তোমার প্রিয় গ্রন্থ রচনা

গ্রন্থ বা বইকে বলা হয় মানুষের তৃতীয় নয়ন অর্থাৎ জ্ঞান বা চক্ষু। বই পড়লে মানুষ অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোকে উন্নীত হয়। সাহিত্যিক সাহিত্য সৃষ্টির। গল্প, উপন্যাস প্রভৃতি পড়তে পড়তে বা নাটক অভিনয় দেখে আমরা কখনও হাসি, কখনও কাঁদি বা শরীর উত্তেজনায় ভরে যায়। তার কারণ, পাঠক যে লেখা পড়ে বা যে দৃশ্য নাটকে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার সাথে জীবনের মিল সে খুঁজে পায়। তাই বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠকের মনকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। আবার বিষয় বৈচিত্রের দি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’। ‘রক্তকরবী’ নাটকের সমালোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্মীকির রামায়ণের রূপকার্যের মধ্যে তুলে ধরেন এক যুগ-সংঘর্ষের কাহিনী-রাম কৃষি-সভ্যতার ও রাবণ শিল্প সভ্যতার প্রতীক, কৃষক জনকের লাঙলের ফলায় উত্থিতা লক্ষ্মীর অংশোদ্ভূতা সীতা সোনার ধান। এই কাহিনী সমৃদ্ধ করেছে রক্তক্ষয়ী লঙ্কাকান্ডকে। সীতা বা সোনার ধানকে অপহরণ করার জন্যই স্বর্ণমুদ্রা বা স্বর্ণ-মারীচের প্রলোভন রাবণের শক্তির চাতুর্য পূর্ণ প্রকাশ। রামায়ণে সেই যুগ সংঘাত এবং সভ্যতার সংঘর্ষের দ্বান্দ্বিকতার প্রতিভাস। একালের কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ চিত্রিত করেছে সেই যুগ সংঘাতের বিশেষ রূপচ্ছবি। রাজি দাগান

মহাকাব্যোচিত প্রেক্ষাপট

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’র যে বৈশিষ্ট্য আমার মনে দাগ কেটেছে তা হল উপন্যাসের মহাকাব্যোচিত বিচিত্র সামাজিক প্রেক্ষাপট, বহু বিচিত্র স্বনিষ্ট চরিত্রের উত্থাপনা। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চ লের একটি অখ্যাত জনপদ তার চিরাচরিত অন্ধতা-মূঢ়তা, বিশ্বাস-কুলাচার, কালাদুদ্র-কর্তাবাবা এবং নিবিড়-ঘন বাঁশবন দিয়ে রচিত হয়েছে এক যুগ-প্রাচীর দুর্ভেদ্য দুর্গ। পুরাতন দৈব-শাসিত কাহার-সমাজ বনোয়ারির নেতৃত্বে তার স্ব-রচিত জীবন-ধারার মধ্যে করেছে আত্ম-পরিক্রমা। এমন সময় বর্ষা-প্লাবিত কোপাই নদীর প্রবল জলোচ্ছাসের মতো সেই অনড় জীবনের উপকূলে প্রথা-বিদ্রোহী করালীর মধ্যস্থতায় চন্ননপুরের রেলওয়ে স্টেশন থেকে যন্ত্র-সভ্যতার উত্তাল তরঙ্গ এসে পড়লো আছড়ে। করালী এই উপন্যাসের প্রতি নায়ক এবং আগামী যুগের নতুন সম্ভাবনার প্রতীক। বনোয়ারী প্রাচীন কৃষিসভ্যতার প্রতীক। এই উপন্যাসে প্রত্যায়িত হয়েছে দুই শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাস্তব চিত্র। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ কিন্তু বিশেষ কোন ব্যক্তির জীবন-চরিত নয়, সমগ্র কাহার সমাজের প্রতিচ্ছবি।

যুগের পূর্বাভাস

এই উপন্যাসের সূচনায় কর্তাবাবার বাহনের শিষধবনি আসন্ন নবযুগের যুগ-সংকটের পূর্বাভাস। কাহার-পাড়ার জীবনযাত্রায় অন্ধ-বিশ্বাসের প্রেক্ষাপট ছড়িয়ে দিয়েছে আতঙ্কের ডানার কালো-ছায়া। কাহার-পল্লীর অন্ধবিশ্বাস তথা কর্তাবাবার বাহনকে হত্যা করেছে সমাজ-বিদ্রোহী, নাস্তিক করালী। গোষ্ঠী মানসে ঘানিয়ে এসেছে দেবতার অভিশাপ-ভীতি, যা কাহার সমাজের বিপর্যয়ের সংকেত।

উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য

হাঁসুলি বাঁকের উপকথায় অখ্যাত এক জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রপূর্ণ জীবন-কাহিনী বাস্তবতার নিরিখে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে, লিপিবদ্ধ হয়েছে অখ্যাত-অজানা চরিত্র পরম, কালাবৌ, নক্ষুবালা পাখী, সুচাঁদ, করালী, বনোয়ারী প্রভৃতি।

বনোয়ারী ও করালী চরিত্রের গুরুত্ব

এই উপন্যাসে বনোয়ারী এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং করালী প্রতিনায়ক হয়েও স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল। করালীর নেই বনোয়ারীর মতো সমাজ-শক্তির সংহত পরিমন্ডল, আধুনিকতার সে এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি, বনোয়ারীর শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার অহংকারের মধ্যে সংস্কারকে উপহাস করার স্পর্ধা তার আছে। করালীর বিদ্রোহাত্মক মনোভাবকে উপেক্ষা করেছে বনোয়ারী তার চারিত্রিক দুর্বলতাকে আড়াল করার জন্য। বনোয়ারী চেষ্টা করেছে করালীর বিদ্রোহকে উপেক্ষার মাধ্যমে তাকে বশীভূত করতে। করালী চায়নি বনোয়ারীর নেতৃত্বকে মেনে নিতে। বনোয়ারীর সাথে সংঘাতে করালী গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে কাহার পল্লীর তরুণ-সমাজে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। অবশেষে করালীর জয় বনোয়ারীর দন্ত চূর্ণ করে; সে উড়িয়েছে যৌবনের বিজয়-নিশান। এই উপন্যাসে করালী নবযুগের নির্মম ইতিহাসের ইঙ্গিতবহ।

উপসংহার

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় যুগ-সংঘাতের বাস্তবতার রূপকার। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’য় যুগ-সংঘাতের অভিব্যক্তি নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত হয়েছে লেখনির মাধ্যমে। এই উপন্যাস যেন সামন্ততান্ত্রিক প্রথার বিলোপের পরে তার ধবংসস্তূপের ওপর গড়ে ওঠা যন্ত্র-শিল্প সভ্যতার সুউচ্চ মিনার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথায়’ এইভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন একটি যুগের অবসান এবং পরবর্তী যুগের সূচনার আলোকোজ্জ্বল ছবি, বিগত যুগের বিশ্বাস-অবিশ্বাস-সংস্কার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রথা-মানবিকতা এবং তার পরিসমাপ্তি ও নতুন যুগের পূর্বাভাস। আমরাও নতুন যুগের পথিক, পুরাতন কৃষিনির্ভর সভ্যতাকে ধবংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে যন্ত্র-সভ্যতা, তার বিষানলের তান্ডব প্রকৃতির বুকে। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ – জীবন-দর্শন বলেই পাঠক হিসাবে রেখাপাত করে আমার মনে তাই আমার প্রিয় গ্রন্থ।

Leave a Comment