রুশ বিপ্লবের কারণ গুলি লেখ
![]() |
রুশ বিপ্লবের কারণ গুলি লেখ
|
রুশ বিপ্লবের কারণ গুলি লেখ
সূচনা
রাজনৈতিক কারণ
দুর্বল জারতন্ত্র: উনিশ শতকের সূচনায় রাশিয়া ছিল একটি মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র। সমগ্র ইউরোপ এই সময় জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক ভাবধারায় উত্তাল হয়ে উঠলেও রাশিয়ায় তখনও চলছিল রোমানভ বংশীয় জারদের নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র। ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী জার ও তাঁদের অনুগ্রহপুষ্ট অভিজাতরাই ছিলেন শাসনব্যবস্থার সর্বেসর্বা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। জার শাসনাধীন রাশিয়ায় সাধারণ মানুষের কোনো ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না। বেত্রাঘাত, জেল, বিনা বিচারে বন্দি ও সাইবেরিয়ায় নির্বাসন ছিল অতি সাধারণ ব্যাপার। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের প্রাককালে জারতন্ত্র একেবারে হীনবল হয়ে পড়ে এবং রাশিয়ার জাতীয় সমস্যাবলির সমাধান করা জারতন্ত্রের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। এই সময়ে দুর্বলচিত্ত জার দ্বিতীয় নিকোলাস (১৮৯৪-১৯১৭ খ্রিঃ) সিংহাসনে আসীন ছিলেন। তিনি সম্পূর্ণভাবে তাঁর রানি জারিনা আলেকজান্দ্রা-র প্রভাবাধীন ছিলেন এবং রানি আলেকজান্দ্রা আবার জর্জিয়া থেকে আগত রাসপুটিন নামে জনৈক ভণ্ড সন্ন্যাসীর প্রভাবাধীন ছিলেন। শাসনকাজ পরিচালনা, মন্ত্রী-আমলা-সেনাপতি নিয়োগ- এমনকি যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রেও রাসপুটিন ও রানি আলেকজান্দ্রার প্রভাব ছিল অপরিসীম। ইতিমধ্যে ইউরোপের গণতান্ত্রিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে বুশ বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক অধিকার লাভের জন্য আন্দোলন শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত বুশ শ্রমিক-কৃষকরাও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশের বিভিন্ন অংশে আন্দোলন শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয় হতে থাকে। ১৯১৭-র বিপ্লবের প্রাক্কালে রাশিয়ার অবস্থা এরকমই ছিল।
সামাজিক কারণ
(১) কৃষকদের অবস্থা: কৃষক ও শ্রমিকদের শোচনীয় অবস্থা এবং ব্যাপক অসন্তোষ বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
- এ সময় রাশিয়ায় শিল্পায়ন শুরু হলেও বুশ অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিনির্ভর। বুশ জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশই ছিল কৃষক। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটলেও তাতে কৃষকদের অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। জমিদারের পরিবর্তে তাদের ওপর ‘মীর’ (গ্রামীণ প্রশাসনিক সংস্থা) -এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
- জমির ওপর মুক্ত ভূমিদাসের কোনো মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কিন্তু কৃষিকাজের জন্য প্রাপ্ত জমির জন্য ক্ষতিপুরণ, সুদ এবং সরকার ও সামন্তপ্রভুদের কর মেটাতে তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। তাদের বীজ, সার, যন্ত্রপাতি- এমনকি লাঙল টানার ঘোড়াও ছিল না। অধিকাংশ কৃষকের সারাবছরের জন্য অন্নের কোনো সংস্থান ছিল না। এর ফলে দরিদ্র কৃষকরা জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এক শ্রেণির স্বচ্ছল কৃষক এইসব জমি কিনে নিতে থাকে এবং এইভাবে রাশিয়াতে এক নতুন ধরনের জোতদার বা ‘কুলাক’ শ্রেণি গড়ে ওঠে। এইভাবে মাত্র নয় বছরের মধ্যে (১৯০৬-১৫ খ্রিঃ) বিশ লক্ষেরও বেশি কৃষক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়।
- ইতিমধ্যে রাশিয়ার জনসংখ্যা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। কৃষকরা নতুন করে ভূমি-বণ্টনের দাবি জানাতে থাকে। সব মিলিয়ে রাশিয়ার গ্রাম্য জীবনে এক তীব্র অশান্তির সূচনা হয়। কৃষকরা জমিদারদের খেতখামার লুঠ করে এবং জমিদার ও তার কর্মচারীদের হত্যা করতে থাকে। নানা স্থানে কৃষকবিদ্রোহ শুরু হয়। গ্রামে গ্রামে জারের পুলিশ ও সৈন্য এবং কৃষকদের লড়াই সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়।
(২) শ্রমিকদের অবস্থা: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয় এবং দেশের বিভিন্ন অংশে নানা কলকারখানা গড়ে ওঠে। এইসব কলকারখানায় কর্মরত ২৫ লক্ষ শ্রমিকের অবস্থা ছিল অতি শোচনীয়।
- স্বল্প বেতনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নানা অসুবিধার মধ্যে তাদের কাজকর্ম করতে হত।
- তাদের জীবন ও জীবিকার কোনো নিরাপত্তা ছিল না।
- শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা বা আন্দোলন করার কোনো অধিকার – তাদের ছিল না। এই অবস্থায় বলশেভিক দল শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার চালিয়ে তাদের সংগঠিত করতে থাকে। শ্রমিকরা ক্রমশ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, জারতন্ত্রের উচ্ছেদ ব্যতীত তাদের অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। ১৯০৫ সালের পর রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমিক ধর্মঘট উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
(৩) রুশীকরণ নীতি: জার শাসনাধীন রাশিয়া ছিল ‘বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কারাগার’। এখানে পোল, ফিন, ইউক্রেনীয়, তুর্কি, বাইলো-বুশ, জর্জীয়, আর্মেনীয় প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করত। তাদের নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ছিল। রাশিয়ার জনসংখ্যার ২০% ছিল এইসব বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ। জার সরকার এইসব অ-বুশ জনগণের ওপর নানা প্রকার দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে। এইসব অ-বুশ জনগণ যে-অঞ্চলে বসবাস করত, সেই অঞ্চলের জমি ছিল খুব উর্বর ও খনিজ সম্পদে পূর্ণ। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের পর জার সরকার এই অঞ্চলের প্রচুর জমি অধিগ্রহণ করে, অ-বুশ জাতিগুলির ওপর তিনগুণ বেশি কর আরোপ করে এবং তাদের ওপর জোর করে রুশ ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি চাপিয়ে দেয়। এই বুশীকরণ নীতির বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং বিভিন্ন অ-রুশ জাতিগোষ্ঠী নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
নারদনিক আন্দোলন
অর্থনৈতিক অবস্থা
দুর্বল অর্থনীতিঃ ১৯১৭-র বিপ্লবের প্রাক্কালে অর্থনীতি ক্ষয়িত্ব, আন্তঃসারশূন্য ও ফাঁপা হয়ে পড়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে বহু একচেটিয়া মালিকানাধীন শিল্প গড়ে উঠেছিল। বুশ শিল্পে ছিল বিদেশি পুঁজির আধিপত্য। রাশিয়ার তেল শিল্পে ব্রিটিশ, রসায়ন ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে জার্মান, কয়লা ও ধাতু শিল্পে ছিল ফরাসি ও বেলজিয়ামের মূলধন। এর ফলে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৪০০ মিলিয়ন বুবল। অপরদিকে, গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল ‘কুলাক’ শ্রেণিভুক্ত মুষ্টিমেয় সমৃদ্ধশালী মানুষের হাতে। এর ফলে বুশ অর্থনীতি একেবারে দুর্বল ও আন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে এবং বিশ্বযুদ্ধের ব্যয়ের চাপে দেশের অভ্যন্তরে এক বৈপ্লবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের প্রভাব: বুশ বিপ্লবের মূলে বুশ সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের অবদানও নেহাত কম ছিল না। ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, তেমনি বুশ বিপ্লবেও দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অবদান ছিল প্রচুর। গোর্কি, ডস্টয়েভস্কি, তুর্গেনিভ, টলস্টয়, পুশকিন, গোগল প্রমুখ সাহিত্যিক দেশবাসীর সামনে স্বৈরাচারী জারতন্ত্রের স্বরূপ তুলে ধরেন। এর ফলে জারতন্ত্র সম্পর্কে জনমনে প্রবল ঘৃণার সঞ্চার হয়।
প্রত্যক্ষ কারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল বিপ্লবাত্মক। এই অবস্থায় জার শাসিত রাশিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করে বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলে।
- এই যুদ্ধ সম্পর্কে বুশ জনসাধারণের সামান্যতম কোনো আগ্রহ ছিল না এবং এর ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতাও রাশিয়ার ছিল না। প্রায় ১০ মিলিয়ন সেনার খাবার, রসদ ও বেতন জোগাতে রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য জার-সরকারকে বিদেশ থেকে ৩০০ মিলিয়ন বুবল ঋণ নিতে হয়।
- কৃষকদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায়, রাশিয়ার সর্বত্র খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়।
- রেলগুলিকে কেবল সেনাদল, যুদ্ধ-সরঞ্জাম ও অস্ত্র-কারখানার মাল পরিবহনের কাজে লাগানোর ফলে কয়লা সরবরাহ ও কয়লা উৎপাদন দারুণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। জ্বালানির সংকট দেখা দেয়। বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং জ্বালানির অভাবে সাধারণ মানুষ প্রবল সংকটে পড়ে। ক্রমে সেনাবাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ কমতে থাকে।
- ইতিমধ্যে বিভিন্ন রণাঙ্গনে রাশিয়ায় পরাজয়, জার্মানি কর্তৃক রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল এবং যুদ্ধে প্রায় ৬০ লক্ষ বুশ সেনার মৃত্যু রাশিয়াতে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
বলশেভিকদের ভূমিকা
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়ায় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ওয়াকার্স পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। বিশ শতকের গোড়ায় দলটি মেনশেভিক ও বলশেভিক এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নামে এবং বলশেভিক বা উগ্রপন্থী সমাজতন্ত্রীরা যায়। মেনশেভিক বা নরমপন্থী সমাজতন্ত্রীরা সংখ্যা গরিষ্ঠ গোষ্ঠী নামে পরিচিত হয়।