জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর Class 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার WBCHSE

Table of Contents

জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর Class 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার WBCHSE

জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর Class 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার WBCHSE
জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর Class 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার WBCHSE

এখানে একাদশ শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় অধ্যায় জাতি ও জাতীয়তাবাদ থেকে বড়ো প্রশ্ন উত্তর শেয়ার করা হলো। প্রতিটি প্রশ্নের মান: ৪ // Class 11 Second Semester Political Science Question Answer // jati O jatiyotabad question answer


জাতি ও জাতীয়তাবাদ বড়ো প্রশ্ন উত্তর ক্লাস 11 সেকেন্ড সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান
প্রশ্নমান: ৪

1. জাতীয় জনসমাজের সংজ্ঞা দাও।

অথবা, জাতীয় জনসমাজ বলতে কী বোঝায়?

জাতীয় জনসমাজের সংজ্ঞা

জাতীয় জনসমাজ (Nationality) হল জনসমাজ (People) ও জাতির (Nation) মধ্যবর্তী পর্যায়। সাধারণভাবে বলা যায়, যখন কোনো জনসমাজ রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্য জনসমাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ আলাদা বলে ভাবতে থাকে, তখন সেই জনসমাজ জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়। বিভিন্ন পণ্ডিত জাতীয় জনসমাজের সংজ্ঞা দিয়েছেন-

ব্রাইস প্রদত্ত সংজ্ঞা: লর্ড ব্রাইসের মতে, জাতীয় জনসমাজ বলতে এমন এক জনসমাজকে বোঝায় যারা শতাব্দীব্যাপী ভাষা, সাহিত্য, ধ্যানধারণা, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ এবং যারা অনুরূপভাবে আবদ্ধ অন্য কোনো জনসমাজ থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র বলে মনে করে থাকে। অবশ্য জাতীয় জনসমাজ শুধু ঐক্যবদ্ধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধসম্পন্ন হলেই চলে না। জাতীয় জনসমাজের মধ্যে এক গভীর রাজনৈতিক চেতনাও থাকা দরকার।

স্টুয়ার্ট মিল প্রদত্ত সংজ্ঞা: জন স্টুয়ার্ট মিল রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজ আখ্যা দিয়েছেন। বস্তুতপক্ষে, রাজনৈতিক চেতনা একটি জাতীয় জনসমাজকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র বলে ভাবতে সাহায্য করে।

কোকার প্রদত্ত সংজ্ঞা: কোকার মনে করেন, জাতীয় জনসমাজ হল প্রধানত অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফল।

ম্যাকাইভার প্রদত্ত সংজ্ঞা: ম্যাকাইভার জাতীয় জনসমাজ বলতে সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐক্যবোধকে বুঝিয়েছেন।

সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা: জাতীয় জনসমাজ হল নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন এমন এক জনসমষ্টি যারা ভাষা-ধর্ম-বংশ-কৃষ্টি, ঐতিহ্যগত ক্ষেত্রে একাত্মতার বন্ধনে আবদ্ধ।

2. জাতীয় জনসমাজ গঠনের মূল উপাদানগুলি আলোচনা করো।

অথবা, জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে যেসব উপাদান কাজ করে সেগুলির বিবরণ দাও।

জাতীয় জনসমাজ গঠনের মূল উপাদান

যেসব সুনির্দিষ্ট উপাদানের সাহায্যে কোনো জনসমাজ জাতীয় জনসমাজের পর্যায়ে উন্নীত হয়, তাকে জাতীয় জনসমাজের উপাদান বলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতীয় জনসমাজ গঠনের উপাদানগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি হল-[1] বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদান এবং [2] ভাবগত উপাদান।

[1] বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদান

জাতীয় সমাজ গঠনের বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদানগুলি হল-

i. ভৌগোলিক একতা: কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় কোনো জনসমষ্টি দীর্ঘকাল একত্রে বসবাস করলে তাদের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা এক গভীর একাত্মবোধের জন্ম দেয়।

ব্যতিক্রম: ভৌগোলিক একতা ছাড়াও জাতীয় জনসমাজ গঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে ইহুদিদের দ্বারা গঠিত ইজরায়েল রাষ্ট্রের কথা বলা যায়।

ii. বংশগত ঐক্য: কোনো জনসমাজের অন্তর্গত মানুষ নিজেদের একই বংশের লোক মনে করলে তাদের মধ্যে যে গভীর একাত্মতার সৃষ্টি হয়, তা এক সুদৃঢ় জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়।

ব্যতিক্রম: ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন ও ভারতীয়দের মতো সমৃদ্ধ জাতিগুলির অবশ্য কোনো বংশগত ঐক্যবোধ নেই।

iii. ভাষাগত ঐক্য: একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় একই ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী থাকলে ভাষাগত ঐক্যের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে এক ধরনের সহজাত একাত্মবোধের জন্ম হয়। এইভাবে ভাষার সূত্রে জাতীয় ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক মজবুত বুনিয়াদ রচিত (যেমন-বাংলাদেশ)।

ব্যতিক্রম: পৃথিবীতে বহু ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে জাতীয় জনসমাজ গঠিত হওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে (যেমন-ভারত)।

iv. ধর্মগত ঐক্য: একই ধর্মের মানুষদের মধ্যে সমজাতীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনা ইত্যাদি প্রচলিত থাকায় গভীর একাত্মবোধের উদ্ভব হয়।

ব্যতিক্রম: ধর্মগত ঐক্য জাতীয় জনসমাজ গঠনের অপরিহার্য উপাদান নয়। আধুনিক পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রই ধর্মনিরপেক্ষ।

v. রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য: দীর্ঘকালব্যাপী কোনো জনসমষ্টি একই সরকারের অধীনে থাকলে তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকা ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করা যায়।

v. অর্থনৈতিক সমস্বার্থ: জাতীয় জনসমাজ গঠনের আর-একটি পুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল একই ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন। অর্থনৈতিক স্বার্থের অভিন্নতা জনগোষ্ঠীকে বিপ্লবে শামিল করেছে এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে অনেক আছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

[2] ভাবগত উপাদান

জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শুধু বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদানই যথেষ্ট নয়, ভাবগত ঐক্যও অপরিহার্য। জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাবগত উপাদানই হল মূল ঐক্যবিধানকারী শক্তি (cementing factor)। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনারের মতে, জাতীয় জনসমাজ সম্পর্কিত ধারণা হল প্রধানত একটি ভাবগত ধারণা। কোনো জনসমাজ যখন ভাবে যে তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, গৌরব-গ্লানি সব এক, তখন সেই জনসমাজের চেতনায় জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটে। এইভাবে গৌরবময় স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস, ভবিষ্যতের স্বপ্ন এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ইত্যাদির ফলে জনসমাজের মধ্যে যে আত্মীয়তার বোধ গড়ে ওঠে, তা জাতীয় জনসমাজ ও পরবর্তী পর্যায়ে জাতি গঠনের সহায়ক উপাদানরূপে কাজ করে।।

মন্তব্য: জাতীয় জনসমাজ গঠনের জন্য বাহ্যিক উপাদান ও ভাবগত উপাদানের মধ্যে কোনো একটিমাত্র উপাদান জাতি গঠনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য নাও হতে পারে, উভয় উপাদানের মিলিত ভূমিকা অনেকসময় সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

3. জাতীয় জনসমাজ ও জাতির মধ্যে পার্থক্য করো।

জাতীয় জনসমাজ ও জাতির মধ্যে পার্থক্য

জাতীয় জনসমাজ (Nationality) ও জাতিকে (Nation) অনেকসময় অভিন্ন মনে করা হয় কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে জাতি ও জাতীয় জনসমাজের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রকৃতিগত পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।

জে এইচ রোজ জাতীয় জনসমাজকে জনসমাজ ও জাতির মধ্যবর্তী পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জনসমাজ থেকেই কালক্রমে জাতীয় জনসমাজের উদ্ভব হয়। একটি ঐক্যবদ্ধ জনসমাজ যখন অন্যান্য জনসমাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলে মনে করে, তখনই তা জাতীয় জনসমাজে রূপান্তরিত হয়। এই ধরনের স্বাতন্ত্র্যবোধসম্পন্ন ঐক্যবদ্ধ জনসমাজ যখন রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়, তখনই জাতীয় জনসমাজ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। এই জাতীয় জনসমাজের মধ্যেই জাতিগত উপাদান নিহিত থাকে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এই সুপ্ত সম্ভাবনা বাস্তব রূপ না পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই জাতীয় জনসমাজ জাতি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে না।

রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জাতীয় জনসমাজ যখন বাইরের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বা মুক্তি পেতে সচেষ্ট হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়, তখনই তা জাতি হয়ে ওঠে। জাতি হল জাতীয় জনসমাজের রাজনৈতিক রূপ। লর্ড ব্রাইস বহিঃশাসন থেকে মুক্ত বা মুক্তিকামী জাতীয় জনসমাজকে জাতি আখ্যা দিয়েছেন। আবার হায়েসের বক্তব্য হল, জাতীয় জনসমাজ যখন ঐক্য ও সার্বভৌম শক্তি অর্জন করে তখনই তা জাতিতে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের ক্ষমতাই জাতিকে জাতীয় জনসমাজ থেকে পৃথক করে। জাতি সম্পর্কিত ধারণা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। সুতরাং, যথার্থ বিশ্লেষণে দেখা যায় রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে পার্থক্যই জাতীয় জনসমাজ ও জাতিকে আলাদা করে, অন্যান্য দিক থেকে তাদের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই।

4. জাতি বলতে কী বোঝ?

জাতি

লাতিন ‘Natio’ শব্দ থেকে আসা ইংরেজি ‘Nation’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ কী হওয়া উচিত তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও, শব্দটি বাংলায় ‘জাতি’ প্রতিশব্দের রূপ পেয়েছে। কিন্তু বাংলায় জাতপাত, বর্ণভেদ, ধর্ম, কুল ইত্যাদি বোঝাতে ‘জাতি’ শব্দের প্রচলন রয়েছে। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ইংরেজি ‘নেশন’ শব্দটি সরাসরি বাংলায় ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন। তবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষারূপে ‘জাতি’ শব্দটির অর্থ ব্যাপক। জাতির ধারণায় বিভিন্ন মত লক্ষ করা যায়, যথা-

সাধারণ মত: বস্তুতপক্ষে ‘জাতি’ হল সাধারণভাবে ‘জনসমাজ’-এর একটি চূড়ান্ত বিকশিত রূপ। জনসমাজের মধ্যে এক গভীর স্বাতন্ত্র্যবোধ দেখা দিলে জাতীয় জনসমাজের উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ, ঐক্যবদ্ধ একটি জনগোষ্ঠী যখন অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মনে করে, তখন জাতীয় জনসমাজ গঠিত হয়। পরে জাতীয় জনসমাজের মধ্যে সুগভীর রাজনৈতিক চেতনার জন্ম হলে, তা জাতিতে রূপান্তরিত হয়। ক্রমে নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে জাতির পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে।

ব্রাইসের মত: লর্ড ব্রাইসের মতে, জাতি বলতে বোঝায় রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সংগঠিত এমন এক জনসমাজকে, যা বহিঃশাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত অথবা মুক্ত হওয়ার জন্য সচেষ্ট।

হায়েসের মত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েসের মতে, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় জনসমাজ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতা অর্জন করলে জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়। কোনো জাতীয় জনসমাজ যখন স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয় অথবা বাস্তবায়িত করার জন্য সচেষ্ট হয়, তখনই জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

স্তালিনের মত: স্তালিনের মতে, জাতি হল ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত এমন একটি স্থায়ী জনসমাজ যাদের ভাষা এক, বাসভূমি এক, অর্থনৈতিক জীবন এক, মানসিক গঠনও এক এবং এই মানসিক গঠন একটি সাধারণ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। স্তালিন প্রদত্ত সংজ্ঞায় জাতিকে ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত একটি স্থায়ী জনসমাজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।


ক্লাস 11 সেকেন্ড সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের ঞ্জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নমান : ৪

5. জনসমাজ কখন জাতিতে রূপান্তরিত হয়? ভারতকে কি একটি জাতি বলা যায়?

জনসমাজের জাতিতে রূপান্তর

জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ যখন নিজস্ব রাষ্ট্র লাভ করে, তখনই তারা জাতির পর্যায়ে উন্নীত হয়। বস্তুতপক্ষে ‘জাতি’ হল ‘জনসমাজ’-এর একটি চূড়ান্ত বিকশিত রূপ। জনসমাজের মধ্যে এক গভীর স্বাতন্ত্র্যবোধ দেখা দিলে জাতীয় জনসমাজের উদ্ভব ঘটে। ঐক্যবদ্ধ একটি জনগোষ্ঠী যখন অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ আলাদা মনে করে, তখন জাতীয় জনসমাজ তৈরি হয়। পরে জাতীয় জনসমাজের মধ্যে সুগভীর রাজনৈতিক চেতনার জন্ম হলে জাতীয় জনসমাজ জাতিতে পরিণত হয়।

একটি জাতি হিসেবে ভারত-প্রাসঙ্গিকতা

ভারতকে একটি জাতি বলা যায় কি না-এ প্রশ্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে সহমত দেখা যায় না বরং এই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। ভারতীয় জনগণের মধ্যে নানা বিষয়ে অনৈক্য বা বৈচিত্র্যকে জাতিত্ব অর্জনের পক্ষে অসুবিধাজনক বলে উল্লেখ করা হয়। সমজাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির কোনোটাই ভারতে নেই বরং ভারত একটি বহু ভাষাভাষী ও মিশ্র সংস্কৃতির দেশ।

এই বিষয়ে অবশ্য ভিন্ন মতও রয়েছে। বলা হয়, জাতি গঠনের ক্ষেত্রে ভাষা বা সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য বাধা হতে পারে না। জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ঐতিহাসিক উপাদান ও রাজনৈতিক ঐক্যবোধ। একই ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি একই রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলে, তা জাতিতে পরিণত হয়। এই মানদণ্ডে বিচার করলে ভারতকে নিঃসন্দেহে জাতি হিসেবে গণ্য করা যায়। সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিভেদের মধ্যে ঐক্যের (unity in diversity) মূল সুরটির সন্ধান পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে শক্তিশালী জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে। স্বাধীন ভারতের সংবিধানেও বিভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যায়। ভারতে নানা বিষয়ে যে ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে, সেবিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে ঐক্যের যে সুরটি ধ্বনিত হচ্ছে তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

6. জাতিগত বিন্যাসে রাষ্ট্র কত রকমের হয়? ‘জাতি-রাষ্ট্র’ কাকে বলে?

জাতিগত বিন্যাসে রাষ্ট্রের প্রকারভেদ

জাতিগত বিন্যাসে রাষ্ট্র দু-রকমের- [1] একজাতিক রাষ্ট্র, যেমন- পাকিস্তান এবং [2] বহুজাতিক রাষ্ট্র, যেমন-ভারত।

জাতি-রাষ্ট্র

ফরাসি বিপ্লবের সময় জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভব ঘটে। তার আগে মধ্যযুগে রাষ্ট্র ছিল বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণ। সেসব রাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে কোনো মৌলিক ঐক্যবোধ কাজ করত না। একই রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের বিভিন্ন জাতিসত্তা থাকায়, তারা নিজেদের পৃথক বলে মনে করত। মার্কসীয় পন্ডিতদের মতে, ধনতন্ত্র যখন প্রথম গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন এই ধরনের পরিবেশ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তাই সুসংহত অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রয়োজনে ধনতন্ত্রের মদতে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ দেখা দেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নসের মতে, জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা ফরাসি বিপ্লবের (1789) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ধারণার উন্মেষ ঘটে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তার ফলশ্রুতিস্বরূপ স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এক জাতি, এক রাষ্ট্র তত্ত্বের প্রভাবে জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিভেদরেখা মুছে যেতে শুরু করে।

সাধারণ সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতি-রাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করেননি। সাধারণভাবে জাতি-রাষ্ট্র বলতে জাতি বা জাতীয় জনসমাজের ভিত্তিতে গঠিত কোনো রাষ্ট্রকে বোঝায়। বার্কারের মতে, একটি অঞ্চলে জাতির ওপর রাষ্ট্রের ছাপ পড়ার ফলে জাতি, জাতীয় সমাজ বা সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্র জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

প্রাসঙ্গিকতা: আধুনিক যুগে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা তত প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ আধুনিক যুগে একটি রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক জাতির অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। পৃথিবীতে এমন বহু রাষ্ট্র রয়েছে যেগুলি বহুজাতি-অধ্যুষিত রাষ্ট্র। এসব রাষ্ট্রেও বিভিন্ন জাতিসত্তার, নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে, তাদের অন্তর্নিহিত গুণাবলি বিকাশের সুযোগ রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করা যায়।

7. জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে কী বোঝ?

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার

1772 খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের বিভক্তিকরণের ঘটনাকে ভিত্তি করেই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

প্রত্যেক জাতির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করার অধিকারকে বলা হয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের মূল ভিত্তি হল ‘এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ নীতি। এই নীতি অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্র হবে জাতিভিত্তিক। এক-একটি জাতিকে নিয়ে গঠিত হবে এক-একটি রাষ্ট্র। কোনো রাষ্ট্র যদি পাঁচটি জাতিকে নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে তাহলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতি অনুসারে ওই রাষ্ট্রকে ভেঙে পাঁচটি আলাদা আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করতে হবে।

এই নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক আত্মসচেতন জাতিই তার নিজস্ব সত্তা ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে চায়। তাই প্রত্যেক জাতির পৃথক রাষ্ট্র থাকা দরকার। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন পণ্ডিতদের অভিমত হল-

মিলের অভিমত: জাতীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্য হল, জাতীয় জনসমাজের সীমানা রাষ্ট্রের সীমানার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

লেনিনের অভিমত: লেনিনের মতে, বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি ও স্বাধীন সরকার গঠন বা অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রাজনৈতিক মুক্তি হল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।

8. জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে যুক্তি দাও।

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে যুক্তি

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে অনেকে মতামত প্রদান করেছেন। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে যুক্তিগুলি হল-

[1] সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে সহায়ক: মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসনের বক্তব্য হল, প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিশ্বজনীনভাবে মেনে নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এর ফলে সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হবে ও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বৈরীভাব প্রভৃতি শেষ হয়ে পৃথিবী থেকে যুদ্ধের ভয় দূর হবে।

[2] গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে উপযুক্ত: জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতি থাকে না। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য মিল একজাতিভিত্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখান।

[3] জাতীয় গুণাবলির বিকাশে সহায়ক: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নীতির প্রবক্তাদের মতে, প্রতিটি জাতির কিছু মৌলিক গুণাবলি রয়েছে, যেগুলির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ শুধু একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় সরকারের মাধ্যমেই ঘটা সম্ভব।

[4] বিশ্বসংস্কৃতির বিকাশে সহায়ক: প্রতিটি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র ও সরকার থাকলে সেই জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্রুত বিকশিত হয়। এইভাবে বিশ্বব্যাপী সভ্যতার বিকাশে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বসংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি সম্ভব হয়।

[5] নৈতিক মানদণ্ডে সমর্থনযোগ্য: নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, প্রতিটি জাতির স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। এই ন্যায়সংগত দাবি অর্জিত হলে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বন্ধ হতে পারে।

[6] জাতিগত সংঘাতের সম্ভাবনা হ্রাস: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত হলে কিংবা ‘এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ নীতি অনুসারে রাষ্ট্র গঠিত হলে জাতিগত সংঘাত বা বিরোধের আশঙ্কা দূর হবে। বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও জাতিদাঙ্গা দেখা যায়, তা এখানে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

[7] রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার সমন্বয়সাধন: একটি জাতির নিজস্ব সরকার থাকলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার সুষ্ঠু সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়। তা ছাড়া একটি রাষ্ট্রে শুধু একটি জাতি থাকলে, কোনো অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসংবাদ না থাকায় প্রত্যেকে নিজের দেশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে সক্ষম হয়।


একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের ঞ্জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নমান : ৫

9. জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে যুক্তিগুলি ব্যাখ্যা করো।

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে যুক্তি

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের তত্ত্বটি নানা দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকরা এই তত্ত্বের বিপক্ষে যে যুক্তিগুলি দেখিয়েছেন, সেগুলি হল-

[1] অখণ্ডতার পরিপন্থী: ‘এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ নীতি স্বীকৃত হলে পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি বহুবিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এইসব ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র কখনোই আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারবে না। এরা বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির শিকারে পরিণত হবে।

[2] অবাস্তব : এই তত্ত্ব অবাস্তব। কারণ, একই ভৌগোলিক পরিবেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দীর্ঘকাল একত্রে বসবাস করার ফলে, তাদের বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। জাতিগত বিভেদের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও (1947 খ্রিস্টাব্দ) ভারতে বহু মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ এখনও রয়েছেন।

[3] উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী: ইংরেজ দার্শনিক লর্ড অ্যাক্টনের বক্তব্য হল, বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে উন্নততর পর্যায়ে যেতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় সীমারেখার ভিতর যেখানে শুধু একটিমাত্র জাতি বসবাস করে সেই সমাজের অনগ্রসর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

[4] উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টিকারী: বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিকে জাতীয়তার ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন করা হলে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হবে। জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভাগের ফলে বহু হিন্দু পরিবার উদ্বাস্তু হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন। এর ফলে ভারতে তীব্র উদ্বাস্তু সমস্যা দেখা দেয়।

[5] সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে সহায়ক নয়: উইলসনের মতে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্ব সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধান ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। সমালোচকরা এ যুক্তি মানতে পারেননি। কারণ, এই তত্ত্বের ভিত্তিতে অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়, তা সত্ত্বেও ভারত ও পাকিস্তানে সংখ্যালঘু জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি।

[6] অগণতান্ত্রিক: ‘এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ তত্ত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। বহুজাতিভিত্তিক ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুইটজারল্যান্ডের অধিবাসীরা কোনো অংশে কম গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেন না।

[7] বৈরী মনোভাবের জন্মদাতা: লর্ড কার্জনের মতে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্ব হল এমন একটি অস্ত্র যার দু-দিকেই ধার আছে। একদিকে যেমন এই নীতিটি একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন করতে সাহায্য করে, অন্যদিকে তেমনই বিভিন্ন জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সন্দেহের সৃষ্টি করে বৈরী মনোভাবের জন্ম দেয়।

[৪] ইতিহাসের পশ্চাদ্গতির সূচক: লর্ড অ্যাকটনের মতে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইতিহাসের পশ্চাদ্গতির ইঙ্গিত দেয়। এই সভ্য যুগে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার বদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চাইলে তা মানবসমাজের পশ্চাদ্গতির সূচনা করবে।

10. জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি

বার্নসের মতে, ইউরোপের নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদের ধারণার উৎপত্তি ঘটে। প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীরা এবং পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা জাতি হিসেবে কখনও নিজেদের কল্পনা করতে পারতেন না। দীর্ঘকাল ধরে এক বিশাল জনসমষ্টি পরস্পর একত্রে বসবাস করলেও, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটেনি।

জাতীয়তাবাদের বিকাশ

জাতীয়তাবাদের ধারণা 1789 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের সময় পূর্ণতা লাভ করে। বিপ্লবের সময়ে ‘জাতি’ শব্দটি যথেষ্ট গুরুত্ব অর্জন করে। 1789 খ্রিস্টাব্দের 1 অক্টোবর ফরাসি সরকারের মৌলিক আদর্শ ঘোষণা করে বলা হয়, ‘জাতি হল সমস্ত ক্ষমতার উৎস।’ ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ে জাতীয়তাবাদের আদর্শকে উজ্জীবিত করার জন্য কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা হল-

[1] জাতীয় সত্তার ওপর গুরুত্ব আরোপ,

[2] শ্রেণিগত বিশেষ সুযোগসুবিধার অবসান ঘোষণা,

[3] চার্চকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা,

[4] জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আদর্শ প্রবর্তন করা,

[5] জাতীয় উৎসবের আয়োজন করা, প্রভৃতি।

এই জাতীয়তাবাদের প্রভাবে জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও রাশিয়ায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে ওঠে। জার্মানিতে ‘জাতি’ শব্দটি একটি নতুন মাত্রা পায়। 1807 খ্রিস্টাব্দে দার্শনিক ফিক্টে জাতির উদ্দেশে এক ঘোষণায় মানুষকে দেশপ্রেমের অগ্নিশিখায় উদ্দীপ্ত করে হাসিমুখে জাতির জন্য আত্মবলিদানের আহ্বান জানান। এইসময় ম্যাৎসিনি জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করে ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐক্যসাধনের কাজে জাতীয়তাবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জার্মানি ও ইতালির ঐক্য এবং গ্রিসের স্বাধীনতা বস্তুতপক্ষে জাতীয়তাবাদেরই জয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ এক নতুন যাত্রাপথ রচনা করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় 100টির মতো স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ আজও এক দুর্বার আপসহীন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা-বিশেষ।

11. আদর্শ ও বিকৃত জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝ?

আদর্শ জাতীয়তাবাদ

জাতীয়তাবাদ এক মহান আদর্শ। এই আদর্শ বিভিন্ন জাতিকে নিজেদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনে অনুপ্রাণিত করে। এই আদর্শ মানুষের মধ্যে ঐক্যবোধ ও দেশপ্রেমের সঞ্চার করে এবং আত্মত্যাগের প্রেরণা জোগায়। আদর্শ জাতীয়তাবাদের মূল কথা হল- ‘নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও।’ আদর্শ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক।

বিকৃত জাতীয়তাবাদ

আদর্শ বা প্রকৃত জাতীয়তাবাদ কখনো-কখনো আদর্শভ্রষ্ট হয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে পরিণত হয় এবং এক উগ্ররূপ ধারণ করে। এই বিকৃত জাতীয়তাবাদ নিজের সম্পর্কে গর্ববোধের পাশাপাশি অন্য জাতির প্রতি ঘৃণার মনোভাব পোষণ করে। এই বিকৃত জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়।

12. জাতীয়তাবাদের অর্থ বিশ্লেষণ করো।

জাতীয়তাবাদের অর্থ

জাতীয়তাবাদ হল এমন এক মতাদর্শ যা জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবিকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে। কোনো জনসমাজের মধ্যে বংশ, ধর্ম, ভাষা, • সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি নানা কারণে যখন গভীর একাত্মবোধের সৃষ্টি হয় এবং এই একাত্মবোধের জন্য জনসমাজের প্রত্যেকে যখন নিজেকে সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায়, মান-অপমানের সমান অংশীদার বলে মনে করে তখন জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়। দেশপ্রেম এই জাতীয়তাবোধের সঙ্গে মিলিত হয়ে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পণ্ডিত জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাদের অভিমত পোষণ করেছেন, সেগুলি হল-

বাট্রান্ড রাসেলের অভিমত: বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, জাতীয়তাবাদ হল এমন এক সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি যা পরস্পরকে ভালোবাসতে শেখায় (“Nationalism is a sentiment of similarity and solidarity”)।

লয়েডের অভিমত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লয়েড জাতীয়তাবাদকে আধুনিক বিশ্বের ধর্ম বলে বর্ণনা করেছেন।

লেনিনের অভিমত: লেনিন নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত ও নির্যাতিত জাতির গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে জাতীয়তাবাদকে দেখেছেন।


Class XI Second Semester
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের ঞ্জাতি ও জাতীয়তাবাদ ৪ নম্বরের প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নমান : ৫

13. জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।

জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য

জাতীয়তাবাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

[1] ঐতিহাসিক ও পরিবর্তনশীল: জাতীয়তাবাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এর ঐতিহাসিক ও পরিবর্তনশীল প্রকৃতি। জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও স্পেনে যে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ঘটে, পরে তা ক্রমশ ইউরোপের বিভিন্ন অংশে এবং অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয়তাবাদ বস্তুতপক্ষে বিগত পাঁচশো বছরের ইতিহাসের ফসল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুসারে, বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতন (1453) থেকে শুরু করে ওয়েস্টফ্যালিয়ার শান্তি চুক্তি (1648), আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (1776), ফরাসি বিপ্লব (1789), প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি সংগ্রাম সব কিছুর মধ্যে জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক বিকাশের সন্ধান পাওয়া যায়।

