একটি জাতির জনসাধারণ যখন তাদের ভাষা, ধর্ম বা সংস্কৃতিগত ব্যবধান ভুলে পরস্পরের প্রতি গভীর একাত্ম বোধ করে, জাতীয় জীবনে সেই অবিচ্ছিন্ন আত্মীয়তার মনোভাবকেই বলে জাতীয় সংহতি। বস্তুত জাতির অগ্রগতির মূলভিত্তিই হল জাতীয় সংহতি। ধর্ম-ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার, শিক্ষা-সংস্কৃতি-আচারগত ভিন্নতা হারিয়ে যে ভূমিবক্ষে সৃষ্টি হয়েছে একটি মহান জাতিসত্তা- শক-হুন-পাঠান-মোগল যে দেশের মাটিতে ‘একপ্রাণএকতা’-র মন্ত্রে দীক্ষিত-তার নাম ভারতবর্ষ।
জাতীয় সংহতির বৈশিষ্ট্য
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জাগরণেই সৃষ্টি হয় জাতীয় সংহতি। এই দেশের সম্পদে সবার সমান অধিকার-এই ধারণাটির বিস্তার ঘটিয়ে তাকে যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই ব্যক্তিগত, ভাষাগত বা সম্প্রদায়গত তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ দেশের প্রতি অন্তর থেকে দায়বদ্ধ হবে। এই দায়বদ্ধতাই জাতীয় সংহতির মূলভিত্তি।
বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির উত্থান
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে কাছাড়-সমগ্র ভারত ভূখণ্ডের মূল সুর একটাই-Unity in diversity। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অসমে বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে > রক্তাক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ এবং বিপন্ন হয়েছে এদেশের ঐক্যচেতনা।
এর প্রধান কারণ ধর্মীয় সংকীর্ণতা তথা মৌলবাদ। তেলেঙ্গানা পৃথক রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলে গোর্খা, বিদর্ভ, বুন্দেলখণ্ড ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন ছোটো রাজ্যের দাবি, বাবরি মসজিদ ধ্বংসে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মুহুর্মুহু দাঙ্গা, জঙ্গি আক্রমণে আজ বিপন্ন জাতিসত্তা, বিপন্ন ভারতের জাতীয় সংহতি।
সুদৃঢ় জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির উপায়
কুচক্রী মানুষদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের প্রিয় দেশকে রক্ষা করতে হলে প্রাথমিক স্তর থেকে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রথমেই জাতীয় শিক্ষানীতি গড়ে তুলে বিদ্যালয় স্তর থেকে তা অবশ্যপাঠ্য করতে হবে। এই প্রসঙ্গে দেশের বিবিধ প্রতিষ্ঠান বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে দেশের শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। সেইসঙ্গে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। মানবঘাতী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
উপসংহার
এই ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ ভারতবর্ষের ঐক্য অখণ্ডতার ঐতিহ্যকে ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শপথ গ্রহণ করতে হবে। সংহতিবিধানের সেই শুভলগ্নে ঝরে পড়বে ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’।