নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি আলোচনা করো

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি আলোচনা করো

অথবা, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল্যায়ন করো

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি আলোচনা করো
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি আলোচনা করো

ভূমিকা

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন ইটালির রেনেসাঁ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। ইটালির ফ্লোরেন্সে এই রাষ্ট্রচিন্তা নায়ক জন্মগ্রহণ করেন। একজন মানবতাবাদী রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবে ম্যাকিয়াভেলি তাঁর সময়কালেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের জনক হিসেবেও সুপরিচিত। অধ্যাপক ডানিং (Dunning)-র মতে “ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন প্রথম আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, যিনি মধ্যযুগের অবসান ঘটান এবং আধুনিক যুগের সূচনা করেছিলেন।”

রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে গ্রন্থ

রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলির আলোড়ন সৃষ্টিকারী দুটি গ্রন্থ হল-‘দ্য প্রিন্স’ (The Prince) এবং ডিসকোর্সেস অন লিভি’ (Discourses on Livy)। তবে দ্য প্রিন্স গ্রন্থটি তাঁকে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্ব 

(1) রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা: ম্যাকিয়াভেলির মতে, রাষ্ট্রকে হতে হবে শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল। রাষ্ট্র নিরন্তর নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করবে। তাঁর মতে, মানুষ তার নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত সম্পদের সংরক্ষণের স্বার্থে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তাই এগুলি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের হাতে প্রভূত ক্ষমতা থাকা দরকার।

(2) রাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা: ‘দ্য প্রিন্স’ (The Prince) গ্রন্থে D ম্যাকিয়াভেলি রাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর মূল বক্তব্য বিশদে আলোচনা করেছেন। রাজা বা রাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর মূল বক্তব্য হল-

  • আদর্শ রাজা: একজন আদর্শ রাজার কী কী গুণ থাকা উচিত দ্য প্রিন্স গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলি তার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। একজন আদর্শ রাজা হবেন সহনশীল, ন্যায়পরায়ণ ও প্রজাকল্যাণকামী। রাষ্ট্র তথা প্রজাদের ভালোমন্দের বিষয়ের প্রতি তাঁকে সর্বদা নজর রাখতে হবে। রাষ্ট্রের স্বার্থে তাঁকে অনেক সময় নিষ্ঠুর হতে হবে।
  • রাজার গুণাবলি: ম্যাকিয়াভেলির মতে, রাজা হবেন সাহসী, দৃঢ়চেতা, বুদ্ধিমান, চতুর, শৌর্য ও বীরত্বের মূর্ত প্রতীক। ভীরু ও নির্বোধ ব্যক্তি কখনও রাজ্যশাসনে উপযুক্ত নন। রাজার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও থাকতে হবে। ম্যাকিয়াভেলির মতে, মানুষ আসলে ক্ষমতালোভী। তাই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও পররাজ্য লোভী, শাসকদের আক্রমণ সম্পর্কে রাজাকে সবসময়ই সতর্ক থাকতে হবে। তাঁর মতে, শাসকের মধ্যে সিংহের ন্যায় শক্তি বা শৌর্য এবং শৃগালের ন্যায় ধূর্ততা এই দুটি গুণের সমন্বয় বিশেষ প্রয়োজন।
  • রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য: রাজার প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্যই হল ( রাজ্যকে রক্ষা করা। প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষাও তাঁর অন্যতম মূল কর্তব্য। তাঁর মতে, রাজাকেও হতে হবে একজন সুদক্ষ যোদ্ধা এবং তাঁকে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেছেন, নতুন রাজা কেবলমাত্র নিজের রাজ্যই রক্ষা করবে না, তাকে পররাজ্য দখল করতে হবে। ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থটিকে অনেকেই নতুন রাজা বা শাসকদের advice book বা পরামর্শ গ্রন্থ বলে মনে করেছেন।

(3) প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা: ম্যাকিয়াভেলি তাঁর ডিসকোর্সেস অন লিভি গ্রন্থটিতে প্রজাতন্ত্রের ভালোমন্দের দিক সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি রাজতন্ত্র অপেক্ষা প্রজাতন্ত্রকেই শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রজাতান্ত্রিক শাসনকে মুক্তরাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি প্রজাতন্ত্রের সাফল্যের জন্য বৈষম্যহীন সমাজের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রজাতন্ত্রের সাফল্যের ক্ষেত্রে ‘ভালো আইন’ (good law), ‘সুনেতৃত্ব’ (good leadership), ‘ভালো উদাহরণ’ (good example)-র ওপর জোর দিয়েছেন।

(4) রাষ্ট্র ক্ষমতা: ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রাষ্ট্র ক্ষমতা। তাঁর মতে, রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রধান উৎস হল বাহুবল ও সামরিক শক্তি (good arms)। তাঁর মতে, সামরিক শক্তির অভাব ফ্লোরেন্সের প্রজাতান্ত্রিক শাসনকে বারংবার দুর্বল করেছে। তাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের স্বার্থে রাষ্ট্রের হাতে অসীম ক্ষমতা থাকা দরকার।

(5) রাষ্ট্র ও সরকারের শ্রেণিবিভাগ: ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্র ও সরকারকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন- (i) রাজতন্ত্র, (ii) অভিজাততন্ত্র এবং (iii) নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র। তিনি কখনও রাজতন্ত্রকে, আবার কখনও প্রজাতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠ শাসন বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, মিশ্র শাসনতন্ত্র প্রজাতন্ত্রের পক্ষে উপযুক্ত।

(6) ধর্ম ও নৈতিকতা: ম্যাকিয়াভেলি রাজনীতিকে ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করেছেন। তাঁর মতে, ব্যক্তিজীবনে ধর্ম ও নৈতিকতার যথেষ্ট ভূমিকা আছে। কিন্তু রাজনীতি তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে এর কোনো ভূমিকা নেই বলেই তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, রাজা বা শাসককে ব্যক্তিগত ধর্ম ও নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠেই শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে।

রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল্যায়ন 

(1) ত্রুটি/সীমাবদ্ধতা: ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্ব সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। 

  • তিনি শাসকের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতা, চাতুর্য, নির্মমতা প্রভৃতি কুৎসিত গুণগুলিকে সমর্থন করেছেন। তাই মারে, স্যাবাইন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেছেন, তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে নৈতিকতা ও মহানুভবতার কোনো স্থান নেই।
  • তিনি রাষ্ট্রনীতি, ক্ষমতা, যুদ্ধকৌশল, শাসকের গুণাবলি প্রভৃতি বিষয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যান্য বহু বিষয় তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে সেভাবে আলোচিত হয়নি।
  • তিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনও রাজতন্ত্রকে, আবার কখনও প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রদর্শনে স্ববিরোধিতা বর্তমান।

(2) অবদান : ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তায় নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। তিনিই প্রথম রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে সার্বভৌম ক্ষমতার কথা তুলে ধরেন। সর্বোপরি তাঁর রাষ্ট্রদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন জ্যাঁ বোঁদা, হেগেল প্রমুখ বহু প্রখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। তাই তাঁকে ‘আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক’ বলা যায়।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment