![]() |
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ, ফলাফল, প্রভাব ও গুরুত্ব |
১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লব
সূচনা: ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের ফলে ফরাসি পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অনুসারে অর্লিয়েন্স রাজবংশের লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। লুই ফিলিপ বিপ্লবী আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। নানা উদারনৈতিক সংস্কারসাধনের মাধ্যমে তিনি ফরাসি জাতির সহানুভূতি অর্জনে সচেষ্ট হন। এসত্ত্বেও তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমে ওঠে এবং ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে তাঁর পতন ঘটে।
জুলাই রাজতন্ত্র
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ
জনসমর্থনের অভাব
- ন্যায্য অধিকার বা রাজতন্ত্রের সমর্থকরা মনে করত যে, ফরাসি সিংহাসনের ওপর লুই ফিলিপের কোনো বৈধ অধিকার নেই। তাঁদের চোখে লুই ফিলিপ ছিলেন অবৈধ বা বেআইনি শাসক।
- ক্যাথলিকরা লুই ফিলিপ প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির ঘোরতর বিরোধী ছিল।
- ‘বোনাপার্টিস্ট’ বা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অনুগামীরা প্রথমে তাঁর পুত্র ও তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র লুই বোনাপার্টকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসাতে উৎসাহী ছিল।
- প্রজাতান্ত্রিকরাও এই রাজতন্ত্রের প্রতি প্রবল ক্ষুদ্ধ ছিলেন, কারণ সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার আইনের ফলে দেশের বৃহত্তম সংখ্যক মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল।
অর্থনৈতিক সঙ্কট
প্রত্যক্ষ কারণ
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব ও প্রভাব
ফ্রান্সে: ফ্রান্স ও ইউরোপের ইতিহাসে এই বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
- ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান এবং প্রজাতন্ত্রের জয় ঘোষিত হয়। লা-মার্টিন এই অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
- সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ৭৫০ জন সদস্য-বিশিষ্ট একটি আইনসভা গঠিত হয়। এই আইনসভা ছিল এককক্ষ-বিশিষ্ট। তাতে চার বছরের জন্য একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ব্যবস্থা হয়। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ভ্রাতুষ্পুত্র লুই নেপোলিয়ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর অকস্মাৎ প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে তিনি রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং তৃতীয় নেপোলিয়ন নামধারণ করে নিজেকে ‘ফরাসিদের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেন। এইভাবে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ফ্রান্সে ‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সত্ত্বেও বলতে হয় যে, ফেব্রুয়ারি বিপ্লব একেবারে ব্যর্থ হয়নি। সর্বজনীন ভোটাধিকারের নীতি স্বীকৃতিলাভ করে এবং নিম্নবিত্ত সাধারণ বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ লাভ করে।
ফ্রান্সের বাইরে: ১৮৪৮-এর বিপ্লবের সূচনা প্যারিসে এবং কালক্রমে তা সমগ্র ইউরোপে পরিব্যাপ্ত হয়। অধ্যাপক টেলর-এর কথায়, “প্যারিস হল বিপ্লবের জননী।” এই বিপ্লব ইউরোপের ১৫টি দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দকে তাই সাধারণভাবে ‘বিপ্লবের বছর’ বলে অভিহিত করা হয়। ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি- সর্বত্রই স্বৈরশাসন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচার এবং মেটারনিস্ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র জাতীয়তাবাদী গণ-আন্দোলন দেখা দেয়।
- জার্মানির প্রাশিয়া, হ্যানোভার, স্যাক্সনি, ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন, ব্রান্সউইক প্রভৃতি রাজ্যে উদারনৈতিক গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং এইসব রাজ্যের রাজন্যবর্গ জনগণকে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র মঞ্জুর করতে বাধ্য হন।
- ইতালির পার্মা, মডেনা, মিলান, ভেনিস, টাস্কেনি, সিসিলি, নেপল্স এবং পোপের রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ভেনিস ও রোমে দুটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
- মেটারনিখের নিজ সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়া-য় ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ভিয়েনা, হাঙ্গেরি, বোহেমিয়া- সর্বত্র বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী ভিয়েনাতে মেটারনিখের বাসভবন আক্রান্ত হয়। মেটারনিখ ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন এবং মেটারনিখতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়। অস্ট্রিয়ার সম্রাট একটি উদারনৈতিক সংবিধান প্রবর্তনে বাধ্য হন।
- ‘হাঙ্গেরির ম্যাৎসিনি’ লুই কসুথের নেতৃত্বে হাঙ্গেরির স্বায়ত্তশাসনের দাবি জয়যুক্ত হয়। বোহেমিয়ায় চেক ও মোরাভিয়ার স্লাভ জাতীয়তাবাদীরা তাদের দাবি আদায়ে সক্ষম হয়।
- ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডে-ও এই বিপ্লবের প্রভাব পড়ে।