শিক্ষার ব্যাপক অর্থ বলতে কী বোঝো

শিক্ষার ব্যাপক অর্থ বলতে কী বোঝো

শিক্ষার ব্যাপক অর্থ বলতে কী বোঝো
শিক্ষার ব্যাপক অর্থ বলতে কী বোঝো

যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর জ্ঞান সমূহ বিকাশের পাশাপাশি তার অভিজ্ঞতার প্রসারও ঘটে এবং যা তাদের ব্যক্তিগত এবং সমাজজীবনের সার্থক উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করে, তাকে ব্যাপক অর্থে শিক্ষা বলা হয়।

অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি ‘ব্যাপক অর্থে শিক্ষা’ সম্পর্কে বলেছেন, এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া যার দ্বারা ব্যক্তিত্বের বিকাশসাধন ঘটে এবং অপর ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক অনুধাবন করতে সমর্থ হয়।

হর্নি বলেছেন ব্যপক অর্থে শিক্ষা হল উন্নত ধরনের সংতিবিধানের ক্ষমতা।

ডামভিল-এর মতে, ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল সেইসমস্ত প্রভাব যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবনে ক্রিয়াশীল। (Education in its widest sense, includes all the influences which act upon an individual during his Passage from cradle to the grave.)

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

ব্যাপক অর্থে শিক্ষাকে বিশ্লেষণ করলে যে বৈশিষ্ট্যগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি হল-

জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া:
এই অর্থে শিক্ষা এবং জীবন সমার্থক। অর্থাৎ আমাদের জন্মমুহূর্ত থেকেই শিক্ষা শুরু হয় এবং মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। লডজের মতে, “Life is education and education is life.”

শিশুর আগ্রষ ও সামর্থ্যভিত্তিক : ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল শিশুকেন্দ্রিক। এখানে শিক্ষার্থীর চাহিদা, সামর্থ্য, জীবনবিকাশের পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

গতিশীল ও পরিবর্তনশীল: শিক্ষা হল একটি গতিশীল ও পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া, যা সারাজীবন ধরে চলতেই থাকে।

বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা: বাস্তব সমস্যাসমাধানের মাধ্যমে বাস্তব পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করে।

সমাজ অভিমুখী শিক্ষা: এই ধরনের শিক্ষা শিক্ষার্থীকে সমাজজীবনের প্রচলিত রীতিনীতি, নিয়মকানুন ও আদবকায়দা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন করে তাকে সমাজ-অভিমুখী হিসেবে গড়ে তোলে।

ক্রমবিকাশমান প্রক্রিয়া: ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল জীবনব্যাপী ক্রমবিকাশমান প্রক্রিয়া। প্রতিটি শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সকল সম্ভাবনাগুলির সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্রমবিকাশে সাহায্য করে।

অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন ও পুনঃসৃজন: প্রতিমুহূর্তে আমরা নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করি। শিক্ষার্থী তার নিজের আগ্রহ, ক্ষমতা ও প্রবণতা অনুযায়ী অভিজ্ঞতাগুলিকে পুনর্গঠন করে।

সামাজিকীকরণ:
এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণে সাহায্য করে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে ও খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে।

কৃষ্টির সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সঞ্চালন: প্রকৃত শিক্ষা কৃষ্টির সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সঞ্চালনে সাহায্য করে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চালন করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তার অগ্রগতিতে সহায়তা করে।

দ্বিমুখী প্রক্রিয়া: ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। এখানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী একে অপরকে প্রভাবিত করে। জন অ্যাডাম্স বলেছেন, “Education is a bi-polar process in which one personality acts on another to modify the development of other.” অর্থাৎ শিক্ষা হল একটি দ্বি-মুখী প্রক্রিয়া, যেখানে একজন ব্যক্তি, অপর ব্যক্তির উপর প্রতিক্রিয়া করে তার বিকাশ ঘটায়।

সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া: দৈনন্দিন জীবনে শিক্ষার্থী নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই শিক্ষা শিক্ষার্থীকে বাস্তব সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।

আচরণের পরিবর্তন:
পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য আচরণের পরিবর্তন আবশ্যক। এই শিক্ষা পুরোনো আচরণ পরিবর্তন করে নতুন আচরণ সম্পাদনে সাহায্য করে।

সর্বাঙ্গীণ বিকাশের উপযোগী: এই শিক্ষা শিক্ষার্থীর জ্ঞানমূলক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গীণ বিকাশেও (Allround development) সহায়তা করে।

তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক জ্ঞানের মিলিত প্রক্রিয়া: শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, সেই জ্ঞানকে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, সেই ব্যাপারে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন থাকা প্রয়োজন। যেমন- বিজ্ঞান বিভাগের পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের অন্তর্গত বিভিন্ন টপিকের যথাযথ জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাবহারিক জ্ঞান থাকতে হবে। শুধুমাত্র বিজ্ঞানই নয় বর্তমানে প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই বিভিন্নভাবে ব্যাবহারিক জ্ঞানের উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই বলাই যায় ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক জ্ঞানের একটি মিলিত প্রক্রিয়া।

বহুমুখী জ্ঞানার্জন: একজন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাহিদা পরিতৃপ্ত করার জন্য কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে জ্ঞানের পরিবর্তে সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ ইত্যাদি বিভিন্ন দিকের জ্ঞান থাকতে হবে। এই বহুমুখী জ্ঞানার্জনে ব্যাপক অর্থে শিক্ষা সাহায্য করে।

আত্মবিশ্বাস গঠনের প্রক্রিয়া:
ব্যাপক অর্থে শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল শিক্ষার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা, যা তাকে আত্ম উপলব্ধিতে সাহায্য করে। আত্মনির্ভর শিক্ষাই হল আত্মবিশ্বাসের মাপকাঠি।

সক্রিয়তাভিত্তিক : ব্যাপক অর্থে শিক্ষায় বলা হয়েছে শিক্ষক শুধু পড়াবেন এবং শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয় শ্রোতা হবে তা কিন্তু নয় শিক্ষার্থী সক্রিয়তার মাধ্যমে শিখবে। সক্রিয়তা বলতে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষানিরীক্ষা, বিভিন্ন ধরনের কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে শেখাকে বোঝায়। সুতরাং আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সক্রিয়তাভিত্তিক, কর্মকেন্দ্রিক, অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠক্রমের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক:
শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকরাই প্রধান। বর্তমান শিক্ষানীতিতে এই দিকটিকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, চাহিদা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। তাই ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষা।

পাঠক্রমিক ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি: শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি স্তরের জন্য পাঠক্রম হবে নির্দিষ্ট। এ ছাড়াও ব্যাপক অর্থে শিক্ষায় সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

পাঠদান এবং শিক্ষণ শিখন সহায়ক উপকরণ:
ব্যাপক অর্থে শিক্ষায় পাঠদানের জন্য বক্তৃতা, প্রতিপাদন, সমস্যাসমাধান, প্রোজেক্ট ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতি স্বীকৃত। এ ছাড়াও চার্ট, মডেল, ইত্যাদি শিক্ষণ-শিখন সহায়ক উপকরণগুলি যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়।

মূল্যায়ন: ব্যাপক অর্থে শিক্ষায় মূল্যায়ন পদ্ধতি হবে মনোবিজ্ঞানসম্মত। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পরীক্ষা ছাড়াও থাকবে বিভিন্ন ধরনের মানসিক অভীক্ষা, প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্বলতা নির্ণায়ক অভীক্ষা, সংশোধনীমূলক শিক্ষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকবে।

শৃঙ্খলা: শিক্ষাক্ষেত্রে স্বতঃশৃঙ্খলা ও সামাজিক শৃঙ্খলার (auto discipline & social discipline) উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। শৃঙ্খলার জন্য কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া চলবে না। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ এই ধরনের শৃঙ্খলার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

বিদ্যালয়: ব্যাপক অর্থে বিদ্যালয় হল সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ (Miniature of society)।

ধনাত্মক মনোভাব গঠন: শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষার মাধ্যমে যাতে নেতিবাচক মনোভাব গড়ে না ওঠে সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। ধনাত্মক মনোভাব গড়ে তোলাই হল ব্যাপক অর্থে শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

কুসংস্কার দূরীকরণ: আমাদের দেশে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। ব্যাপক অর্থে শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কুসংস্কার দূর করা।

মূল্যবোধের শিক্ষা: এই শিক্ষা শিক্ষার্থীর মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ইত্যাদি মানবিক মূল্যবোধগুলির বিকাশ ঘটায়।

জীবনদর্শনের শিক্ষা:
আদর্শ চরিত্রগঠনের জন্য জীবনদর্শনের শিক্ষা আবশ্যক। এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের চরিত্রবান এবং সুনাগরিক করে তোলে।

সুতরাং ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল শিক্ষার্থীর মধ্যে সমস্ত ধরনের উন্নত গুণের বিকাশ (সর্বাঙ্গীণ বিকাশ) ঘটানো এবং যে-সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি শিক্ষার্থীদের চরিত্রগঠনের সহায়ক নয় সেগুলিকে পরিত্যাগ করে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।

সুতরাং আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা হল শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের জন্য পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান ও কৌশল আয়ত্ত করা। অপরপক্ষে, ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশসাধন। তাই বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য প্রগতিশীল দেশগুলির মতোই শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

Leave a Comment