নবম শ্রেণি প্রশ্নবিচিত্রা উত্তর বিষয় ইতিহাস সেট ২

Balurghat High School

নবম শ্রেণি প্রশ্নবিচিত্রা উত্তর বিষয় ইতিহাস সেট ২

বিভাগ-ক
1 (i) ফ্রান্স ছিল ‘রাজনৈতিক কারাগার’ – একথা বলেন – (c) ভলতেয়ার।
(ii) ‘ক্যাপিটেশন’ ছিল এক ধরনের (b) উৎপাদন কর। 
(ii) ‘’দ্য স্পিরিট অফ লজ’ গ্রন্থটি লেখেন – (c) মন্তেস্কু।
(iv) ‘টিলসিটের সন্ধি’ হয়েছিল – (b) ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে। –
(v) ফ্রান্সের ‘নাগরিক রাজা’ বলা হত – (d) লুই ফিলিপকে।
(vi) বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন (a) স্টিফেনসন।
(vii) ‘বিশ্বের কারখানা’ বলা হয় – (c) ইংল্যান্ডকে।
(viii) ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ মহাদেশ বলা হয় – (b) আফ্রিকা মহাদেশকে 
(ix) স্পেনে ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা ছিলেন (d) জেনারেল ফ্রাঙ্কো।
(x) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য সংখ্যা – (a) ৫টি।
(xi) ‘উড়ন্ত মাকু’ আবিষ্কার করেন (d) জন কে। 
(xii) জার্মানির সম্রাটকে বলা হত – (b) কাইজার।
(xiii) ‘প্রজাপতি রাজা’ নামে পরিচিত ছিলেন (d) পঞ্চদশ লুই।
(xiv) ‘ভ্যাঁতিয়েম’ ছিল এক ধরনের – (b) আয়কর। –
(xv) অ্যাসাইনেট ছিল এক ধরনের – (c) কাগজের নোট।
(xvi) ষোড়শ লুই ফ্রান্সের সিংহাসন আরোহণ করেন (a) ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে।
(xvii) লিপজিগের যুদ্ধ হয়েছিল – (b) ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে। 
(xvii) ভিয়েনা অবস্থিত – (b) অস্ট্রিয়ায়।
(xix) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বর্তমান মহাসচিব হলেন- (d) অ্যান্টোনিও গুটারেস ।
( xx) মেনশেভিক কথার অর্থ – (b) সংখ্যালঘিষ্ঠ ।
বিভাগ-খ
2 (i) ‘হেটাইরিয়া ফিলিকে’ হল গ্রিস দেশের একটি গুপ্ত সমিতি।
(ii) লেনিনের পুরো নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানড
(iii) ‘মোরাটোরিয়াম’ কথার অর্থ স্থগিতাদেশ।
(iv) ‘লেবেনশ্রউম’কথার অর্থ Living Space অর্থাৎ ভালোভাবে বাঁচার জন্য যথেষ্ট জায়গা । 
(v) গ্যারিবল্ডি ইটালির নেপলস ও সিসিলি অঞ্চলগুলি ঐক্যবদ্ধ করেন।
3 (i) বেইলি ‘দ্য পার্সিয়ান লেটারস’ গ্রন্থটি রচনা করেন। মিথ্যা। [ সঠিক উত্তর : মন্তেস্কু ]
(ii) ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব হয়েছিল। • মিথ্যা। [ সঠিক উত্তর : ১৮৪৮ ]
(iii) হো-চি-মিন ছিলেন ভিয়েতনামের নেতা। – সত্য। 
(iv) জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। — সত্য।
(v) শান্তি, রুটি, জমি’ স্লোগান জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বলশেভিক বিপ্লবের সময়। — সত্য।
4 বামস্তম্ভের সঙ্গে ডানস্তম্ভের মিলকরণ :
(i) জুলাই বিপ্লব → (b) ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ
(ii) কার্বোনারি → (a) ইটালির গুপ্ত সমিতি
(iii) স্পিনিং জেনি → (d) জেমস হারগ্রিভস
(iv) হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ → (c) ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ
5 (i) ফ্যাসিস্ট কথার অর্থ হল দড়িবাঁধা কাষ্ঠদণ্ড। 
(ii) জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব ছিলেন জেমস এরিক ড্রুমন্ড।
iii) নাগাসাকি ও হিরোশিমা শহর দুটি অবস্থিত ছিল জাপানে।
(iv) ‘দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস’ গ্রন্থটি রচনা করেন অ্যাডাম স্মিথ।
6 (i) ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সে এক শ্রেণির অর্থনীতিবিদের আবির্ভাব হয়, যারা অবাধ বাণিজ্য ও বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন তাদের ফিজিওক্র্যাটস বলা হয়। এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন কুয়েসনে, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ। এই অর্থনীতিবিদরা ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেন।
(ii) ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ‘ন্যায্য অধিকার নীতি’ বলতে বোঝায় ফরাসি বিপ্লবের আগে যে রাজা বা রাজবংশ যেখানে রাজত্ব করতেন সেখানে আবার তাদের রাজত্ব করার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। অর্থাৎ ইউরোপে প্রাক্-বিপ্লব যুগের পুনঃপ্রবর্তন করা। এই নীতি অনুসারে ফ্রান্সে বুরবো বংশ, হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ এবং ইটালিতে পোপের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
(iii) ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে সিভিল কনস্টিটিউশন অফ দ্য ক্লার্জি নামক আইন দ্বারা পোপের ক্ষমতা বিনষ্ট করা হয় এবং ফ্রান্সের চার্চগুলির জাতীয়করণ করা হয়। এর ফলে পোপের সঙ্গে ফরাসি সরকারের বিরোধ বাধে।
১৮০১ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন চার্চের জাতীয়করণ নীতির সঙ্গে পোপের দাবির সমতা রক্ষা করে যে মীমাংসা সূত্র বা সমাধান সূত্র রচনা করেন, তা ‘কনকর্ডাট’ নামে পরিচিত।
(iv) রাইন রাষ্ট্রসংঘ বা কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন : ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়াকে পরাজিত করে নেপোলিয়ন বার্লিনে আসেন। এই স্থানে তিনি জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যের (ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন, উইটেনবার্গ, স্যাক্সনি ইত্যাদি) রাজাদের নিয়ে একটি সংঘ বা ফেডারেশন গঠন করেন শাসনকার্যের সুবিধার জন্য। এটিকেই বলা হয় কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন বা রাইন রাষ্ট্রসংঘ। এই রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল নেপোলিয়নের ওপর।
(v) আক্ষরিক অর্থে যারা ‘ব্রিচেস’ ছাড়া পায়জামা পরত, ফ্রান্সে তাদের সাঁকুলো বলা হত। মূলত প্রাকৃবিপ্লব ফ্রান্সে তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্গত নগরবাসী শ্রমজীবী, চালচুলোহীন ভবঘুরে মানুষদের সাঁকুলোত্ বলা হত; এরা ফরাসি বিপ্লবের জঙ্গি সমর্থক ছিল।
(vi) Baita MN High School (HS)-এর 3. (iv)-এর উত্তর দেখুন।
(vii) ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে সুইটজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল। এই সম্মেলনে জার্মানির প্রস্তাব ছিল হয় জার্মানিকে ফ্রান্সের সমান সামরিক শক্তি বৃদ্ধির অনুমতি দেওয়া হোক নয়তো ফ্রান্সের সামরিক শক্তি জার্মানির সমান করা হোক। কিন্তু জার্মানির এই প্রস্তাব নাকচ হলে জার্মানির প্রতিনিধিরা সম্মেলন ত্যাগ করে। এর কয়েকদিন পর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর জার্মানি জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে।
(viii) আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের কাজ হল © আন্তর্জাতিক বিবাদের নিষ্পত্তি, আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা প্রদান এবং © সদস্য রাষ্ট্রগুলির আইনগত বিরোধের মীমাংসা করা।
(ix) ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৯-১২ আগস্ট আটলান্টিক সনদ রচিত হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের রণতরী ‘অগাস্টা’ (Augusta) ও প্রিন্স অফ ওয়েলস’ (Prince of Wales) নামক যুদ্ধজাহাজে কয়েকবার আলোচনার পর ‘আটলান্টিক সনদ’ রচিত হয়।
(x) Baita MN High School (HS)-এর 3. (ix) – এর উত্তরটি দেখুন।
(xi) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ৯ জানুয়ারি রবিবার সেন্ট পিটারসবার্গে প্রায় ৬ হাজার শ্রমিক ফাদার গ্যাপন-এর নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ মিছিলে শামিল হয়। জারের পুলিশবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে, বহু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ‘রক্তাক্ত রবিবার’ নামে পরিচিত।
(xii) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাঁচজন স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের একমত হওয়া জরুরি। কোনো সদস্য রাষ্ট্র গৃহীত সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ না করে এক বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রস্তাব রুখে দিতে পারে। এই বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারকে ‘ভেটো’ বলা হয়।
(xiii) কোড নেপোলিয়ন : ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত নানা ধরনের বৈষম্যমূলক পরস্পরবিরোধী এবং যুগের অনুপযোগী আইনগুলির সমন্বয়সাধনের জন্য নেপোলিয়নের উদ্যোগে ট্রনসেটের নেতৃত্বে চারজন বিশিষ্ট আইনজীবী কর্তৃক সংকলিত নতুন আইনবিধি কোড নেপোলিয়ন নামে পরিচিত। এই আইন সংহিতাতে ফ্রান্সের প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান, রোমান রীতিনীতি এবং ফরাসি বিপ্লবী ঐতিহ্যের সমন্বয় লক্ষ করা যায়। ২২৮৭টি ধারা সংবলিত এই আইন সংহিতার মাধ্যমে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়কে স্বীকার করে নেওয়ার কারণে ঐতিহাসিক লেফেভর এই আইন সংহিতাকে ‘ফরাসি সমাজের বাইবেল’ বলে অভিহিত করেছেন।
7 (i) টেনিস কোর্টের শপথ : ফরাসি বিপ্লবের প্রথম দিকে টেনিস কোর্টের শপথ এক উল্লেখযোগ্য বিষয়। দীর্ঘ ১৭৫ বছর পর ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে স্টেটস জেনারেলের সভা বসে ৫ মে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে। জাতীয় সভার সদস্যদের ভোটাধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নটি জাতীয় সংকটের সৃষ্টি করে। যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় চেয়েছিল দলগত ভোট হোক। অন্যদিকে তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি ছিল মাথাপিছু ভোটাধিকার।
সম্রাট ষোড়শ লুই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন অধিবেশন কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন, যাতে গণপ্রতিনিধিরা কক্ষে প্রবেশ করতে না পারেন। ফলে ক্রুদ্ধ জনপ্রতিনিধিরা মিরাবো ও আবে সিয়েসের নেতৃত্বে সভাকক্ষের পার্শ্ববর্তী টেনিস খেলার মাঠে জমায়েত হয়ে শপথ করেন ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনা ও সুশাসন প্রবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবেন। এই ঘটনা টেনিস কোর্টের শপথ নামে পরিচিত।
তাৎপর্য : টেনিস কোর্টের শপথের সময় ১৩৯ জন যাজক এবং ৪৭ জন অভিজাত থার্ড এস্টেটে যোগদান করেন। ফলে প্রথম দুই এস্টেট গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং ফরাসি জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করে তৃতীয় সম্প্রদায়। তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের মাথাপিছু ভোট, নতুন সংবিধান রচনা ও তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশনের দাবি সম্রাট ষোড়শ লুই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হন। ফলে বুর্জোয়া শ্রেণি নিজেদের স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হয় এবং ফরাসি বিপ্লবের পথ সুগম হয়।
অথবা, ট্রাফালগারের যুদ্ধ : ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের সঙ্গে নীলনদের যুদ্ধে (১৭৯৮ খ্রি) পরাজিত হলে ইংল্যান্ডের প্রতি তার আক্রোশ সৃষ্টি হয়। তারই ফলস্বরূপ ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ২১ অক্টোবর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। অ্যামিয়েন্সের শর্তানুযায়ী (১৮০২ খ্রি) ইংরেজরা ‘মাল্টা’ দ্বীপ ফ্রান্সকে দিতে রাজি না হওয়ায় উভয়ের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়। আবার ইংল্যান্ডের সংবাদপত্রগুলি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে অনবরত অপপ্রচার চালাতে থাকলে নেপোলিয়ন ক্রুদ্ধ হন এবং উভয় শক্তির মধ্যে সংঘাত বাধে। ব্রিটিশ নৌবহর ফরাসি বাণিজ্যপোতের ওপর আক্রমণ হানলে (১৮০৩ খ্রি) নেপোলিয়ন এর প্রতিবাদে ফ্রান্সে ভ্রমণকারী ১০০ ইংরেজকে আবদ্ধ করেন। এই পরিস্থিতিতে নেপোলিয়ন ইংলিশ চ্যানেল ও উত্তর সমুদ্রের তীরে ২ লক্ষ ১০ হাজার সেনা সমাবেশ করেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের উদ্যোগে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও সুইডেনকে নিয়ে ফ্রান্স বিরোধী তৃতীয় শক্তিজোট গঠিত হয় এবং ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে ইংরেজ নৌ-সেনাপতি নেলসন ফরাসি নৌ-সেনাপতি ভিলনেউভকে পরাজিত করেন এবং ফ্রান্সের নৌবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।
গুরুত্ব : ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে ফ্রান্সের তুলনায় ব্রিটিশ নৌবাহিনী অনেক শক্তিশালী, দক্ষ তা প্রমাণিত হয়। ও এই যুদ্ধে ফরাসি নৌবহর সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ায় ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডকে প্রতিহত করা ফ্রান্সের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ও নেপোলিয়ন সুবিশাল ফরাসি সাম্রাজ্য গড়ে তোলার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা ট্রাফালগারের নৌযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। • ট্রাফালগারের যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের ফলে ইউরোপে নেপোলিয়নের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে নষ্ট হয়ে পড়ে।
(ii) মেটারনিখ ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণ : ১৮১৫ থেকে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের সর্বত্র মেটারনিখের আধিপত্য বজায় ছিল। কিন্তু ১৮৩০ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ‘মেটারনিখ পদ্ধতি দ্রুত শিথিল হতে থাকে। নানা কারণে মেটারনিখতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল (১) মেটারনিখ পদ্ধতি ছিল রক্ষণশীলতার সমর্থক ও যুগধর্ম বিরোধী। সমকালীন যুগের জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও উদারনৈতিক ভাবধারাকে অস্বীকার করে তিনি পুরাতনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। (২) মেটারনিখ পদ্ধতির মধ্যে দূরদর্শিতার যথেষ্ট অভাব ছিল। তিনি বুঝতে পারেননি যে শিল্পবিপ্লব এবং তার ফলস্বরূপ নগরের প্রসার, জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি এবং বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান ইউরোপীয়দের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। (৩) ফরাসি বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক দিকের প্রতি মেটারনিখের দৃষ্টি পড়েছিল। বিপ্লবের গঠনমূলক দিকগুলি তিনি দেখতে পাননি। (৪) মেটারনিখ পদ্ধতি ছিল নেতিবাচক, সংকীর্ণ, দমনমূলক, সংস্কার বিরোধী এবং সুবিধাবাদী। (৫) মেটারনিখ ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থা রজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। পিডমন্ট, স্পেন, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশের আন্দোলনকে তিনি সেনাবাহিনী বা পুলিশবাহিনী দিয়ে দমন করার চেষ্টা করেন, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। (৬) মেটারনিখ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইউরোপের সব দেশ সহযোগিতা করেনি। মেটারনিখ দমনপীড়ন ও অত্যাচারের মাধ্যমে তাঁর নীতি বাস্তবায়িত করেছিলেন। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে এইভাবে মানুষের মনে ভীতি উৎপন্ন করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদি জনসমর্থন লাভ করা যায় না। শেষপর্যন্ত ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আঘাতে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে।
অথবা, মহাদেশীয় অনরোধ ব্যবস্থা : ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইংল্যান্ডের সামুদ্রিক বাণিজ্যকে স্তব্ধ করে তার সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিপর্যস্ত করার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মোট চারটি ডিক্রি (বার্লিন, মিলান, ওয়ারশ, ফন্টেন্যু) জারি করে যে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলেন, তাকেই মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা’ বলা হয়। নেপোলিয়ন তাঁর সেনাপতি মন্ট জেলার্ডের অর্থনৈতিক অবরোধের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে মহাদেশীয় ব্যবস্থার ছক তৈরি করেন।
বার্লিন ডিক্রি : ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ নভেম্বর নেপোলিয়ন ‘বার্লিন ডিক্রি জারি করে বললেন যে, ফ্রান্সের বন্দরগুলিতে ইংল্যান্ড বা তার উপনিবেশগুলি থেকে আগত কোনো জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি ইংল্যান্ডে উৎপাদিত শিল্পজাত সামগ্রীও অন্য কোনো দেশের জাহাজে করে ইউরোপে আনলে তা বাজেয়াপ্ত হবে।
অর্ডারস-ইন-কাউন্সিল : ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড বার্লিন ডিক্রির জবাব হিসেবে ‘অর্ডারস-ইন-কাউন্সিল’ জারি করে বলে যে, ইউরোপের কোনো রাষ্ট্র ফ্রান্স বা ফ্রান্স অধিকৃত বন্দরে পণ্যসামগ্রী পাঠালে তা বাজেয়াপ্ত হবে। এই ঘোষণায় আরো বলা হয় যে, নিরপেক্ষ দেশের জাহাজ ব্রিটিশ বন্দরে এসে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত শুল্ক প্রদান করার পর ফ্রান্স ও তার মিত্র দেশগুলিতে যেতে পারবে।
মিলান ডিক্রি ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইংল্যান্ডের ‘অর্ডারস-ইন- কাউন্সিল’-এর পালটা ব্যবস্থা হিসেবে ‘মিলান ডিক্রি’ জারি করে বলেন যে, অর্ডারস-ইন-কাউন্সিল মান্যকারী যে-কোনো দেশের জাহাজ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
ওয়ারশ ডিক্রি ও ফন্টেনব্যু ডিক্রি : নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ওয়ারশ ডিক্রি (১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ) ও ফন্টেনব্যু ডিক্রি (১৮১০ খ্রিস্টাব্দ) জারি করে বলেন যে, নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার অপরাধে ফ্রান্স অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে ব্রিটিশ পণ্যবাহী জাহাজ প্রবেশ করলে ব্রিটিশ পণ্য . বাজেয়াপ্ত হবে এবং তাতে প্রকাশ্যে অগ্নিসংযোগ করা হবে।
ইংল্যান্ডের সর্বনাশ করতে গিয়ে নেপোলিয়ন মহাদেশীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন। পরিশেষে তাই বলা যায় যে, নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা তার পতনকে কেবল ত্বরান্বিতই করেনি, অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।
(iii) ফ্রান্সের আর্থিক অবস্থা ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ফ্রান্সের রাজস্বব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তা ছাড়া সরকারের অমিতব্যয়িতা, বিলাসিতা, ব্যয়সংকোচে অনিচ্ছা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ফ্রান্সের পরিস্থিতিকে ভয়ংকর করে তুলেছিল। এইসব কারণে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তৎকালীন ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ বলেছেন।
ত্রুটিপূর্ণ করব্যবস্থা : ফ্রান্সে কর আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো ন্যায়সংগত নীতি ছিল না। অভিজাত ও যাজকরা ছিলেন ফ্রান্সের বেশিরভাগ জমির মালিক। অথচ তারা কর দিতেন সরকারের আয়ের মাত্র ৪%। আর মোট রাজস্বের ৯৬% দিতে হত দরিদ্র কৃষকদের।
সরকারের বেহিসাবি অর্থব্যয় : ফ্রান্সের রাজাদের বেহিসাবি অর্থব্যয়ের ফলে ফ্রান্সের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। 
যুদ্ধনীতির অযৌক্তিকতা : চতুর্দশ লুই ও পঞ্চদশ লুইয়ের আমলে বিভিন্ন যুদ্ধে যোগদানের ফলে ফ্রান্সের প্রচুর অর্থব্যয় হয়েছিল, যা ফরাসি অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়।
রাজকোশে সংকট : উপরোক্ত কারণে বিপ্লব-পূর্ব ফ্রান্সের রাজকোশে সংকট দেখা যায়। ষোড়শ লুইয়ের সময়ে তুর্গো, নেকার প্রমুখ অর্থমন্ত্রী অভিজাতদের বিরোধিতায় আর্থিক সমস্যা সমাধানের কাজটি সঠিকভাবে করতে না পারায় রাজকোশ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে।
অর্থনৈতিক সংকট : জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদির ফলে প্রাক্-বিপ্লব পর্বে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শস্যহানি ঘটলে এই সংকট আরও প্রবল হয়। ফ্রান্সের এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় কালক্রমে ফরাসি বিপ্লব সংগঠনে ইন্ধন জুগিয়েছিল।
অথবা, ভূমিকা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের, ২৮ জুন) মিত্রশক্তিবর্গের সঙ্গে জার্মানির ‘ভার্সাই চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির দলিলে জার্মানিকে ‘যুদ্ধ অপরাধী’ ঘোষণা করে অর্থনৈতিক শর্তাবলি আরোপ করা হয়, যাকে জার্মান জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা জবরদস্তিমূলক চুক্তি’ বলে উল্লেখ করেছেন।
উদ্দেশ্য : ভার্সাই চুক্তির অর্থনৈতিক শর্তাবলির মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির অর্থনীতিকে দুর্বল করা। ও ইউরোপের রাজনীতিতে জার্মানি যাতে ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা।
অর্থনৈতিক শর্তাবলি : (১) জার্মানির ওপর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৬৬০ কোটি পাউন্ড অর্থের বোঝা চাপানো হয়। (২) জার্মানির মোট ৬৭টি কয়লাখনির মধ্যে ৫৩টি, ১৬টি জিঙ্ক এবং ১১টি সিসার খনি পোল্যান্ডের অধীনে থাকবে। (৩) ইটালি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গ প্রভৃতি রাষ্ট্রকে বাধ্যতামূলকভাবে লোহা, কাঠ, রবার ইত্যাদি জোগান দেওয়ার দায়িত্ব জার্মানিকে দেওয়া হয়। (৪) জার্মানির বড়ো আকারের বাণিজ্যিক বন্দরগুলি ফ্রান্স এবং যুদ্ধজাহাজগুলি ইংল্যান্ড পাবে। (৫)জার্মানির এলবা, ওডার, রাইন, দানিয়ুব প্রভৃতি নদী আন্তর্জাতিক শাসনাধীনে থাকবে, যাতে সুইটজারল্যান্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়ার মতো দেশগুলির সমুদ্রপথে যোগাযোগ সহজ হয়। (৬) জার্মানি মিত্রপক্ষকে পাঁচ হাজার রেলওয়ে ইঞ্জিন ও দেড়লক্ষ মোটরগাড়ি প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। (৭) জার্মানির বাইরে বসবাসকারী জার্মান নাগরিকদের সম্পত্তি মিত্রশক্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
(iv) অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্স সর্বাপেক্ষা ঐশ্বর্যশালী ও শক্তিশালী দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিল্পবিপ্লব প্রথম ঘটে ইংল্যান্ডে। এ বিষয়ে পণ্ডিতেরা নানা কারণের উল্লেখ করেছেন। যথা –
কৃষিবিপ্লব : অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও শ্রমিকদের জন্য সস্তায় খাদ্যের কোনো অভাব হয়নি।
মূলধন : শিল্পবিপ্লবের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হল মূলধন বা পুঁজি। সপ্তদশ শতক থেকে ব্যাবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে এক শ্রেণির মানুষের হাতে সঞ্চিত পুঁজি বা মূলধন শিল্পে বিনিয়োগের প্রবণতা দেখা দেয়।
বিশ্বব্যাপী বাজার : এই সময় ইংল্যান্ডের কৃষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পেলে তাদের শিল্পপণ্য কেনার ক্ষমতা বাড়ে। তা ছাড়া ইংল্যান্ডের উপনিবেশগুলিও তাদের পণ্যবিক্রির একচেটিয়া বাজারে পরিণত হয়।
সুলভ শ্রমিক : সপ্তদশ শতক থেকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এই সময় থেকে ইউরোপের বহু শ্রমিক রুজি-রোজগারের খোঁজে ইংল্যান্ডে আসতে শুরু করলে শ্রমিকের জোগান সহজলভ্য হয়। এই সুলভ শ্রমিক শিল্পবিপ্লবের সহায়ক হয়।
প্রাকৃতিক পরিবেশ : প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে কয়লা, লোহা, টিন ও তামা পাওয়া যেত। ইংল্যান্ডের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া বস্ত্রশিল্পের উপযোগী ছিল। প্রাকৃতিক বন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রচুর নদীনালা থাকায় কাঁচামাল ও পণ্য চলাচলে অনেক সুবিধা হয়।
বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আবিষ্কার : এই অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বেশ কিছু যন্ত্রপাতির সময়োপযোগী আবিষ্কার, যা শিল্পবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। ইংল্যান্ডে বয়নশিল্পকে কেন্দ্র করে প্রথম যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন শুরু হয়। জন কে-এর ‘উড়ন্ত মাকু”, হারগ্রিভস-এর “স্পিনিং জেনি’, আর্করাইট-এর ‘ওয়াটার ফ্রেম’, কার্টরাইট-এর ‘মিউল’, জেমস ওয়াট-এর ‘বাষ্পীয় ইঞ্জিন’, হামফ্রে ডেভি-এর ‘সেফটি ল্যাম্প’ প্রভৃতি আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব শুরু হয়।
অথবা, ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে টিলসিটের সন্ধি দ্বারা ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্ব হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অতঃপর ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন।

নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের কারণ : 

যুদ্ধের কারণ : জার আলেকজান্ডারের পক্ষ থেকে :
নেপোলিয়ন সম্পর্কে জারের মোহভঙ্গ : টিলসিটের সন্ধি স্বাক্ষরের পর জার আশা করেছিলেন সুইডেন, পোল্যান্ড ও তুরস্কে রাশিয়া সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ পাবে। নেপোলিয়ন সুইডেন ও তুরস্কের বিরুদ্ধে জারকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পালন করেননি। 
গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ : নেপোলিয়ন প্রাশিয়া অধিকৃত পোল্যান্ডের অংশ নিয়ে গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ গঠন করেন। পরে অস্ট্রিয়ার গ্যালিসিয়া দখল করে এর সঙ্গে যুক্ত করেন। এতে রাশিয়ার ধারণা হয় নেপোলিয়ন স্বাধীন পোল্যান্ড রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করছেন। 
মহাদেশীয় ব্যবস্থা : নেপোলিয়নের কথামতো রাশিয়া মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা মেনে নেয়। এতে রাশিয়া প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রাশিয়ার জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় জার ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াকে ব্রিটিশ বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। 
ওল্ডেনবার্গ দখল: রাশিয়ার জারের ভগ্নীপতি ছিলেন ওল্ডেনবার্গের ডিউক। তিনি মহাদেশীয় ব্যবস্থা অমান্য করলে নেপোলিয়ন তাঁর রাজ্য দখল করেন। এই ঘটনায় জার ও রুশ অভিজাতরা নেপোলিয়নের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। 
নেপোলিয়নের পক্ষ থেকে: নেপোলিয়ন গোপনসূত্র দ্বারা সংবাদ পান যে, ফ্রান্স আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে রুশ প্রশাসন এবং রাশিয়া সুইডেনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে সুইডেনকে পাশে পাওয়ারও চেষ্টা করছে। নেপোলিয়ন গোপন সূত্রে আরও খবর পান যে, রাশিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের যুদ্ধ হলে অস্ট্রিয়া নিরপেক্ষ থাকবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ক্ষুব্ধ হয়ে নেপোলিয়ন রাশিয়া অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে গ্র্যান্ড আর্মি নিয়ে রাশিয়া অভিযান করেন। 
(v) জার প্রথম নিকোলাস-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আলেকজান্ডার জার হিসেবে সিংহাসনে বসেন (১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে)। দ্বিতীয় আলেকজান্ডার পিতার মতো স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ এবং প্রজাকল্যাণকামী শাসক।

দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের কার্যাবলি : 

স্বৈরাচারী শাসন এবং ভূমিদাসপ্রথাই যে রাশিয়ার অবক্ষয়ের প্রধান কারণ – এই সত্য জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে তিনি রাশিয়ার উন্নতিসাধনে তৎপর হন।
উদারনৈতিক ব্যবস্থা : দ্বিতীয় আলেকজান্ডার জার নিকোলাসের আমলের দমননীতিকে রদ করেন, বিদ্রোহীদের নির্বাসনদণ্ড মকুব করেন, গুপ্তচর বাহিনী ভেঙে দেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন।
ভূমিদাসপ্রথার বিলোপ সাধন : ভূমিদাসরা (সাফ) রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের মেরুদণ্ডস্বরূপ ছিল। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ছিল সার্ফ সম্প্রদায়ভুক্ত। সার্ফদের জীবন ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। এই .. সার্ফদের মুক্তিদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি মুক্তির ঘোষণাপত্র’ (Edict of Emancipation) -তে স্বাক্ষর করেন। ফলে রাশিয়া থেকে ভূমিদাসপ্রথার অবসান হয়। ভূমিদাসদের দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে তিনি ‘মুক্তিদাতা জার’ (Czar Liberator) নামে খ্যাত।
বিচারবিভাগীয় সংস্কার : জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অনুকরণে বিচারবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসাধন করেন। শাসনবিভাগ থেকে বিচারবিভাগকে পৃথক করা হয়।
শাসনবিভাগীয় সংস্কার : তিনি সমগ্র রাশিয়াকে ৩৫০টি জেলায় বিভক্ত করে প্রত্যেক জেলায় জেমস্টোভো (Zemstvo) নামে একটি কাউন্সিল বা প্রাদেশিক সভা গঠন করেন। শিক্ষা ও শিল্পের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি আনার চেষ্টা করেন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের এই সংস্কারগুলি ছিল প্রায় নিষ্ফল। সংস্কারগুলি রূপ লাভ করেছিল অনেক বিলম্বে। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চালু থাকায় সংস্কারের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছোয়নি। আইনগতভাবে ভূমিদাসপ্রথা লোপ পেলেও গ্রাম্য সমবায় বা ‘মির’-দের আধিপত্য বজায় থাকে। তবুও বলতে হয়, এই সংস্কারগুলি ছিল ইতিবাচক এবং রাশিয়ার বদ্ধ সমাজে খোলা বাতাসের ন্যায়।
অথবা, ইটালির ঐক্য আন্দোলনে যে সকল ব্যক্তি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুর। ইটালির ঐক্য আন্দোলনে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল ধারার প্রবর্তক। ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি ম্যাৎসিনির নীতি পরিত্যাগ করে একটি স্বতন্ত্র নীতি গ্রহণ করেন।
ক্যাভুরের নীতি : ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ক্যাভুর বিদেশি শক্তির সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি মনে করতেন, একমাত্র বিদেশি শক্তির সাহায্যেই ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে। ইটালির এই ঐক্য সংগ্রামে পিডমন্ট রাজ্যের নেতৃত্বকে বাস্তব ও সঠিক পন্থা বলে মনে করতেন তিনি। এজন্য তিনি পিডমন্টকে জাতীয় আন্দোলনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন। এরপর তিনি ইউরোপীয় দেশগুলির সহানুভূতি লাভের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষে যোগদান করেন। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে তিনি ঐক্য আন্দোলনে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি লাভে সক্ষম হন।
প্লোমবিয়ার্সের চুক্তি : ইটালি থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে ক্যাভুর ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সঙ্গে প্লোমবিয়ার্সের চুক্তি স্বাক্ষর করেন (১৮৫৮ খ্রি)। এর দ্বারা স্থির হয় অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্রান্স পিডমন্টকে সামরিক সাহায্য দেবে এবং বিনিময়ে স্যাভয় ও নিস পাবে। তৃতীয় নেপোলিয়নের সাহায্যেই তিনি অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে মধ্য ইটালিকে সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হন।
এইভাবে ক্যাভুরের প্রচেষ্টায় মধ্য ইটালির ঐক্য সফল হয়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ ইটালির সংযুক্তির ক্ষেত্রেও ক্যাভুরের অবদান ছিল। তাঁর নির্দেশে গ্যারিবল্ডি রাজা ইমান্যুয়েলের আনুগত্য স্বীকার করলে উত্তর ও দক্ষিণ ইটালির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়। এই কারণে ক্যাভুরকে ইটালির ঐক্য আন্দোলনের মস্তিষ্ক’ বলা হয়।
(vi) মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেসব বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের সেরাজেভো হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন বলেছেন যে, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে যে ঘটনাবলির সূচনা হয়, তার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
কারণ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলিকে আমরা দু-ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি প্রত্যক্ষ কারণ ও পরোক্ষ কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড।

প্রত্যক্ষ কারণ সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড : 

সেরাজেভো হল বসনিয়ার রাজধানী। অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ ও তাঁর পত্নী সোফিয়া সেরাজেভো শহরে পরিভ্রমণে এসেছিলেন। এখানে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন স্লাভ বিপ্লবী সংগঠন ‘ব্ল্যাক হ্যান্ড’ (Black Hand)-এর সদস্য গাৱিলো প্রিন্সিপ (Gavrilo Princip) যুবরাজ ও যুবরানিকে হত্যা করে। এই ঘটনা ‘সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত।
এই ঘটনার জন্য অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং এক চরমপত্র দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার শর্তপূরণ করতে বলে। কিন্তু সার্বিয়ার পক্ষে সব দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
এতে অস্ট্রিয়া ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সার্বিয়ার পক্ষে রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার পক্ষে জার্মানি, তুরস্ক, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশ যোগদান করলে উক্ত যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।
অথবা, উগ্র জাতীয়তাবাদ : একটি জাতির জাতীয়তাবাদ অনেক সময় সংকীর্ণ রূপ ধারণ করে। তখন তারা নিজের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগুলিকে নিকৃষ্ট বলে মনে করে। এইরূপ জাতীয়তাবাদকে উগ্র জাতীয়তাবাদ’ বলা হয়।
আন্তর্জাতিকতাবাদ : বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ফলে মানুষের মধ্যে এক বিশেষ মানসিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। মানুষ তার নিজের ঐক্যবোধ ও আনুগত্যকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে যখন বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়, তখন সেই ব্যাপক মানসিকতাকে ‘আন্তর্জাতিকতাবাদ’ বলা হয়।
পার্থক্য :
(১) উগ্র জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ জাত্যাভিমানকে উৎসাহিত করে। এইরকম জাত্যাভিমানযুক্ত জাতি বিশ্বাস করে যে তার ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আন্তর্জাতিকতাবাদ বিভিন্ন জাতির ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে। (২) উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিতে জাতিতে যুদ্ধের সূচনা করে, যুদ্ধকে সমর্থন করে। সবল জাতি দুর্বল জাতির স্বাধীনতা ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে। আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতির স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে এবং বিশ্ব সমাজের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে। (৩) উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্‌বুদ্ধ রাষ্ট্রনেতাগণ আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়নীতিকে অবজ্ঞা করে বা তার বিরোধী আচরণ করে। আন্তর্জাতিকতাবাদ আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়নীতি মেনে চলার শিক্ষা দেয়। (৪) উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিবিদ্বেষ বৃদ্ধিতে উসকানি দেয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকতাবাদ নানা জাতির মধ্যে বিরোধ ও বিদ্বেষের অবসান ঘটিয়ে পারস্পরিক সুসম্পর্ক এবং সহাবস্থানের আদর্শ প্রচার করে। (৫) বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটার পেছনে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাই উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়াবহ গ্রাস থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রসার খুবই প্রয়োজনীয় বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
৪ (i) ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাত্র ২০ বছর পরে এই যুদ্ধ আরম্ভ হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অপেক্ষা এটি অনেক বেশি হিংসাত্মক ও বিভীষিকাময় ছিল। বহু ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে নানান কারণে এই যুদ্ধের সূচনা হয়।
অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি : জবরদস্তিমূলক ভার্সাই সন্ধির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। মিত্রপক্ষ জার্মানিকে যুদ্ধ অপরাধী চিহ্নিত করে জার্মানির ওপর বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল এবং জার্মানির শিল্প, বাণিজ্য, নৌশক্তি ও সামরিক শক্তিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল।
ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল উপনিবেশ দখলের লড়াই। ভার্সাই সন্ধির ফলে জার্মানি তার উপনিবেশগুলি থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ তাদের শিল্প ও কারখানার প্রয়োজনে প্রচুর কাঁচামাল ও বাজারের দরকার। মিত্রশক্তিবর্গের বিমাতৃসুলভ আচরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করেছিল।
নিরস্ত্রীকরণ নীতির ব্যর্থতা : সুইটজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বিশ্বের প্রথম নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে উপস্থিত সদস্য রাষ্ট্রগুলির সকলেই জার্মানির অস্ত্র হ্রাসের কথা বললেও, নিজেদের অস্ত্র হ্রাসের প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। ফলে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে অস্ত্রসজ্জায় মনোযোগ দেয়।
ইঙ্গ-ফরাসি তোষণনীতি : মিত্রশক্তির প্রধান দুই স্তম্ভ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত তোষণনীতি কার্যকর রেখেছিল। হিটলারের প্রচেষ্টায় জার্মানির সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, অস্ট্রিয়া, রাইনল্যান্ড, সুদেতান সহ চেকোশ্লোভাকিয়া দখলে পরোক্ষভাবে উৎসাহ জুগিয়েছিল ইঙ্গ-ফরাসি তোষণনীতি। ঐতিহাসিক এ জে পি টেলর ইঙ্গ-ফরাসি তোষণনীতিকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখেছেন।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ গঠিত হয়। কিন্তু বাস্তবে জাতিসংঘ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। জার্মানি, জাপান, ইটালি, রাশিয়া এই সংঘ থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে আবার এক বিশ্বযুদ্ধের মাদল বেজে ওঠে।
সামরিক প্রতিযোগিতা : ইঙ্গ-ফরাসি নীতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যেভাবে জাপান, জার্মানি, ইটালি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছিল তাতে আতঙ্কিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডও একই নীতি নেয় যা সামরিক ভারসাম্য নষ্ট করেছিল।
হিটলারের পররাষ্ট্রনীতি : হিটলার আনশ্লুস নীতির মাধ্যমে অস্ট্রিয়া দখল করেন। চেকোশ্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে সুদেতান অঞ্চলে অত্যাচারের মিথ্যা অভিযোগ এনে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নির্লজ্জ মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে প্রথমে সুদেতান দখল করেন এবং এরপর চুক্তি অমান্য করে ৬ মাসের মধ্যে পুরো চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করেন। ফলে যুদ্ধ প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল।
পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট গঠন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট গঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছিল। একদিকে জার্মানি, ইটালি, জাপান এই অতৃপ্ত রাষ্ট্রগুলি রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি গঠন করেছিল অপরদিকে জোটবদ্ধ হয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স গঠন করেছিল মিত্রশক্তি। যুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যোগদান করে মিত্রশক্তিকে আরও জোরদার করেছিল। এই দুই শক্তিজোটের পারস্পরিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ষড়যন্ত্র বিশ্বযুদ্ধের মতো জটিল অবস্থা তৈরি করেছিল।
প্রত্যক্ষ কারণ : হিটলার কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ। হিটলার ইঙ্গ-ফরাসি জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ চিরশত্রু সোভিয়েতের সঙ্গে প্রথমে গোপনে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন কারণ তিনি পোল্যান্ড আক্রমণকালে রুশ নিরপেক্ষতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। জার্মান অধ্যুষিত ডানজিগ বন্দরে যাওয়ার জন্য হিটলার পোলিশ করিডর দাবি করলে পোল্যান্ড তা মানতে অস্বীকার করে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন কমন্স সভার অনুমতিক্রমে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
(ii) পৃথিবীর যুগান্তকারী ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম হল ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত রুশ বিপ্লব। রাশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে এই বিপ্লবের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য।

রুশ বিপ্লবের প্রভাব :

রাজনৈতিক প্রভাব : রুশ বিপ্লব রাশিয়ায় জারের স্বৈরতন্ত্র, অভিজাতবর্গের বিশেষ অধিকার এবং যাজকদের প্রাধান্যের বিলোপ ঘটিয়ে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে রাশিয়াতেই সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ায় ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ চালু হয়েছিল। কারণ রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার জনসাধারণ বলশেভিক সরকারের সপক্ষে এলেও অভিজাত, যাজক ও বিত্তশালী শ্রেণিগুলি বলশেভিক সরকারের বিরোধী হয়ে ওঠে। এর ফলে রাশিয়ায় প্রতিবিপ্লবের ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ শুরু হয়।
অর্থনৈতিক প্রভাব : রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ব্যক্তিগত মালিকানা ও ব্যক্তিগত মুনাফার নীতি পরিত্যক্ত হয় এবং বিনা ক্ষতিপুরণে কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করে শ্রমিকদের হাতেই পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কৃষিক্ষেত্রে জমিদারদের থেকে জমি কেড়ে নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এইভাবে রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ন্যায্য বণ্টন ব্যবস্থার প্রচলন করে রুশবাসীর অর্থনৈতিক উন্নতির চেষ্টা করা হয়।
সামাজিক প্রভাব : রুশ বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ায় বসবাসকারী অ-রুশ জাতিগুলিকে সমমর্যাদা ও সমান অধিকার প্রদান করে রুশ জীবনের অংশীদার করে তোলা হয়। মার্কস-এঙ্গেলসের সাম্যবাদের বাস্তব প্রয়োগ ঘটে রাশিয়ায়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব প্রচলিত সমাজকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল।
আন্তর্জাতিক প্রভাব : ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বা বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য শুধুমাত্র রাশিয়াতেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। —
ঔপনিবেশিক আন্দোলনে প্রভাব : ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবে বলশেভিক দলের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবিরোধী মুক্তি আন্দোলন শুরু হয় এবং চিন ও ভারত-সহ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা : রুশ বিপ্লবের প্রভাবে বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা হয়। বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলনের মধ্যে সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে লেনিনের উদ্যোগে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মস্কোতে তৃতীয় আন্তর্জাতিক (Third International) বা কমিন্টার্ন (Comintern) প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব : রুশ বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্র চ্যালেঞ্জ জানায়। এর ফলে বিশ্ব রাজনীতি পুঁজিপতি ও সমাজতান্ত্রিক এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন রাজবংশের পতন : রুশ বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ায় রোমানভ রাজবংশ, জার্মানিতে হোহেনজোলার্ন রাজবংশ, অস্ট্রিয়ায় হ্যাপসবার্গ রাজবংশের পতন ঘটে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
শ্রমিক শোষণে অব্যাহতি : ইউরোপে সাম্যবাদী ভাবধারার গতিরোধ করার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন প্রবর্তন করে শ্রমিক শোষণ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়।
(iii) Baita MN High School (HS)-এর 5.(ii)-এর প্রথম অংশের উত্তরটি দেখুন।

Leave a Comment