পারস্যের ‘ক্ষত্রপ’ ও চিনের ‘ম্যান্ডারিন’-এর বর্ণনা দাও
প্রতিটি দেশের শাসন পরিচালনার জন্য একটি সুদক্ষ শাসন সংগঠনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সেরকমই অতীতে সুবিশাল সাম্রাজ্যের শাসকেরা তাদের প্রশাসনিক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশাসক বা শাসন সংগঠন গড়ে তোলেন, যেমন- পারস্যের ক্ষত্রপ বা স্যাট্রাপ ও চিনের ম্যান্ডারিন।
পারস্যের স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপ
পারস্য সাম্রাজ্য বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে ছিল অন্যতম। ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাস এই সাম্রাজ্যের পরিধির বিস্তার ঘটান। এই সুবিশাল সাম্রাজ্যকে পরিচালনার জন্য তিনি তাঁর সাম্রাজ্যকে ক্ষুদ্র-বৃহৎ কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেন। এই প্রদেশগুলিকেই স্যাট্রাপি বলা হত। প্রত্যেকটি স্যাট্রাপিতে নিয়োগ করা হত প্রাদেশিক শাসনকর্তা, যারা পরিচিত ছিলেন স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপ নামে। সাইরাস এই ব্যবস্থার সূত্রপাত করলেও প্রথম দরায়ুস এই স্যাট্রাপি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রূপ দান করেন।
স্যাট্রাপ শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ
স্যাট্রাপি ও স্যাট্রাপ-এই দুই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ স্যাট্রাপিয়া থেকে। পারসিক ধারণা অনুযায়ী সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা হলেন স্যাট্রাপ। অপর মত অনুযায়ী, সংস্কৃত শব্দ ক্ষত্রিয় থেকে স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপ শব্দটির উৎপত্তি। তাছাড়াও এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল- প্রাচীন পারস্যের প্রদেশগুলির শাসক।
স্যাট্রাপদের নিয়োগ এবং মর্যাদা
পারসিক সম্রাটগণই স্যাট্রাপদের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করতেন। এই স্যাট্রাপরা ছিলেন মূলত রাজপরিবার বা অভিজাত পরিবারের সদস্য। স্যাট্রাপের পুত্রই স্যাট্রাপ হতে পারতেন অর্থাৎ, এই ব্যবস্থা ছিল বংশানুক্রমিক। মর্যাদার দিক থেকেও এই স্যাট্রাপগণ ছিলেন প্রদেশের গভর্নরের সমান।
স্যাট্রাপদের কার্যাবলি
স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রিয়রা যেসকল দায়িত্বগুলি পালন করতেন সেগুলি হল- (a) স্যাট্রাপরা সামরিক দায়িত্ব পালন করতেন যেমন- সৈনিক নিয়োগ, দুর্গগুলির রক্ষণাবেক্ষণ, সৈন্যদের সুবিধারক্ষার্থে পথঘাট নির্মাণ প্রভৃতি। (b) স্যাট্টাপগণ প্রদেশগুলি থেকে কর বা রাজস্ব আদায় করতেন। সেই রাজস্ব নির্দিষ্ট সময়ে কেন্দ্রীয় কোশাগারে জমা দিতেন। (c) প্রদেশগুলিতে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কাজের জন্য স্থানীয় কর্মচারী বা আমলাদের নিয়োগের দায়িত্বও পালন করতেন স্যাট্রাপরা। (d) স্যাট্রাপরা দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার করতেন। এককথায় স্যাট্রাপরা ছিলেন প্রদেশগুলির সর্বোচ্চ বিচারক। পাশাপাশি স্যাট্রাপগণ আইনশৃঙ্খলা, সুশাসন ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন, যাতে সাধারণ মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে।
সম্রাটদের সঙ্গে স্যাট্রাপদের সম্পর্ক
স্যাট্টাপরা যাবতীয় কার্যের জন্য সম্রাটের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেন। তারা স্যাট্রাপির শাসন পরিষদকে সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। স্যাট্রাপরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে সম্রাটরা স্যাট্রাপদের সতর্ক করে দিতেন। সম্রাটরা আগাম সতর্ক করে দেওয়ার পরও যদি স্যাট্রাপরা তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতেন, তাহলে সম্রাট তাদের সেই পদ থেকে পদচ্যুত করতে পারতেন।
স্যাট্রাপদের বিদ্রোহ
স্যাট্রাপদের বিদ্রোহ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে। দরায়ুসের আমলেও স্যাট্রাপিতে বিদ্রোহ দেখা যায়। সেই বিদ্রোহ দমন করেন প্রথম দরায়ুস। সম্রাট জারেক্সেস-এর আমলেও বিদ্রোহ লক্ষ করা যায়। স্যাট্রাপগণ সবথেকে বড়ো আকারের বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তৃতীয় আলেকজান্ডারের সময়কালে।
স্যাট্রাপদের বিলোপ
প্রশাসনিক স্তরে স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। এর ফলে অযোগ্যদের প্রবেশ ঘটায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা হয়ে পড়ে দুর্বল। স্যাটাপরাও বারংবার বিদ্রোহ করার ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি শিথিল হয়ে যায়। পরবর্তীকালে স্ট্যাটেগো নামক কর্মচারীদের উত্থান ঘটলে স্যাট্রাপদের বিলোপসাধন হয়।
চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থা
চিনে মাঞ্জু রাজবংশের শাসনকালে সরকারি কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন ঘটে। নতুনভাবে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রূপ দান করা হয়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে বিশ শতকের সূচনাকালে চিনে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, তা পরিচিত ম্যান্ডারিন নামে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিনে সরকারি কর্মচারীদের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ম্যান্ডারিন পদটি যথার্থ রূপ লাভ করে।
ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার উৎস ও অর্থ
ইংরেজি ‘ম্যান্ডারিন‘ শব্দটির উৎপত্তি পোর্তুগিজ শব্দ ম্যান্ডারিম থেকে। গবেষকদের মধ্যে অনেকেই অনুমান করেন এই ভাষাটি পোর্তুগিজরা মালয়ী ভাষা থেকে গ্রহণ করেছেন এবং মালয়ীরা এই শব্দটি গ্রহণ করেছে মন্ত্রিণ শব্দ থেকে। মালয়েশিয়ার উংকু আবদুল আজিজ-এর মতে, সুলতানি আমলে মালাক্কায় যেসকল পোর্তুগিজরা বসবাস করত, তাদের মধ্যে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বলা হত মেস্তেরিন। এই শব্দেরই বিবর্তিত রূপ হল ম্যান্ডারিন।
যোগ্যতা
কঠোর পরীক্ষার মাধ্যমে ম্যান্ডারিনদের নিয়োগ করা হত। জন্ম এবং বংশপরিচয়ের পাশাপাশি যে বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হত সেগুলি হল- প্রশাসনিক দক্ষতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, চিনা ঐতিহ্যের পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা প্রভৃতি। তবে পাহারাদার, অপরাধী, বণিক, সংগীতজ্ঞ প্রমুখ ব্যক্তিদের ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থী হিসেবে পরীক্ষায় বসার জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করা হত না।
নিয়োগ
ম্যান্ডারিন পদে প্রথমদিকে সম্রাটের আত্মীয় বা পরিচিতরা নিযুক্ত হতে পারতেন। পরবর্তীকালে এই পদে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা নেওয়া হত। পরীক্ষায় মূলত সাহিত্য, কনফুসীয় দর্শন, তাওবাদ, সাধারণ জ্ঞান, রাজনীতি বিষয়ক প্রশ্ন করা হত। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের গুণগতমান অনুযায়ী কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক বা স্থানীয় অঞ্চলে নিয়োগ করা হত।
ম্যান্ডারিনদের স্তর ও পোশাক-পরিচ্ছদ
পদমর্যাদার দিক থেকে ম্যান্ডারিনদের দুটি স্তর ছিল। প্রথম শ্রেণির অর্থাৎ, উচ্চশ্রেণির ম্যান্ডারিনরা চিনা প্রধানমন্ত্রীর সমপর্যায় ছিলেন। তাদের পোশাকে সারস পাখির চিহ্ন আঁকা হত। তারা পদ্মরাগমণিযুক্ত টুপি ব্যবহার করতেন। দ্বিতীয় শ্রেণির অর্থাৎ, সাধারণ ম্যান্ডারিনরা স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। এঁদের পোশাকে সোনার লেজযুক্ত পাখির চিহ্ন আঁকা হত। তারা সোনা, রুপো, প্রবাল দেওয়া টুপি ব্যবহার করতেন।
ম্যান্ডারিনদের কার্যাবলি
ম্যান্ডারিনরা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যেসকল কার্যকলাপ পরিচালনা করতেন সেগুলি হল- ম্যান্ডারিনরা সম্রাটকে প্রশাসনিক কাজে পরামর্শ প্রদান করতেন। এ ছাড়া উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা অন্যান্য বিষয়েও সহায়তা প্রদান করতেন। প্রদেশ বা স্থানীয় অঞ্চলগুলিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব থাকত সাধারণ বা নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের। ম্যান্ডারিনরা চিনের স্থানীয় শাসক ও রাজার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার কাজ করতেন। এ ছাড়াও চিনের ঐতিহ্য রক্ষা করা ছিল তাদের অন্যতম কর্তব্য। সম্রাটের দরবারে বৈদেশিক সম্পর্ক, নিরাপত্তা, আইন, বিচার প্রভৃতি ক্ষেত্রে ম্যান্ডারিনরা যুক্ত থাকতেন। গ্রামাঞ্চলে কর বা রাজস্ব সংগ্রহেও তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অবসান
ম্যান্ডারিনরা আর্থিক দিক থেকে সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল। নিজেদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের দরুন তারা সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিল। ম্যান্ডারিনদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যে পরীক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চিনে মাঞ্জু বংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়।