![]() |
মানসিক দূষণ রচনা |
ভূমিকা
আজকে সারা পৃথিবীতে অবনমন ও অবক্ষয়, দূষণ ও দুর্নীতি প্রায় সমার্থক শব্দ। আর এগুলি পরস্পর একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু তাই নয়, এগুলির উদ্ভব, বিকাশ, পরিণতি ও গতিপ্রকৃতি সমাজের উচ্চস্থান থেকে নিম্নস্থানের দিকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কৃত্রিম স্বার্থসর্বস্ব পৃথিবীতে তা প্রকট হয়ে উঠেছে। আমাদের আলোচ্য হল জল, বায়ু, শব্দ, ভূমি, দৃশ্য দূষণ নয়; বরং এগুলির বাইরে অবস্থিত মানসিক অবনমন বা অবক্ষয় যা আমাদের অন্তর্গত ‘রক্তের ভিতর খেলা করে’ আমাদের অবক্ষয়িত করে, অবক্ষয়িত করে দেশ ও পৃথিবীকে। এই অবনমন রোধ করতে গেলে প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সার্বিক সচেতনতা।
পটভূমি
বিশ্বায়নের ফলে আজকের একবিংশ শতাব্দীর মানুষ বাজার অর্থনীতির অক্টোপাশে আবদ হয়ে বড়ো বেশি কৃত্রিম ও স্বার্থসর্বস্ব জীবনকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হয়েছে। বাজারসর্বস্ব অর্থনীতির ঠেলায় প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে মানুষ তার চিরন্তন চারিত্রিক সম্পদগুলিকে (ত্যাগ, ধৈর্যশক্তি, মায়া-মমতা-ভালোবাসা, শ্রমশীলতা) হারিয়ে ফেলেছে বা অবক্ষয়িত করেছে। ফলে সুবিধাবাদী মনোভাব প্রকট হয়ে উঠেছে, প্রকাশিত হয়ে পড়েছে মানুষের অন্তরের দেউলেপনা। তাই মানুষ আজ তার পুরানো মন্ত্র ‘চিচিং ফাঁক’ ভুলে গিয়ে ‘আলু ফাঁক’, ‘কুমড়ো ফাঁক’ বলে চিৎকার করছে; তাতে বদ্ধ দরজা খোলা যাচ্ছে না যার ফলে অপমৃত্যু বা মানসিক মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। যে মানুষ স্বার্থপর, যে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, নিজের সমস্যাকে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে না, তার পরিণতি শূন্যতা ও নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণায় তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কী-বা হতে পারে।
প্রকৃতি ও পরিবেশ
অথচ প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের দিয়েছিল সুস্থ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক জীবনধারণের উপাদান, পৃথিবীতে জীবন বিকাশও সম্ভব হয়েছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য। কিন্তু নানা কারণে প্রকৃতি ও পরিবেশ অবক্ষয়িত হয়েছে। ফলে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিচ্যুত হওয়ায় শুরু হয়েছে নানা রকমের দূষণ। আর এই দূষণের আতুড় ঘর হল আমাদের অষ্টাবক্স (contradictory) মানসিকতা। তা যেন ‘জলে নামব বেণী ভিজাব না’-এর মতো। অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে আমরা সম্পদ গ্রহণ করব, জীবনধারণের রসদ জোগাড় করব অথচ তার পরিচর্যায় নিজেকে নিয়োজিত করব না। শুধুই নেব, কিছুই দেব না-এই দর্শন যখন মনের মধ্যে জন্ম নেয় তখনই সৃষ্টি হয় মানসিক অবনমনের এবং যা অপ্রাকৃতিক ও কৃত্রিম। অন্যদিকে পৃথিবীর ধনী দেশগুলি এই অবনমনকে সুদৃঢ় করছে-তেল ও অস্ত্র বিক্রির কৌশলের মাধ্যমে। মানুষ যত সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর হবে ততই সে কৃত্রিম ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠবে। এ ধরনের ব্যক্তিকে বাঁচতে গেলে প্রয়োজন তেল ও অস্ত্র-যা ধনী দেশগুলি জোগান দিয়ে আমাদের মানসিক অবনমনকে ত্বরান্বিত করছে।
অবনমন
প্রশ্ন আসতে পারে, এই মানসিক অবনমন কী বাধ্য হয়েই? এছাড়া কোনো উপায় কী আমাদের ছিল না? একশো কোটির ভারতবর্ষে স্বাভাবিক নিয়মে এই অবনমন তো ঘটেছে। কেননা জনসংখ্যা থেকে দারিদ্র্য, আর তা থেকে দূষণ (Popula- tion> Poverty>Pollution)। একথা মানলাম। কিন্তু তার পরেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আমাদের মনের মধ্যে যদি অতিরিক্ত ভোগাকাঙ্ক্ষা না থাকত কিম্বা শ্রমশক্তি হারিয়ে অতিমাত্রায় যন্ত্রনির্ভর বা কৃত্রিম না হতাম তাহলে আমরা এই অবক্ষয়ের শিকার হতাম না।
স্বরূপ
আজ ভারতে একটি শিশু জন্ম নেবার পর থেকেই সে জানছে প্রতিবেশী দেশ তার শত্রু। ফলে সে তার সমাজে প্রতিবেশী ভাইকেও শত্রু ভাবতে শেখে। একজন মা তার শিশুকে বলে-এটা ওকে দিবি না, ওর সঙ্গে কথা বলবি না, ওর কাছ থেকে খাবি না-ইত্যাদি। কিম্বা একজন পাওনাদারের কাছ থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য বাবা বলে দেয়, বলে দে বাবা বাড়ি নেই। অকৃত্রিম সেই শিশু পাওনাদারকে বলে-বাবা বললেন, ‘বাবা বাড়িতে নেই’। আবার উচ্চাশার রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের ইঁদুর দৌড়ে সামিল করে দিচ্ছেন। নির্মম অসম প্রতিযোগিতায় নেমে শিশুমন দিশেহারা হয়ে পড়ছে। বর্তমান কর্পোরেট জীবনে বিজয়ীর প্রতিষ্ঠা আর বিজিতের অপমৃত্যু। আজকের বাবা-মায়েরা চান না-‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। তাঁরা চান, ‘আমার সন্তান যেন থাকে এ.সি. ঘরে’।
কারণ
সেকেন্ড হওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, যত কৃতিত্ব ফার্স্ট হওয়ার মধ্যে। মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ হল আনন্দ। সেই আনন্দও আজ মানুষের কাছে বিকৃত পথে আসে-অপরের ক্ষতি করে মানুষ আজ আনন্দ পায়। প্রতিযোগিতায় হেরে মানুষ যেমন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তেমনই চেয়ার-টেবিল ভেঙে, মানুষকে আহত করে তারা আনন্দ প্রকাশ করে। উচ্চাশা কিম্বা প্রতিযোগিতার মনোভাব সবসময়ই কাম্য। কিন্তু তা কখনোই কোনোমতেই বিষম নয়। ‘পরাজিত পরাজিত’ মনোভাব নিয়ে দিশেহারা হয়ে মানুষ আজ অসম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। উন্মত্ত খ্যাপা কুকুরের মতো সে লোভ, লালসার, ভোগের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। এই ধ্বংসাত্মক মনোভাবের ভবিষ্যৎ-ই বা কী, কোথায়ই-বা এর শেষ। আজকের যুব সমাজও এর কবলে-অবশ্য তা মিডিয়ার সৌজন্যে। তারা টিভিতে বিভিন্ন অপরাধমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে, তাদের মধ্যেকার পাশবিক সত্তাকে উস্কে দিচ্ছে। সামাজিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এখন তাদের কাছে অবান্তর। সমষ্টিগত প্রতিবাদের ভাষা আমরা হারিয়েছি। রাস্তাঘাটের সংগঠিত অপরাধের কাছে আমরা নীরব প্রত্যক্ষদর্শী।
উপসংহার
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ-একথা জেনেও পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করে মানসিক অবনমন রোধ করা যাবে না। কিম্বা অতিরিক্ত ভোগাকাঙ্ক্ষা জিইয়ে রেখে শ্রমবিমুখ হয়ে অলস জীবনযাপন করে কৃত্রিম সুবিধাবাদী স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই অবনমন প্রতিহত করা যাবে না। এজন্য চাই পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি নির্মাণ করা, সহযোগিতার মনোভাব দৃঢ় করা, শ্রমশীল হয়ে ন্যূনতম চাহিদাকে তৃপ্ত করা, মানসিক মূল্যবোধে মনুষ্যত্ববোধে নিজেদের জাগ্রত করা, নিজেদের ক্ষুদ্র অহং (Igo)-কে ঝেড়ে ফেলে ‘দেশে দেশে মোর ঘর আছে সেই ঘর লব খুঁজিয়া’-এই দিব্যদৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ হওয়া। তাহলেই এই মানসিক অবনমন রোধ করা অসম্ভব হবে না। তাহলে জীবনানন্দের সুরে সুর মিলিয়ে আমরা বলতে পারব- “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।”