ন্যায়নীতি সম্পর্কে জন রলসের তত্ত্বটির একটি বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করো

ন্যায়নীতি সম্পর্কে জন রলসের তত্ত্বটির একটি বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করো
ন্যায়নীতি সম্পর্কে জন রলসের তত্ত্বটির একটি বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করো

ন্যায়নীতি সম্পর্কে জন্ম রসের তত্ত্ব

মার্কিন রাষ্ট্র-দার্শনিক জন রল্স বর্তমান শতাব্দীর উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার একজন অন্যতম প্রবত্তা। তিনি তাঁর A Theory of Justice-এ উদারনীতির আলোকেই ন্যায়নীতি (Justice) সংক্রান্ত তত্ত্বটি উদ্ভাসিত করেন। রল্স তাঁর আলোচনায় অভিনব কৌশল অবলম্বন করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি তিনটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। এগুলি হল- [1] আদি বা প্রাথমিক অবস্থান, [2] অজ্ঞতার আড়াল বা অবগুন্ঠন, [3] ন্যায়বিচারের স্বচ্ছতা।

[1] আদি বা প্রাথমিক অবস্থান: 

ন্যায়নীতি সম্পর্কে প্রথমেই সামাজিক চুক্তি মতবাদকে স্মরণ করেছেন। সামাজিক চুক্তি অনুসারে মানুষ পরিচালিত হয়েছে নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা। প্রত্যেকে কেবল নিজ ভাবনাটুকুই ভাবত, অপরের ভাবনা দ্বারা পরিচালিত হওয়া বা অপরকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো কাজ করত না। লক্ষ্যপূরণ ও সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য মানুষ যেমন একে অপরের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে, সামাজিক চুক্তির মতবাদে সেভাবে দেখানো হয়নি। অর্থাৎ প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ একে অন্যের কাজে আগ্রহী ছিল, তবে তারা মুক্তিহীন ছিল না। রল্স মানুষের এই অবস্থা থেকেই নির্মাণ করেন তাঁর চুক্তির ধারণাটি। কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ তার বুদ্ধিশক্তি থেকে একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিল না। ‘আদি অবস্থান’ হল তাই এমন এক ‘ধরন’ যেখানে মানুষের সব কিছুই ছিল, কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কাল্টকে অনুসরণ করে রল্স উল্লেখ করেছেন যে, মানুষ আগ্রহী ছিল অধিকার, স্বাধীনতা, ক্ষমতা, সুযোগসুবিধা, আত্মসম্মান প্রভৃতি লাভ করতে। আদি অবস্থানেই আবার মানুষের সর্বাধিক সুবিধালাডের কামনা জেগেছিল।

[2] অজ্ঞতার আড়াল বা অবগুন্ঠন: 

জন রল্স আদি অবস্থানের আলোচনা প্রসঙ্গেই ‘অক্ততার আড়াল ধারণাটির নির্মাণ করেন। ‘অক্ততার আড়াল’ হল এমন একটি প্রতীকী রূপ, যার দ্বারা আদি অবস্থানের বাস্তবায়ন ঘটে। মূলত সামাজিক চুক্তি তত্বে মানুষকে এমন একটি অবস্থায় অবস্থানের কথা বলা হয়েছে, যেখানে যুক্তিশীল মানুষ থাকলেও তাদের বিকাশ ছিল না। একে তাই তিনি বলেছেন, অক্ততার আড়াল বা অবগুন্ঠন। রল্স দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক অবস্থায় অজ্ঞতার আড়ালে থাকার কারণ হল ওই সময়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক-অর্থনৈতিক বিষয়ের প্রাথমিক ধারণা থাকলেও অসাম্য, বৈষম্য, বিবাদ, সংঘর্ষ প্রভৃতি সম্পর্কে কিছুই তারা বুঝতে চাইত না। অন্যভাবে বলা যায়, এগুলি কোন ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ধৃত তা তাদের জ্ঞানের অতীত ছিল। অজ্ঞতার আড়ালে নিমজ্জিত থাকার আরও কারণ হল, মানুষ তার সামাজিক অবস্থান, শ্রেণিগত মর্যাদা, ব্যক্তির জ্ঞানবুদ্ধি কোনো কিছুই জানার চেষ্টা করেনি। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ন্যায় সম্পর্কিত বোধ থাকলেও এর কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না; অথচ তারা তাদের সার্বিক কল্যাণে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল।

[3] ন্যায়নীতি বা ন্যায়বিচারের স্বচ্ছতা: 

জন রল্স ‘আদি অবস্থান’ ও ‘অজ্ঞতার আড়াল’-এর ধারণা থেকে ‘ন্যায়নীতির স্বচ্ছতা’ (Justice as Fairness)-র ধারণায় এসেছেন। এই নীতির দ্বারা তিনি ন্যায্য পাওয়ার বা বণ্টনের রূপটি তুলে ধরেন। অর্থাৎ তিনি মনে করেন, ন্যায়বিচারের স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে ন্যায্য বণ্টনের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। এই বণ্টনের ক্ষেত্রে যুক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ তাদের ইচ্ছা, স্বার্থ, নিজস্ব মনোভাব প্রভৃতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে নীতির রূপায়ণ করবে। উদাহরণ হিসেবে এখানে বলা হয় যে, কোনো জন্মদিনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের একটি কেক কাটতে দেওয়া হল। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ যদি বিশেষ কোনো ব্যক্তির কথা না ভাবে, তাহলে সকলের জন্য সমানভাবে তা কাটবে এবং তাদের যদি এ কথা জানা না থাকে যে তারা ‘কে’, ‘কী’ পাবে, তাহলে বস্টনের ক্ষেত্রে কোনো বিরোধ দেখা দেবে না। এইভাবে ‘আদি অবস্থান’ ও ‘অক্ততার আড়াল’-এ থেকে যে চুক্তি সাধিত হয়, তাকেই বলা হয় ‘ন্যায়নীতির স্বচ্ছতা’ বা “Justice as Fairness’ | এই নীতি অনুসারে সকলের মূল বোধের সমবণ্টন জরুরি।
রল্স ‘ন্যায়নীতি’ তত্ত্বের আলোচনায় সমবন্টনের ক্ষেত্রে দুটি মূলনীতির উল্লেখ করেছেন। এই নীতি দুটি হল- 
[a] প্রথম নীতি: রল্স তাঁর প্রথম নীতিতে সকলের জন্য সম-অধিকার সম্পন্ন স্বাধীনতার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের স্বাধীনতার সামঞ্জস্য প্রয়োজন। স্বাধীনতা বলতে রল্স বুঝিয়েছেন-প্রত্যেকের ভোটদানের অধিকার, সরকারি পদে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার, আইনের অনুশাসনের অধিকার প্রভৃতি। অর্থাৎ প্রশমননীতির দ্বারা ব্যক্তির স্বাধীনতার তথা কল্যাণের দিকটিকে তিনি তুলে ধরেছেন। এর ফলে উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে।
[b] দ্বিতীয় নীতি: এই নীতিতে সম সুযোগসুবিধা দানের ক্ষেত্রে তিনি সামাকে প্রতিফলিত করেছেন। এই নীতি অনুসারে বলা হয়েছে যে, সকলের সুবিধার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলিকে বিনান্ত করে দেখতে হবে, সবচেয়ে কম সুবিধাভোগীদের কীভাবে সর্বাধিক সুবিধাভোগীদের তালিকায় নিয়ে আসা যায়। তাঁর এই নীতি সর্বাধিক নীতি বা Maximin Priciple নামে পরিচিত।

সমালোচনা: 

রসের ন্যায়নীতি তত্ত্ব আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞান জগতে এক নব উদ্ভাবন, যদিও এটি একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়। তাঁর তত্ত্বের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তিগুলি দেখানো হয় তা হল–

[1] শ্রেণিবৈষম্য: 

সমালোচকগণ মনে করেন যে, রল্স শ্রেণিবৈষম্যকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। তিনি মনে। করেছেন, সম্পদশালীদের সম্পদের বৃদ্ধি ঘটলে সম্পদহীনদের উপকার হবে।

[2] সম্প্রদায়কে উপেক্ষা: 

মাইকেল ম্যান্ডেল, ম্যাকাইভার প্রমুখ মনে করেন যে, ব্যক্তির পরিচয় তার সম্প্রদায়ের মধ্যে। সম্প্রদায়ই ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন দিক গঠন করে। রল্স ব্যক্তির সঙ্গে এই সম্প্রদায়গত মিলটিকে উপেক্ষা করেছেন। 

[3] মার্কসবাদীদের অভিমত: 

মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় বিষয়গুলি সম্পর্কে ধারণা ছাড়া আদি অবস্থানের আলোচনা যুক্তিসম্মত হতে পারে না। প্রতিটি সমাজই শ্রেণিবৈষম্য দ্বারা আচ্ছন্ন।
পরিশেষে বলা যায় যে, রল্স যে ন্যায়নীতির তত্ত্ব উপস্থিত করেছেন, তা বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হলেও একেবারে তাৎপর্যহীন বলা যায় না।

Leave a Comment