দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা করো

দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা করো

অথবা, দিল্লির সুলতানি শাসন কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল

দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা করো
দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা করো

দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি/দিল্লির সুলতানি শাসন ধর্মাশ্রয়ী ছিল কি না-বিতর্ক

সুলতানদের শাসনকালে (১২০৬- ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ বা প্রকৃতি বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত, সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি বা চরিত্র ধর্মাশ্রয়ী (Theocratic State) ছিল কি না, তা নিয়ে সমকালীন ও আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়।

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র – পক্ষে যুক্তি

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Theocratic State. গ্রিক শব্দ Theos থেকে উৎপত্তি ঘটেছে Theocracy বা দেবতাতন্ত্র শব্দটির। এই Theos-এর অর্থ হল ঈশ্বর। সরাসরি ঈশ্বর কর্তৃক কিংবা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যাজক শ্রেণি (Sacerdotal Class) দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রই হল ধর্মাশ্রয়ী বা দেবতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সুলতানি রাষ্ট্রের ধর্মাশ্রয়ী চরিত্র সম্পর্কে আর পি ত্রিপাঠী, ঈশ্বরীপ্রসাদ, এ এল শ্রীবাস্তব প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন যুক্তি প্রদান করেছেন-

(a)ফাতায়া-ই-জাহান্দারি গ্রান্থর ভাষ্য

ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে বারানি লিখেছেন যে, ধর্ম ও রাজনীতি পরস্পরের সহায়ক। মন্দ জগতকে কেবল ধর্মীয় পথেই শুদ্ধ করা যায়। সুলতান এমনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন যাতে কোনও বিধর্মী কোনও বিষয়ে মুসলমানদের উপর প্রভুত্ব করতে না পারে। বারানির মতে, ইসলামের বিধানকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করা শাসকের কর্তব্য।

(b) খলিফাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য

বিশিষ্ট আরব পণ্ডিত ইবন খালদুন-এর মতে, অনুশাসনিক প্রয়োজনে খিলাফৎ-এর সৃষ্টি। তাই প্রতিটি মুসলমানের খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ছিল বাধ্যতামূলক। ভারতের সুলতানি আমলের প্রায় সব শাসকই খলিফাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। যেমন- (i) ইলতুৎমিস খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতিপত্র (মনসুর) সংগ্রহ করেন। (ii) বলবন তাঁর মুদ্রায় খলিফার নাম উৎকীর্ণ করার পাশাপাশি নিজেকে খলিফার সহকারী বলে প্রচার করেন। (iii) ফিরোজ শাহ তুঘলক নিজে খলিফার নায়েব উপাধি নেন, খলিফার নামে খুতবা পাঠ এবং মুদ্রা খোদাই করেন। খলিফাতন্ত্রের প্রতি এই আনুগত্য ও মান্যতা সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মকেন্দ্রিকতার প্রমাণ দেয়।

(b) উলেমাতন্ত্রের প্রভাব

আক্ষরিক অর্থে যাঁরা জ্ঞান (ইলম) অর্জন করেন, তাঁরাই আলিম। এঁদের বহুবচনে বলা হয় উলেমা। এই উলেমারা ছিলেন শরিয়তের ব্যাখ্যাকর্তা। তাঁদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সুলতানগণ শাসন পরিচালনা করতেন। মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণি উলেমাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও কর্তৃত্ব সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী করেছিল। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ্য- (i) সুলতানি শাসনকালে উলেমাদের এক বৃহৎ অংশ সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। এঁরা ধর্মীয় আইনের ভিত্তিতে প্রশাসনকে চালিত করতে প্রয়াসী হন। (ii) সামাজিক ক্ষেত্রেও উলেমাদের বিশেষ প্রভাব ছিল। আলাউদ্দিন খলজির আগে পর্যন্ত আগত সুলতানেরা উলেমাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে ভয় পেতেন। (iii) রোমিলা থাপার লিখেছেন যে, ‘ধর্ম ও রাজনীতির মিলনের ফলে রাজ্যশাসনে উলেমাদের প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। উলেমাদের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য সুলতানরা তাঁদের ভূমিদান করতেন, মাঝে মাঝে দেবমূর্তি ও হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে অমুসলমান-বিরোধী ভাবমূর্তি তুলে ধরতেন।’

(c) ধর্মকেন্দ্রিক আইনবিধি

ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, সুলতানি আমলের আইনগুলি ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রের ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল। রাজকীয় অনুশাসনের ভিত্তি ছিল শরিয়তের ভাষ্য। রাজস্ব আইনের ভিত্তি ছিল ধর্মের বিধান। অমুসলমান হিসেবে হিন্দুরা জিজিয়া কর দিতে বাধ্য ছিলেন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সুলতানি করব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। অমুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত।

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র-বিপক্ষে যুক্তি

মহম্মদ হাবিব, কে এম আশরাফ, সতীশচন্দ্র, ড. মুজিব, ড. হাবিবউল্লাহ, ড. নিজামি, ড. ইফতিকার আলম খান, ইশতিয়াক হোসেন কুরেশী প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে যেসকল মত প্রদান করেছেন, তা হল নিম্নরূপ-

(a) জিয়াউদ্দিন বারানির অভিমত

বারানি ইসলামকে ধর্মপথে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনে ধর্মমুখী রাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনিও নিশ্চিত ছিলেন যে, ধর্মীয় অনুজ্ঞা বা অস্ত্রের জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে ধর্মীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই ‘ফতোয়া’ গ্রন্থের অন্যত্র তিনি ইহজাগতিক রাজ্যকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। তৃতীয় শ্রেণির রাজ্য হিসেবে তিনি সেইসব রাজ্যের কল্পনা করেছেন যেখানে রাজা স্বৈরাচারী এবং তাঁর শাসনপ্রণালী কোরান বা শরিয়তের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি শাসকের অন্তরের সৌন্দর্য প্রকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

(ii) খলিফার প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য

দিল্লির সুলতানদের খলিফার প্রতি আনুগত্য ছিল বাহ্যিক এবং প্রয়োজনভিত্তিক। সুলতানরা ব্যক্তিগত প্রতিভা ও উদ্যোগে ভারতে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। মুসলিম মিল্লাতকে পক্ষে রাখার প্রয়োজনে কেউ কেউ হয়ত খলিফার অনুমোদন নিয়েছিলেন। কিন্তু তা ধর্মীয় আদর্শ বা প্রেরণা থেকে নয়, বাস্তব রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে। সুলতানদের কেউ কেউ নিজের নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রায় নিজেদের নাম খোদাই করতেন। জানা যায়, আলাউদ্দিন খলজি ও মহম্মদ বিন তুঘলকের মতো কয়েকজন সুলতান খলিফার অনুমোদন অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখতেন। মুবারক শাহ নিজেকেই খলিফা বলে দাবি করেছেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ধর্মীয় আনুগত্য নয়; খলিফার অনুমোদন নিয়ে নিজের স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে একটা বৈধতা দেওয়ার ইচ্ছা সক্রিয় ছিল মাত্র।

(iii) উলেমাদের প্রভাব অতিরঞ্জন মাত্র

দিল্লির সুলতানরা ছিলেন ক্ষমতা ও স্বৈরাচারের প্রতীক। কিছু সরকারি পদে উলেমাদের নিয়োগ করলেও, তাঁদের হাতের পুতুল সুলতানরা ছিলেন না। আবার উলেমারাও জানতেন যে, দিল্লির সুলতানদের কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে আপস করতে না পারলে অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ দিল্লি সুলতানির শাসনে উলেমাদের প্রভাব ছিল গৌণ। ইলতুৎমিসের আমলে উলেমা শ্রেণি সুলতানকে কঠোর ইসলামীয় আইন প্রয়োগের অনুরোধ জানালে সুলতান তা প্রত্যাখ্যান করেন। *2 আবার মহম্মদ বিন তুঘলক, গিয়াসউদ্দিন বলবন প্রমুখের আমলে উলেমাদের ক্ষমতা যথেষ্ট হ্রাস করা হয়। কে এম আশরাফ লিখেছেন যে, দিল্লি সুলতানি ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরশাসন। রাজশক্তির এমন জ্বলন্ত স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে কোরানের আদর্শের সামঞ্জস্যবিধান অসম্ভব।

(iv) জাওয়াবিত (নির্দেশনামা) জারির স্বাধীনতা

দিল্লির সুলতানরা বাস্তবে ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা জাওয়াবিত (নির্দেশনামা) জারি করতেন। এর সঙ্গে ধর্মীয় নির্দেশের আদৌ কোনও সামঞ্জস্য ছিল না, বরং অনেক নির্দেশ ছিল কোরানের ভাষ্যের বিপরীত। কোরান ও শরিয়তি আইনের বাইরে আইন বা নির্দেশ জারির এই রাজকীয় অধিকার ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিফলন হতে পারে না।

(v) শরিয়ত বহির্ভূত নির্দেশ

সুলতানি আমলের বহু নির্দেশনামা শরিয়তের ভাষ্যের বিপরীত ছিল। যেমন- (i) শরিয়তের বিধান অনুসারে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ। কিন্তু সুলতানি আমলে বাণিজ্যের প্রয়োজনে সুদ গ্রহণ স্বীকৃত ছিল। (ii) ইসলামের বিধান অনুসারে জিম্মি (যেমন- ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু)-রা জিজিয়া প্রদানের বিনিময়ে, মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসের অধিকারী। কিন্তু সুলতানি আমলে হিন্দুরা নাগরিক হিসেবে বসবাস করা ও সরকারি চাকুরি করার অধিকার পেতেন। (iii) শরিয়তে প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু সুলতানি রাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। অর্থাৎ ইসলাম স্বীকৃত নয় এমন বহু সুযোগসুবিধা সুলতানি আমলে চালু ছিল।

মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায়, দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতিতে ভিন্নধর্মী ও মিশ্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। তবে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সুলতানির রাষ্ট্রের প্রকৃতি ধর্মাশ্রয়ী ছিল না। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক-এর ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের উপরই অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আরও সাম্প্রতিক গবেষণার ফলস্বরূপ বহু ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে সামরিক ও অভিজাততান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আরও পড়ুন – গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

Leave a Comment