ছোটোগল্প হিসাবে ‘ছুটি’ কতখানি সার্থক তা পর্যালোচনা করো

ছোটোগল্প হিসাবে ‘ছুটি’ কতখানি সার্থক তা পর্যালোচনা করো।

ছোটোগল্প হিসাবে 'ছুটি' কতখানি সার্থক তা পর্যালোচনা করো
ছোটোগল্প হিসাবে ‘ছুটি’ কতখানি সার্থক তা পর্যালোচনা করো

ছোটোগল্পের স্বরূপধর্ম ও রূপকল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় খুবই সুন্দর অথচ স্পষ্ট করে বলেছেন- ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ।’

ছোটোগল্পের এই সজ্ঞায় রয়েছে বিন্দুতে সিন্ধুর আভাস, নাটকীয় ঘটনার আকস্মিকতা এবং সমাপ্তির সাংকেতিক ব্যঞ্জনা। এ প্রসঙ্গে রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের মন্তব্যের অংশবিশেষ স্মরণ করা যেতে পারে- “ছোটোগল্প যেন চোরালণ্ঠনের আলো।” ছোটোগল্পের কাহিনিতে ‘ঘটনার ঘনঘটা’ মোটেও প্রত্যাশিত নয়। সমালোচক হাডসন একেই বলেছেন, “Singleness of aim and singleness of affect”।-এইসব বৈশিষ্ট্যের সূত্র ধরে আমাদের পাঠ্য ‘ছুটি’ গল্পটি ছোটোগল্প হিসাবে কতটা শিল্পসার্থক হয়েছে তা আলোচনা করা যেতে পারে।

ছুটি-র অর্থ হল মুক্তি। এই মুক্তি ফটিকের স্নেহপ্রেমহীন কৃত্রিম জীবন থেকে- যে জীবন তার বাঞ্ছিত ছিল না, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ফটিককে সেই ছুটি মেনে নিতে হয়েছে। তাই ফটিকের মুক্তি গল্পকে দিয়েছে ছোটোগল্পের বাঞ্ছিত শিল্পরূপ।

গল্পের পরিণতির বিচারেও সার্থক ছোটোগল্প ‘ছুটি’। গল্পের সমাপ্তিতে ফটিকের কণ্ঠে পাওয়া যায়- “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।” ফটিকের এই বক্তব্যে যে ভাবরস ঘনীভূত হয়, তা বেশ আকর্ষণীয়। এক দুরন্ত বালকের অকালমৃত্যু স্বাভাবিক হলেও পাঠকের কাছে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, থেকে যায় অতৃপ্তি।

ছোটোগল্পের চরিত্রগুলি হয় সংকেতধর্মী। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক সম্বন্ধেও পাঠক স্বল্প পরিসরে আদ্যোপান্ত অনুমান করে নিতে পারে। পল্লিগ্রামের দুরন্ত দামাল ছেলে মায়ের আশ্রয় ছেড়ে কলকাতায় এসে পরিস্থিতির চাপে কীভাবে পরিবর্তিত হল, তারই এক বাস্তবসম্মত চিত্র ফটিকের চরিত্রে চিত্রিত হয়েছে।

‘ছুটি’ গল্পের সমাপ্তিতে করুণরসের অবতারণা হয়েছে। এই করুণরস সার্থক ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন। গল্পের শেষে মায়ের আহ্বানের উত্তরে মুমূর্ষু ফটিক মাকে যা বলেছে তাতে পাঠকের চিত্তে সহানুভূতি ও ভয় জাগ্রত হয়।

গল্পটির মধ্যে অন্তত তিনবার নাটকীয় দ্বন্দু তৈরি হয়েছে। প্রথমে ফটিকের মামার আগমনে নতুন জায়গায় যাওয়ার প্রসঙ্গ; দ্বিতীয়ত, মামাবাড়ি থেকে ফটিক বাড়ি যেতে চাইলে এবং গল্পের সমাপ্তিতে ফটিক যখন মা-কে বলে-“মা, আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

গল্পের মধ্যে এই দ্বন্দু পাঠককে মোহগ্রস্ত করে রাখে, কোথাও হাঁফ ছাড়তে দেয় না। আবার আমাদের জীবনের দু-চারটি অশ্রুজলকে এত ঘরোয়াভাবে এই গল্পে পরিবেশন করা হয়েছে যা, ছোটোগল্পের বিষয় হিসাবে সার্থক হয়ে উঠেছে। গল্পটির মধ্যে কোথাও কোথাও রবীন্দ্রনাথ তত্ত্বকথা শোনালেও তা শিল্পের পক্ষে ক্ষতিকর হয়নি।

তাই ছোটোগল্পের বাঞ্ছিত প্রকরণের রূপায়ণে গল্পটি ছোটোগল্প হিসাবে শিল্পসার্থকতা লাভ করেছে।

আরও পড়ুন – নদীতীরে বালকদের খেলার দৃশ্যটি বর্ণনা করো

Leave a Comment