Bankura Zilla School
১.১ “সেই জন্যেই গল্প বানানো সহজ হলো।” – বক্তা হলেন (গ) সোমেশ।
১.২ “সঙ্গে সঙ্গে আর একজনকে মনে পড়িতেছে” – ‘একজন’ হলেন (খ) হীরু।
১.৩ সভ্যতার নব নব তৃয়া (ঘ) ক্ষুধা।
১.৪ পঞ্চবটী বনে থাকে না। (ঘ) চন্দন।
১.৫ আমরা (খ) মারী নিয়ে ঘর করি।
১.৬ “চল রে গাঁটকাটা” • একথা বলেছে – (গ) দুই রক্ষী।
১.৭ হিমালয় রেল রোড আরম্ভ হয়েছে – (ক) শিলিগুড়ি থেকে।
১.৮ ভুটিয়ানিরা আপন পরিচয় দেয় (ঘ) পাহাড়নি বলে।
১.৯ “তা তোর জীবিকা বেশ পবিত্র বলতে হয় দেখছি।” উক্তিটির বক্তা – (গ) শ্যালক।
১.১০ স্বর্ণপর্ণীর বা সোনোপত্তির খবর দিয়েছিলেন (গ) টিক্ড়ীবাবা।
১.১১ সন্ডার্স শঙ্কুর বাক্সে মিরাকিউরল-এর পরিবর্তে যে ওষুধ রাখেন তা হল – (ঘ) সেকোন্যাল।
১.১২ লিঙ্গুয়াগ্রাফ হল (ঘ) অচেনা ভাষা ইংরেজিতে অনুবাদ করার যন্ত্র।
১.১৩ ছেলের দল প্রতিদিন নদীতে স্নান করতে যেত – বাক্যটিতে ক্রিয়ার – (খ) নিত্যবৃত্ত অতীত কাল বোঝাচ্ছে।
১.১৪ আলংকারিক অব্যয় বাক্যের 1 (খ) সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
১.১৫ – নবম শ্রেণি—এখানে ‘নবম’শব্দটি—(ঘ) পূরণবাচক বিশেষণ।
১.১৬ ‘হরতাল’ শব্দটি যে ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে তা হল – (ক) গুজরাটি শব্দ।
১.১৭ ‘Portmanteau word’ কথাটির আভিধানিক অর্থ হল – (ক) জোড়কলম শব্দ ।
১.১৮ যে শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের সঙ্গে প্রচলিত অর্থের সম্পর্ক প্রায় নেই তাকে বলে – (গ) রুঢ় শব্দ।
১.১৯ ‘সাবাস’ শব্দটি – (গ) প্রশংসাসূচক অব্যয়।
১.২০ ‘জিজ্ঞাসা’ শব্দটির প্রকৃতি-প্রত্যয় করলে পাই – (গ) জ্ঞা + সন্ + অ + আ ।
২.১ কবি নজরুল আলোচ্য কবিতায় অগ্রদূতকে কারাগারের লোহার দরজা লোপাট করে, লাথি দিয়ে তালা ভেঙে কারাগারের ভিত্তি উপড়ে ফেলার কথা বলেছেন।
২.২ হজরত মহম্মদের খুড়তুতো ভাই তথা জামাতা হজরত আলিকে হায়দার বলা হয়। তিনি ছিলেন চতুর্থ খলিফা। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর উচ্চৈঃস্বরে হাঁক শুনে শত্রুপক্ষের রক্ত হিম হয়ে যেত বলে, রক্ত হিম করা সেই তেজোদৃপ্ত হাঁককে বলা হয় হৈদরী হাঁক।
২.৩ প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত ‘নিরুদ্দেশ’ গল্পে আশ্চর্য ব্যাপারটা হল খবরের কাগজে একসঙ্গে সাতটা নিরুদ্দেশ-এর বিজ্ঞাপন।
২.৪ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘চন্দ্ৰনাথ’ গল্পে চন্দ্রনাথ ও নরেশের সহপাঠী হীরু বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত পরীক্ষায় স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করে। ভালো ফল করায় সে স্কলারশিপ পাবে, সেই আনন্দেই ধনী পরিবারের সন্তান হীরুর বাড়িতে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়েছিল।
২.৫ বেগম রোকেয়া লিখিত ‘হিমালয় দর্শন’ রচনাংশে লেখিকা বলেছেন, তাঁর প্রাণ ভরে জলপ্রবাহ দেখার সাধ হয়েছিল। পথে ট্রেন একটি বড়ো ঝরনার কাছে থামে জল পরিবর্তন করার জন্য। সেই সুযোগে লেখিকার মনোরথ পূর্ণ হয়।
২.৬ ‘হিমালয় দর্শন’ গদ্যাংশের লেখিকা বেগম রোকেয়া বলেছেন যে তিনি ইতিপূর্বে সমুদ্র দেখতে আগ্রহী ছিলেন। বঙ্গোপসাগর দর্শন করে তাঁর সেই সাধ মিটলেও এর পরে তাঁর ইচ্ছা ছিল পর্বত দর্শন করার। কার্সিয়াং-এ পৌঁছে তাঁর সেই সাধ পূর্ণ হয়েছে।
২.৭ ‘ধীবর-বৃত্তান্ত’ নাট্যাংশটির প্রবাদবাক্যটি হল— “বেদজ্ঞ ব্রাক্ষ্মণ স্বভাবে দয়াপরায়ণ হলেও যজ্ঞীয় পশুবধের সময় নির্দয় হয়ে থাকেন।”
২.৮ চন্দ্রনাথকে লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
২.৯ পালযুগের দু’জন বিশিষ্ট শিল্পী ধীমান ও তাঁর পুত্র বিপাল বরেন্দ্রীয় অধিবাসী এবং স্থপতি ছিলেন।
