ছুটি গল্পের ভাববস্তু
ছুটি গল্পের ভাববস্তু
রবীন্দ্রনাথের সাধনা পর্বে বহুচর্চিত ও জনপ্রিয় একটি ছোটোগল্প হল ‘ছুটি’। এই গল্পের ফটিক যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা দ্বারিকাপুরের চক্রবর্তীদের ছেলে হারানচন্দ্র একথা স্বীকার করেছেন অনেক রবীন্দ্রগবেষক। রবীন্দ্রনাথও নিজেও অন্যত্র বলেছেন ‘The character of the boy in my story ‘chuti’ was suggested by a boy in a village. I then imagined what would happen to this boy if he were taken to Calcutta for his education and made to live in an unsympathetic atmosphere of a family with his aunt. That was the back ground.’ এইভাবেই বাস্তব চরিত্রের ভিত্তিতে এই ‘ছুটি’ গল্পটি গড়ে উঠেছে। যার ভাববস্তুর কেন্দ্রে আছে প্রকৃতির উদার অসীমতায় মুক্তিলাভের ইচ্ছায় কাতর এক গৃহবন্দি বালকের অসহায় বেদনা। গ্রামের মুক্ত প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা দুরন্ত বালক ফটিক কেমন করে শহরের চার দেয়ালের কঠিন বাঁধনে বন্দি হয়ে রইল কেমন করেই এই মুক্ত পাগল বালক চিরকালের মত ছুটি নিয়ে হারিয়ে গেল তার বাস্তব করুণ কাহিনিকে আগাগোড়া একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার উপর দাঁড় করিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বয়ঃসন্ধিকালীন বিড়ম্বনা এবং তার সামাজিক প্রভাব-এই দুই মূল ভাব এই গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মূলত শিশু ও কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিজনিত নানারকমের আবেগ, অনুভূতি, কৌতূহল, পরিবর্তন, চাহিদা, চারপাশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি-সবকিছুই এই গল্পের মূল বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু।
এই গল্পের সামাজিক প্রেক্ষিতও উপেক্ষণীয় নয়। বিধবা মা তার অবাধ্য দুরন্ত ছেলের পড়াশোনার সকল দায়-দায়িত্ব দাদার ওপর দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে চেয়েছেন। তার নিরুপায় অসহায়তা অভিভাবকহীন সংসারে সন্তান প্রতিপালনের অক্ষমতাই ছেলেকে তাঁর স্নেহাঞ্চল ছাড়িয়ে দূর শহরে পাঠানোর কারণ। মা হিসাবে ফটিকের দায়িত্ব দাদার ওপর ন্যস্ত করে দিয়ে তিনি মনে মনে শান্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু ফটিকের এই যাওয়াই যে শেষ যাওয়া এমন অকরুণ আশঙ্কা মা হিসাবে তিনি করেননি। অন্যদিকে দুরন্ত, চঞ্চল ফটিক শহরে যাওয়ার অতি আগ্রহে তার গ্রামের বন্ধুদের ভুলে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাই মাখনকে নিজের ঘুড়ি-লাটাই উপহার দিয়ে মামার সঙ্গে শহরে চলে আসে। ‘আবার আসিব ফিরে’ এই প্রত্যাশা হয়তো তার অবুঝ মনে সুপ্ত ছিল কিন্তু শহর দেখার অদৃশ্য ইচ্ছাই ছিল তখন তার কাছে প্রধান।
যে অবাধ্য, চঞ্চল বালককে গল্পের সূচনায় দেখা যায়, গল্পের শেষে সে যেন এক অন্য কিশোর। মামার সঙ্গে কলকাতায় যাওয়ার পর থেকে মামির অনাদর, অবহেলা, দুর্ব্যবহারের সে শিকার হয়েছে। সর্বোপরি, ফটিক যখন কলকাতায় মামার বাড়ি আসে তখন তার বয়স ছিল তেরো-চোদ্দো বছর। এই বয়সটা ছেলেমেয়েদের বয়ঃসন্ধির কাল। এই বয়সের সুন্দর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ গল্পে দিয়েছেন। এ বয়সের ছেলেদের কোনো শোভা নেই। কোনো কাজেও লাগে না, স্নেহও উদ্রেক করে না। তার মুখে আধো-আধো কথা ন্যাকামি এবং পাকা কথা জ্যাঠামি বলে মনে হয়। তার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা কোথায় হারিয়ে যায়, কণ্ঠস্বর হয়ে যায় কর্কশ। শৈশব ও যৌবনের অনেক দোষ ক্ষমাযোগ্য হলেও এই বয়সের দোষ-ত্রুটিগুলো স্বাভাবিক ও অনিবার্য জেনেও তা ক্ষমার যোগ্য হয় না। আসলে বয়ঃসন্ধিকালীন দৈহিক অশোভনতা, এবং অন্যান্য বিরূপ ব্যবহার সকলের কাছে অপ্রীতিকর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে এই বয়সের ছেলেরাও নিজেদেরকে অন্যদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও পারে না। সবসময় নিজেকে অপরাধী বলে মনে করে এবং অন্যের স্নেহশূন্য ব্যবহার তাদের বেদনাময় করে তোলে। এই বয়ঃসন্ধিকালে ফটিকের যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল নিজের মাকে, সেখানে মামির মতো হৃদয়হীন নারীর দুর্ব্যবহার তাকে মর্মবিদ্ধ করেছিল। মায়ের স্নেহই সর্বোশ্রেষ্ঠ যা দুরন্ত, অবাধ্য সন্তানেরও একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। মায়ের ভর্ৎসনাতেও স্নেহ থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে ফটিকের কাছে মা-শূন্য পরিবেশ তাই নরকতুল্য শাস্তিভোগের জায়গা হয়ে উঠেছিল। মামার বাড়ির মামির অনাদর, অবহেলা; শহরের স্কুলের বন্ধুদের অবজ্ঞা, উপহাস, মামাতো ভাইদের তাচ্ছিল্য, পড়ার চাপ সব কিছু নিয়ে ফটিক তার সহজ চাপল্য হারিয়ে এক ভীরু জীবে পরিণত হয়েছিল।
শহরের কঠিন, সমতাহীন আশ্রয় থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে ফটিক ফিরতে চেয়েছে মায়ের কাছে নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু সেই কাঙ্খিত আশ্রয়ে আর ফিরে আসা হয়নি ফটিকের। মামার সঙ্গে শহরে আসার সময় নৌকায় সে মাঝিদের জল মাপার যে সুর শুনেছিল, নিজের শেষযাত্রায় ফটিক সেই স্মৃতির অনুসঙ্গে জল মেপে ফিরতে চেয়েছে প্রকৃতির কোলে, নিজের মায়ের কোলে। কিন্তু ফটিকের এই যাত্রা অকূল সমুদ্রে তাই তলে পৌঁছানো গেল না। যাত্রা গিয়ে থামে অকূল অসীম মৃত্যুলোকে।
আরও পড়ুন – ‘বই কেনা’ রচনার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে লেখো