রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্য কী

রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্য কী?
রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্য কী?

রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের পার্থক্য

সাবেকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রতত্বকে সমার্থক বলে মনে করা হত। কারণ সেই সময় রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে রাষ্ট্রতত্বের সম্পর্ক ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটিকে পৃথক করে অপরটির আলোচনা ছিল অর্থহীন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। দৃষ্টবাদ (Positivism)-এর উদ্ভবের ফলে উভয় শাস্ত্রের মধ্যে ভিন্ন রূপ লক্ষ করা যায়। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের পরবর্তীকাল থেকে মূলামান নিরপেক্ষ (value-free) আলোচনার উদ্ভাবন ঘটিয়ে অভিজ্ঞতাবাদীগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দার্শনিক চিন্তাধারার পরিবর্তন সাধন করেন। এই শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দর্শনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ ও বাস্তবভিত্তিক চিন্তাধারার প্রয়োগ করতে গিয়ে তথ্যসংগ্রহ, ভৌতবিজ্ঞানের পদ্ধতি প্রয়োগ প্রভৃতি দ্বারা এক নতুন চিন্তাধারার উদ্ভাবন করলে রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্যের সুস্পষ্টতা প্রকাশ পায়।
মূলত তিনটি দিক থেকে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যথা-

[1] উদ্দেশাগত পার্থক্য: 

রাজনৈতিক দর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক জীবনধারায় কীভাবে একটি সর্বজনীন ও সাধারণ তত্ত্ব (General Theory) গড়ে তোলা যায়, তারই চেষ্টা করা। অপরদিকে অভিজ্ঞতাবাদী গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে রাজনৈতিক তত্ত্ব কোনো কিছুর কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আচরণবাদী তাত্ত্বিকগণ ঘটনার আলোচনা করতে গিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা, সংখ্যায়ন, বিচারবিশ্লেষণ প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেই তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন।

[2] বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য: 

একটি আদর্শ রাষ্ট্র (Ideal State) কীভাবে নির্মাণ করা যায় তা রাজনৈতিক দর্শনের বিষয়বস্তু। অর্থাৎ রাজনৈতিক দর্শন চায় একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য ও সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা। যেমন বলা যায়, ‘The Republic’ নামক প্রশ্নে, একটি আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণের ব্যাপারে প্লেটো ‘দার্শনিক-রাজা’ (Philosopher king)-র কথা উল্লেখ করেন। অপরদিকে বাস্তব রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আলোচনার মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটিয়ে রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশ্লেষণমূলক আলোচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। রাজনৈতিক তত্বে ভবিষ্যতের কথা পর্যালোচনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত হয়।

[3] বৈধতা বিচারের পার্থক্য: 

বৈধতা সম্পর্কিত চিন্তাধারা দ্বারা রাজনৈতিক দর্শনকে বিচার করা সম্ভব নয়। কারণ দর্শনের বৈধতা বিষয়ক বিচারবিশ্লেষণ একটি অবান্তর ধারণা। অপরদিকে রাজনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে বৈধতা বিচার সংযুক্ত। রাজনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে বৈধতা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের বিচার করা সম্ভব।

মূল্যায়ন: 

রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনৈতিক তত্বের মধ্যে যে পার্থকা দেখানো হয় তা কৃত্রিম। কারণ রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোচনার ক্ষেতে রাজনৈতিক দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটবেই। অর্থাৎ রাজনৈতিক দর্শনকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক তত্বের নির্মাণ করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই তাঁর নিজ নিজ চিন্তাধারা ও মতাদর্শ দিয়ে তাঁদের গবেষণাকে সম্পূর্ণ রূপ দেন। কাজেই রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনৈতিক তত্ত্ব একে অপরের পরিপূরক।

Leave a Comment