২.১০ শঙ্কু কখনোই চাননি তাঁর আবিষ্কৃত মিরাকিউরল খেয়ে দু’জন পাষণ্ড হিটলার ও তার পার্শ্বচর গোয়রিং-এর রোগমুক্তি ঘটুক। শঙ্কুর বন্ধু সন্ডার্সও এই মহৌষধ বিশ্বের হীনতম প্রাণীর উপকারে আসবে, এটা চায়নি। তাই সে শঙ্কুর বাক্স খুলে শিশি থেকে মিরাকিউরল বার করে তার জায়গায় অব্যর্থ ঘুমের ওষুধ ‘সেকোন্যালের’ বড়ি ভরে দেয়। মিরাকিউরলে যে নাৎসিদের কোনো উপকারই হয়নি, তা জেনে, শঙ্কুর মন থেকে সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়।
২.১১ ‘মিরাকিউরল’ শব্দটির বাংলা অর্থ হল সর্বরোগনাশক বড়ি।
২.১২. বেড়ালকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রোফেসর শঙ্কু যে বড়ি আবিষ্কার করেছিলেন তার নাম মার্জারিন।
২.১৩ যৌগিক ক্রিয়াপদ : একটি অসমাপিকা ও একটি সমাপিকা ক্রিয়া মিলিত হয়ে যে ক্রিয়াপদ গঠন করে তাকে যৌগিক ক্রিয়াপদ বলে। যেমন— খেয়ে ফেলল। অসমাপিকা ক্রিয়া (খেয়ে) প্রাধান্য পায় বলে তা মুখ্যক্রিয়া এবং সমাপিকা ক্রিয়াটি (ফেলল) হয় গৌণ বা সহকারী ক্রিয়া।
২.১৪ একা দেখি কুলবধূ কে বট আপনি। – ‘বট্’ ধাতুটি হল এখানে পঙ্গু ক্রিয়ার উদাহরণ। ‘বট্’ ধাতুর বর্তমান ছাড়া অন্য কোনো কাল নেই।
২.১৫ খণ্ডিত শব্দ : যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শব্দের চেহারায় পরিবর্তন ঘটে এবং শব্দটি আকারে ছোটো হয়ে যায় অথচ শব্দের অর্থগত বা ব্যাকরণগত কোনো পরিবর্তন হয় না তাকে বলে। খণ্ডিত শব্দ । যেমন— টেলিফোন > ফোন, ছোটোকাকা > ছোটকা।
২.১৬ দ্বিকর্মক ক্রিয়ার উদাহরণ পড়াচ্ছেন। মাস্টারমশাই ছাত্রদের ব্যাকরণ ২.১৭ সাপেক্ষ সর্বনামের উদাহরণ – যত মত তত পথ।
২.১৮ পদান্বয়ী অব্যয় : বাক্যস্থ বিভিন্ন পদের মধ্যে অন্বয় বা সম্পর্ক স্থাপন করে যে অব্যয় তাকে পদান্বয়ী অব্যয় বলে। যেমন— সঙ্গে, নিমিত্ত, সহিত ইত্যাদি।
২.১৯ বর্তমান অনুজ্ঞা : যে ক্রিয়াপদ বর্তমান কালের কোনো অনুজ্ঞা অর্থাৎ আদেশ, অনুরোধ, প্রার্থনা, উপদেশ, আশীর্বাদ বোঝায় তাকে বর্তমান অনুজ্ঞা বলে। যেমন— মন দিয়ে শোনো।
২.২০ সন্দিগ্ধ অতীত : অতীতে কোনো কাজ ঘটছে কি না সন্দেহ আছে বোঝালে পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ কাল হয়। রূপে ভবিষ্যৎ (কেননা ফল অনিশ্চিত) অথচ অর্থে অতীত বলে এর অন্য নাম সন্দিগ্ধ অতীত। যেমন— হয়তো আমিই বলে থাকব।
৩.১ আলোচ্য উদ্ধৃতাংশটি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ‘আমরা’ কবিতার অংশবিশেষ।
” বাঙালি ভগবানকে প্রিয়জন মনে করে। হিন্দু ধর্মানুসারে মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা পরমাত্মা তথা ঈশ্বরে বিলীন হয়। বাঙালির কাছে মৃত আত্মীয় দেবতুল্য। ‘আকাশ প্রদীপ’ প্রসঙ্গে কবি এই ইঙ্গিত দিয়েছেন। কবিগুরু বলেছিলেন- ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।’ তাদের কাছে পিতা-মাতা-স্বজন সকলই ঈশ্বররূপে আরাধ্য। বাঙালি জীবনধারার এই প্রকাশে ‘ছন্দের জাদুকর’ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বাঙালির মহিমা প্রচারক ‘আমরা’ কবিতায় দেবতার আত্মীয়ের কথা বলেছেন।
৩.২ উদ্ধৃতাংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘খেয়া’ কবিতার অংশবিশেষ।
” আলোচ্য কবিতায় উল্লিখিত অখ্যাত গ্রামদুটি পরস্পরকে বহুদিন ধরে চেনে, জানে। তীরে অবস্থিত গ্রাম দুটির ব্যবধান মধ্যবর্তী বহমান নদীটুকু। গ্রাম দুটির মাঝে সংযোগ তথা সম্বন্ধ রক্ষা করে চলেছে খেয়াতরি; একই কিরণ গায়ে মেখে তারা তপ্ত হয়, একইসঙ্গে নামে সন্ধ্যার আঁধার – নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা যুগ যুগ ধরে। তারা পরস্পরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। যেমন জীবন চেয়ে থাকে মরণের দিকে কিংবা মরণ জীবনের দিকে।
৪.১ রবীন্দ্র-পরবর্তী বিখ্যাত ছোটোগল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘নিরুদ্দেশ’ গল্পের শোভন বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রায় দু-বছর পর হঠাৎ একদিন তার নিজের বাড়িতে হাজির হয়।
শোভন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে ছিল না। তাদের প্রাচীন জমিদারি অনেক দুর্দিনের ভিতর দিয়ে এসেও সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়নি। শোভন তার একমাত্র উত্তরাধিকারী। দীর্ঘ দু-বছরের স্বাধীন জীবনের দুঃখ-কষ্ট গ্রাহ্য না করলেও এর প্রভাব শোভনের উপর পড়েছে। তার চেহারাও অনেকখানি বদলে গিয়েছে। কিন্তু সে এতটা আশঙ্কা করতে পারেনি যে, তাদের বাড়ির কর্মচারীরা তাকে চিনতে পারবে না।
৪.২ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চন্দ্রনাথ’ গদ্যাংশে চন্দ্রনাথ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে স্কুলকে পত্র দেয়। কারণ সে বরাবর প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। এই সংবাদ প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে জানতে পারেন চন্দ্রনাথের পিতৃসম দাদা নিশানাথ। তিনি স্কুলে দেওয়া পত্রটি নিয়ে মুখোমুখি হন ভাইয়ের। বিনা ভূমিকায় চিঠি দেওয়ার কৈফিয়ত চান। চন্দ্রনাথ অত্যন্ত স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে বলে –
“আমি সেকেন্ড প্রাইজ রিফিউজ করেছি।” কারণস্বরূপ বলে “সেকেন্ড প্রাইজ নেওয়া আমি বিনিথ মাই ডিগ্নিটি বলে মনে করি।” ভাইয়ের এরূপ উত্তরে ক্ষোভে তিনি কাঁপছিলেন।
৫.১ সংস্কৃত সাহিত্যের মহাকবি কালিদাস রচিত ‘ধীবর-বৃত্তান্ত’ নাট্যাংশ থেকে উদ্ধৃত উক্তিটি নেওয়া হয়েছে। একথা নগর-রক্ষার দায়িত্বে থাকা দুই রক্ষী রাজ শ্যালককে উদ্দেশ করে বলেছেন।
ধীবরের কাছে প্রাপ্ত এই বহুমূল্য রত্নখচিত আংটিটি ছিল দুর্বাসার অভিশাপ খণ্ডনের জন্য, রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পরিচিতির একমাত্র স্মারক। আংটিটি রাজার ভীষণ প্রিয় ছিল। রাজ শ্যালকের কথন থেকে বুঝতে পারা যায় আংটিটি দেখে রাজার প্রিয়জন অর্থাৎ শকুন্তলার কথা মনে পড়ে। তাই মহারাজ খুশি হয়েছিলেন।
৫.২ আলোচ্য পক্তিটি মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটকের বাংলা অনুবাদ ‘ধীবর-বৃত্তান্ত’ শীর্ষক নাট্যাংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। নগর-রক্ষায় নিযুক্ত রাজ শ্যালক এবং এক দীন ধীবর পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হয়েছে।
রাজনামাঙ্কিত রত্নখচিত আংটি চুরির অপরাধে ধৃত ধীবরের কথার সত্যতা যাচাই করতে ও অপরাধীর শাস্তি জানতে রাজ শ্যালক রাজার কাছে গিয়েছিলেন। ধীবরের কথার সত্যতা নিরূপণ হওয়ায় রাজা তাকে পুরস্কৃত করে মুক্তির নির্দেশ দেন। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য এবং পারিতোষিকের পরিমাণ দেখে নগররক্ষীরা ঈর্ষান্বিত হয়। সামান্য ধীবর সেই পুরস্কারের অর্ধেক দিয়ে দেয় সেই রক্ষীদের যারা কিছু আগে ধীবরকে অপমান করেছিল। ধীবরের চরিত্রের সততা, দৃঢ়তা এবং উদারতা মুগ্ধ করেছিল রাজ-শ্যালককে। তাই তিনি তাকে ‘একজন বিশিষ্ট প্রিয় বন্ধু’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
৬.১ নামকরণ হল ‘সৃষ্টির ললাটে স্রষ্টার সংক্ষিপ্ততম অভিধা’। কবিতার নামকরণ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবিরা সাধারণত কবিতার বিষয় বা ভাব অনুযায়ী নামকরণ করে থাকেন। এসবকে ছাড়িয়েও নামকরণ কখনও ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে ওঠে।
‘খেয়া’ কবিতায় প্রথমদিকে দেখি, এক নাম না জানা নদী এবং তার দুই পার্শ্বে নাম না জানা দুখানি গ্রাম। খেয়া নৌকা দুই গ্রামের মানুষদের পারাপার করে। খেয়া নৌকাই দুই গ্রামের মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে, গড়ে তোলে আত্মীয়তার বন্ধন।
এরপর কবি তুলে ধরেন পৃথিবীতে লড়াই, দ্বন্দ্ব এবং সর্বনাশের চিত্র। দ্বন্দ্বের মাধ্যমে এক রাজার মুকুট অন্য রাজার মাথায় শোভা পায়। মানুষের জীবন সভ্যতা হয়ে ওঠে সংকটাপন্ন। কখনও দ্বন্দ্বের এই বীভৎস চিত্র বহন করে আনে বিষরূপী ধ্বংসকে, কখনও বা সুধারূপী সৃষ্টিকে।
এতক্ষণ নামকরণ, বিষয়ধর্মী বলে মনে হয়েছে। কিন্তু কবি আবার নাম না জানা দুইখানি গ্রামের কথা বলেছেন। খেয়া নৌকায় পারাপারের মধ্যে দিয়ে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে আত্মীয়তা, ঐক্য ও শান্তির সুর। খেয়া নৌকা যেন জীবনের বন্ধন সূচিত করে। নাগরিক জীবনের সেই লড়াই-দ্বন্দ্ব এই দুই গ্রামের মানুষের সম্প্রীতিতে চিড় ধরাতে পারে না। অটুট থাকে তাদের পারস্পরিক প্রেম, ভালোবাসা।
কবি তাঁর কবিতায় ‘খেয়া’র রূপকে বলতে চেয়েছেন জীবনের সঙ্গে জীবনের অকৃত্রিম বন্ধন হোক নাগরিক সভ্যতার মূলমন্ত্র। হিংসা, বিদ্বেষের পরিবর্তে তাদের মধ্যে গড়ে উঠুক স্নেহ, প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন। এই বন্ধন অতীত বর্তমানের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত হোক ভবিষ্যতের দিকে। নদীর জলস্রোতের মতো খেয়ার যাত্রী হয়ে মানবপ্রবাহ যেন বয়ে চলেছে পৃথিবীর পথে। তাই নামকরণ হয়ে উঠেছে ব্যঞ্জনাধর্মী এবং সার্থক।
৬.২ বঙ্গভারতীর সেবক সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘কুহু ও কেকা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আমরা’ কবিতায় বাঙালি জাতির অতীত-এর বিচিত্র প্রতিভার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণ করেছেন।
বাঙালির সাহস ও বীরত্ব : বাঙালি একসময় বাঘের সঙ্গে লড়াই করেছে, বিষধর সর্পকে অনায়াসে করেছে বশীভূত। বাঙালি চতুরঙ্গ সেনাবাহিনী সাজিয়ে যুদ্ধ করেছে “দশানন জয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে’। বাঙালির ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কা জয় করেছে। বাঙালি মগ দস্যু ও মোগল আক্রমণ প্রতিহত করেছে। চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে দিল্লির সম্রাটকে পিছু হটতে হয়েছে এসবই বাঙালির সাহস ও বীরত্বের পরিচয়।
দর্শন ও সাহিত্যে অবদান : বাংলার মাটিতে সৃষ্ট কপিলের সাখ্যদর্শন বাঙালি জাতির মূল্যবান কীর্তি। অতীশ দীপঙ্কর, তর্কযুদ্ধে জয়ী হওয়া রঘুনাথ বাঙালির গর্ব ও গৌরব। বাংলার কবি জয়দেবের কান্ত-কোমল পদাবলি রচনা, কীর্তন ও বাউল গান বাঙালির হৃদয় ও মনকে জয় করেছে।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পে গৌরব : স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও পটশিল্পে বাঙালি শিল্পীদের অবদান বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায়। বরভূধর ও শ্যাম কম্বোজের ‘ওঙ্কার-ধাম’ বাঙালির প্রাচীন কীর্তি। ধ্যানের ধনে মূর্তি গড়ে ভাস্কর শিল্পী বিপাল আর ধীমান আজও অমর। অজন্তায় বাঙালির পটশিল্পের নিদর্শন রেখেছেন কোনো বাঙালি পটশিল্পী।
বাঙালি সাধক ও সাধনা : মন্বন্তর ও মারীর কাছে বাঙালি হার মানেনি। বাঙালি আকাশ-প্রদীপ জ্বালে, দেবতাকে আত্মীয়রূপে ভজনা করে। বাঙালির অধ্যাত্ম সাধনার সিদ্ধিদাতা মানবপ্রেমিক শ্রীচৈতন্য এবং স্বামী বিবেকানন্দ।
বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা : আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিশ্বকে দিয়েছেন গবেষণালব্ধ মূল্যবান সম্পদ। এ সংগীত সাধনা : রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখ কবি ও গীতিকাররা বিশ্বমানবকে শুনিয়েছেন মহামিলনের গান। তাই কবি বলেছেন ‘বাঙালির কবি গাহিছে জগতে মহামিলনের গান,/ বিফল নহে এ বাঙালি জনম বিফল নহে এ প্রাণ।’ এইভাবে ‘আমরা’ কবিতায় কবি বাঙালি জাতির অতীত গৌরবের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন।
৭.১ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চন্দ্রনাথ’ কাহিনির নামচরিত্রটি চেহারায় ও স্বভাবে ছিল বলিষ্ঠ। কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলীর খঙ্গধারী বিশাল আকৃতির মতো চন্দ্রনাথের চেহারা ও ভঙ্গিমা ছিল দৃপ্ত। অন্ধকার অসীম আকাশের বুকে কালপুরুষ যেমন নিঃসঙ্গ, তেমনি জীবনের পথে চন্দ্রনাথও একা দৃপ্ত পদক্ষেপে পাড়ি দিয়েছিল। তাই তার সহপাঠী তথা আলোচ্য কাহিনির কথক নরেশ কালপুরুষ নক্ষত্রের সঙ্গে চন্দ্রনাথের তুলনা করে আনন্দ পায়। চন্দ্রনাথ দরিদ্র, মেধাবী ছাত্র। জীবনে সে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হওয়ার স্বাদ পায়নি, তাই স্কুলের অন্তিম পরীক্ষায় হীরুর প্রথম হওয়া সে মেনে নিতে পারেনি। প্রধান শিক্ষককে পত্র লিখে দ্বিতীয় পুরস্কার সে প্রত্যাখ্যান করেছে।
দাদা নিশানাথের শত শাসন ও অনুরোধেও সে প্রত্যাখ্যান পত্র ফিরিয়ে নেয়নি। হীরুর প্রথম হওয়ার নেপথ্যে এক সহশিক্ষকের পক্ষপাতিত্ব ছিল এবং হীরু নিজেও অসদুপায় অবলম্বন করেছিল। এসব কথা দাদাকে বিস্তারিতভাবে জানিয়ে চন্দ্রনাথ বলেছে, ‘সেকেন্ড প্রাইজ নেওয়া আমি বিনিথ মাই ডিগ্নিটি বলে মনে করি।’ এর জন্য দাদার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদকেও সে মেনে নেয়।
অতিরিক্ত আত্মসচেতনতা এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস তাকে অহংকারী ও উদ্ধৃত করে তুলেছিল। তাই প্রধানশিক্ষক ডেকে পাঠালেও সে দেখা করেনি। সে মনে করে ‘গুরুদক্ষিণার যুগ আর নেই’। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেও হীরুর প্রথম হওয়া এবং স্কলারশিপ পাওয়াকে চন্দ্রনাথ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই হীরুর বাড়ির উৎসবের দিনই গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে সে।
চন্দ্রনাথ চরিত্রটি নানা গুণের সমাবেশে আকর্ষণীয়। দু-একজনের অসাধুতায় যে প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারেনি তার অনমনীয় জেদ ও অহংকারের জন্য। এই অনমনীয়তাই তাকে কালপুরুষের মতো নিঃসঙ্গ এবং নিরুদ্দেশের পথে একক যাত্রী করে তুলেছে।
৭.২ প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘নিরুদ্দেশ’ গল্পে সোমেশ চরিত্রটিই আসলে শোভন। শোভন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে ছিল না। তাদের পৈতৃক জমিদারি ছিল, যা দুর্দিনে কিছুটা ম্লান হলেও সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি। শোভন তার উত্তরাধিকারী ছিল।
প্রাচীন জমিদার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী শোভন বাড়ি ছেড়েছিল নেহাত খেয়ালের বশে। এদিকে সংবাদপত্রের পাতায় দিনের পর দিন শোভনের নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন বেরোতে লাগল। প্রথমে ছেলেকে ফিরে আসার অনুরোধ করে মায়ের আর্তনাদ, পরে বাবার কাতর অনুরোধ। এরপর ঘোষিত হয় যে শোভনের সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে। এইভাবে প্রায় দু-বছর ধরে বিজ্ঞাপন চলতে চলতে হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ করে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুই বৎসর পরে উদাসীন শোভন বাড়ি ফিরে আসে। দীর্ঘ দু-বছর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে শোভন প্রথম বাধা পায় তাদের পুরানো নায়েবমশাইয়ের কাছে। এমনকি বৃদ্ধ খাজাঞ্চি ও অন্যান্য কর্মচারীরাও তাকে বাধা দেন কারণ দীর্ঘ দু-বছরে শোভনের চেহারার পরিবর্তন হয়েছে। সাতদিন আগে শোভনের মৃত্যুসংবাদ বাড়িতে পৌঁছেছিল এবং হাসপাতালও এই ঘটনা সমর্থন করেছে। আর সম্পত্তির লোভে এর আগেও শোভন পরিচয়ে দুজন দাবিদার এসে ফিরে গেছে, যাদের একজনের সঙ্গে জঙুলের পর্যন্ত মিল আছে। এরপর তার বাবার সাথে তার দেখা হয়। বাবাকে দেখে শোভনের ঝড়ে ভাঙা গাছের মতো বিধ্বস্ত মনে হয়েছিল, যার চলনে পুত্রের দুর্ঘটনার শোকার্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল। ‘বাবা’ বলে ডাকার পর বাবার বেদনাময় বিমূঢ় মুখটি দেখে শোভন বুকে ছুরি বেঁধার মতো বেদনাহত হয়েছিল। বৃদ্ধকে নায়েবমশাই বোঝায় এ শোভন নয়, আগের দু-বার-এর মতো এও কোনো প্রতারক। বৃদ্ধ শোভনকে কিছু না বলে শেষবারের মতো কাতরভাবে তাকিয়ে ঘরে ফিরে যান। শোভনের বাবার এই প্রতিক্রিয়া দেখে শোভন স্তব্ধ হয়ে যায়।
৮.১ ‘ধীবর-বৃত্তান্ত’নাট্যাংশটি বাংলায় তরজমা করেন সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী। ‘ধীবর-বৃত্তান্ত’ নাট্যাংশটি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটকের অংশবিশেষ। এই নাট্যাংশটির প্রধান চরিত্র হল ধীবর। ধীবর চরিত্রের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে উঠেছে, সেগুলি হল –
নিজ পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল : ধীবর দুষ্মন্তের নাম খোদাই করা আংটিটি রুই মাছের পেট থেকে পাওয়ার পর যখন তা বিক্রি করার জন্য লোককে দেখাচ্ছিল তখন রাজকর্মচারীরা তাকে আংটি চুরির অপরাধে ধরে নিয়ে যায়। ধীবর জানায় সে মাছ ধরে সংসার চালায়, যা শুনে রাজ-শ্যালক তার বৃত্তি নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। কিন্তু ধীবর সেই ব্যঙ্গ শুনে নিজেকে হীন না ভেবে নিজ পেশার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
সততা : ধীবর চরিত্রের সততার দিকটিও চোখে পরার মতো। আংটি পাওয়ার বিষয়ে সে রাজ শ্যালক এবং রক্ষীদের যা যা বলেছে পরবর্তীকালে তা সবই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে।
নির্ভীকতা : ধীবর চরিত্রের মধ্যে আমরা নির্ভীকতার গুণটিও দেখতে পাই। ধীবরকে নানারকমভাবে আংটি চুরির দোষে দোষী করা হলেও সে সর্বদা একই কথা বলে যে, সে এই আংটি চুরি করেনি। তাকে বিভিন্ন প্রকারে মৃত্যুভয় দেখানো হলেও তিনি সেই ভয়ে ভীত না হয়ে নিজ সিদ্ধান্তে অটুট থাকে।
স্পষ্টভাষী : রাজ-শ্যালক তার বৃত্তি নিয়ে ব্যঙ্গ করলে সে • যেমন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে-কোনো পেশাই ছোটো নয়, ঠিক তেমনি রাজ শ্যালক রাজার কাছ থেকে ফিরে এসে জেলেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলে, ধীবর আনন্দে আত্মহারা না হয়ে বরং ওই দিনের সংসার খরচ সে রাজকর্মচারীদের কাছে দাবি করে। এর থেকেই বোঝা যায় ধীবর স্পষ্টভাষী।
বন্ধুভাবাপন্ন : রাজকর্মচারীরা তাকে চোর প্রতিপন্ন করে নানা দুর্ব্যবহার করলেও সে যখন সন্দেহমুক্ত হয় তখন সে রাজকর্মচারীদের প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শন না করে বরং তাদের প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেক দেয় এবং রাজ-শ্যালকের বন্ধুত্বের আহ্বানও স্বীকার করে।
৮.২ সংলাপ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নাটকের চরিত্রগুলির পরিচয় প্রকাশ পায়। ভাষা ব্যবহারে সংলাপ নির্মিত হয় আর ঘটনার আবর্তে সংলাপ হয়ে ওঠে নাটকের প্রাণ। মহাকবি কালিদাস রচিত ‘ধীবর-বৃত্তান্ত’ নামক অনুবাদ নাট্যাংশের সংলাপ যথেষ্ট নাটকীয় ও প্রাণবন্ত। ঘটনা ও চরিত্র নির্বিশেষে সংলাপের পরিবর্তন হয়। আলোচ্য নাট্যাংশে রাজ-শ্যালক, দুই রক্ষী ও ধীবরের সংলাপ ব্যবহারে তাই ভিন্নতা দেখা যায়।
রাজ শ্যালকের সংলাপ : নগর সুরক্ষায় নিযুক্ত রাজ-শ্যালকের সংলাপে পদমর্যাদার অহংকার ও শ্লেষ দেখা যায়— “তা তোর জীবিকা বেশ পবিত্র বলতে হয় দেখছি” বা “…এ অবশ্যই গোসাপ খাওয়া জেলে হবে।” আবার ধৃতের জবানবন্দি ধৈর্য নিয়ে শোনা বা রাজার আদেশের প্রতি নিষ্ঠা এই বৈশিষ্ট্যগুলি তার সংলাপের মাধ্যমে সম্পাদক দেখিয়েছেন। শেষ পর্বে নির্দোষ ধীবরের উদারতা দেখে রাজ শ্যালক তাকে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে তাও নাট্যকার সংলাপে প্রকাশ করেছেন। রাজ শ্যালকের সংলাপে আভিজাত্য, মার্জিত রুচির প্রভাব রয়েছে।
রক্ষীদ্বয়ের সংলাপ : দুই নগররক্ষী রাজকর্মচারী হলেও তাদের শিক্ষার মান যথেষ্ট ছিল না বলেই অনায়াসে ধীবরের উদ্দেশে তারা ‘চোর’, ‘বাটপাড়’, ‘গাঁটকাটা’ প্রভৃতি মন্তব্য করেছে। নাট্যকার এই চরিত্রদ্বয়ের মুখে এরূপ ভাষা প্রয়োগ করে চরিত্রের নীতিহীনতা, নির্দয়তাকে প্রকাশ করেছেন। ধীবরের মুক্তি ও পুরস্কারপ্রাপ্তি দেখে তাদের ঈর্ষান্বিত সংলাপ ব্যবহারে লোভ-লালসা ফুটে উঠেছে।
ধীবরের সংলাপ : নিরপরাধ ধীবর একাধিকবার দৃঢ়তার সঙ্গে সত্য প্রকাশ করেছে রক্ষীদের কাছে। তার ক্রোধহীন অকপট, উচ্চারণ দেখা যায়— “এখন আমাকে মারতে হয় মারুন….” সংলাপের মধ্যে। আবার নিজগুণে পারিতোষিক পেয়ে কৃতজ্ঞ ধীবর লালসার দমন করে তা ভাগ করে নিয়েছে দুই রক্ষীর সঙ্গে। ধীবরের এই ধৈর্যশীলতা তার সংযমী সংলাপ উচ্চারণে প্রকাশ পেয়েছে।
উপমা প্রয়োগ : উপমা প্রয়োগেও নাট্যকার চরিত্রানুযায়ী যথার্থতা অবলম্বন করেছেন। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের দয়াশীল মনের পাশাপাশি যজ্ঞীয় পশুবধের নির্দেশ তার স্বভাববিরুদ্ধ। ধীবর নিজের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতায় এই উপমা ব্যবহার করেছে। আবার তার মুক্তির পর ব্যঙ্গ করে রক্ষীরা কখনও বলেছে— “এই জেলে যমের বাড়ি গিয়ে আবার ফিরে এল।” কখনও রাজানুগ্রহে ঈর্ষান্বিত হয়ে বলেছে— “…এ যে শূল থেকে নামিয়ে একেবারে হাতির পিঠে চড়িয়ে দেওয়া…।” আলোচ্য নাট্যাংশে সংলাপ ব্যবহারে ও উপমা প্রয়োগে নাট্যকার দক্ষ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন।
৯.২ বেগম রোকেয়া রচিত ‘হিমালয় দর্শন’ গদ্যাংশে হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সেখানকার অধিবাসীদের জীবনযাত্রা বর্ণনা করেছেন প্রাবন্ধিক।
হিমালয়ের পাহাড়ি মহিলারা, অর্থাৎ ভুটিয়ানিরা নিজেদের ‘পাহাড়নি’ বলে পরিচয় দেয়। ভুটিয়ানিরা সাত গজ লম্বা কাপড় ঘাগরার মতো করে পরে, কোমরেও একখণ্ড জড়িয়ে নেয় এবং গায়ে জ্যাকেট ও মাথায় বিলাতি শাল ঢাকা দিয়ে অনায়াসেই পিঠে দু-এক মন বোঝা নিয়ে কঠিন পাহাড়ি পথ বেয়ে ওপরে উঠে যায়। জীবনধারণের জন্য তারা পুরুষের উপর নির্ভরশীল নয়। পাথরের বোঝা এরা বয়ে নিয়ে যায় এবং রাস্তা তৈরির কাজে পুরুষদের সাহায্য করে। আবার অনেক বালক-বালিকারাও এই কাজ করে।
এরা সমতলের অধিবাসীদের ‘নীচেকা আদমি’ বলে। বর্তমানে তাদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন হওয়ায় ভিন্ন জনজাতির সঙ্গে এদের মিশ্রণ ঘটছে। ভুটিয়ারা সাধারণত পরিশ্রমী, কার্যপ্রিয়, সাহসী ও সত্যবাদী। তবে লেখিকার মনে হয়েছে ‘নীচেকা আদমি’-দের সঙ্গে মেলামেশার ফলে এরা এদের মহৎগুণগুলিকে কিছুটা নষ্ট করে ফেলেছে। তবে আলোচ্য প্রবন্ধে ভুটিয়াদের জীবনযাত্রা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখিকা মূলত এদের মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সশ্রদ্ধচিত্তে উল্লেখ করেছেন।
১০.১ প্রোফেসর শঙ্কু কলকাতার কলেজে অধ্যাপনার সময়ে নেচার পত্রিকা থেকে জেরেমি সন্ডার্সের কথা জানতে পারেন। ধীরে ধীরে পত্র বিনিময়ের মধ্যমে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারপর প্রায় আট মাস পরে সন্ডার্সের যকৃৎ ক্যানসারের কথা জানতে পারেন শঙ্কু।
তিনি তৎক্ষণাৎ স্বর্ণপর্ণী গাছড়ার বড়ি মিরাকিউরল পাঠিয়ে দেন। সেই মিরাকিউরলের দ্বারা সুস্থ হয়ে সন্ডার্স শঙ্কুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। সন্ডার্স চরিত্রের যে দিকগুলি পাঠককে আকৃষ্ট করে, সেগুলি হল –
বন্ধুবৎসল : জেরেমি সন্ডার্স শঙ্কুর মিরাকিউরল ওষুধের প্রভাবে সুস্থ হয়ে তার বাড়িতে আসেন। কীভাবে শঙ্কু স্বর্ণপর্ণী আবিষ্কার করে মিরাকিউরল বড়ি বানিয়েছেন সেটা জেনে সন্ডার্স শঙ্কুকে সুপরামর্শই দেন এবং মৃদু ভর্ৎসনাও করেন যে কেন শঙ্কু চিঠিতে সবটা জানাননি। তিনি শঙ্কুকে মিরাকিউরলের পেটেন্ট নেওয়ার কথা বলেন এবং শঙ্কু রাজি না হলে সন্ডার্স প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বলেন “তুমি কি বুঝতে পারছ না যে, এ ওষুধ তোমাকে ক্রোড়পতি করে দেবে?’ এখানে বন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসা লক্ষণীয়। এরপর শঙ্কুকে তিনি লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কারণ তাঁর এই মিরাকল্ কিওরের’ কথা শুনে শুধু ডাক্তারি মহলে নয়, বৈজ্ঞানিকদের মধ্যেও তুমুল আলোড়ন পড়ে। তাঁরা শঙ্কুকে দেখতে চান। তারপর বড়ির কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করানোর কথা তিনিই প্রথম বলেন। এরপর শঙ্কু লন্ডন পৌঁছানোর পর প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর সঙ্গে থেকেছেন এবং শেষপর্যন্ত গোয়রিং-এর হাত থেকে শঙ্কুকে বাঁচিয়ে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়ই তিনি দিয়েছেন।
শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক : ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে আমরা যতটুকু সন্ডার্সের পরিচয় পাই তাতে তাঁকে তীক্ষ্ণ, সুদক্ষ বুদ্ধির অধিকারী বলেই মনে হয়। শঙ্কুর এই আবিষ্কারের কথা সকলকে জানানোর পিছনে তাঁর অবদান অনেকখানি। তিনি শঙ্কুকে পথ দেখিয়েছিলেন কীভাবে দেশ বিদেশের কাছে তাঁর এই খ্যাতি পৌঁছে দেওয়া যায়। তিনি শঙ্কুকে এও বুঝিয়েছেন যে স্বর্ণপর্ণীর কথা প্রাচীন সংস্কৃত ডাক্তারি শাস্ত্রে পাওয়া গেলেও কোনোদিন কেউ যে গাছ চোখে দেখেনি, সেই গাছের সন্ধানে ঘোড়ার পিঠে চড়ে সাড়ে ছ-হাজার ফুট উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে গভীর জঙ্গলে জীবন বিপন্ন করে একমাত্র শঙ্কুই গিয়েছিল। সুতরাং এতে আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাতি একমাত্র শঙ্কুরই প্রাপ্য।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী : সন্ডার্স ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী এক ব্যক্তি। ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পের প্রতিটি পরতে পরতে শঙ্কুর প্রতি তাঁর চিন্তা লক্ষণীয়। শঙ্কু যাতে কোনোমতেই গোয়রিং-এর হাতে না পড়ে সেদিকে তাঁর লক্ষ ছিল সবসময়। এমনকি তিনি শঙ্কুকে আগ্নেয়াস্ত্র সবসময় সঙ্গে রাখতে বলেন। যখন নরবার্ট শঙ্কুকে নিয়ে যেতে চায় তখন শঙ্কুর প্রতি তাঁর চিন্তা লক্ষ করা যায়। তিনি শঙ্কুকে তাঁর স্ত্রী ডরথির সঙ্গে বেড়াতে বের করেন, মিরাকিউরলের বড়ি বার করে ঘুমের অব্যর্থ ওষুধ ‘সেকোন্যালের বড়ি’ ভরে দেন, যার জন্য শঙ্কু নাৎসিদের খপ্পরে পড়েও বেঁচে গিয়েছিলেন। সুতরাং সব মিলিয়ে বলা যায় আলোচ্য গল্পে সন্ডার্সের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
১০.২ ভারতরত্ন সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্প থেকে গৃহীত উদ্ধৃত উক্তিটির বক্তা প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু।
প্রোফেসর শঙ্কুর বাবা ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু ছিলেন একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। পেশাদারি জীবনে তিনি অসামান্য সাফল্যলাভ করলেও জীবনে বিশেষ একটি আদর্শকে সর্বদাই মেনে চলতেন। সারাজীবন বহু দরিদ্র মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা করে তিনি সেই আদর্শবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি প্রায়শই পুত্র শঙ্কুর উদ্দেশে বলতেন যে, সামর্থ্য থাকলেই অঢেল অর্থ উপার্জন করার প্রয়োজন নেই, সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য পরিমিত অর্থ উপার্জনের মধ্য দিয়ে একটা সহজ শান্তি লাভ করা যায়। এই সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা দুস্থ, দরিদ্র, অসহায়; যারা দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায় না; যারা সারাটা জীবন দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে কোনোমতে বেঁচে আছে; আবার এমনও অনেক মানুষ আছে যারা দৈব দুর্বিপাকে পড়ে একেবারেই উপার্জন করতে পারে না। মানুষ হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করা, তাদের সেবা করা, তাদের দুঃখ লাঘব করার মধ্যেও একটা আনন্দ ও সার্থকতা আছে। বাবার এই কথাগুলোই প্রোফেসর শঙ্কুর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল।