শিক্ষা হল একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনা করো
সারাজীবন ধরে (জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত) যে প্রক্রিয়া ঘটে, তাই-ই হল জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।
বৈশিষ্ট্য
ইচ্ছানির্ভর: শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। শিক্ষার্থীর মন যদি না চায় তবে শিক্ষা হতে পারে না।
লক্ষ্যভিত্তিক: শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কী করতে চায় কিংবা কী বৃত্তি গ্রহণ করতে চায় বা কী পেশায় নিযুক্ত হতে চায় কিংবা কী ধরনের ডিগ্রি নিতে চায় তার উপর ভিত্তি করেই শিশুবয়স থেকেই শিক্ষা প্রদান করা উচিত অর্থাৎ শিক্ষা হবে লক্ষ্যভিত্তিক।
শিক্ষায় বয়সের নির্দিষ্ট সীমা নেই: শিশুবয়স থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতাগুলি আমরা অর্জন করি, তাই-ই হল শিক্ষা। সুতরাং শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়সের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। তাই বর্তমানে প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় যে-কোনো বয়সের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পাঠক্রম নির্দিষ্ট নয়: স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রথাগত শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠক্রম নির্দিষ্ট। কিন্তু সারাজীবন ধরে আমরা যা শিখি তার জন্য কোনো পাঠক্রম নেই। সারাজীবন যা শিখি তাই-ই হল শিক্ষা।
ব্যক্তিস্বাধীনতা: যে-কোনো ব্যক্তি যে-কোনো মুহূর্তে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে অর্থাৎ শেখে। অভিজ্ঞতা ভালো বা মন্দ যাই হোক-না-কেন এতে তার স্বাধীনতা রয়েছে।
মূল্যায়ন: যে-কোনো শিক্ষায় ঠিক কী ভুল হচ্ছে তা মূল্যায়ন করা উচিত। ঠিক হলে সেইমতো কাজ করা উচিত কিন্তু ভুল হলে তা সংশোধন করা উচিত। ভুল শিক্ষা সারাজীবনব্যাপী চলতে থাকলে জীবনে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
কোর্স: প্রথাগত শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কোর্স রয়েছে। প্রথাবহির্ভূত শিক্ষারও কোর্স রয়েছে। তবে অপ্রথাগত শিক্ষা অর্থাৎ যা আমরা পরিবার বা সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে শিখি তার কোনো নির্দিষ্ট কোর্স নেই। তাই প্রথাগত, প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় কোর্স থাকলেও সারাজীবন ধরে আমরা অন্যান্য যা কিছু শিখি তার নির্দিষ্ট কোর্স নেই।
বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা: প্রথাগত, প্রথাবহির্ভূত, মুক্তশিক্ষা ইত্যাদি যে-কোনো ধরনের শিক্ষাই হোক-না-কেন তা জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ ডিউই-এর মতে, শিক্ষাই হল জীবন, জীবনই হল শিক্ষা।
জীবনব্যাপী শিক্ষার নীতি
- শিক্ষা কেবলমাত্র শিশুবয়স থেকে বয়ঃসন্ধিকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই ধারণা ত্যাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়সের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
- নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন-এই ধারণা পরিত্যাগ করা হয়েছে।
- নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, সারাজীবনব্যাপী শিক্ষা চলে অর্থাৎ সময়ের বাধ্যবাধকতা নেই।
- কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জন নয়, প্রতি মুহূর্তে একজন ব্যক্তি যা শেখে (জ্ঞান, বোধ, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি) তাই-ই হল জীবনব্যাপী শিক্ষা অর্থাৎ কোর্সের বাধ্যবাধকতা নেই।
- জীবনব্যাপী শিক্ষা হল প্রথাগত, প্রথাবহির্ভূত, মুক্ত, অপ্রথাগত ইত্যাদি সব ধরনের শিক্ষার সমন্বয়।
জীবনব্যাপী শিক্ষার ভিত্তি
উল্লম্ব সমন্বয়: শিক্ষা এমনভাবে দেওয়া দরকার যাতে শিক্ষার মাধ্যমে একস্তর থেকে পরবর্তী উচ্চ স্তরে পৌঁছোনো যায়। একে উল্লম্ব সমন্বয় বলে। যেমন-একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পাস করলে তবে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়তে পারে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তবে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করে। এইভাবে সারাজীবন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় শিক্ষা চলতে থাকে।
অনুভূমিক সমন্বয়: প্রথাগত বা প্রথাবহির্ভূত যেভাবেই একজন ব্যক্তি শিক্ষাগ্রহণ করুক-না-কেন, তার শিক্ষাকে বিভিন্ন কাজের মধ্যে সঞ্চালিত করা প্রয়োজন। একেই বলে অনুভূমিক সমন্বয়।
জীবনব্যাপী শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য:
ব্যক্তির জীবনব্যাপী শিক্ষা নেওয়ার যথাযথ শিক্ষা ও বাস্তব জীবন সম্পর্কে সচেতনতা চাহিদা থাকা দরকার, প্রয়োজন, ব্যক্তির মধ্যে জীবনব্যাপী শিক্ষা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো প্রবণতা থাকতে হবে, ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস থাকবে।
জীবনব্যাপী শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা:
জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
চাহিদার পরিতৃপ্তি: প্রতিটি ব্যক্তির চাহিদার পরিতৃপ্তির জন্য শিক্ষার প্রয়োজন।
ব্যক্তিগত পরিবর্তন: সভ্যতা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের জীবনপ্রণালী পরিবর্তিত হচ্ছে ফলে অভিজ্ঞতারও পরিবর্তন ঘটছে। পরিবর্তনশীল জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে শিক্ষার পরিবর্তন প্রয়োজন।
সামাজিক পরিবর্তন: বিজ্ঞান, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের যেমন পরিবর্তন ঘটছে ঠিক তেমনই সামাজিক পরিবর্তনও ঘটছে। সামাজিক পরিবর্তন সারাজীবন ধরেই চলতে থাকে। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনশীল মূল্যবোধের সঙ্গে সমতাবিধান করে চলতেও পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রয়োজন।
বৃত্তিগত পরিবর্তন: বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভিন্ন ধরনের বৃত্তির সুযোগ করে দিয়েছে। বিভিন্ন বৃত্তির জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন। বৃত্তির প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যা জীবনব্যাপী শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব হয়।
অবসরকালীন জীবনযাপন: বিভিন্ন বৃত্তি বা চাকুরি থেকে নির্দিষ্ট বয়সের পর অবসর নিতেই হয়। সেই অবসর জীবনযাপনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার। জীবনব্যাপী শিক্ষার মাধ্যমে অবসরকালীন জীবনযাপনের শিক্ষা পাওয়া যায়।
সকলের জন্য শিক্ষা: সকলের যথাযথভাবে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। সেই শিক্ষা প্রথাগত, প্রথাবহির্ভূত, মুক্ত যাই হোক-না-কেন। অনেকে প্রথাগত শিক্ষা মাঝপথে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তাদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জীবনব্যাপী শিক্ষার মাধ্যমে সকলকে জীবনের উপযোগী শিক্ষা দেওয়া যায়।
নিরক্ষরদের শিক্ষা: যেসব মানুষ এখনও পর্যন্ত নিরক্ষর রয়েছেন তাদেরকে সাক্ষর করা প্রয়োজন। তাদেরকে ন্যূনতম এমন শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা তাদের ন্যূনতম চাহিদাগুলিকে পরিপূর্ণ করতে পারে। এদের জন্য দরকার জীবনব্যাপী ও জীবনকেন্দ্রিক শিক্ষার।
জীবনধারণের মানের পরিবর্তন: সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনধারার মানেরও পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তন বিষয়ে সচেতন হওয়ার •জন্য প্রয়োজন জীবনব্যাপী শিক্ষার।