নবম শ্রেণি প্রশ্নবিচিত্রা উত্তর বিষয় ইতিহাস সেট ৩

Bankura Zilla School

নবম শ্রেণি প্রশ্নবিচিত্রা উত্তর বিষয় ইতিহাস সেট ৩

বিভাগ-ক
1 (i) ফ্রান্সে শ্রমকর’ বা বেগার খাটাকে বলা হত – (a) করভি। 
(ii) ‘স্টেটস্ জেনারেল’-এর অধিবেশন আহ্বান করেন –(c) ষোড়শ লুই।
(iii) ফ্রান্সের উগ্র বামপন্থী দল হল – (b) জেকোবিন দল। 
(iv) বিশ্বকোশের রচয়িতা হলেন (b) ডেনিস দিদেরো ও দ্য এলেমবার্ট।
(v) ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসটির লেখক হলেন (a) টলস্টয়। 
(vi) পূর্ব ইউরোপের শোকাহত জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র হল – (b) পোল্যান্ড।
(vii) ‘চতুর্থ শক্তিজোট’ গঠিত হয়েছিল – (d) ১৮১৩ খ্রি। 
(viii) ‘আধুনিক যুগের সিজার’ বলা হয় – (c) নেপোলিয়ন-কে।
(ix) লুডাইট দাঙ্গার নেতা ছিলেন – (a) নেড লুড।
(x) ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ রচিত হয় – (b) ১৮৪৮ খ্রি।
(xi) ‘রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ওয়ার্কার্স পার্টি’র মুখপত্র হল – (a) ইসক্রা।
(xii) প্যারিস শান্তি সম্মেলনে স্বাক্ষরিত হয় (a) পাঁচটি চুক্তি। 
(xiii) ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে তিক্ততার অবসান হয় (b) লোকার্নো চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে।
(xiv) হিটলারের অপারেশন বারবারোসা হল – (c) রাশিয়া আক্রমণ নীতি ।
(xv) ‘লেন্ড লিজ অ্যাক্ট’ অনুসারে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করেছিল যে দেশ সেটি হল – (a) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
(xvi) ডি ডে পালিত হয়েছিল – (b) ১৯৪৪ খ্রি ৬ জুন। 
(xvii) আমেরিকা ভিয়েতনামের যুদ্ধে যে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহার করেছিল তা হল – (a) নাপাম ।
(xviii) পৃথিবীর যে দেশকে ‘গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার’ বলে তা হল – (d) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
(xix) লিগ অফ নেশনস-এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন (c) এরিক ড্রুমণ্ড।
(xx) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের যত নং ধারায় উদ্দেশ্যের কথা বলা আছে তা হল – (a) ১নং ।

বিভাগ-খ
উপবিভাগ : A
(i) কোড নেপোলিয়নে ২২৮৭ টি ধারা রয়েছে ।
(ii) মস্কো ‘অভিযানকে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবাদের শেষ সংগীত বলে।
(iii) ‘নিউ ডিল’ প্রবর্তন করেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট।
(iv) ‘লেবেনশ্রউম’ কথার অর্থ Living Space অর্থাৎ ডালোভাবে বাঁচার জন্য যথেষ্ট জায়গা ।
উপবিভাগ : B
(i) নেপোলিয়ন ৩০০টি ছোটো ছোটো রাষ্ট্র নিয়ে রাইন রাষ্ট্রসংঘ গঠন করেন। — সত্য।
(ii) জার তৃতীয় আলেকজান্ডার ‘রুশীকরণ নীতি’-এর বিরোধিতা করেছিলেন। — মিথ্যা। [ সঠিক উত্তর : কার্যকরী করেছিলেন ]
(iii) রাশিয়া ও জার্মানি ব্রেস্ট-লিটভস্কের সন্ধি স্বাক্ষর করেছিল। — সত্য।
(iv) আটলান্টিক চার্টার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠনের প্রথম ধাপ ছিল। – মিথ্যা। [ সঠিক উত্তর : লন্ডন ঘোষণাপত্ৰ ]
উপবিভাগ : C
ক-স্তম্ভের সঙ্গে খ-স্তম্ভের মিলকরণ :
(i) পোল্যান্ড আক্রমণ → (c) ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর
(ii) রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি → (d) ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ
(iii) লেন্ড লিজ আইন  → (b) ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ
(iv) বিজয় দিবস → (a)  ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ
উপবিভাগ : D
(i) শিল্পবিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন লুই অগাস্তে ব্ল্যাকি ।
(ii) ডেকাব্রিস্ট আন্দোলন হয়েছিল ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে।
(iii) জাতিসংঘের জনক হলেন উড্রো উইলসন ।
(iv) আন্তর্জাতিক বিচারালয়টি নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে অবস্থিত।
উপবিভাগ : E
(i) ব্যাখ্যা (a) তিনি জনগণের কথা শুনতেন না এবং বলতেন, ‘আমার ইচ্ছাই আইন।’
(ii) ব্যাখ্যা (b) তিনি ফরাসি বিপ্লবের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শকে বাস্তবায়িত করেন। 
(iii) ব্যাখ্যা (a) শেয়ার বাজারে ধস নামার কারণে অর্থসংকট বৃদ্ধি পায়।
বিভাগ-গ
3 (i) বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক, কবি ও নাট্যকার ভলতেয়ার তাঁর বিতর্কিত গ্রন্থ ‘ফিলোজফিক্যাল ডিকশনারি (১৭৬৪)-তে ফ্রান্সকে রাজনৈতিক কারাগার’ বলে অভিহিত করেছেন। বিপ্লব- পূর্ববর্তী ফ্রান্সে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘লেতর দ্য ক্যাশে’ নামক একটি রাজকীয় গ্রেফতারি পরোয়ানার মাধ্যমে যে-কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে বাস্তিল দুর্গে বন্দি করে রাখা হত। এই কারণে ফ্রান্সকে ‘রাজনৈতিক কারাগার’ বলা হয়।
(ii) জেকোবিন দলের দুজন সদস্যের নাম হল রোবসপিয়র এবং হিবার্ট।
(iii) ১৭৯৫-১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফ্রান্সে ডাইরেক্টরি শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই শাসনকালে ফ্রান্সের শাসনব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ফ্রান্সে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অনাচার প্রভৃতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশব্যাপী বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই সুযোগে নেপোলিয়ন ডিরেক্টরদের সরিয়ে কনস্যুলেট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
(iv) পেনিনসুলার যুদ্ধের কুফল : পেনিনসুলার বা উপদ্বীপের যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের ফলে • ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপে তাঁর আধিপত্য ধ্বংস হয়। ও এই দীর্ঘদিনব্যাপী যুদ্ধের ফলে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এবং প্রায় ৩ লক্ষেরও বেশি সৈন্য মারা যায়। ও ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সামরিক কাঠামোর অভাবনীয় ক্ষতি হয়।
