানিয়েছেন।

“ডাক্তার চিন্তিত বিমর্ষ মুখে জানাইলেন, অবস্থা বড়োই খারাপ।”- কোন্ প্রসঙ্গে এরূপ উক্তি? অবস্থা কি সত্যিই খারাপ ছিল, শেষাবধি কী জানা যায়?

প্রসঙ্গ: যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠা ও সার্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার লক্ষ্যে ফটিক তার মামাবাড়িতে এসেছিল ঠিকই কিন্তু সেখানে প্রতিনিয়ত মামির ঝাঁজালো কথা ও মামাতো ভাইদের তাচ্ছিল্য, উদাসীনতাকে আর মেনে নিতে পারছিল না ফটিক। পারছিল না প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে। ইতিমধ্যে বই হারিয়ে ফেলায় ও স্কুলে সর্বদা বকুনি-অপমানে জর্জরিত হয়ে সে গ্রামে ফিরে যেতে চাইলে মামা জানিয়ে দেন, পুজোর ছুটিতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এতদিন নিজেকে ধরে রাখার ধৈর্য আর তার ছিল না। তাই জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে এবং মাথাব্যথাকে সঙ্গী করেই সে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেও পুলিশি তৎপরতায় মামা তাকে ফিরিয়ে আনেন। তখন তার অবস্থা সংকটজনক-আপাদমস্তক ভিজে, সর্বাঙ্গে কাদা, চোখ রক্তবর্ণ, জ্বরে কম্পমান, চলচ্ছক্তিহীন। বিশ্বম্ভর তাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে যান ও ডাক্তারকে খবর দেন।

প্রচণ্ড জ্বরে মুহ্যমান কিশোর প্রলাপ বকা শুরু করলে ডাক্তারবাবু তার শরীরের তীব্র অসুস্থতার কথা জানাতে প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেছেন।

অবস্থার পরিণতি: ফটিকের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, তার সুস্থ হওয়ার কোনো আশা গল্পের শেষে গিয়েও লক্ষ করা যায় না। বরং এই অসুস্থতা যে তার অকালমৃত্যুই ডেকে আনবে তা বোঝা যায়।

ফটিক খালাসিদের মতো সুর করিয়া বলিতে লাগিল, “এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ না।”- ফটিকের এরূপ অবস্থা হয়েছিল কেন, তা পাঠ্যাংশ অনুসরণে বিবৃত করো।

ব্যাখ্যা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক। তাকে ঘিরেই সমগ্র গল্পের ঘটনাপ্রবাহ। গ্রাম্য, প্রাণোচ্ছল, দুষ্টুমিতে ভরা উন্মুক্ত প্রাণপাখিকে খাঁচায় বন্দিদশায় এনে ফেলেছিলেন তার মামা। যদিও যথার্থ মানুষ করে ফটিককে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলাই ছিল মামার মূল লক্ষ্য।

অসহায় ফটিক: ফটিক কলকাতায় এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। মামার বাড়িতে প্রতিনিয়ত মামির গঞ্জনা, মামাতো ভাইদের ঔদাসীন্য ও স্কুলের প্রতিকূল পরিবেশে ক্রমাগত খাপ খাওয়াতে অক্ষম কিশোর ফটিক বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে বাড়ি যেতে চায়। কিন্তু মামা সোজাসুজি জানিয়ে দিলেন, একমাত্র পুজোর ছুটিতেই তার বাড়ি ফেরা সম্ভব। ফটিকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

ফটিকের গ্রামে ফেরার প্রবল আগ্রহ, অসুস্থতা এবং প্রলাপ: মামার বাড়ির ওই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে নিজেই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় ফটিক। মাথাযন্ত্রণা ও জ্বর জ্বর গা নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে কাউকে না জানিয়ে মামাবাড়ি থেকে সে তার গ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। এদিকে এই বিষয়টি মামির কাছে বাড়তি ঝঞ্ঝাট বলে মনে হয়। নতুন পরিবেশ, নতুন জগৎ-যদি কিছু হয়ে যায় সেই ভেবে, মামা পুলিশি তৎপরতায় ফটিককে ফিরে পান। একদিকে বাড়ি না ফিরতে পারার যন্ত্রণা- অন্যদিকে শারীরিক কষ্টে বিধ্বস্ত ফটিককে দেখে মামা ডাক্তারবাবুকে ডাকেন। ডাক্তার জানিয়ে দেন যে, ফটিকের অবস্থা খুবই খারাপ।

ফটিকের মামা দেরি না করে বোনকে খবর পাঠিয়ে দেন। একে তো মায়ের মুখ দেখার অসীম আগ্রহ, অন্যদিকে রোগশয্যায় শায়িত ফটিক জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে। যে হাঁক সে কলকাতা আসার পথে খালাসিদের মুখে শুনেছিল, সেই হাঁকই সে জ্বরের ঘোরে আওড়াতে থাকে। খুবই অর্থপূর্ণ এ প্রলাপ। ফটিকের এই প্রলাপ যেন তার অতল, টলমল, অসহায় অবস্থারই সূচক।

এক বাও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ না-কে, কখন এ কথা বলেছে? এই উক্তির মধ্য দিয়ে লেখক আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন?

যে, যখন বলেছে: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিক মামাবাড়িতে থাকাকালীন যখন প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে তখন প্রলাপের মধ্যে সে খালাসিদের মতো সুর করে বলেছে-“এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ না।” স্টিমারের খালাসিরা কাছি ফেলে জল মাপার সময় কেমন সুর করে কথা বলে, তা মামার সঙ্গে কলকাতা আসার সময় পথে শুনেছিল। ফটিক। জ্বরের ঘোরে সেই সুর সে অবচেতনে উচ্চারণ করেছে।

ব্যাখ্যা: শহরের হৃদয়হীন বাতাসে যখন ফটিকের দম বন্ধ হয়ে এসেছে, সে ফিরতে চেয়েছে আপন সাম্রাজ্যে-প্রকৃতিলগ্ন গ্রামজীবনের উদার-উন্মুক্ত স্বাধীন জীবনে। মামার বাড়িতে মামির নির্দয় আচরণ তাকে বারেবারে পীড়িত করেছে। স্কুল থেকে ফিরে এসে ফটিকের জ্বর আসলে সে তখন মামিকে অকারণ-অনাবশ্যক জ্বালাতন করতে না চেয়ে বর্ষণমুখর রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়েছে। সে শহরের দমবন্ধ আবহাওয়া থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। হঠাৎ জ্বর আসায় সে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় একাই। পরে বিশ্বম্ভরবাবুর তৎপরতায় পুলিশ তাকে খুঁজে আনে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে তার জ্বর তখন প্রবল। ডাক্তার আসেন, বিশ্বম্ভরবাবু নিরন্তর সেবা করে চলেন। তবু ফটিকের শারীরিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয় না। প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে সে সুর করে খালাসিদের মতো উচ্চারণ করে-“এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ না।” আসলে রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চান মৃত্যুপথযাত্রী ফটিক যে অকূল সমুদ্রে যাত্রা করেছে, তার যেন কোনো তল পাচ্ছে না সে। ফটিকের চেতনার গভীরে সেই অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রকল্পটি নিহিত ছিল, জ্বরের আচ্ছন্নতায় সেটিই সে উচ্চারণ করেছে অবচেতনে। তার এই অবচেতন অবস্থায় অস্পষ্ট উচ্চারণের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ফটিকের অস্থিরচিত্ততা ও আসন্ন করুণ পরিণতিকেই নির্দেশ করেছেন।

ফটিকের মাতা ঝড়ের মতো ঘরে প্রবেশ করিয়াই উচ্চকলরবে শোক করিতে লাগিলেন।”- ফটিকের মায়ের এরূপ আচরণের কারণ কী?

মায়ের আচরণের কারণ: প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ শীর্ষক ছোটোগল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। ফটিকের স্বভাবের পরিবর্তন এবং পড়াশোনার উন্নতি কামনা করে তার মা, নিজের দাদার কাছে ছেলেকে বড়ো আশা নিয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক উন্নতির পরিবর্তে, ফটিকের অসুস্থতার খবরে মা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

সন্তানের অসুস্থতার সংবাদে পাগলিনিপ্রায় মাতা: কলকাতা থেকে ফটিকের গ্রামের দূরত্ব নেহাত কম নয়। কিন্তু অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল, পাঠে অমনোযোগী ছেলেকে শুধুমাত্র সুশিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায়ে বিধবা মা রাজি হয়েছিলেন, ফটিককে কলকাতায় দাদার কাছে পাঠাতে। দুটি ছেলেকে একাহাতে লালন করাও মায়ের কাছে অসুবিধাজনক ছিল এবং দুরন্ত ফটিককে সামলানোও ছিল কষ্টকর। ফটিক কখন মাখনকে গুরুতরভাবে আঘাত করে ফেলবে-এই দুশ্চিন্তা করেই মা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ফটিককে। কিন্তু কলকাতায় এসে হিতে বিপরীত হল, এমনকি সে অসুস্থও হয়ে পড়ল। এমনিতেই অনেকদিন ছেলেকে দেখতে পাননি মা, তার উপর অসুস্থতার কথা শুনে মায়ের অবস্থা পাগলিনিপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি দাদার বাড়ি পৌঁছেই যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে, প্রায় দৌড়ে ছেলেকে দেখার জন্য ঘরে প্রবেশ করেন। ব্যাকুল মায়ের এই আচরণ প্রসঙ্গেই উদ্ধৃতাংশটি উল্লেখ করা হয়েছে।

“মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”- কে, কখন এ কথা বলেছে? এ কথা বলার কারণ কী?

যে, যখন বলেছে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে নেওয়া প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটির বক্তা ফটিক। মৃত্যুপথযাত্রী ছেলের কাছে মা এসে উপস্থিত হয়ে ব্যাকুলতা প্রকাশ করলে জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন ফটিক এ কথা বলেছে।

এ কথা বলার কারণ: ‘ছুটি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন-প্রকৃতির সঙ্গে যার অচ্ছেদ্য বন্ধন, তাকে প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন করার অর্থ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। আলোচ্য গল্পের নায়ক কিশোর ফটিক বড়ো হয়ে উঠেছে প্রকৃতিলগ্ন গ্রামবাংলার শ্যামলতার সঙ্গে একীভূত হয়ে। মায়ের স্নেহবঞ্চিত ফটিক অভিমান করে মামার প্রস্তাবে রাজি হয়ে কলকাতা চলে এসেছে। কলকাতার হৃদয়হীন বাতাসে সে বুঝেছে ইট-কাঠের দম বন্ধ করা পরিবেশে সে বড্ড বেমানান। কলকাতায় এসে মামির সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই বুঝেছিল, সেই সংসারে সে অপাঙ্ক্তেয়। মামির স্নেহশূন্য আচরণ, মামাতো ভাইদের অবজ্ঞা আর অপরিসীম অনাদরে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। গ্রামজীবনের উদার-উন্মুক্ত, নির্ভার জীবনে ফটিক ফিরে যেতে চায়- যেখানে গেলে ঘুড়ি ওড়ানোর অন্তহীন আকাশ, সাঁতার কাটার সংকীর্ণ-নির্মল স্রোতস্বিনী এবং অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানোর সীমাহীন নদীতীর সে ফিরে পাবে। মামাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, কার্তিক মাসে পুজোর ছুটি পড়লে সে বাড়ি যেতে পারবে। কিন্তু বাড়ি আর যাওয়া হয়ে ওঠে না তার। একদিন প্রবলজ্বরে আক্রান্ত হয় ফটিক। রাতের অন্ধকারে মামার বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় জ্বর গায়েই। পরদিন সন্ধ্যায় পুলিশের তৎপরতায় তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় বিশ্বম্ভরবাবুর বাড়িতে। জ্বর আরও বাড়ে, ডাক্তার তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির আশা দেখতে পান না। জ্বরের ঘোরে ফটিক প্রলাপ বকতে থাকে। মামাকে জিজ্ঞেস করে, তার ছুটি হয়েছে কি না। বিশ্বম্ভরবাবু ফটিকের মাকে আনতে পাঠান। উদ্ভ্রান্তের মতো ফটিকের মা মুমূর্ষু ছেলের কাছে পৌঁছোলে অচেতন প্রায় ফটিক মাকে বলে- “এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।” মৃত্যুপথযাত্রী ফটিকের ব্যঞ্জনাবাহী কথাটির মধ্য দিয়ে গল্পের ইতি টানেন রবীন্দ্রনাথ। ফটিকের এই উক্তি তার অন্তর্গত ব্যাকুলতারই বহিঃপ্রকাশ।

আরও পড়ুন – প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment