নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর | Noon Kobitar Question Answer Class 11

Table of Contents

নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর | Noon Kobitar Question Answer Class 11

নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর
নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

১। ‘আমরা তো অল্পে খুশি’-‘অল্পে খুশি’ মানুষদের জীবনযন্ত্রণার যে ছবি ‘নুন’ কবিতায় ফুটে উঠেছে তার পরিচয় দাও।

অথবা, ‘আমরা তো অল্পে খুশি’-বক্তার জীবনচরিতের কীরূপ পরিচয় কবিতায় ফুটে উঠেছে?

এক অতিসাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের কোনোক্রমে টিকে থাকার রোজনামচার ছবি ফুটে উঠেছে কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতায়। অভাব, অনটনে জর্জরিত এই মানুষগুলোর চাহিদা খুবই কম। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ে কায়ক্লেশে তাদের দিন চলে; ধারদেনা করতে হয় অসুখজনিত কারণে। প্রতিদিনকার এই সাংসারিক জীবনযন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে নেশাভাঙ জীবনেরই অংশ হয়ে দাঁড়ায়। অভাবের জেরে প্রতিদিন বাজার হয় না। আবার যখন হাতে পয়সা আসে তখন অপূর্ণ স্বপ্নপূরণের তাগিদে তা হয় মাত্রাছাড়া। গাছের চারা পোঁতার জায়গার অভাব সত্ত্বেও দু-চোখে উজ্জ্বল নতুনত্বের খোঁজে অত্যন্ত দ্বিধান্বিত চিত্তে কিনে আনে গোলাপচারা। তা থেকে ফুল ফোটার সম্ভাবনা নিয়েও সংশয় দেখা যায়। দিন শেষে তাদের শুকনো ভাতে সামান্য লবণটুকুও জোটে না। তখন বেপরোয়া রাগ ‘অল্পে খুশি’ থাকার ফানুসটাকে ছিঁড়ে ফাটিয়ে মানবিক অধিকারের চিরকালীন এক দাবি রাখে-তাদের ভাতে যেন লবণের ব্যবস্থা হয়।

এভাবেই ‘নুন’ কবিতায় অল্পে খুশি মানুষদের জীবনযন্ত্রণার ছবি কবি তুলে ধরেছেন সুন্দরভাবে।

২। ‘কী হবে দুঃখ করে?’- কবির এমন মন্তব্যের পিছনে যে জীবনযন্ত্রণার কথা লুকিয়ে আছে তা ব্যাখ্যা করো।

রাজা আসে, রাজা যায় কিন্তু দিন বদলায় না। কেবল শাসক ফেরিওয়ালার দল নতুন নতুন স্বপ্ন ফেরি করে মাত্র। সাধারণ মানুষ লুব্ধ হয় তাদের সেই স্বপ্নফেরিতে। তারা আবার প্রতারিত হয়। চির তমসা থেকে যেন সাধারণ মানুষদের মুক্তি নেই। তারা তাদের একঘেয়ে অভাবটাকে সহ্য করতে শেখে। সাধারণ ভাতকাপড়ের ধারণা আর অসুখবিসুখকে সম্বল করেই এদের দিন চলে।

তাদের জীবনযন্ত্রণার হাত থেকে ক্ষণিক নিস্তার দেয় সস্তার নেশার আমোদ। পয়সার অভাবে সবদিন বাজার না-হলেও যেদিন সুযোগ হয় সেদিন মাত্রাছাড়া বাজার করে; সৌন্দর্যবোধের তাগিদে গোলাপচারা কিনে আনে। কিন্তু ফুল ফোটার আয়াস দেখানোর সুযোগ তাদের জীবনবৃত্তে নেই। আসলে স্বপ্নকে ক্রমশ বিবর্ণ হতে দেখার এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে তারা অভ্যস্ত ও বাধ্য। যে মানুষগুলোর দরিদ্রাবস্থা থেকে উত্তরণের কিংবা মুক্তির কোনো পথ নেই, তাদের দুঃখ করে দুঃখ দূর করার কোনো উপায় নেই। তীব্র অসহায়তা থেকেই তাই এমন উক্তি।

৩। ‘রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে’-উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

জয় গোস্বামী তাঁর ‘নুন’ কবিতায় পীড়িত-দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ছবি তুলে ধরেছেন।

সামান্য চাহিদা ও অল্পে খুশি এই মানুষগুলো জীবনের হাজারো যন্ত্রণাকে ভুলে সাধারণ ভাতকাপড়ে দিন চালিয়ে নেয়। তাই রোগব্যাধিতে এই ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ মানুষগুলোর অন্যের কাছে হাতপাতা ছাড়া কোনো গতি থাকে না। এই দরিদ্র মানুষগুলোর সবদিন বাজারও হয় না, যেদিন হাতে সামান্য পয়সা আসে সেদিন বেহিসাবি স্বপ্নপূরণের তাগিদে কেনাকাটা হয় মাত্রাছাড়া। সুস্থ, সুন্দর, স্বপ্নময় জীবনের ঘোরে এরা সংশয় ও দ্বিধা নিয়েই বাজার থেকে গোলাপচারা কিনে আনে। দিন শেষে কর্মক্লান্ত এই মানুষগুলো যখন ঠান্ডা ভাতে সামান্য লবণটুকুও পায় না, তখন তাদের মাথায় রাগ চড়ে যায়। অভাব-আত্মগ্লানি আর জীবনযন্ত্রণাকে ভুলতে ‘বাপব্যাটা’ যেন দুই বন্ধুর পর্যায়ে নেমে এসে নেশা করে, সস্তার আমোদে মন ভোলায়।

দীনদরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতাকে কবি এভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।

৪। ‘হেসে খেলে, কষ্ট করে, আমাদের দিন চলে যায়’- উদ্ধৃতিটির মধ্য দিয়ে কবি যে জীবনবোধের কথা বলতে চেয়েছেন তা বিবৃত করো।

‘নুন’ কবিতায় আছে অসহায়, পীড়িত ও চিরবঞ্চিত মানুষগুলোর দিনযাপনের কথা। কবি জয় গোস্বামী তাদের জীবনবাণী যেন স্বকণ্ঠে ধারণ করেছেন।

দেশ স্বাধীন হলেও, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে প্রেক্ষাপট বদলালেও, নিম্নবিত্ত এই মানুষগুলোর অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি। একটা সময় অসহায় মানুষগুলো বুঝে যায় এদের প্রকৃত অবস্থার উন্নতি নিয়ে কেউ হয়তো ভাবিত নয়। না খেতে পেয়ে পেয়ে এ মানুষগুলোর খিদেটাও যেন কোথায় হারিয়ে যায়। সাধারণ ভাতকাপড়ে অসুখবিসুখ, ধারদেনা নিয়েই তাদের দিন কাটে।

অভাবের দৈন্যতায় রোজ বাজার করার কথা ভাবা এদের কাছে বাহুল্য। আবার শখ-শৌখিনতা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতেও এরা অক্ষম। ফলে ফুল ফোটার অনিশ্চয়তা কিংবা গাছ লাগানোর স্থানের অভাবের কথা জেনেও। আবেগের বশে গোলাপচারা কিনে আনে।

এভাবেই অপ্রাপ্তি-অভাব এসব কিছু ভুলে এরা অল্পে খুশি হয়ে হেসে খেলে কষ্ট করে কোনোরকমে জীবনটা কাটাতে অভ্যস্ত। কবি অসহায় এই মানুষগুলোর সরল জীবনবোধ, বঞ্চনা আর উপেক্ষাকে তীব্র ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে তাই প্রশ্নের এই উদ্ধৃতিটি করেছেন।

৫। ‘মাঝে মাঝে চলেও না দিন,’-কার, কেন মাঝে মাঝে দিন চলে না?

কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতা থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশটিতে কবিতার কথক যিনি সমগ্র নিম্নবিত্ত দারিদ্র্যপীড়িত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন-তাঁর মাঝে মাঝে দিন চলে না।

‘মাঝে মাঝে চলে না দিন’ কথাটির মধ্য দিয়ে সমাজের ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ নিম্নবিত্ত মানুষদের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে প্রতিদিনের জীবনযাপনের কথার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। অত্যন্ত ন্যূনতম চাহিদাসম্পন্ন এই প্রান্তিক মানুষগুলো টিকে থাকতে গিয়ে সাধারণ ভাতকাপড়ের মধ্যেই চাহিদাকে সীমাবদ্ধ রাখে। তবে সঞ্চয়হীন এই মানুষগুলো দিন আনে দিন খায়-তাই সামান্য অসুখবিসুখেই এদের ধারদেনা করতে হয়। এরা বেহিসাবি কারণ হাতে পয়সা এলে এরা মাত্রাছাড়া খরচ করে। অল্পে খুশি, হেসেখেলে, কষ্ট করে দিন চালানো মানুষগুলোর তাই মাঝেমধ্যে দিন চলে না।

৬। ‘আমরা তো সামান্য লোক’-কে, কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলেছে?

উদ্ধৃত অংশটি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতা থেকে গৃহীত। কবিতায় উক্ত অংশটির বক্তা কবিতার কথক। কথক এক্ষেত্রে সমগ্র দরিদ্র সমাজের শ্রেণি-প্রতিনিধি হয়ে ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

নিম্নবিত্ত মানুষগুলো সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। একটা দিন কাজ না-করলে তাদের অন্ন জোটে না। ফলে মাঝে মাঝে অর্থাভাবের কারণে এদের দিন চলতেও চায় না। এমন অবস্থায় কর্মক্লান্ত মানুষগুলো যখন গভীর রাতে বাড়ি ফিরে শুকনো ভাতে সামান্য লবণটুকু পায় না, তখন তাদের মাথায় রাগ চড়ে যায়। বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে সারাপাড়া মাথায় করে। এভাবে রাগের বেপরোয়া অনিয়ন্ত্রিত বহিঃপ্রকাশে মানুষের অসুবিধার কথাও তারা জানে। আসলে এ পথেই তারা নিজেদের অসহনীয় অবস্থাকে বৃহত্তর ভদ্রসমাজরূপী শাসকের কাছে তুলে ধরতে চায়। কারণ নুনে-ভাতে থাকার সমস্ত মানুষের এই যৎসামান্য দাবির মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। দু-চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে যাদের পূর্বপুরুষরা লড়াই করেছিল তাদের এই সামান্য চাওয়াটুকুর আশা থাকতেই পারে।

৭। ‘আমরা তো সামান্য লোক’- ‘সামান্য লোক’ শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

উদ্ধৃত অঁশটি কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতা থেকে গৃহীত। ‘সামান্য লোক’ শব্দটির সাহায্যে কবি জয় গোস্বামী সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষদেরকে বুঝিয়েছেন। যারা অল্পে খুশি। অভাব ও দুঃখটাকে নিত্য ধরে নিয়ে যারা সাধারণ ভাতকাপড়ে কোনোভাবে দিন চালায়, তারা তো ‘সামান্য’, তুচ্ছ কিংবা উপেক্ষার পাত্র। তাই রাতদুপুরে এদের শুকনো ভাতে সামান্য – লবণটুকুও জোটে না। শাসকের অবজ্ঞা আর অবহেলা যে সাধারণ মানুষের আর্থিক দৈন্যদশার মূল, কবির ‘সামান্য লোক’ শব্দবন্ধে কোথাও যেন সেই শ্লেষ ও বিদ্রুপ প্রকট হয়ে ওঠে।

৮। ‘আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে’-‘নুন’ কবিতায় নিম্নবিত্ত জীবনের যে ছবি প্রকাশ পেয়েছে তা লেখো।

উদ্ধৃত অংশটি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতার অংশবিশেষ। এখানে কবিতার কথক তাঁর জবানীতে একটি সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কবিতায় তাই ‘আমরা’, ‘বাপব্যাটা’, ‘দু-ভাই’ ইত্যাদি বহুবচনবোধক পদের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। স্বাধীনোত্তর সমাজে নিম্নবিত্ত শ্রেণিও হয়তো জীবনবদলের স্বপ্ন দেখেছিল। তাই তারা কখনও রাস্তায় নেমে মিছিলে হেঁটেছে, আবার কখনও মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দাবি জানিয়েছে। দিন বদলেছে কিন্তু তারা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। একঘেয়ে অভাবটাকে ক্রমাগত সহ্য করতে করতে তারা স্বপ্ন দেখাই ভুলতে বসেছে। চাহিদাকে তারা সীমিত পরিসরে বেঁধে ফেলেছে। অল্পে খুশি হয় বলেই হয়তো, তাদের কোনো দুঃখ থাকে না। অসুখবিসুখের হাতছানিকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকার লড়াই চলে। ফলে শখ-শৌখিনতার ঘোরও তাদের ছেড়ে যায় না। তাই একটু উপার্জন হলে মাত্রাছাড়া বাজার করে, সৌন্দর্যকে বাঁচিয়ে রাখতে গোলাপচারা কিনে আনে। গোলাপের ফুল হয়ে ফোটা হবে না জেনেও হেসেখেলে কষ্ট করে দিন চালিয়ে নেয়। অথচ রাতে এদের শুকনো ভাতে সামান্য লবণটুকুও জোটে না। তখন এরা শুকনো ভাতে সামান্য লবণের ব্যবস্থার দাবি জানায়। কিন্তু বেঁচে থাকার চিরকালীন দাবিটুকু অমলিন থাকলেও সমাধান অধরাই থেকে যায়।

৯। ‘বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপচারা’- গোলাপচারা কেনার মধ্যে কোন্ সত্য প্রকাশিত হয়েছে? যে জীবনের কথা এখানে বর্ণিত হয়েছে তা লেখো।

কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতাটি যেন বিত্তশূন্য মানুষের জীবনবেদ। কবি এই পঙ্ক্তিটিতে বোঝাতে চেয়েছেন যে, শত দারিদ্র্য ও অভাববোধ সত্ত্বেও মানুষের মন থেকে সৌন্দর্যবোধ ও শুভচেতনা নষ্ট হয়ে যায় না। তাই অনটন ও অভাবের মাঝেও সে গোলাপচারা কেনার মতো উন্নাসিক ও বেহিসাবি মানসিকতা দেখায়।

কবি এই কবিতায় নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের নিত্য টানাপোড়েনের একটি নিখুঁত ও বাস্তব ছবি এঁকেছেন। অল্পেতে খুশি মানুষগুলোকে দুঃখের অনল পুড়িয়ে দগ্ধ করতে পারেনি। বরং তারা যেন পুড়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। তাই মোটা ভাতকাপড়ে দারিদ্র্যে-দেনায় হেসেখেলেই তারা দিন কাটায়। সামান্য বাড়তি পয়সা হাতে এলেই এরা সব কিছু ভুলে মাত্রাছাড়া বাজার করে ফেলে। সুস্থ ও সুন্দরের স্বাভাবিক ঝোঁকেই কিনে আনে গোলাপচারা। নিজেদের অস্তিত্বের অনিশ্চয়তার মতোই গোলাপের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎও এদের কাছে সত্য; কিন্তু শেষ সত্য নয়। এভাবে সৌন্দর্য ও নতুনত্বের প্রতি সাময়িক আচ্ছন্নতা এ মানুষগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা মনুষ্যত্বকেই বড়ো করে তোলে।

১০। ‘ফুল কি হবেই তাতে?’-কোন্ ফুল? এই সংশয় কেন?

কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতা থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে ‘ফুল’ বলতে গোলাপ ফুলের কথা বলা হয়েছে। তবে এখানে কবি ‘গোলাপ’-কে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের সৌন্দর্যবিলাস ও শৌখিন জীবনযাপনের প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে ইঙ্গিত করেছেন।

কবির মতে সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষ যারা ‘অল্পে খুশি’, যাদের সাধারণ ভাতকাপড়ে দিন চলে কিংবা অসুখে-ধারদেনাতে যারা জর্জরিত; তাদের জীবনের মধ্যে একটা বেপরোয়া বেহিসাব আছে। এরা সুযোগ পেলেই মাত্রাছাড়া হয়ে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে লালিত অপ্রাপ্তি ও অচরিতার্থ বাসনাকে পূর্ণ করতে আবেগের বশে হয়তো গোলাপচারা কিনে ফেলে। অর্থাৎ অভাব, যন্ত্রণা এবং ক্লান্তির মধ্যে বেঁচে থাকলেও এই মানুষগুলোর জীবন থেকে সৌন্দর্যবোধ মুছে যায় না।

পরক্ষণেই রূঢ় বাস্তবিকতা মনে সংশয় জাগায়, চারাটুকু পোঁতার মতো জায়গার অভাবের সঙ্গে ফুল হয়ে ফোটার মতো দীর্ঘসূত্রতাকে রক্ষা করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি!

আসলে বারবার প্রতিশ্রুতিভঙ্গ আর স্বপ্নভঙ্গের তিক্ত অভিজ্ঞতা যেন তাদেরকেই বিদ্রুপ করে। ইচ্ছেপূরণের ব্যর্থতার এই সংশয়ধ্বনিই প্রশ্নের এই অংশে ব্যক্ত হয়েছে।

১১। ‘সে অনেক পরের কথা’- কোন্ কথা? উক্তিটির মর্মার্থ লেখো।

কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতা থেকে নেওয়া। আলোচ্য অংশে ‘কথা’-টি হল অতিসাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের অবদমিত শখ ও সৌন্দর্যের প্রতীকস্বরূপ বাজার থেকে কিনে আনা গোলাপচারায় ফুল ফুটবে কিনা সেই কথা।

মানুষ তার ক্ষমতানুসারে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে এবং তাকে বাস্তবায়িত করতে চায়। কিন্তু সমাজের নীচুতলার মানুষগুলি যারা অল্পে খুশি, যাদের সাধারণ ভাতকাপড়ে দিন চলে, যাদের চাহিদা সামান্য, যারা ক্রম-ক্ষয়িষু- কঠোর বাস্তব তাদের ইচ্ছে-সাধ কিংবা স্বপ্নকে কখনও পূর্ণতা পেতে দেয় না। সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ, সুস্থ কিংবা সুন্দর জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা তো অনিবার্য। তাই বাজার থেকে গোলাপচারা কিনে আনা মানবীয় স্বভাববৈশিষ্ট্যের পক্ষে একটুও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কারণ এই মানুষগুলোর মনে জায়গা এবং যত্নের অভাবজনিত সন্দেহ আর সংশয় থাকলেও তাদের ভালোভাবে বাঁচার ইচ্ছেটুকু তো মিথ্যে নয়। এভাবে বাস্তবকে ভুলে অভাবী মানুষের এই • স্বপ্ন-উড়ানকেই কবি এখানে এক আশ্চর্য সমমর্মিতায় ব্যক্ত করেন।

১২। ‘খেতে বসে রাগ চড়ে যায়’-রাগের কারণ কী? এই রাগ কতদূর সংগত বলে তুমি মনে কর?

উদ্ধৃতাংশটি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতা থেকে নেওয়া। এক্ষেত্রে দারিদ্র্যক্লিষ্ট কর্মক্লান্ত মানুষগুলো যখন রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে খেতে বসে ঠান্ডা ভাতে সামান্য লবণটুকু থেকেও বঞ্চিত হয়, তখন তাদের রাগ চড়ে যায়।

এ রাগ অত্যন্ত স্বাভাবিক। অল্পে খুশি হয়ে কোনোক্রমে টিকে থেকে নিম্নবিত্ত মানুষ দিন গুজরান করে। দিন বদলায় অথচ অভাব, অনটন, দৈন্য এদের পিছু ছাড়ে না। সাধারণ ভাতকাপড়ে ধারদেনায় স্বল্প চাহিদায় এরা কোনোরকমে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। ক্রমশ নিঃস্ব, শূন্য ও সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়াই যেন এদের ভবিতব্য। অথচ রাষ্ট্র তথা ভদ্রসমাজের কাছে এরা চির উপেক্ষার – ‘সামান্য লোক’। তাই শাসকের কাছে এদের শুকনো ভাতে সামান্য লবণের সোচ্চার দাবি-এটাই স্বাভাবিক। ‘লবণ’ শব্দটির মধ্য দিয়ে তারা জীবনের ন্যূনতম ও অপরিহার্য চাহিদাপূরণের কথা বলে। দরিদ্র জনগণের ক্ষুধার্ত পেটে সামান্য ‘নুন’-এর প্রত্যাশা যেন বেঁচে থাকার ন্যায়সংগত অধিকারের সুগভীর ব্যঞ্জনাকেই তুলে ধরে।

১৩। ‘আমি তার মাথায় চড়ি’-কে, কার মাথায় চড়ে? পঙ্ক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

আলোচ্য অংশে নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রতিভূ হিসেবে ‘নুন’ কবিতার কথক, রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে শুকনো ভাতে সামান্য নুনটুকু না-জোটায়; বেপরোয়া ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বোঝাতে উপরোক্ত মন্তব্যটি করেছেন।

জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতাটি দরিদ্র, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের রোজকার ভাষ্য। ‘অল্পে খুশি’ অভাবী মানুষগুলোর চাহিদা খুব বেশি নয়। একঘেয়ে দুঃখকষ্টকে মেনে নিয়ে সাধারণ ভাতকাপড়েই তাদের দিন চলে। কিন্তু ক্ষয়িষু শরীরটাকে অসুখবিসুখে ধরলে; অন্যের কাছে হাত পেতে ধারদেনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। বাজার করার সামর্থ্যও সবসময় থাকে না, আবার কোনোদিন সামান্য অর্থাগম ঘটলে এরা মাত্রাছাড়া বাজার করে, স্বপ্ন ও শৌখিনবিলাসের ঘোরে কিনে আনে গোলাপচারা। এভাবেই কোনোরকমে হেসেখেলে কষ্ট করে এদের দিন চলে। আবার দিন শেষে কর্মক্লান্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে শুকনো ভাতে সামান্য লবণটুকু জোটে না। তখন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই মানুষগুলোর সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। লাগামহীন-অসংযত রাগ বিস্ফোরকের মতো ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশ্যে পুঞ্জীভূত রাগের এই বহিঃপ্রকাশকে তীব্রতর করে ফুটিয়ে তুলতেই, ‘আমি তার মাথায় চড়ি’ পঙ্ক্তিটি লেখা হয়েছে।

১৪। ‘বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে সারাপাড়া মাথায় করি’-উদ্ধৃত অংশটিতে কবি কী বুঝিয়েছেন? বক্তা কেন সারাপাড়া মাথায় করেন?

উদ্ধৃতাংশটি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতা থেকে গৃহীত। এখানে ‘বাপব্যাটা দু-ভাই’ বলতে কবি রাগে কিংবা নেশার ঘোরে ‘ব্যাপব্যাটা’-র বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানকে বুঝিয়েছেন। অন্যদিকে খিদের জ্বালায় উভয়ের অসংযত আচরণ ও অশান্তিতে ‘সারাপাড়া মাথায়’ করার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাকে, যেন খানিক কৌতুকের ছলেই কবি ফুটিয়ে তুলেছেন।

‘অল্পে খুশি’ হতদরিদ্র মানুষেরা জীবনের দুঃখকে খুব সাধারণভাবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। অর্থাভাবে প্রায়ই এদের এমন অবস্থা হয় যে, সাধারণ ভাতকাপড়েও এদের দিন যেন চলতে চায় না। তখন দুপুররাতে বাড়ি ফিরে শুকনো ভাতে সামান্য লবণটুকুও না-পেয়ে বহুদিনকার মেনে মানিয়ে নেওয়ার সুপ্ত ক্ষোভ উগড়ে দেয়। এরা সামাজিক সম্ভ্রম, শিষ্টাচার ইত্যাদি ভদ্রজনোচিত প্রথাকে ক্ষুধার্ত মুখে যেন ঠুকরে ভাঙতে চেষ্টা করে। এভাবেই ‘সামান্য লোক’ হয়েও শিক্ষিত ভদ্রলোকের পৃথিবীটাকে নিজের মতো করে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে মুখরিত করে তুলে তাদেরকে অবজ্ঞা করার দুঃসাহস দেখায় বলেই কবি আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।

১৫। ‘আমরা তো সামান্য লোক/ আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক’-কবিতায় ‘সামান্য লোক’ কারা? তাদের ‘শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা’ করার দাবি কীভাবে উল্লিখিত হয়েছে লেখো।

কবি জয় গোস্বামীর ‘ভুতুমভগবান’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া, পাঠ্য ‘নুন’ কবিতার আলোচ্য অংশে ‘সামান্য লোক’ বলতে কবি সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত নিম্নবর্গীয় মানুষদের কথা বোঝাতে চেয়েছেন।

আলোচ্য কবিতার মাধ্যমে নিম্নবিত্তের একঘেয়ে অভাব অতিক্রমকারী; সত্যিকারের দাবির কথা ফুটিয়ে তুলেছেন কবি।

স্বাধীনতার পর হয়তো এরা স্বপ্ন দেখেছিল পেট ভরে দু-বেলা খেতে পাবে। ভেবেছিল মাথাগোঁজার ঠাঁই ও লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থা হবে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। জীবনযুদ্ধে চলতে চলতেই দেয়ালের প্রান্তে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এরা নিজস্ব প্রত্যাঘাতের পথে হেঁটেছে। দুপুররাতে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা ভাতে সামান্য লবণের বন্দোবস্ত না-হওয়ায় ভেঙেছে সহনশীলতার বাঁধ। তোয়াক্কা না-করে তাদের ক্ষোভের নিজস্ব বিস্ফোরণে মুহূর্তের জন্য হলেও ক্ষমতাবানের নিশ্ছিদ্র শান্তিস্বর্গ ঝলসে উঠেছে।

সারাজীবন এই শ্রমজীবী মানুষেরা অভাবে-ধারদেনাতে জীবন কাটাতে কাটাতে ক্লান্ত। দিন বদলে যায় প্রকৃতির নিয়মে কিন্তু তারা থেকে যায় পীড়িত ক্ষুধার্তই। তাই দাবি জানাতে সোচ্চার হয় তারা।

১৬। ‘আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক’-এ দাবি কার কাছে? কেন?

কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতা থেকে গৃহীত আলোচ্য নিম্নবিত্ত, ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ সাধারণ মানুষগুলোর শুকনো ভাতে সামান্য লবণটুকুও জোটে না। তাই রাষ্ট্র তথা ভদ্রসমাজের কাছে তারা, এই চিরকালীন দাবিটি জানায়।

স্বাধীনতার পরে কয়েক দশক কেটে গেলেও গরিব নিম্নবিত্তের অবস্থা বদলায়নি। আজও এ দেশের গরিব নিম্নবিত্ত মানুষ অভাব, অসুখ আর ধারদেনাকে সঙ্গী করে কোনোক্রমে বেঁচে থাকে। তারা জানে দুঃখ প্রকাশ করলেই দুঃখ দূর হয় না, তাই অল্পে খুশি হওয়ার চেষ্টা করে।

কোনোদিন হয়তো বাজার করার সামর্থ্যও থাকে না, আবার কোনোদিন টাকাপয়সা হাতে আসার উচ্ছ্বাসে মাত্রাছাড়া বাজার করে ফেলে। এরা বেশি দূর ভাবে না, বেশি কিছু চায় না। তবু মাঝেমধ্যেই উদয়াস্ত খেটে দুপুররাতে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা শুকনো ভাতে সামান্য লবণটুকুও পায় না। তখন এভাবে মেনে মানিয়ে নেওয়ার ফানুসটাকে অসংযত ক্ষোভে ছিঁড়ে ফেলে এবং অগ্নিশর্মা হয়ে বলে ওঠে- ‘আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।’ এই যৎকিঞ্চিৎ প্রত্যাশা পূরণের সোচ্চার ঘোষণা রাষ্ট্রনায়কদের কানে তারা পৌঁছে দিতে চায়। তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত।

আরও পড়ুন – ‘বই কেনা’ রচনার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে লেখো

Leave a Comment