(v) জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যে পৃথক পৃথক আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক প্রচলিত ছিল। এতে বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে খুবই সমস্যা দেখা দিত। মেটারনিখ জার্মানির রাজনৈতিক ঐক্যসাধনে বাধা দিলে, বিভিন্ন জার্মান রাজ্যে শুল্ক সংক্রান্ত বিভেদগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে জার্মান অর্থনীতিবিদ ম্যাজেন-এর উদ্যোগে এবং প্রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘জোলভেরাইন’ নামে শুল্কসংঘ গঠিত হয়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অস্ট্রিয়া ছাড়া সব জার্মান রাজ্য এতে যোগ দেয়। জার্মানির এই অর্থনৈতিক ঐক্য তার রাজনৈতিক ঐক্যের পথ সুগম করেছিল।
(vi) রাশিয়াতে শিল্পবিপ্লবের প্রসার হয়েছিল অনেক দেরিতে। এর কারণ ছিল– (১) রাশিয়া ছিল কৃষিপ্রধান ও সামন্ততান্ত্রিক দেশ। তাই শিল্পবিপ্লবের প্রথম পর্বে রাশিয়াতে শিল্পোদ্যোগী বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠেনি।
(২) রাশিয়ার ভূমিদাসরা গ্রামে বসবাস করত এবং তারা সামন্তপ্রভুর অনুমতি ছাড়া শহরে শ্রমিকের কাজ করতে যেতে পারত না।
(৩) রাশিয়ার যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ছিল নিম্নমানের। ফলে রাশিয়াতে শিল্পায়নের সূচনা হয় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে।
(vii) সুয়েজ খাল খননের পূর্বে ইউরোপ থেকে এশিয়া বা পূর্ব আফ্রিকায় যেতে গেলে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে বহু পথ ঘুরে যেতে হত। সুয়েজ খাল খননের ফলে ভারতের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব কমে যায় এবং যোগাযোগ ও বাণিজ্য অনেক সহজ হয়ে যায়। এই খাল খননের ফলে ইউরোপ থেকে এশিয়া আসতে গেলে আর আফ্রিকা ঘুরে আসার প্রয়োজন হত না।
(viii) বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য : বুর্জোয়া পুঁজিবাদের বিকাশের ফলস্বরূপ সমাজে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যথা—
(১) সমাজে দুটি পরস্পরবিরোধী শ্রেণি—বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত তথা শোষক ও শোষিত শ্রেণির আবির্ভাব হয়। 
(২) পুঁজিপতি শ্রেণি ছিল উৎপাদনের সকল উপাদানের মালিক, অপরদিকে সর্বহারা শ্রেণি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমশক্তি দিলেও তারা মালিকানা ভোগ করার অধিকারী ছিল না।
(৩) কার্ল মার্কস বলেছিলেন, সর্বহারা শ্রেণিকে শোষণের জন্য রাষ্ট্র পুঁজিপতি শ্রেণিকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে।
(ix) ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার রোমানভ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন মিখাইল রোমানভ। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছরের বেশি। সময় ধরে রাশিয়া রোমানভ বংশীয় রাজতন্ত্রের শাসনাধীনে ছিল। এই বংশের রাজারা সার্বভৌম শক্তির প্রতীকরূপে নিজেদের ‘জার’ বলে অভিহিত করতেন। এদের শাসনকাল ‘জারতন্ত্র’ নামে পরিচিত।
(x) বলশেভিক বিপ্লবকালে লেনিনের নির্দেশে ট্রটস্কি-এর নেতৃত্বে লাখ-লাখ শ্রমিক কৃষককে নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হল লাল ফৌজ বা রেড গার্ড। রাশিয়ার পুরোনো সেনাবাহিনী ভেঙে ‘লাল ফৌজ’ গঠিত হয়। জারের প্রায় ৫০ হাজার সামরিক অফিসার লাল ফৌজকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে এই কমিউনিস্ট বাহিনী লাল পতাকা নিয়ে যুদ্ধ করত বলে তারা লাল ফৌজ নামে পরিচিত ছিল।
(xi) এক জার, এক চার্চ, এক রাশিয়া এই নীতি গ্রহণ করে জার দ্বিতীয় নিকোলাস রাশিয়ায় বসবাসকারী সংখ্যালঘু পোল, ফিন, জার্মান, ইহুদি প্রভৃতি অরুশ প্রজাদের ওপর জোর করে রুশ ভাষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি চাপিয়ে দেন এবং অরুশ প্রজাদের জমি, চাকরি প্রভৃতি কেড়ে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় নিকোলাসের এই নীতিকে বলা হয় রুশীকরণ নীতি।
(xii) ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলা স্পেনের গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন জেনারেল ফ্রাঙ্কো। তিনি গৃহযুদ্ধে জয়ী হন, এবং স্পেনের রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন।
(xiii) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়লাভের পিছনে অনেক কারণ ছিল o আমেরিকার মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের মিত্রপক্ষে যোগদান, ও ব্রিটেনের নৌশক্তির প্রাধান্য, ও জার্মানির মিত্র দেশগুলির জার্মানিকে অসহযোগিতা, কানাডা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশগুলির সম্পদ মিত্রশক্তির স্বার্থে ব্যবহার ইত্যাদি মিত্রশক্তিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাফল্য জুগিয়েছিল।
(xiv) ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভা প্রোটোকল রচিত হয়।
এর উদ্দেশ্য ছিল– (১) শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিরোধের মীমাংসা করা, (২) যুদ্ধকে বেআইনি ঘোষণা করা, (৩) আন্তর্জাতিক আইনসংক্রান্ত বিরোধগুলিকে আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানির জন্য প্রেরণ করা ইত্যাদি।
(xv) ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর মস্কো সম্মেলনে ইংল্যান্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া এবং চিনের প্রতিনিধিবর্গ এক যুগ্ম ইস্তাহার প্রকাশ করেন যা মস্কো ঘোষণা নামে পরিচিত। এই ঘোষণার ৪ এবং ৭ নং ধারায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ নামক শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এই ঘোষণায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষাকবচ হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করা হয় যে প্রতিষ্ঠানের দ্বার বিশ্বের সকল শান্তিকামী দেশের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
(xvi) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘ (ILO) গঠিত হয়। এর সংস্থা গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল – পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি এবং তাদের উন্নয়নের প্রতি জাতিপুঞ্জের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, শ্রমিকদের সর্বপ্রকার শোষণমুক্তির বিষয়ে নজর দেওয়া, শ্রমকে পণ্যদ্রব্য হিসেবে ক্রয় না করা, প্রতিটি মানুষকে আর্থিক নিরাপত্তা ও সমান সুযোগসুবিধা দান এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দ্বারা দেশের উন্নতি ঘটানো।

বিভাগ-ঘ
4 (i) অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই ফ্রান্সে স্বৈরাচারী অর্থনীতি প্রচলিত ছিল। তবে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যা ছিল না, ফ্রান্সে তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। একমাত্র ফ্রান্সেই দার্শনিকদের প্রভাবে জনগণ ফরাসি প্রশাসনের স্বৈরাচার ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যা শেষ পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়েছিল।
ফরাসি অর্থনীতি সম্পর্কে দার্শনিকদের মতামত : প্রাক্-বিপ্লব পর্বে ফরাসি সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বরূপ সম্পর্কে দার্শনিকদের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দার্শনিকরা তাঁদের কাল করেন। দার্শনিক সমালোচনামূলক লেখনীর মাধ্যমে ফ্রান্সের তৎকালীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার চেষ্টা করেন। ল্যাগুয়ে (Linguet) সম্পত্তিতে বংশগত অধিকার ও ব্যক্তিগত মালিকানার অবসানের কথা বলেন। তিনি মনে করেন, সম্পত্তিবান লোকেরাই শক্তিশালী, যারা অন্য শ্রেণিকে শোষণ করে। মরেলি (Morelly)-ও সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানাকে সামাজিক অসাম্য ও শোষণের জন্য দায়ী করেছেন। অর্থনীতি সম্পর্কে ‘ফিজিওক্র্যাটদের’ (Physiocrats) চিন্তাভাবনাও গুরুত্বপূর্ণ। এঁরা অর্থনীতি বিষয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করেন। এঁরা মনে করতেন, স্বাধীন ও অবাধ বাণিজ্যের দ্বারাই ফ্রান্সের উন্নতি সম্ভব। ফিজিওক্র্যাটদের বক্তব্য শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
এইভাবে ফরাসি দার্শনিকগণ তাঁদের চিন্তাধারা এবং যুক্তিপূর্ণ লেখনীর মাধ্যমে ফ্রান্সের প্রাক্-বিপ্লব পর্বের ফরাসি রাজতন্ত্রের স্বৈরাচার ও অর্থনীতি সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করেছিলেন।
অথবা, Baita MN High School (HS)-এর 4. (ii) -এর উত্তরটি দেখুন।
(ii) রোবসপিয়রের মৃত্যুতে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান হলে জাতীয় সভা ফ্রান্সে ডাইরেক্টরি (Directory) শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে। কিন্তু এই শাসনব্যবস্থা নতুন সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত ছিল না। ডাইরেক্টরি শাসনব্যবস্থার এই অক্ষমতাই নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল।
নেপোলিয়নের ক্ষমতা লাভ : ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান নেপোলিয়ন অতি অল্পকালের মধ্যে ফ্রান্সের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের কাছ থেকে তুলোঁ (Touloun) বন্দরের পুনরুদ্ধার এবং ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাত থেকে জাতীয় সভাকে রক্ষা তাঁকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে। তা ছাড়া বিপ্লবের দশ বছরের মধ্যে ফ্রান্সে কখনোই সুস্থিরতা আসেনি। সন্ত্রাসের আতঙ্ক মানুষের মন থেকে বিলীন হয়ে যায়নি। এই পরিস্থিতিতে নৈরাজ্য থেকে ফ্রান্সকে রক্ষা করতে নেপোলিয়ন এগিয়ে আসেন এবং জনগণ তাঁকে বিপুলভাবে সমর্থন করে। ফ্রান্সের জনগণ ডাইরেক্টরি শাসনে (১৭৯৫-১৭৯৯ খ্রি) অসন্তুষ্ট হয়েছিল। এই অবস্থার সুযোগে নেপোলিয়ন সসৈন্য কাউন্সিলে উপস্থিত হন। নেপোলিয়নের অনুগত ডাইরেক্টর ও সদস্যগণ আনুষ্ঠানিকভাবে ডাইরেক্টরি শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। ফলে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্সে কনস্যুলেটের শাসনের সূচনা হয় (১ নভেম্বর, ১৭৯৯ খ্রি)।
তিনজন কনসালের ওপর শাসনক্ষমতা অর্পিত হয়। এর মধ্যে নেপোলিয়ন হলেন সর্বশক্তিমান প্রথম কনসাল ।
ফ্রান্সের প্রথম কনসাল হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে নেপোলিয়ন ফ্রান্স-বিরোধী দ্বিতীয় রাষ্ট্রজোট-এর আক্রমণ প্রতিহত করেন। এরপর ইটালি, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইটজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ দখল করেন। এইসব সাফল্যের ফলশ্রুতিরূপে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন ‘কাউন্সিল অফ স্টেট’-এর প্রস্তাব অনুসারে চিরজীবনের জন্য প্রথম তথা প্রধান কনসাল পদে অধিষ্ঠিত হন।
অবশেষে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে সিনেটের প্রস্তাবমতো গণভোটের মাধ্যমে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাজবংশীয় না হয়েও ‘ফরাসি জাতির সম্রাট’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ফরাসি প্রজাতন্ত্র নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়।
অথবা, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কেবলমাত্র রণনিপুণ সেনাপতি ছিলেন না 1 তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। নেপোলিয়ন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ জয় করে পুরাতনতন্ত্র ধ্বংস করেন এবং ইউরোপের পুনর্গঠন করেন। ইউরোপের পুনর্গঠনে নেপোলিয়নের লক্ষ্য ছিল ফ্রান্সের চারপাশে অনুগত রাষ্ট্র সৃষ্টি করা।
ইটালি : নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের সর্বাধিক ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটেছিল ইটালি ও জার্মানির রাজ্যগুলিতে। নেপোলিয়ন ইটালির পুনর্গঠন করেন।
(১) অস্ট্রিয়া ইটালির কয়েকটি অঞ্চল দখল করে রেখেছিল। নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে ওই অঞ্চলগুলিকে ফরাসি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেন। নেপোলিয়ন নিজেকে ইটালির রাজা (King of Italy) বলে ঘোষণা করেন। এখানে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর ও জোসেফাইনের পুত্র ইউজিন বুহারনেকে শাসক নিযুক্ত করেন।
(২) তিনি পোপকে বন্দি করে পোপের রাজ্য রোম নগরীকে ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্ত করেন।
(৩) তিনি ইটালির টাসকানি, পিডমন্ট, জেনোয়া প্রভৃতি দখল করে ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্ত করেন।
(৪) নেপোলিয়ন তাঁর ভাই জোসেফকে (Joseph) দক্ষিণ ইটালির রাজা হিসেবে নেপলসের সিংহাসনে বসান।
জার্মানি : নেপোলিয়ন জার্মানি জয় করে ৩০০টি রাজ্যকে পুনর্গঠন করে ৩৯টি রাজ্যে পরিণত করেন।
(১) নেপোলিয়ন জার্মানিকে অস্ট্রিয়ার প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি ব্যাভেরিয়া ও তার পাশের অঞ্চল নিয়ে গঠন করেন ব্যাভেরিয়া রাজ্য। তিনি উইটেনবার্গ ও ব্যাডেনকে নিয়ে অস্ট্রিয়ার প্রভাবমুক্ত দুটি রাজ্য গঠন করেন।
(২) রাইনের রাষ্ট্রজোট (কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন, Confederation of the Rhine) : তিনি ব্যাভেরিয়া, উইটেনবার্গ, স্যাক্সনি, ব্যাডেন-সহ দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির অনেকগুলি রাজ্যকে নিয়ে রাইনের রাষ্ট্রজোট বা ‘কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন’ গঠন করেছিলেন। প্রথমে ১৬টি ও পরে ১৮টি জার্মান রাজ্য নিয়ে কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন গঠিত হয়েছিল।
(৩) ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্য (Kingdom of Westphalia) : নেপোলিয়ন হ্যানোভার, হেমফেলেস ও স্যাক্সনি রাজ্যের সমন্বয়ে ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্য গঠন করেন। তাঁর ভাই জেরোম (Jerome ) এই রাজ্যের শাসক নিযুক্ত হন।
(৪) গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ (Grand Duchy of Warsaw) নেপোলিয়ন প্রাশিয়া ও পোল্যান্ডের অংশ নিয়ে গঠন করেছিলেন। ‘গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ’ নামক একটি নতুন রাজ্য।
ইউরোপের পুনর্গঠন করে ইটালি ও জার্মানির ঐক্যের পথ প্রশস্ত করা ছিল নেপোলিয়নের বড়ো কৃতিত্ব।
(iii) Balurghat High School -এর 7. (iv)-এর উত্তরটি দেখুন।
অথবা, শিল্পবিপ্লব ইউরোপ মহাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ছিল অপরিসীম।
সামাজিক প্রভাব : সামাজিক জীবনে শিল্পবিপ্লবের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যথা –
(১) দুটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব মালিক ও শ্রমিক : শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে পুঁজিপতি মালিকশ্রেণি এবং শ্রমজীবী শ্রেণি। শিল্পোৎপাদনে মূলধন বিনিয়োগ করে যারা তা থেকে মুনাফা লাভ করত, তারা হল পুঁজিবাদী শ্রেণি বা Capitalist Class । আর যারা কারখানায় শ্রমদান করে পণ্য উৎপাদন করত, বিনিময়ে পণ্যের ওপর কোনো দাবি না করে শুধু মজুরি পেত, তারা শ্রমজীবী শ্রেণি বা Working Class নামে পরিচিত ছিল।
(২) নতুন নতুন নগরের সৃষ্টি : বিভিন্ন স্থানে কলকারখানার প্রতিষ্ঠার ফলে অনেক নতুন নতুন শিল্পনগরী গড়ে ওঠে। শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার, নিউ ক্যাসেল, ব্রিস্টল, বার্মিংহাম, লিভারপুল প্রভৃতি স্থানে নতুন নতুন শিল্পনগরীর সৃষ্টি হয়।
(৩) নগরকেন্দ্রিক সমাজের সৃষ্টি : কলকারখানায় কাজ করার জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ দলে দলে শহরে এসে বসবাস শুরু করে। ফলে একদিকে জনবহুল নগর সমাজের সৃষ্টি হয়, কিন্তু অপরদিকে গ্রামগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে।
(৪) বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ও প্রভাব বৃদ্ধি : শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, মহাজন ইত্যাদি পেশাদার শ্রেণির মানুষের উদ্ভব হয়। এরা ‘বুর্জোয়া শ্রেণি’ বা ‘মধ্যবিত্তশ্রেণি’ নামে পরিচিত। কালক্রমে এই নতুন বুর্জোয়া শ্রেণি সমাজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পূর্বতন সামন্তশ্রেণির অবলুপ্তি ঘটে।
(৫) শ্রমিকদের দুর্দশা এবং শ্রমিক সংঘ : শ্রমিক শ্রেণির ব্যাপক কর্মসংস্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এক সংঘবদ্ধ সামাজিক শ্রেণি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে নানা সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যার অন্তর্ভুক্ত ছিল খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি প্রায় সবকিছু। নারী ও শিশুদেরও বেশি করে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ফলে শ্রমিক শ্রেণির সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য শ্রমিক সংঘ গড়ে ওঠে ও শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয়।
(iv) চিনের ব্যবচ্ছেদ : ঊনবিংশ শতাব্দীতে চিনে মাঞ্জু রাজবংশের অপদার্থতার সুযোগে ইউরোপীয় দেশগুলি সেখানে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠে। জনৈক ঐতিহাসিক হেরল্ড ভিন্যাক-এর ভাষায় ‘তরমুজকে যেমন লোকে খণ্ড খণ্ড করে খায়, সেইভাবে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি চিনা তরমুজকে খণ্ড খণ্ড করে আহার করতে উদ্যত হয়।’
ব্রিটেন : প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দ) চিনকে ব্রিটেন পরাজিত করে। নানকিং-এর সন্ধির দ্বারা হংকং বন্দর, কৌলুন দ্বীপ এবং দক্ষিণ চিনের ক্যান্টন-সহ পাঁচটি বন্দর ব্রিটেন হস্তগত করে। দ্বিতীয় ইঙ্গ-চিন যুদ্ধেও (১৮৫৬-৬১ খ্রিস্টাব্দ) চিন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে তিয়েনসিনের সন্ধি স্বাক্ষর করলে প্রায় ১১টি বন্দর বিদেশি বণিকদের কাছে উন্মুক্ত হয়।
জার্মানি : জার্মানি চিনের কিয়াওচাও বন্দর দখলের পর শানটুং প্রদেশে তার অধিকার কায়েম করে।
ফ্রান্স : ফ্রান্স ইন্দোচিন বা আনাম থেকে চিনের ভিতর পর্যন্ত নিজ নিয়ন্ত্রণে রেলপথ গঠনের অধিকার পায়। ফলে ইউনান, কোয়াংশি ইত্যাদি অঞ্চলের খনিজ সম্পদ রেলপথ দ্বারা ফ্রান্সে নিয়ে যাবার সুযোগ লাভ করে।
রাশিয়া : রাশিয়া পোর্ট আর্থার বন্দর ও লিয়াও টুং উপদ্বীপ দখল করে। এ ছাড়া রাশিয়া চিনে বক্সার বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করে মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র : এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করে যে, সব দেশ মিলে চিন দখল করে নিলে মার্কিন বাণিজ্যের আর কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জন হে তাঁর ‘Open Door Policy’ বা ‘উন্মুক্ত দ্বার নীতি’ ঘোষণা করেন। এই নীতিতে চিনে ইউরোপীয়দের অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে আমেরিকাকে বাণিজ্যের সমান সুযোগসুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়।
অথবা, ভারত ছিল ব্রিটিশদের উপনিবেশগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান উপনিবেশ। অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকে পরবর্তী দেড় শতকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতের অর্থসম্পদকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হয়।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সময়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যাবতীয় খরচ ভারত থেকেই আদায় করার কথা বলা হয়। ও ভারতের বাজারকে ব্রিটেনে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুসারে ব্রিটেনের ল্যাঙ্কাশায়ারে তৈরি সুতির কাপড়ের ৮৫% ভারতে বিক্রি হত। ও ভারতে রেলপথ ও রেলগাড়ি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত লৌহ-ইস্পাতের ১৭% ব্রিটেন থেকে আনা হত। ভারতীয় উপনিবেশের শিল্প-বাণিজ্যের অভিমুখ ব্রিটেনের স্বার্থে পরিচালিত হত। অর্থাৎ সবদিক থেকে ভারত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম লাভজনক উপনিবেশ। তাই ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে দামি ‘রত্ন’ বলা হত।
(v) মধ্যশিক্ষা পর্ষদ প্রদত্ত নমুনা প্রশ্নপত্রে -এর 5. (iii) -এর প্রথম অংশের উত্তরটি দেখুন।
অথবা, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব সমকালীন সমগ্র বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ঐতিহাসিক ই এইচ কার (E H Carr) বলেছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বলশেভিক আন্দোলন একটি বিশ্ব আন্দোলনে পরিণত হয়।
রাজনৈতিক প্রভাব :
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সর্বপ্রথম শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণির সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপে ও এশিয়ার কোনো কোনো দেশে সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বৃদ্ধি : রুশ বিপ্লবের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ভারত, চিন-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পরাধীন জাতিগুলি নতুন উৎসাহ -উদ্দীপনার সঙ্গে মুক্তি সংগ্রাম শুরু করে।
ট্রেড ইউনিয়ন গঠন : রুশ বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ফলে বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে এবং তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করে।
বিশ্বে আদর্শগত গোষ্ঠীবিভাজন : রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সমাজতন্ত্র হল ধনতন্ত্রের বিরোধী আদর্শ। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই- -এর সূত্রপাত হয়। এই রুশ বিপ্লব পৃথিবীর রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সাম্যবাদী আতঙ্ক পুঁজিবাদী দেশগুলিকে গ্রাস করে এবং দুই শিবিরে পারস্পরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

(vi) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের কারণ : 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে অক্ষশক্তিভুক্ত অন্যতম সদস্য জার্মানি যথেষ্ট সাফল্য দেখালেও শেষপর্যন্ত জার্মানি পরাজিত হয়। জার্মানির পরাজয়ের পশ্চাতে নানা কারণ ছিল।
দুর্বল সহযোগী দেশ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল দুটি জোটশক্তির মধ্যে, কোনো নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে যুদ্ধ হয়নি। জার্মানির যে জোটশক্তি ছিল সেখানে তার সদস্য দেশগুলি ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল দেশ। কিন্তু বিপরীতদিকের জোটশক্তির বেশিরভাগ রাষ্ট্রগুলি সামরিক দিক থেকে জার্মান জোটের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। ফলে জার্মানির ওপর চাপ বেশি ছিল যা জার্মানির একার পক্ষে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে জার্মানির পক্ষে মিত্রশক্তির সঙ্গে বেশিদিন মোকাবিলা বা জয়লাভ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
আধুনিক অস্ত্রের অভাব : জার্মানির কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র থাকলেও মিত্রশক্তি ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের অস্ত্রের তুলনায় কম ছিল। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে লড়াই করা ততটা সহজ ছিল না।
প্রয়োজনীয় রসদের অভাব : ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল জার্মানির থেকে অনেক বেশি। যুদ্ধে প্রয়োজনীয় রসদ জোগাড় করা ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের পক্ষে যতটা সহজ ছিল, জার্মানির পক্ষে ততটাই কঠিন ছিল। ফলে জার্মান বাহিনীর সর্বত্র সমান রসদ জোগান না পাওয়ার ফলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
দুর্বল নৌশক্তি : নৌশক্তিতে জার্মানি ইংল্যান্ডের তুলনায় অনেকটা দুর্বল ছিল। যদিও জার্মানি প্রথম এই যুদ্ধে সাবমেরিন ব্যবহার করে, কিন্তু মিত্রশক্তি ডেপথচার্জ আবিষ্কার করে জার্মান সাবমেরিন ধ্বংস করলে জার্মান জলশক্তি কমে যায়।
দুই মুখ রণাঙ্গন : অক্ষশক্তির প্রধান দেশ ছিল জার্মানি। ফলে তার দায়িত্বও ছিল বেশি। জার্মানিকে একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রধান দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। কিন্তু মিত্রশক্তির কোনো দেশকে এমন দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়নি, ফলে জার্মানি দুর্বল হয়ে পড়ে ও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়।
কূটনৈতিক ব্যর্থতা : কূটনীতিতে জার্মানি ওই সময়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। মিত্রশক্তি কূটনীতির দ্বারা ইটালিকে তার নিজের দিকে টেনে নেয়, এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তীকালে মিত্রশক্তিতে যোগদান করে, ফলে মিত্রশক্তি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং জার্মানির পক্ষে এর মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি।
যুদ্ধে আমেরিকার যোগদান : আমেরিকা প্রথম থেকে মিত্রপক্ষকে অস্ত্র, রসদ দিয়ে সাহায্য করছিল। শেষের দিকে সরাসরি সামরিক শক্তি নিয়ে আমেরিকা অক্ষশক্তির বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়লে জার্মানির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়।
উপরোক্ত কারণে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও সামরিক দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত হওয়া সত্ত্বেও জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়।
অথবা, উড্রো উইলসনের চোদ্দো দফা নীতি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ভাববাদী মানুষ মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে উইলসন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই পরিকল্পনা ‘চোদ্দো দফা নীতি’ নামে পরিচিত। এই নীতির শর্তগুলি ছিল –
(১) গোপন কূটনীতি ত্যাগ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্র খোলাখুলিভাবে শান্তি স্থাপনের ব্যবস্থা অবলম্বন করবে। 
(২) যুদ্ধ ও শান্তি সবসময়েই সমুদ্রপথ সকলের জন্য খোলা থাকবে। 
(৩) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ইত্যাদি সমস্ত বাধা অপসারণ করতে হবে। 
(৪) শত্রুপক্ষের উপনিবেশে বসবাসকারী মানুষের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে হবে। 
(৫) রাশিয়ার হৃত রাজ্যাংশ ফিরিয়ে দিয়ে তাকে স্বাধীন ও জাতীয় নীতি অনুসরণ করার সুযোগ দিতে হবে। 
(৬) সমস্ত রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিশ্বে শান্তি রক্ষার প্রহরী হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। 
(৭) প্রতিটি দেশকেই যুদ্ধের সরঞ্জাম হ্রাস করতে হবে। 
(৮) ইটালি রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। 
(৯) বেলজিয়ামের হৃত গৌরব ফিরিয়ে দিতে হবে। 
(১০) তুরস্কবাসী অ-মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। 
(১১) বলকান অঞ্চলের পুনর্গঠন করতে হবে। 
(১২) ফ্রান্সকে আলসাস ও লোরেন ছেড়ে দিতে হবে। 
(১৩) অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিবাসী জনগণকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। 
(১৪) পোল্যান্ডের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে তাকে সমুদ্রে যাওয়ার পথ দিতে হবে।
বিভাগ-ঙ
(i) ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়ার সার্বিয়া আক্রমণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য যেসব কারণ দায়ী ছিল তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির সাম্রাজ্যবাদ। অনেক ঐতিহাসিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালকে সাম্রাজ্যবাদের যুগ’ (Age of Imperialism) বলে চিহ্নিত করেন।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা: পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ভৌগোলিক আবিষ্কারের পর ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিশেষত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানির শিল্পপতি শ্রেণি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে ইউরোপের দেশগুলি এশিয়া, আফ্রিকায় উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি সাম্রাজ্য বিস্তারকে গর্বের প্রতীক বলে মনে করত। আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্স অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। পরবর্তীকালে ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব পোষণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
কাঁচামাল ও বাজার দখলের লড়াই : শিল্পবিপ্লবের ফলস্বরূপ প্রত্যেক দেশে শিল্পোৎপাদিত দ্রব্য উৎপাদনের পাশাপাশি কাঁচামালের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। সেই কারণে উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য বিক্রয়ের জন্য বাজার ও কাঁচামাল সংগ্রহকে কেন্দ্র করে শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে বিবাদ দেখা দেয়। এই কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে এক নগ্ন প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়।
জার্মানির সাম্রাজ্যবাদী নীতিগ্রহণ : ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর চ্যান্সেলার বিসমার্ক বলেছিলেন, জার্মানি একটি ‘পরিতৃপ্ত দেশ’। কিন্তু কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম ঘোষণা করেন যে, ‘জার্মানি পরিতৃপ্ত দেশ নয়, তার সামনে অনন্ত সম্প্রসারণের সম্ভাবনা আছে।’ জার্মানির সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা ও ব্রিটেনের জার্মান ভীতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী ছিল।
সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য সামরিক শক্তি বৃদ্ধি : জার্মানি সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম নৌশক্তি বৃদ্ধি করেন। বিভিন্ন দেশে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা ও অস্ত্রনির্মাণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ফলস্বরূপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
ব্রিটেন ও জার্মানির সাম্রাজ্যবাদী বিবাদ : সাম্রাজ্য বিস্তারে অতৃপ্তি পূরণ করার জন্য যুদ্ধই যে একমাত্র পথ তা বুঝতে পেরে জার্মানি তার স্থল ও নৌবাহিনীর শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি করতে থাকে। জার্মানির এই শক্তিবৃদ্ধি ব্রিটেনের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জার্মানির এই শক্তিবৃদ্ধির মূল উদ্দেশ্য ছিল ধীরে ধীরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলিকে গ্রাস করা। আর নৌশক্তিতে যেহেতু ব্রিটেন ছিল বিশ্ব সেরা সেই কারণে ব্রিটেনের সমতুল্য নৌশক্তি তৈরি করা ও তাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য জার্মানি এইরূপ শক্তিবৃদ্ধি ঘটায়।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আন্তর্জাতিক সমস্যা : সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সমস্যা তৈরি হয়। যেমন— মরক্কোকে কেন্দ্র করে রাশিয়া-জার্মানির সংঘাত, বলকান অঞ্চলকে কেন্দ্র করে জার্মানি-রাশিয়া বিবাদ, মিশরকে নিয়ে ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের বিরোধ, পারস্যকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড-রাশিয়া বিবাদ ও চিনকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স-জার্মানির বিরোধ প্রভৃতি। এই একাধিক বিবাদগুলি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপ দুটি পরস্পর বিবদমান শিবিরে যথা – ত্রিশক্তি চুক্তি ও ত্রিশক্তি মৈত্রীতে বিভক্ত হয়।  
এছাড়াও সশস্ত্র শান্তির যুগে বিভিন্ন মারণাস্ত্রের আবিষ্কার, গড়ে ওঠা পরস্পরবিরোধী সামরিক জোট উত্তেজনার পারদ বাড়িয়ে দেয়। সেরাজেভোর ঘটনা তাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যোগ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটে।
(ii) ফ্যাসিবাদের উত্থানের পূর্বে ইটালি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত জার্মানির মতো বিজয়ী ইটালির জাতীয় জীবনেও সার্বিক বিপর্যয় নেমে আসে। অর্থনৈতিক দুর্দশা বৃদ্ধি, কৃষিব্যবস্থায় ভাঙন, দেশে চরম খাদ্যাভাব ও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী ভেঙে গেলে বেকার সমস্যা তীব্রতর হয়ে ওঠে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের ফলে ইটালির আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রায় ১২০০ কোটি ডলার। ইতালীয় মুদ্রা লিভ্র-এর দাম পড়ে যায়। শিল্পসমৃদ্ধ ইটালির উত্তর অংশে লাগাতার ধর্মঘটের ফলে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে কৃষিসমৃদ্ধ ইটালির দক্ষিণ অংশে কৃষির উৎপাদন ব্যাপক কমে গেলে খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বলশেভিক ভাবধারা ইটালিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেকার যুবক ও শ্রমিকরা সমাজতন্ত্রী দলে যোগদান করে। শ্রমিকরা তাদের কাজের সময়সীমা হ্রাস ও মজুরি বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন শুরু করে। দেশে দাঙ্গাহাঙ্গামা, লুঠতরাজ ইত্যাদি শুরু হয়ে যায়। ইটালি সমাজবিরোধী ও ফাটকাবাজদের দখলে চলে যায়। দেশের এই অরাজক পরিস্থিতিতে ১৯১৯-২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ছয়টি মন্ত্রীসভার পতন হলেও ইটালির সমস্যা সমাধান তাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকটিত হয় এবং জনগণ সাম্যবাদ ও গণতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। ইটালির এই সংকটজনক পরিস্থিতিতেই বেনিটো মুসোলিনির (Benito Mussolini) আবির্ভাব হয়।

ইটালিতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব :

মুসোলিনির প্রথম জীবন : মুসোলিনি ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই ইটালির রোমানার পেদ্যপ্পিও গ্রামে এক দরিদ্র কর্মকার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার প্রভাবে মুসোলিনি প্রথম জীবনে সমাজতন্ত্রী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি স্কুলশিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু ইটালিতে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা চালু হলে তিনি সুইটজারল্যান্ডে পালিয়ে যান। সেখানে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে সুইটজারল্যান্ড সরকার তাঁকে বহিষ্কার করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান : ইটালিতে প্রত্যাবর্তন করে মুসোলিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ‘আভান্তি’ (Avanti, প্রগতি) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে তাঁর সমাজতন্ত্রী মতাদর্শ প্রচার করেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইটালির যোগদান সমর্থন করায় সমাজতন্ত্রী দল থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি নিজেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেছিলেন এবং যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন।
এক ফ্যাসিস্ট দল গঠন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইটালির যুদ্ধফেরত কর্মচ্যুত সৈনিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে মুসোলিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ মিলান শহরে ১১৮ জন কর্মচ্যুত সৈনিক এবং তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট দল’ (Fascist Party) গঠন করেন। মুসোলিনি তাঁর দলের অনুগামীদের নিয়ে একটি সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীও গঠন করেছিলেন। তাঁর দলের সদস্যরা কালো পোশাক পরত বলে, তাদের ‘কালো কোর্তা’ বা ‘ব্ল্যাক শার্টস্’ (Black Shirts) বাহিনী বলা হত।
জনসমর্থন লাভ : বামপন্থী অরাজকতা, সংসদীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতার হাত থেকে ইটালিকে উদ্ধার করে প্রাচীন রোমের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা মুসোলিনি প্রচার করেন। প্রচার ও সংগঠনের প্রসারের ফলে ‘ফ্যাসিস্ট’ দলের শক্তি ও জনপ্রিয়তা বহুগুণে বেড়ে যায়। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দলীয় কর্মীরা বিরোধীদের দমন করে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে ফ্যাসিস্টরা বিপুল সাফল্য লাভ করে।
মুসোলিনির ক্ষমতা দখল : ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ফ্যাসিস্ট দলের সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ লক্ষ। ওই বছরের নির্বাচনে মুসোলিনি ৩৫টি আসন দখল করেছিলেন। ইটালির জিওলিত্তি সরকার ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে পদত্যাগ করলে মুসোলিনি Black Shirts বাহিনীর ৩০ হাজার সদস্য নিয়ে রোম অভিযান করেন। মুসোলিনির শক্তি প্রদর্শনে ভীত হয়ে সম্রাট তৃতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল (Victor Emmanuel III) মুসোলিনিকে ইটালির সরকার গঠন করতে আহ্বান জানান।
মুসোলিনি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইটালির সর্বেসর্বা বা ইল-দ্যুচে’ (II Duce) হন।
(iii) বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল সর্বগ্রাসী ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, যা ইতিপূর্বে সংঘটিত হয়নি। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছয় বছর এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কে প্রভাব পড়েছিল।
ভয়াবহ ধ্বংসলীলা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের সবদেশে থাবা বসায়। ধ্বংসাত্মক দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অপেক্ষা আরও ভয়াবহ। এই যুদ্ধে ৪ কোটি মানুষ নিহত হয়। এর অর্ধেক ছিল রাশিয়ান। ২.১ কোটি মানুষ গৃহহারা হয়। বহু মানুষকে দাস হিসেবে জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেককে বন্দি শিবিরে আটক রাখা হয়। জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইটালি, জাপান প্রভৃতি দেশের বৃহৎ অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
শক্তি ও মর্যাদার পরিবর্তন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ইংল্যান্ড ছিল মহাশক্তিধর রাষ্ট্র। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাপানের ওপর পরমাণু বোমা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটে। অন্যদিকে স্থলযুদ্ধে জার্মানিকে পরাজিত করে সোভিয়েত রাশিয়ার লাল ফৌজ বাহিনী তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে।
ঘর ঠান্ডা লড়াই-এর শুরু : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাম্যবাদী রাশিয়ার মধ্যে এক আদর্শগত সংঘাত দেখা দেয়, যা ঠান্ডা লড়াই (Cold War) নামে পরিচিত। এর পেছনে যেমন আদর্শগত কারণ ছিল, তেমনি বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কারণও ছিল। সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ইউরোপে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, আলবেনিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া প্রভৃতি দেশকে নিয়ে ‘সোভিয়েত বলয়’ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্রুম্যান নীতি, কেন্নানের বেষ্টনী নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনা ঘোষণা করে নিজের আধিপত্য বিস্তারে উদ্যোগী হয়।
অক্ষশক্তির মর্যাদা ও প্রাধান্য হ্রাস : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মানির হিটলার, ইটালির মুসোলিনি, জাপানের তোজো অর্থাৎ অক্ষশক্তি যে সাফল্যলাভ করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে সেই সম্মান, আধিপত্য, গৌরব—সবই ধুলায় লুণ্ঠিত হয়।
স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি : উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেমন— ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, স্পেন, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় তাদের উপনিবেশ গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার এই সকল দেশে জোরদার স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয় এবং একে একে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচিন প্রভৃতি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে মূলত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ও রুশ প্রধান স্ট্যালিনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations Organisation) প্রতিষ্ঠিত হয় (২৪ অক্টোবর, ১৯৪৫)।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলে। এই দেশগুলি মার্কিন নেতৃত্বাধীন ধনতন্ত্রী জোট ও রুশ নিয়ন্ত্রিত সাম্যবাদী জোটের বাইরে ছিল। তাই এর নাম জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মিশরের রাষ্ট্রপতি কর্নেল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ড. সুকর্ণ এবং যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রধান প্রধান নেতা ছিলেন ৷
আর্থিক পুনর্বাসন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র পৃথিবীতে কমবেশি আর্থিক প্রভাব ফেলেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে সচল করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরে ‘জাতিপুঞ্জ ত্রাণ ও পুনর্বাসন’ বা ‘UNRRA’ (United Nations Relief and Rehabiliation Administration) প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরমাণু যুগের সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি ও ব্যবহার করে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু শক্তিধর হয়। একে একে অনেক দেশ পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠে। শুরু হয় পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্ব নাৎসি আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল সত্য। কিন্তু তার জন্য কম মূল্য দিতে হয়নি। এই ভয়াবহ যুদ্ধে বহু মানুষ মারা যায় ও গৃহহীন হয়। জাপানের ওপর পরমাণু বোমা ফেলায় জাপানের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। রক্তক্ষয়ী এই মারণ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে এক শিক্ষাস্বরূপ। ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না হয় তার জন্য আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ এবং বিশ্বের সকল দেশের নেতারা সচেষ্ট হয়। এই চেষ্টার সাফল্যের ওপর মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

Leave a Comment