রাষ্ট্রচিন্তার জগতে প্লেটোর অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো
রাষ্ট্রচিন্তায় প্লেটোর অবদান
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তায় বেশকিছু ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্ব, আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা, সাম্যবাদী ভাবনা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আপাত বিচারে প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শন অবাস্তব, কল্পনাশ্রয়ী এবং নীতিসর্বস্ব মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবুও রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর মতামতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। গেটেল লিখেছেন যে, ‘প্লেটোর অনেক আদর্শই নিছক কল্পনাবিলাসিতা এবং বর্তমান কালে সেগুলির কোনও বাস্তব মূল্য নেই, কিন্তু তাঁর বেশকিছু চিন্তার চিরন্তন সত্যতা অনস্বীকার্য।’
(i) শাসকের নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার নিদর্শন স্বরূপ রাষ্ট্রদর্শন : এথেন্সে নগররাষ্ট্রের এক সংকটকালে প্লেটো তাঁর দর্শনচর্চা করেছিলেন। নৈতিকতার অভাব সেখানকার নগররাষ্ট্র ব্যবস্থার অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। প্লেটো সেই অবক্ষয় রোধের উদ্দেশ্যেই শাসক শ্রেণির নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিকাশের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং ন্যায়বিচার তত্ত্ব প্রকাশ করেন। শাসকের নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার গুরুত্ব প্রমাণের জন্য প্লেটোর এই রাষ্ট্রদর্শন অবশ্যই অনুসরণযোগ্য।
(ii) অভিনব ও অনুকরণযোগ্য ভাবনা: প্লেটো ছিলেন যথার্থই সুনাগরিক ও স্বদেশপ্রেমী। তাই ব্যক্তিস্বার্থের সংকীর্ণতাজনিত কারণে রাষ্ট্রের ভাঙন রোধ করার লক্ষ্যে তিনি রাষ্ট্রকে ব্যক্তিসত্তার উপরে স্থান দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সংহতি সুদৃঢ় করার জন্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের অধীন ও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সত্তা হিসেবে প্লেটোর এই ভাবনা যেমন অভিনব তেমনি অনুকরণীয়।
(iii) শিক্ষার বহুমুখী দিকের গুরুত্ব: প্লেটোর অ্যাকাডেমি এবং শিক্ষাবিষয়ক চিন্তা আজকের দিনেও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ শিক্ষা, শারীরশিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের উপর জোর দিয়ে তিনি শিক্ষাব্যবস্থার বহুমুখী বিকাশ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছেন।
(iv) কঠোর বাস্তবতার প্রকাশ: শাসক শ্রেণির জন্য শিক্ষার আবশ্যিকতা এবং প্রশাসকের নৈতিকতা বৃদ্ধির বিষয়ে তাঁর আগ্রহ নিঃসন্দেহে অভিনব এবং যুগোপযোগী। শিক্ষিত বা জ্ঞানী শাসকই প্রজাসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের কথা চিন্তা করতে সক্ষম হবেন- প্লেটোর এমন চিন্তা এক কঠোর বাস্তবকেই তুলে ধরে।
(v) রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা: সম্পত্তির মালিকানা এবং ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের ধারণা প্লেটোর সমর্থন পায়নি। নারী-পুরষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সামাজিক বৈষম্য রদ করে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কাজে প্লেটোর উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
মূল্যায়ন: মূলত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ অব্দে এথেন্সের সংকটের প্রেক্ষাপটে প্লেটো তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও তাঁর ভাবনার গভীরতা নিঃসন্দেহে ভাবীকালের জন্য শিক্ষণীয়। শাসকের নৈতিক আচরণ, রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থের বিসর্জন ইত্যাদি সম্পর্কে প্লেটোর ধ্যানধারণা আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থা রূপায়ণের কাজে পথপ্রদর্শকের কাজ করবে।
আরও পড়ুন – কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কী ছিল