রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা করো।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা করো।

ভূমিকা : 

সমাজবিজ্ঞানের নবীনতম শাখা হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জন্মের ইতিহাস দুশো বছরের অধিক নয়। তবে এই শাস্ত্রটি যাত্রা শুরু করে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। বর্তমানে এই শাস্ত্রটি বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাস নীচে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল-

গ্রিক যুগ : 

প্রাচীন গ্রিসেই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রচর্চার সূত্রপাত ঘটে। এই সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন সোফিস্ট দার্শনিকেরা (প্রোটাগোরাস, থ্রেসিমেকাস, হাইপাসিয়া, জর্জিয়াস প্রমুখ)। এরা ছিলেন ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক ও যুক্তিবাদী পণ্ডিত। পরবর্তীকালে সক্রেটিস সত্যজ্ঞানের আলোকে রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রগতি ঘটান। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো তাঁর ‘দ্য রিপাবলিক’, ‘দ্য স্টেটম্যান’, ‘দ্য লজ’ গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্র, ন্যায়বিচার, সাম্যবাদ, দার্শনিক রাজার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। পরবর্তীকালে প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টট্ল তাঁর ‘পলিটিকস্’ পুস্তকে রাষ্ট্র, সংবিধান, শিক্ষা, বিপ্লব, দাসপ্রথা প্রভৃতির বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন। তাই অ্যারিস্টট্লকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তা : 

রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তিভূমি হিসেবে প্রাচীন গ্রিসের প্রথমে নাম থাকলেও ভারতেও প্রায় এই সময়ে রাজনীতি-সংক্রান্ত চিন্তার সূত্রপাত ঘটেছিল—এ কথা অস্বীকার করা যায় না। ঋগবেদের যুগে কৌমতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। মহাভারতের শান্তিপর্বে রাষ্ট্রতত্ত্ব, রাজনীতি, রাজা-প্রজার সম্পর্ক, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রভৃতির পরিচয় মেলে। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ রাজধর্ম, দণ্ডনীতি, নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে বিশেষ আলোচনা করা হয়।

তিনটি প্রধান দর্শন : 

গ্রিক জগতের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের যুগে গ্রিক মনীষীরা রাজনীতির পরিবর্তে দর্শন আলোচনা শুরু করেন। এই সাধার এই সময় তিনটি দর্শন গড়ে ওঠে। যথা— a. এপিকিউরীয় দর্শন b. স্টোয়িক দর্শন এবং c. সিনিক দর্শন। এপিকিউরীয় দর্শনের মূল প্রবক্তা হলেন এপিকিউরাস। স্টোয়িক দর্শনের প্রবক্তারা হলেন জেনো ও ক্রায়োসপাস। সিনিক দর্শনের প্রধান ছিলেন অ্যান্টিসথেনিস ও ডায়োজেনিস।

রোমান যুগ : 

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্বাব্দ 753 অব্দে টাইবার নদীর তীরে রোমুলাস রোম নগরী স্থাপন করেন। বিশিষ্ট রোমান দার্শনিকেরা হলেন সিসেরো, বলিয়াস প্রমুখ। রোমান চিন্তাবিদগণ রাজনীতির চিন্তাভাণ্ডারে যে অবদান রেখে গেছেন তা হল—রাষ্ট্র, নাগরিকতা, আইন, চুক্তি, গণসার্বভৌমিকতা, মিশ্র শাসনব্যবস্থা, বিশ্বজনীনতা প্রভৃতি । রোমান শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বিষয় হল – সেনেট, জনসভা, দ্বাদশ বিধান, শাসন ভেদনীতি প্রভৃতি।

মধ্যযুগ : 

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কাল মধ্যযুগ। এ যুগের প্রখ্যাত চিন্তাবিদরা হলেন অগাস্টাইন, অ্যাকুইনাস, মার্সিলিও প্রমুখ। সারা মধ্যযুগ ছিল চার্চ ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব। সেন্ট অগাস্টাইন চার্চকেই প্রাধান্য দেন। অ্যাকুইনাস প্রথম দিকে চার্চকে প্রাধান্য দিলেও শেষ পর্বে রাষ্ট্রকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। মার্সিলিও সর্বপ্রথম রাষ্ট্রকে চার্চের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। মধ্যযুগকে ‘অন্ধকারময় যুগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়।

আধুনিক যুগের সূচনা : 

পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সূচনা হয় আধুনিক যুগ-এর। পরিষদীয় আন্দোলন, সংস্কার আন্দোলন, নবজাগরণ এবং আরও কিছু ভাবধারা রাজনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে। সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, ভৌগোলিক আবিষ্কার, মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রচিন্তার জগতে মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল। ম্যাকিয়াভেলী ছিলেন ‘নবজাগরণের সন্তান এবং আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক’। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হল ‘দ্য প্রিন্স’।

ষোড়শ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা: 

এই পর্বের বিশিষ্ট রাষ্ট্র দার্শনিকেরা হলেন বোঁদা এবং হবস্। ফরাসি দার্শনিক বোঁদা তাঁর ‘সিক্স বুকস অন দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে সার্বভৌম ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করেন। হবস্ তাঁর ‘লেভিয়াথান’ গ্রন্থে চরম সার্বভৌমিকতার ব্যাখ্যা দেন। তিনি ছিলেন আইনগত সার্বভৌমিকতার জন্মদাতা।

সপ্তদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা : 

উদারনীতিবাদের জনক হলেন জন লক। লকের রাজনৈতিক চিন্তার উল্লেখযোগ্য অবদান হল—স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব, সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব, সম্মতির তত্ত্ব, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ, ব্যক্তিস্বাধীনতা,সম্পত্তির তত্ত্ব, চুক্তিতত্ত্ব প্রভৃতি। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘টু ট্রিটিজ অন সিভিল গভর্নমেন্ট’। এই সময় ইংল্যান্ডে গৌরবময় বিপ্লব (1688) ঘটে যায়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা : 

এই পর্বে রুশো তাঁর ‘সামাজিক চুক্তি’ গ্রন্থে সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব নির্মাণ করেন। তিনি হলেন জনগণের সার্বভৌমিকতার জন্মদাতা। এই পর্বে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ঘটে যায়। একটি আমেরিকার স্বাধীনতা বিপ্লব (1776), অন্যটি ফরাসি বিপ্লব (1789)। এই সময় বেন্থাম হিতবাদ বা উপযোগিতাবাদের তত্ত্ব নির্মাণ করেন। এর মূল কথা হল—‘সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক সুখ লাভ করা’।

ঊনবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা : 

এই পর্বে যাঁরা রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তাঁরা হলেন মিল, মার্কস, হেগেল, কান্ট, স্পেনসার প্রমুখ। মিলের অবদান হল ব্যোমীয় হিতবাদের সংশোধন, স্বাধীনতা, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রভৃতি। জার্মান ভাববাদের প্রতিষ্ঠা করেন হেগেল ও কান্ট। কান্ট হলেন ভাববাদের জনক। মার্কসীয় দর্শন শ্রেণিহীন, শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ গড়ার কথা বলেন। হার্বার্ট স্পেনসারের অবদান হল বিবর্তনবাদ, জৈব মতবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ।

বিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা : 

‘মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংঘ’ (1904) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করে দেয়। বিশের দশকে দৃষ্টবাদী আন্দোলনের ফলে শাস্ত্রটি বিজ্ঞানভিত্তিক শাস্ত্রে রূপান্তরিত হয়। 1923 খ্রিস্টাব্দে গঠিত ‘সমাজবিজ্ঞান গবেষণা পর্ষদ’ আন্তঃসমাজবিজ্ঞান কেন্দ্রিক আলোচনার সূত্রপাত করেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে আচরণবাদের উদ্ভব ঘটে। আচরণবাদের প্রধান প্রবক্তারা হলেন—গ্রাহাম ওয়ালাস, চার্লস মেরিয়াম, রবার্ট ডাল, ডেভিড ইস্টন প্রমুখ। গুরুত্ব দেওয়া হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণ, ক্ষমতা, নির্বাচন, ভোট, কর্তৃত্ব, জনমত প্রভৃতিকে। 1960-এর দশকে আচরণবাদের সংকট দেখা দিলে ইস্টন তার সহগামীদের নিয়ে উত্তর আচরণবাদের সূত্রপাত করেন। উত্তর আচরণবাদীর মূল্যবোধের আলোকে সমস্ত কিছুকে বিচারবিশ্লেষণ করেন। 1970-এর দশক থেকে নয়া উদারনীতিবাদের জন্ম হয়। এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয় মুক্তবাজার অর্থনীতি, সীমিত সরকার, অবাধ বাণিজ্য, পুঁজির বিশ্বায়ন প্রভৃতিকে। বর্তমানে নারীবাদ, নাগরিক সমাজ, পরিবেশ আন্দোলন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, তুলনামূলক রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠী, সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা গুরুত্ব সহকারে শুরু করা হয়েছে।

Leave a Comment