[2] বিবিধ রূপ: জাতীয়তাবাদের নানা রূপ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক কুইন্সি রাইট জাতীয়তাবাদের কয়েকটি রূপের কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলি হল-রাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ, উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদ, জঙ্গি ও স্বৈরতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ।

[3] ভাবগত ঐক্যের সহায়ক: জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে একটি ভাবগত বা মানসিক ঐক্যের ধারণা বলে বর্ণনা করেছেন।

[4] রাষ্ট্রকাঠামো গঠনে সহায়ক: জাতীয়তাবাদ নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গঠনে উৎসাহ দেয়। জাতীয়তাবাদ ও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এক অদম্য প্রেরণা জুগিয়েছে জাতীয়তাবাদ।

[5] গণসার্বভৌমিকতার আদর্শ স্বীকৃত: জাতীয়তাবাদের মতাদর্শে গণসার্বভৌমিকতার তত্ত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 1789 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের পটভূমিকায় রচিত মানবাধিকার সনদে জাতিকে ‘সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এভাবে জাতীয়তাবাদে জাতি তথা জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

[6] নেতিবাচক ও ইতিবাচক দিকের অস্তিত্ব: জাতীয়তাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল একাধারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকের অস্তিত্ব। নেতিবাচক জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ বলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জার্মানির নাৎসি জাতীয়তাবাদ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে থাকা ভারত-সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রাম হল জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক দিক।

[7] মুক্তির দিশারি: পরাধীন দেশগুলির কাছে জাতীয়তাবাদ মুক্তির দিশারিরূপে কাজ করে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার জন্য ভারতবাসী জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার প্রায় 100 টিরও বেশি দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করে মুক্তির স্বাদ লাভ করে।

[৪] ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক: জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের কথা প্রচার করে জাতীয়তাবাদ এক প্রগতিশীল ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এভাবে, রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে ইউরোপে জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা জাতীয় রাষ্ট্রের ধ্যানধারণা প্রচার করেন। এই কারণে জাতীয়তাবাদকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীকরূপে অভিহিত করা হয়।

[9] জাত্যভিমানের প্রতীক: অনেকসময় জাতীয়তাবাদ জাতির মধ্যে জাত্যভিমানেরও জন্ম দিয়ে থাকে। এর ফলে জাতিবিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। শুধু নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করার ফলে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অন্য জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা জন্মায়। জার্মানি ও ইতালিতে যথাক্রমে হিটলার ও মুসোলিনি এভাবে জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাত্যভিমানের প্রসার ঘটিয়েছিলেন।

[10] আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির সহায়ক: জাতীয়তাবাদ যখন আদর্শ জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে, তখন তা সহযোগিতা, সম্প্রীতি ও আন্তর্জাতিকতার সহায়ক হয়। জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র হল ‘নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও’ (Live and let live)। আদর্শ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযোগিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক বৈরীভাবকে দূর করতে চায়। আদর্শ জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক বলে মনে করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিমার্নের মতে, জাতীয়তাবাদ হল আন্তর্জাতিকতাবাদে পৌঁছোনোর এক প্রশস্ত সরণি (Nationalism is a highway to Internationalism.)।

মন্তব্য: জাতীয়তাবাদ একটি মহান মুক্তিকামী আদর্শ। জাতীয়তাবাদ পরাধীন জনগণকে মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে এক প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে।

14. জাতীয়তাবাদের সপক্ষে যুক্তিগুলি নির্দেশ করো।

জাতীয়তাবাদের সপক্ষে যুক্তি

একটি সৃজনশীল ও রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শরূপে জাতীয়তাবাদের স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি একই সঙ্গে বিকৃত ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ হল মানবমুক্তির অগ্রদূত। এর পক্ষে যুক্তিগুলি হল-

[1] মহান আদর্শ: এক মহান আদর্শরূপে প্রকৃত জাতীয়তাবাদ সমগ্র জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীন জাতিগুলি মুক্তির জন্য আমরণ সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার জন্য ভারতবাসীরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

[2] গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক: ইউরোপে নবজাগরণের সময়ে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়, তা পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসি বিপ্লব-সহ পৃথিবীর বহু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়।

[3] সম্প্রীতির প্রতীক: প্রকৃত জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র হল-‘নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও’ (Live and let live)। জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির কাছে সংঘর্ষ ও সংঘাতের বদলে সহযোগিতা ও সম্প্রীতির বাণী পৌঁছে দেয়।

[4] মানবসভ্যতার বিকাশে সহায়ক: জাতীয়তাবাদের জনক ইতালির ম্যাৎসিনির মতে, আদর্শ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির অন্তর্নিহিত গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে মানব-সভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত হতে সাহায্য করে।

[5] স্থায়িত্ব ও শান্তির সহায়ক: জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করায় শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ, হানাহানি, অবিশ্বাস ইত্যাদি না থাকায় দেশের শাসনব্যবস্থায় স্থায়িত্ব আসে এবং শান্তির অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে।

[6] যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাসকারী: আদর্শ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে যে সহযোগিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তার ফলে জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক বৈরী মনোভাব বিনষ্ট হয়। সেই কারণে যুদ্ধ বা যুদ্ধ সংক্রান্ত আশঙ্কা দূর হয়।

[7] আন্তর্জাতিকতাবাদের সোপান: জিমার্নের মতে, জাতীয়তাবাদ হল আন্তর্জাতিকতাবাদে পৌঁছোনোর এক প্রশস্ত সরণি। বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি রাষ্ট্র ‘নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও’-এই জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও মৈত্রীর বাতাবরণ গড়ে তোলে, তার ফলে আন্তর্জাতিকতার পথ প্রশস্ত হয়।

15. জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তিগুলি নির্দেশ করো।

জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তি

‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি একইসাথে প্রকৃত ও বিকৃত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হিটলারের জার্মানি হল এই জাতীয়তাবাদের একটি দৃষ্টান্ত। হায়েসের মতে, উগ্র জাতীয়তাবাদ হল চরম অন্যায় ও অকল্যাণের প্রধান উৎস। রবীন্দ্রনাথ একে মানবসভ্যতার শত্রুরূপে চিহ্নিত করেছিলেন। এর বিপক্ষে যুক্তিগুলি হল-

[1] সাম্রাজ্যবাদের জনক: বিকৃত জাতীয়তাবাদকে সাম্রাজ্যবাদের জনকরূপে অভিহিত করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছিল।

[2] জাতিবিদ্বেষের জনক: বিকৃত জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা শুধু নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। অন্য জাতির কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রতি ঘৃণার মনোভাব জাতিবিদ্বেষের জন্ম দেয়।

[3] সুস্থ সংস্কৃতির পরিপন্থী: বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বদা নিজের সংস্কৃতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, এমনকি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তারা অপরের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।

[4] গণতন্ত্র হত্যাকারী: বিকৃত জাতীয়তাবাদীদের শাসনকালে কোনো বিরোধী পক্ষকে জীবিত রাখা হয় না। যাবতীয় বিরোধিতাকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়, বিরোধীকণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।

[5] সাংস্কৃতিক স্থবিরতার জন্মদাতা: বিকৃত জাতীয়তাবাদের ফলে, জাতীয় রাষ্ট্র অন্যান্য জাতির উন্নত সংস্কৃতির কাছ থেকে যা কিছু শিক্ষণীয় তা সব বিসর্জন দেয়। এই উন্নাসিক মানসিকতার ফলে একটি জাতি সাংস্কৃতিক স্থবিরতার শিকার হয়।

[6] বিশ্বশান্তির বিরোধী: বিকৃত জাতীয়তাবাদের জনক মুসোলিনি বিশ্বশান্তির প্রচেষ্টাকে ‘কাপুরুষের স্বপ্ন’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুটি যুদ্ধেই বিকৃত জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

[7] আন্তর্জাতিকতার বিরোধী: মার্কসবাদীদের মতে, জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হয়ে শুধু শোষকশ্রেণির স্বার্থের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। এই ধরনের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সোপান বেয়ে কখনোই আন্তর্জাতিকতার প্রশস্ত আঙিনায় পৌঁছোনো যায় না।

মন্তব্য: আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদ সব সময়ই মানবকল্যাণের অগ্রদূত। সবধরনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত যুক্তিনির্ভর প্রকৃত জাতীয়তাবাদ মানবজাতির সার্বিক উন্নয়নের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদই যখন সংকীর্ণ বা আগ্রাসী চেহারা নেয়, তখন তা সমগ্র মানবসভ্যতার কাছেই বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয়তাবাদ বিকৃত রূপ ধারণ করলে মানবকল্যাণের পথ রুদ্ধ হয়, বিশ্বশান্তি বিনষ্ট হয়। এই ধরনের বিকৃত জাতীয়তাবাদকে নিঃসন্দেহে মানবসভ্যতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বস্তুত, জাতীয়তাবাদ কীভাবে ব্যবহৃত হবে তার ওপরেই নির্ভর করে তার কল্যাণকর-অকল্যাণকর ভূমিকা।

16 তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করো।

তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য

‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল 1952 খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে একসঙ্গে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। প্রথম বিশ্ব অর্থাৎ উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি এবং দ্বিতীয় বিশ্ব অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি থেকে এদের পার্থক্যকে স্পষ্ট করার জন্যই এই নামকরণ করা হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা প্রসারিত হয়েছিল উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ইউরোপের জাতীয়তাবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নাই। তবে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে, যথা-

[1] সাম্রাজ্যবাদবিরোধী: ইউরোপে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটেছিল নবজাগরণের মাধ্যমে এবং জাতি-রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে তা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে জাতি-রাষ্ট্র গঠনে জাতীয়তাবাদ ব্যর্থ হয়েছে।

[2] ধর্মীয় প্রভাবযুক্ত: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকার ফলে ওইসব দেশগুলিতে মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। এর একটা বড়ো লক্ষণ হল, জাতীয় জীবনে ধর্মের প্রভাব। এ কারণে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। ফলে জাতীয়তাবাদ তার ঐক্যবদ্ধ রূপ প্রকাশ করতে পারেনি।

[3] গোষ্ঠীগত ভেদাভেদ: গোষ্ঠীগত ভেদাভেদ তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের গোষ্ঠীগত প্রভাব ও স্বাতন্ত্র্যের মনোভাব ত্যাগ করতে না পারার ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। ফলে এক সামগ্রিক জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তৃতীয় বিশ্বে দেশগুলিতে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ প্রশ্রয় পায়।

[4] ভাষাগত বৈচিত্র্য: ভাষাগত বৈচিত্র্যও তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ফলে শাসক তার নিজের ভাষায় শিক্ষিত এক শ্রেণির মানুষের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। শাসকের ভাষায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ভাষাগত বিভেদ সৃষ্টি করে শাসক সম্প্রদায় তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে।

[5] জাতিগত ভেদাভেদ: জাতিগত ভেদাভেদও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ওইসব দেশগুলি দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। শাসক সম্প্রদায় জাতিতে-জাতিতে ভেদাভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে ওইসব দেশের জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে তোলে। কারণ, শাসক সম্প্রদায়ের নীতিই ছিল, ভাগ করো ও শাসন করো।

[6] আবেগপ্রবণতা: তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল আবেগপ্রবণতা। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করতে গিয়ে ওইসব দেশের জাতীয়তাবাদ অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। আবেগপ্রবণতা অনেকসময়ই যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় না। ফলে আদর্শগত কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জাতীয়তাবাদ কখনো-কখনো শক্তিশালী হলেও প্রায়শই তা দিশাহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

মন্তব্য: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জাতীয়তাবাদ ইউরোপের জাতীয়তাবাদের থেকে পৃথক হলেও, তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ ওইসব দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল, সেই জাতীয়তাবাদই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।


জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর Class 11 // রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় সেমিস্টার // WBCHSE Second Semester

17. জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধ্যান-ধারণা সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করো।

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের। তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনা একদিকে যেমন স্বদেশি চেতনার সীমিত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, অন্যদিকে তেমনই ইউরোপীয় জাতীয়তাবোধের অহমিকার মধ্যেও সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বমানবতাবাদের পূজারি। তাই তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা ছিল আন্তর্জাতিক চিন্তা- ভাবনার আলোয় আলোকিত। জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে চেয়েছিলেন, সেখানে কোনোরকম সংকীর্ণতার স্থান ছিল না।

ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের সমালোচনা: রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ (Nationalism) গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নিজের মৌলিক চিন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। 1916-17 খ্রিস্টাব্দে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় বিভিন্ন জায়গায় তিনি যেসব বক্তৃতা দেন, সেগুলি নিয়েই তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ, বিশেষত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। পাশ্চাত্যের মাটিতে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম, তাকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ শুধু ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরোধ আর বিচ্ছেদের জন্ম দেয়। এই জাতীয়তাবাদ ধর্ম, মানবতাবাদ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এই কারণে পশ্চিমের দেশগুলিতে মারামারি-হানাহানি নিরন্তর ঘটে চলেছে। ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ‘জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে তাঁর কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। নিজের দেশ, নিজের জাতি বড়ো আর অন্য সব দেশ, অন্য সব জাতি ছোটো ও নীচ-জাতীয়তাবাদের এই ধারণা বিভেদের বীজ বপন করে, তা ক্রমশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। শেষপর্যন্ত তা দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে গ্রাস করে সমগ্র বিশ্বে আধিপত্য কায়েমে সচেষ্ট হয়। এজন্য রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি জাতীয়তাবাদকে আধিপত্যবাদ বা প্রভুত্ববাদ বলে অভিহিত করেছেন।

পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, ইউরোপ তথা পশ্চিমের যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি হল জাতীয়তাবাদ। পরাধীন দেশগুলিকে শোষণ করে রিক্ত করে তোলাই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানবজাতি এবং সমগ্র মানবসভ্যতার পক্ষে এক ভয়াবহ বিপদ। জীবনের অন্তিম লগ্নে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে গভীর দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা-অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে। মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি।… জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।”

জাতি ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে একথা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জাতি (nation) গঠিত হয়েছে সত্যের জোরে কিন্তু জাতীয়তাবাদ (Nationalism) সত্য নয়। তাঁর মতে, জাতীয়তাবাদ এমন এক ধরনের দুর্বৃদ্ধি, যেখানে দেশের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পায়। এ এমন এক রিপু যেখানে সকলের দিকে নয়, নিজের দিকেই টান বেশি থাকে।

জাতির চেয়ে মানুষ বড়ো: মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতির চেয়ে মানুষই ছিল বড়ো। তাই তিনি জাতিপূজার কঠোর বিরোধিতা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তাতে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। জাতীয়তাবাদী ধারণা ব্যক্তিমানুষকে বলি দেয়। এখানে মানুষের সৃজনশীল সত্তার স্বাধীন বিকাশ ঘটে না। ব্যক্তিমানুষ নেশনের অধীনে যন্ত্রে পরিণত হয়। জাতীয়তাবাদের জাতীয় গরিমার যে আবেগ মানুষের মনে বিভেদের সৃষ্টি করে, তা ক্রমশ মানুষকে দানবে পরিণত করে। মানুষের যাবতীয় শুভ চিন্তা, শুভ চেতনা সব ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার সংকট ডেকে আনে।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ-পশ্চিমি সভ্যতার এই পথ কখনোই ভারতবর্ষের পথ হতে পারে না। ভারত কখনোই পাশ্চাত্যের ধারণায় ‘নেশন’ বা ‘জাতি’ ছিল না। ভারতের ‘জাতি’ সম্পর্কিত সমস্যা থাকলেও তা রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না, ভারতের সামাজিক ব্যবস্থা তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। তাই নানা যোদ্ধা জাতি ভারতে এসেছে কিন্তু তারা কেউ ভারতের সমাজব্যবস্থাকে স্পর্শ করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন যে, ‘নেশন’ বা ‘ন্যাশনালিজম’-এর উগ্র উন্মাদনার দানবীয় রূপ কখনও ভারতের কাম্য হতে পারবে না। ভারতের কাম্য হল মহোত্তম মানবিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যে উদ্বুদ্ধ এক বিশ্বজনীন আদর্শের দেশ।

মন্তব্য: সমকালীন পৃথিবী যে সময় উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদের উদগ্র কামনায় মেতে উঠেছিল, সেসময় রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবজাতির ঐক্যচেতনার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, মানবজাতির আত্মিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয়তাবাদ-সম্পর্কিত ধারণায় নিজের জাতির মধ্যে সকল জাতির এবং সকল জাতির মধ্যে নিজের জাতির সত্য রূপটিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন – আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

Leave a Comment