পোর্তুগালের ভৌগোলিক অভিযানের বিবরণ দাও

পোর্তুগালের ভৌগোলিক অভিযানের বিবরণ দাও

পোর্তুগালের ভৌগোলিক অভিযানের বিবরণ দাও
পোর্তুগালের ভৌগোলিক অভিযানের বিবরণ দাও

ভূমিকা

পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কালে পোর্তুগাল, স্পেন, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ দুঃসাহসিক সামুদ্রিক অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানগুলির ফলে অনেক নতুন নতুন জলপথ এবং নতুন দেশ ও মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়। এই ভৌগোলিক আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা অগ্রগণ্য ছিল পোর্তুগাল।

(1) শুরুর কথা: ইউরোপের দুই প্রতিবেশী দেশ পোর্তুগাল ও স্পেনের মধ্যে সামুদ্রিক অভিযানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দ্বন্দু ও বিরোধ ছিল। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের বুল বা নির্দেশনামা দ্বারা এবং ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে টর্ভেসিল্লাস-এর চুক্তির (Treaty of Tordesillas) মাধ্যমে সেই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। স্থির হয় যে, আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম দিক হবে স্পেনের এবং পূর্ব দিক হবে পোর্তুগালের নৌঅভিযানের এলাকা।

(2) নাবিক হেনরির অভিযান: পোর্তুগালের রাজকুমার ইনফ্যান্টি হেনরি ভৌগোলিক অভিযানের প্রাণপুরুষ। মূলত তাঁরই উদ্যোগে পোর্তুগাল প্রথম ভৌগোলিক অভিযানে লিপ্ত হয়। তাই তাঁকে হেনরি দ্য নেভিগেটর (Henry the Navigator) আখ্যা দেওয়া হয়। তিনি প্রাচ্যে আসার জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টা করেন এবং গিনি, মাদেইরা, অ্যাজোর্স প্রভৃতি স্থান আবিষ্কার করেন। ১৪২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি দুর্গম বোজাডোর (Cape Bojador) অন্তরীপে পৌঁছোন। নাবিক হেনরি সমুদ্রপথের একটি মানচিত্র তৈরি করেন এবং পোর্তুগালের আলগার্ড নামক স্থানে সাগ্রেস নামে একটি নৌবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

(3) বার্থেলোমিউ দিয়াজের অভিযান: ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নাবিক বার্থেলোমিউ দিয়াজ সমুদ্র অভিযানে বেরিয়ে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-তম প্রান্তে এসে পৌঁছোন। যাত্রাপথে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির বাধা অতিক্রম করে এখানে পৌঁছোন বলে তিনি এর নাম দেন ঝড়ের অন্তরীপ (Cape of Storm)। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় জন ‘ঝড়ের অন্তরীপ’-এর আবিষ্কার থেকে ধারণা করেন যে, এই পথ ধরেই ভারতে পৌঁছোনো সম্ভব হবে। তাই তিনি ঝড়ের অন্তরীপের নাম পরিবর্তন করে নাম দিলেন উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of good hope)।

(4) পাইভা ও ক্যাওরের অভিযান: নাবিক আলফানসো ডি পাইভা ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে জলপথে ইথিওপিয়ায় যেতে সমর্থ হন, যা ভারতে আসার জলপথের আবিষ্কারের সম্ভাবনা তৈরি করে। দিওগো ক্যাওর ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার কঙ্গো আবিষ্কার করেন। তিনি ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নামিবিয়া পর্যন্ত পৌঁছোন।

(5) ভাস্কো-দা-গামার অভিযান: ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা পোর্তুগাল থেকে যাত্রা শুরু করে উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে ভারতের কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছোন ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে। এইভাবে ভাস্কো-দা-গামা ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কার ইউরোপের নাবিকদের সমুদ্র অভিযানে প্রেরণা ও দিনির্দেশের কাজ করে।

(6) আলবুকার্ক-এর অভিযান: ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে আলফানসো ডি আলবুকার্ক ইথিওপিয়ার কাছে হরমুজ বন্দরটি দখল করেন এবং উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে ভারতের গোয়ায় আসতে সমর্থ হন ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে। ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতমহাসাগরের নিকটবর্তী মালাক্কা দখল করেন। আলবুকার্ক চিনের ম্যাকাও বন্দরে পৌঁছে পোর্তুগিজ বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেন।

(7) কেব্রালের অভিযান: ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে পেড্রো আলভারেজ কেব্রাল আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ব্রাজিল আবিষ্কার করেন। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে অভিযান করে সেখানে পোর্তুগিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। কেব্রাল ভারতের কোচিন বন্দরে পৌঁছে পোর্তুগিজ বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেন।

(8) পোর্তুগালের সাফল্যের কারণ: সামুদ্রিক অভিযান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারে পোর্তুগিজ নাবিকদের অসাধারণ সাফল্যের পিছনে বেশ কেছু কারণ ছিল-

  • পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের পোর্তুগালের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ভৌগোলিক অভিযানের সহায়ক হয়েছিল।
  • ভৌগোলিক অভিযানে নতুন নতুন দেশ-মহাদেশের বিশেষত আফ্রিকার সোনা ও সম্পদ আহরণ করে নিজ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটানোর আকাঙ্ক্ষায় এদেশের রাজশক্তি ভৌগোলিক অভিযানে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল।
  • ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কারণে পোর্তুগালের নৌপ্রযুক্তি অন্যান্য দেশের থেকে উন্নত ছিল।

মূল্যায়ন

ঐতিহাসিক জন হোরেস প্যারির মতে, পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ভৌগোলিক অভিযানের ‘প্রাথমিক নিরীক্ষণের যুগ’-এ সর্বাধিক সাফল্যের অধিকারী দেশ ছিল পোর্তুগাল। মূলত পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযানের ফলেই আফ্রিকার দ্বার ইউরোপের কাছে উন্মুক্ত হয় এবং জলপথে ভারতে আসার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা সফল হয়।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment