মুদ্রণ বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করো

মুদ্রণ বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করো

মুদ্রণ বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করো
মুদ্রণ বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করো

ভূমিকা

আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ছিল বিশ্বের এক যুগান্তকারী ঘটনা। ইউরোপে পঞ্চদশ শতক থেকে যে মুদ্রণ বিপ্লব শুরু হয়েছিল, তা শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞান সহ মানবসভ্যতার সর্বক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। নিউ কেম্ব্রিজ মর্ডান হিস্ট্রি গ্রন্থে বলা হয়েছে, মুদ্রণ মানুষের চিন্তার জগতকে উন্মোচিত করে।

(1) নির্ভুল বইপত্র প্রকাশ : আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা বইপত্র আগেকার হাতে লেখা পুথির তুলনায় অনেক বেশি নির্ভুল হয় এবং প্রুফ দেখার রীতি চালু হওয়ায় ভুল সংশোধনও অনেক সহজ হয়।  বই-এর মান যাতে সঠিক হয় সেদিকে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা যুক্ত থাকার ফলে প্রায় নির্ভুল বইপত্র প্রকাশ করা সম্ভব হয়।

(2) ধ্রুপদি যুগের বই-এর পুনমুদ্রণ: নতুন মুদ্রণ ব্যবস্থার দ্বারা – প্রাচীন ধ্রুপদি যুগের লেখকদের মূল্যবান বইগুলি আবার ছাপা হয়ে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়। সিসেরো, প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল, ভার্জিল প্রমুখের রচনা জনসাধারণের লভ্য হয়।

(3) ধর্মনিরপেক্ষ বই প্রকাশ: মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে পূর্বেকার  ধর্মকেন্দ্রিক বই ছাপার বদলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বই ছাপা হতে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য, আইন, ব্যাকরণ, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে বই ছাপার ফলে এগুলির চর্চা বৃদ্ধি পায়।

(4) শিক্ষার্থীদের সুবিধা: মুদ্রণ বিপ্লব পূর্ববর্তী যুগে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের বক্তৃতা কানে শুনে মনে রেখে, তাই নিয়ে চর্চা করাই ছিল শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের একমাত্র পদ্ধতি। কিন্তু ব্যাপক পরিমাণে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক ছাপা ও তা স্বল্পমূল্য শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া হয়। ফলে জ্ঞানচর্চায় স্বচ্ছতা ও পরিপূর্ণতা আসে। ই এফ রাইস বলেছেন, “মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়।”

(5) বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি: মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন আবিষ্কার, তত্ত্ব রচনা, মতামত ইত্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছোয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, কেপলার প্রমুখের আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর ব্যাখ্যা সম্পর্কে মানুষ আগ্রহী হন, যা সাধারণ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি করে।

(6) আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ: শুধুমাত্র লাতিন ভাষায় বই ছাপার পরিবর্তে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যরচনা শুরু হয়। দান্তে, পেত্রার্ক, চসার প্রমুখের মতো আরও অনেক সাহিত্যিক নিজের নিজের ভাষায় সাহিত্যরচনা করে ছাপার ফলে অনেক ভাষার বিকাশ ঘটে।

(7) ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নির্মাণ: আগে ধর্মচর্চা তো বটেই, জ্ঞানচর্চাতেও চার্চের নিয়ন্ত্রণ ছিল শেষকথা। প্রচুর পরিমাণে ছাপা বই বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি করে এবং মানুষ যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শেখে। বাইবেলের অনুবাদের ফলে চার্চের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যে ফাটল ধরে। চার্চের দুর্নীতি-অনাচার মানুষের চোখে পড়ে, যা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে।

(8) নতুন জীবিকা: আধুনিক মুদ্রণ পদ্ধতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে যন্ত্র পরিচালনাসহ বই ছাপার বিভিন্ন স্তরে অনেক লোকের প্রয়োজন হয়। লেখক, প্রুফরিডার, হরফ প্রস্তুতকারক প্রভৃতি নতুন নতুন জীবিকার সংস্থান হয়।

মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায় যে, মুদ্রণ বিপ্লব মানবজীবন তথা মানবসভ্যতার সর্বক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। শিক্ষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও মুদ্রণ বিপ্লবের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment