রেনেসাঁ যুগের ভাস্কর্যশিল্প সম্পর্কে টাকা লেখো

ভূমিকা
ইউরোপের সামগ্রিক বৌদ্ধিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতালীয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শিল্পের অন্যান্য শাখাগুলির মতো ভাস্কর্যকেও প্লাবিত করেছিল। প্রাচীন ধ্রুপদি ধারার ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যগুলিকে ধরে রেখে শিল্পীদের নিজস্ব স্বাধীন ভাবনা ও প্রকৃতিবোধের মিশ্রণে এই সময় ইটালিতে এক নতুন ধারার ভাস্কর্যের সৃষ্টি হয়। অচিরেই এই নতুন রীতি ইউরোপের অন্যত্র বিস্তারলাভ করে।
(1) বৈশিষ্ট্য: প্রাচীন গ্রিকে রোমান ভাস্কর্যগুলির মতো পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে ভিত্তি করে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এ যুগের ভাস্কর্যগুলি নির্মিত হয়। ভাস্কর্যশিল্প ও স্থাপত্যশিল্প ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ যুগের অনেক ভাস্করই একাধারে স্থপতি ও চিত্রশিল্পীও ছিলেন, যেমন-মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। এঁরা ইটালিতে ধর্মীয় বিষয় ও ধর্মের চোখে ‘পাপ’ এমন বিষয় উভয়কেই নিজেদের শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। নগ্ন মানবদেহে সঠিক ভঙ্গি, প্রকৃতি, অনুপাত, অনুভূতি ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলার জন্য শিল্পীরা চার্চের ভ্রুকুটি এড়িয়ে শবব্যবচ্ছেদ করতেন। যাতে মানুষের শারীরিক গঠনসৌষ্ঠব নিখুঁতভাবে বোঝা যায়।
(2) রেনেসাঁ ভাস্কর্য বিকাশের পর্যায়বিভাগ: ইতালীয় রেনেসাঁ যুগের ভাস্কর্য আলোচনার ক্ষেত্রে কলাবিশারদগণ সমগ্র রেনেসাঁ যুগের ভাস্কর্য বিকাশকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। খ্রিস্টীয় পনেরো শতকের সময়কালকে বলা হয়েছে ‘Quattrocento’ বা প্রাথমিক রেনেসাঁ পর্যায়। সে পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য ভাস্কর হলেন-লরেঞ্জা ঘিবার্টি, দোনাতেল্লো, দেল্লা কোয়ারসিয়া, ডেল্লা রাব্বিয়া, ম্যাজোনি প্রমুখ। পরবর্তী পর্যায় হল, পরিণত রেনেসাঁ পর্যায় বা ‘Cinquecento’ যা খ্রিস্টীয় যোলো শতক ধরে বিকশিত হয়েছে। এই পর্যায়ের ভাস্কররা হলেন-মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, সানসোভিনো, চেল্লিনি, আম্মানাতি প্রমুখ।
(3) লরেঞ্জো গিবার্টি: পনেরো শতকে ফ্লোরেন্সকে কেন্দ্র করে ভাস্কর্য-স্থাপত্যের যে নতুন ঢেউ উঠেছিল, তার অগ্রদূত হলেন লরেঞ্জো ঘিবার্টি। তিনি ফ্লোরেন্সের ব্যাপটিস্ট্রির দুটি ব্রোঞ্জের দরজা খোদাই করে অলংকরণ করেন, যেগুলি ২৮টি করে প্যানেলে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি প্যানেলে যিশুখ্রিস্টের জীবনের নানা পর্যায় ছবির মাধ্যমে খোদাই করে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর তৈরি দ্বিতীয় দরজাটিকে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো ‘স্বর্গের দরজা’ বলে সম্মানিত করেছেন।
(4) দোনাতেল্লো: আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের জনক বলা যায় দোনাতেল্লোকে। তিনিই সর্বপ্রথম মূর্তি তৈরিতে সঠিক দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও পরিধি সংক্রান্ত ধারণা, যাকে কলাবিজ্ঞানের ভাষায় Fithree dimension বলা হয়, তার ব্যবহার করেন। তাঁর সৃষ্টি মানব-মানবীর বাস্তব আকৃতি তুলে ধরাকে গুরুত্ব দিয়েছিল। আবক্ষমূর্তি বা ‘Bust portrait sculpture’-এর সৃষ্টিকর্তা বলা যায় দোনাতেল্লোকে। তাঁর তৈরি ডেভিড, অ্যান্টোনিও নারনি, সেন্ট লরেন্স, গাট্টামেলাটা প্রভৃতি অন্যতম স্থাপত্যকীর্তি।
(5) মাইকেল অ্যাঞ্জেলো: পনেরো শতকের শেষ দিক থেকে ষোলো শতকের অনেকটা সময় জুড়ে যে ভাস্কর ইটালিতে অমর শিল্প সৃষ্টি করে নতুন ধারার সূচনা করেছেন তিনি হলেন মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। চিত্র অঙ্কনের সঙ্গে সঙ্গে ভাস্কর্যশিল্পে তাঁর প্রধান অবদান ফ্লোরেন্সের পরিপূর্ণ অবয়বে নগ্ন ডেভিডের মূর্তি, যা বাস্তব মানবগঠন, অভিব্যক্তি ও অনুভূতিকে প্রকাশ করেছে নিখুঁতভাবে। এ ছাড়া রোমের সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিং এবং দেয়ালে তাঁর অনবদ্য খোদাই অলংকরণ আজও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটারের ব্যাসিলিকার ভিতরে ‘দ্য পিটা’, সান পিয়েত্রোতে ‘মোজেস’, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর অমর কীর্তি। সমগ্র পনেরো ও ষোলো শতক জুড়ে ইটালি এবং তার ছোঁয়ায় ফ্রান্স, ইংল্যান্ড সহ সমগ্র ইউরোপে মানবতাবাদী, বাস্তববাদী এক বিপ্লবী ধারার ভাস্কর্যের গঠন অব্যাহত থাকে। দোনাতেল্লোর ‘জুডিথ ও হোলোফার্নেস’, ভেরোচ্চিত্তর ‘যেশাস’, পাল্লদিত্তর ‘হারকিউলিস ও অ্যান্টিয়াম’ চেল্লিনির ‘পারসিয়াস উইথ দ্য হেড অফ মেডুসা’ ইত্যাদি রেনেসাঁ ভাস্কর্য হিসেবে অমরত্ব লাভ করেছে।
(6) ম্যানারিজম ও বারোক পদ্ধতি: ষোড়শ শতকের শেষ দিকে রেনেসাঁ স্থাপত্যশিল্পের যে ভিন্নধারার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তা ম্যানারিজম (mannerism) নামে পরিচিত। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, গিয়োলো রোমানো, পেরুজি প্রমুখ ছিলেন এ সময়ের স্থপতি। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নবনির্মাণ এই ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য। সপ্তদশ শতকের শুরুতে ভারী অলংকরণযুক্ত যে স্থাপত্যরীতি ইটালি থেকে সমগ্র { ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে তা বারোক (Baroque) রীতি নামে পরিচিত।
মূল্যায়ন
এভাবে এক দীর্ঘ সময়পর্ব ধরে স্থাপত্যশিল্পের ক্রমবিবর্তন ঘটেছে। প্রাচীন ধ্রুপদি ধারার কিছু বৈশিষ্ট্যকে পুনরুজ্জীবিত করে তার সঙ্গে নতুন বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদী স্থপতিরা ধর্ম-মানবজীবন-শিল্পকে একীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, সংগঠন এমনকি চার্চও এ সময় শিল্পীর স্বাধীনতার মর্যাদা দিয়েছিল।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর