সক্রেটিসের পরিচয় এবং তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোকপাত করো

সক্রেটিসের পরিচয় এবং তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোকপাত করো

সক্রেটিসের পরিচয় এবং তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোকপাত করো
সক্রেটিসের পরিচয় এবং তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোকপাত করো

প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে বিতর্কিত দার্শনিক ছিলেন সক্রেটিস (Socrates, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০-৩৯৯ অব্দ)। তিনি পড়তেন অনেক, কিন্তু লিখতেন না কিছুই। তাঁর জীবন ও দর্শন সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক জ্ঞানের সূত্র হল অ্যারিস্টোফেনিস এবং জেনোফন (Xenophon)-এর রচনা। এ ছাড়া তাঁর ঘনিষ্ঠতম অনুগামী প্লেটো এবং প্লেটোর অনুগামী অ্যারিস্টটলের রচনা থেকেও নানান তথ্য পাওয়া যায়।

সক্রেটিসের পরিচয়

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান গ্রিক দার্শনিক। জন্মসূত্রে সক্রেটিস ছিলেন এথেন্সের দরিদ্র কারিগর পরিবারের সন্তান। হপলাইট সেনা হিসেবে তিনি অংশ নিয়েছিলেন বহু যুদ্ধে।*1 প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পেলোপনেসীয় যুদ্ধের আমলে তিনি দেশপ্রেমের পরিচয় দেন। দরিদ্র জীবনকে সক্রেটিস পুরস্কার বলেই মেনে নিয়েছিলেন।

শিক্ষাদান পদ্ধতি

একজন সমাজপ্রেমী এথেনীয় হিসেবে সক্রেটিস চেয়েছিলেন গ্রিক সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে সংকটাবস্থা থেকে মুক্ত করতে। এই মহান দার্শনিকের শিক্ষাদানের পদ্ধতিটি ছিল বেশ অভিনব। হাটে-বাজারে সমবেত মানুষদের কাউকে প্রথমে তিনি প্রশ্নজালে বিব্রত করতেন। তারপর সমবেত যুবসমাজকে যুক্তি-তথ্য দিয়ে নিজের অভিমত সম্পর্কে অবহিত করতেন। তাঁর অনুগামীরা ছিলেন মূলত এথেন্সের অভিজাত উঁচুতলার মানুষ। দেশের যুব সম্প্রদায়ের উপর সক্রেটিসের প্রভাব ছিল অসীম। বয়সকালে এথেন্সের প্রশাসনিক কাজেও যুক্ত ছিলেন তিনি।

সক্রেটিসের রাষ্ট্রচিন্তা

সক্রেটিসের চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল কোনও বিষয়কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থিত করা। বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। বস্তুতপক্ষে সফিস্টদের বিক্ষিপ্ত ভাবধারাকে নিয়ে পরবর্তীকালে এক বুদ্ধিদীপ্ত রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তুলেছিলেন সক্রেটিস। পেলোপনেসীয় যুদ্ধের পর এথেন্সের সমাজজীবনে নৈরাজ্য ও ভাঙন দেখা দেয়। এমতাবস্থায় সক্রেটিসের লক্ষ্য ছিল সেই ভাঙন থেকে সমাজকে রক্ষা করা। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কতগুলি দিক উল্লেখযোগ্য। যথা-

  1. তিনি বলেন যে, কেবল প্রাচীন রীতিনীতি ও বিশ্বাসের সংরক্ষণ দ্বারা সমাজের ভাঙন রোধ করা যাবে না। এরজন্য প্রয়োজন মানুষের মূল্যবোধ ও বিচারবোধের জাগরণ।
  2. রাজনৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে এই বিচারবোধ জাগিয়ে তোলা সম্ভব বলেই সক্রেটিস মনে করতেন। রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে যুক্তিবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করলে মানুষ সত্য ও ন্যায়ের পথে চালিত হবে।
  3. জ্ঞানের সার্বভৌমিকতাকে প্রচার করতে সচেষ্ট ছিলেন সক্রেটিস। তিনি বিশেষ কোনও গোষ্ঠী বা শ্রেণিগত চিন্তার ঊর্ধ্বে অবস্থান করতেন। সক্রেটিস তাঁর চিন্তাভাবনাকে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন।
  4. তিনি আরও বলেছেন যে, একমাত্র জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের পক্ষেই সত্যকে উপলব্ধি করা সম্ভব। সুতরাং, তাঁরাই রাষ্ট্রশাসনের কাজে উপযুক্ত।

তাছাড়া সর্বজনীন গণতন্ত্র সুস্থ ও দৃঢ় রাষ্ট্রব্যবস্থার উপযোগী নয় বলেই সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন। এমন গণতন্ত্র হল অজ্ঞ ও অশিক্ষিতের শাসন, তাই বর্জনীয়। তবে জ্ঞানী শাসক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সংহতির প্রয়োজনে নাগরিকদের ইচ্ছা ও মতামতকে গুরুত্ব দেবেন। পাশাপাশি বলা যায়, গণতন্ত্র সম্বন্ধে সক্রেটিসের মনে নানান দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। লটারির মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনরীতি তাঁর পছন্দ ছিল না। গেটেল (Gettell)-এর মতে, সক্রেটিসই নীতি ও রাজনীতির মধ্যে সংযোগসাধনের গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন।

গণতন্ত্রের দুর্বলতার বিরুদ্ধে সক্রেটিসের বক্তব্য এথেনীয় প্রশাসকদের মনঃপূত হয়নি। এথেনীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অ্যালকিবিয়াডিস (Alcibiades) ও ক্রিটিয়াস (Critias)-এর বিদ্রোহকে সক্রেটিসের ইন্ধন-প্রসূত বলে অভিযোগ আনা হয়। শুধু তাই নয়, দেশদ্রোহিতার পাশাপাশি তিনি প্রচলিত দেবদেবী ও ধর্মবিশ্বাসকে ভেঙে ফেলতে উদ্যত বলেও অভিযোগ উত্থাপিত হয়। শেষপর্যন্ত এথেন্সের গণ আদালত বিচার করে মহামতি সক্রেটিসকে প্রাণদণ্ডের বিধান দেয় (৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। প্রাণদণ্ড ঘোষিত হওয়ার ঠিক ১ মাস পরে সক্রেটিস নিজ হাতে হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়ুন – গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

Leave a Comment