রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞাগুলি লেখো।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞাগুলি লেখো।

ভূমিকা : 

কোনো বিষয়কে জানতে হলে তার সংজ্ঞা দিয়েই শুরু করা দরকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্দেশ করা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটি বড়ো সমস্যা। তার কারণ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার পূর্বে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ও ব্যবহার জানা প্রয়োজন।

‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দের অর্থ : 

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল সর্বপ্রথম ‘পলিটিক্স’ (Politics) শব্দটি ব্যবহার করেন। এই ‘পলিটিক্স’ (Politics) শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘পোলিস’ (Polis) থেকে। গ্রিক ভাষায় ‘পোলিস’ (Polis) শব্দটির অর্থ নগর রাষ্ট্র। নগর রাষ্ট্র সম্বন্ধে আলোচিত বিষয়বস্তুই ‘পলিটিক্স’ (Politics)। বর্তমানে নগর রাষ্ট্রের পরিবর্তে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটলেও পলিটিক্স (Politics) শব্দটি রয়ে গেছে। আর ‘সায়েন্স’ (Science) বা ‘বিজ্ঞান’ শব্দটির অর্থ সুসংবদ্ধ ও শৃঙ্খলিত জ্ঞান।

‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দের প্রথম ব্যবহার : 

অ্যারিস্টট্লকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনকরূপে অভিহিত করা হলেও তিনি তাঁর ‘Politics’ পুস্তকে কোথাও ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ কথাটি ব্যবহার করেননি। 1701 খ্রিস্টাব্দে লিবনিজ বিশপকে দেওয়া একটি চিঠিতে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে 1890 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়টিকে প্রথম তালিকাভুক্ত করেন। আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথিকৃৎ হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ধীরেন্দ্রনাথ সেন।

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা :

বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একাধিক সংজ্ঞা দিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যেসব সংজ্ঞা পাওয়া যায় সেগুলিকে প্রধানত তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যেতে পারে। যথা—i. সাবেকি (রাষ্ট্রকেন্দ্রিক) সংজ্ঞা
ii. আধুনিক (অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক) সংজ্ঞা এবং iii. মার্কসীয় সংজ্ঞা।

i. সাবেকি (রাষ্ট্রকেন্দ্রিক) সংজ্ঞা : 

সনাতন বা সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে সেই শাস্ত্রকে বোঝায় যা সমাজবদ্ধ মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনকে নিয়ে আলোচনা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাজ হল রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য এবং কার্যাবলি বিশ্লেষণ করা। ব্লুন্টসলি, গার্নার, গেটেল, গিলক্রিস্ট প্রমুখেরা সাবেকি দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন।
ব্লুন্টসলির মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাষ্ট্রের বিজ্ঞান।”
গার্নারের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়ে।”
গেটেলের মতে, “রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।” গিলক্রিস্টের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে আলোচনা করে।”

ii. আধুনিক (অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক) সংজ্ঞা : 

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুসারে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল এমন এক সামাজিক বিজ্ঞান যা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচার-আচরণ, ভোটদান, তুলনামূলক আলোচনা- ও মূল্যায়ন করে। ডেভিড ইস্টন, রবার্ট ডাল, ল্যাসওয়েল, অ্যালান বল প্রমুখেরা এই দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিয়েছেন।
ডেভিড ইস্টনের মতে, “মূল্যের কর্তৃত্বমূলক বণ্টনের আলোচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।” রবার্ট ডালের মতে, “ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও শাসন সম্পর্কে যে শাস্ত্র আলোচনা করে, তা-ই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।” ল্যাসওয়েলের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজের প্রভাব ও প্রভাবশালীদের সম্পর্ক।” অ্যালান বলের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সেই শাস্ত্র যা সমাজবদ্ধ মানুষের বিরোধ ও বিরোধের মীমাংসা নিয়ে আলোচনা করে।”

iii. মার্কসীয় সংজ্ঞা : 

মার্কসীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা হলেন—কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, গ্রামসি, মাও-জে-দং প্রমুখ। মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজের শ্রেণি সম্পর্ক ও শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কিত বিচারবিশ্লেষণ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। তাদের মতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই হল রাজনীতি তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। অর্থাৎ শ্রেণিসংগ্রাম, শ্রেণি আধিপত্য ও শ্রেণি প্রভুত্বই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল কথা।

গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা : 

যেহেতু রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল সমাজবিজ্ঞান, সেহেতু কোনো একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলি থেকে এ কথা বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের সেই শাখা, যেখানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, কার্যাবলি, সরকার, শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, সংগঠন, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বৈদেশিক সম্পর্ক, তুলনামূলক রাজনীতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দল, চাপ-সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে এবং মূল্যায়ন করে।

Leave a Comment