নতুন রাজতন্ত্র বলতে কী বোঝো? সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বলার কারণ কী

নতুন রাজতন্ত্র বলতে কী বোঝো? সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বলার কারণ কী

নতুন বা নব্য রাজতন্ত্র

পঞ্চদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক নতুন ধরনের সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। এসময় ইংল্যান্ডে টিউডর রাজাদের রাজত্বকালেও এই ধরনের শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উত্থান দেখা যায়। বেশকিছু ঐতিহাসিকরা প্রথম টিউডর শাসক সপ্তম হেনরি (Henry VII, ১৪৮৫-১৫০৯ খ্রি.)-র প্রতিষ্ঠিত এইরূপ রাজতন্ত্রকে ‘নব্য রাজতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক রিচার্ড গ্রিন সর্বপ্রথম ‘নব্য রাজতন্ত্র’ (New Monarchy) কথাটি ব্যবহার করেন।

তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ১৫৩০-এর দশকে ইংল্যান্ডে রাজত্ব করতেন দ্বিতীয় টিউডর রাজা অষ্টম হেনরি এবং তাঁর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন টমাস ক্রমওয়েল। তাঁদের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে ইংল্যান্ডের সরকার ও প্রশাসনে, তাই এই সময়কালকে ‘নব্য রাজতন্ত্র’ বলা যায়, অন্যদিকে পঞ্চদশ শতকের কিছু ইউরোপীয় শাসক যাঁরা নিজ নিজ জাতিকে দৃঢ় কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন, যেমন- স্পেনের ফার্দিনান্দ, পোর্তুগালের প্রথম জন, ফ্রান্সের একাদশ লুই, ইংল্যান্ডের সপ্তম হেনরি প্রমুখ শাসকের রাজতন্ত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝাতেও ‘নব্য রাজতন্ত্র’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। তবে সাধারণত, ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত টিউডর রাজতন্ত্রকে নতুন বা নব্য রাজতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে ‘নতুন রাজতন্ত্র বলার কারণ

সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে নতুন রাজতন্ত্র বলার কারণগুলি হল-

(ii) কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সুদৃঢ়করণ: সপ্তম হেনরি কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সুদৃঢ়করণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিকেন্দ্রীভূত শক্তিগুলিকে একত্রিত করেন। এসময় টিউডর বংশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গেও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হলে, রাজনৈতিক ঐক্যের পাশাপাশি ইংল্যান্ডের আয়তন, শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

(ii) নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন: প্রচলিত শাসননীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে, প্রশাসনিক কাঠামোকে সুসংহত করার মাধ্যমে এক নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করেন সপ্তম হেনরি।

(ⅲ) ব্যারনদের ক্ষমতা হ্রাস: সেসময়ে ইংল্যান্ডে ব্যারনরা ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। সে দেশের রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে তারা নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে বাড়িয়েছিল। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাবান ব্যারনরা শাসনব্যবস্থায় নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করত। কিন্তু রাজা সপ্তম হেনরি ব্যারন পরিবারের পরিবর্তে ফ্রান্স, স্পেন ও স্কটল্যান্ডের রাজবংশগুলির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলেন। এতে একদিকে ব্যারনদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যেমন খর্ব করা হয়, অন্যদিকে তেমনই টিউডর বংশের মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

(iv) ধর্মসংস্কার আন্দোলন: টিউডর শাসনকালে ক্যাথলিক ধর্ম, পোপতন্ত্র, যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার যুক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। এসময় ধর্মকে যুক্তির আলোকে বিচার করা হতে থাকে। এই বিষয়টি সাধারণত ধর্মসংস্কার আন্দোলন (Reformation Movement) নামে পরিচিত। পোপতন্ত্রের অসারতা, যাজকতন্ত্রের আধিপত্য যুক্তিবাদী মানুষের কাছে ক্রমশ গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিল। ফলস্বরূপ ক্যাথলিক ধর্মের বিরুদ্ধ মতবাদ হিসেবে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের উদ্ভব হয়।

(v) পার্লামেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি: টিউডর বংশীয় রাজা সপ্তম হেনরি পার্লামেন্টে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন (যেমন- Livery ও Maintenance) করে সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা হ্রাস করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঘটান। স্বল্প সময়ে কম সংখ্যক পার্লামেন্ট ডাকলেও তাতে সপ্তম হেনরি কর্তৃক যতগুলি আইন প্রণীত হয়, তা ইতিপূর্বে কখনও হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই পার্লামেন্টের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

(vi) সামাজিক পরিবর্তন: সপ্তম হেনরি এবং তাঁর পরবর্তী শাসক অষ্টম হেনরির আমলে শুধু যে ধর্মের ক্ষেত্রে, পোপতন্ত্র-যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে, কিংবা পার্লামেন্টের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যে অসাধারণ পরিবর্তন এসেছিল তা নয়, পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। অভিজাত শ্রেণির ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং বৃদ্ধি পায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষমতা। অনেকের মতে, এইভাবে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিকতার পথে পা বাড়াতে থাকে।

(vii) বিচার বিভাগের মর্যাদা বৃদ্ধি: এসময় বিচার বিভাগের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ধরনের আদালত প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হলে, বিচার বিভাগের উপর জনগণের আস্থা ফিরে আসে।

(viii) আর্থিক সংস্কার: সপ্তম হেনরি পার্লামেন্টে Resumption আইন পাস করে, ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে রাজার হারানো সমস্ত জমি আবার রাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এনে বার্ষিক উপার্জন বৃদ্ধি করেন, এ ছাড়া বাণিজ্য বিশেষত বস্ত্র বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলে বাণিজ্য শুল্ক থেকে রাজার আয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

উপরোক্ত কারণগুলির প্রেক্ষাপটে একথা বলা যায় যে, সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রে যে অভিনবত্ব লক্ষ করা যায় সেই বিচারে ওই রাজতন্ত্রকে ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বলা বোধ হয় অযৌক্তিক হবে না।

আরও পড়ুন – ১। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতাগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো

২। প্লেটোর সাম্যবাদী তত্ত্বের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করো

৩। রাষ্ট্রচিন্তার জগতে প্লেটোর অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো

৪। অ্যারিস্টটলের ধারণায় রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী ছিল

৫। সরকারের শ্রেণিবিভাজন সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমত আলোচনা করো

৬। রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে অ্যারিস্টটলের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

৭। গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্ব আলোচনা করো

৮। এপিকিউরীয় ও সিনিক রাষ্ট্রদর্শনের বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা করো

৯। টাকা লেখো- দ্বাদশ সারণী

১০। রোমান আইনতত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

১১। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ পলিবিয়াসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

১২। সিসেরোর পরিচয় সংক্ষেপে আলোচনা করো

১৩। আদর্শ রাষ্ট্র ও সাম্যনীতি প্রসঙ্গে সিসেরোর অভিমত উল্লেখ করো

১৪। রাষ্ট্রে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সিসেরোর অভিমত সংক্ষেপে আলোচনা করো

১৫। রাষ্ট্রচিন্তায় সিসেরোর অবদান সম্পর্কে লেখো

১৬। সেনেকা কে ছিলেন

১৭। রোমান রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্ব আলোচনা করো

Leave a Comment