সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর Class 11 দ্বিতীয় সেমিস্টার WBCHSE
এখানে একাদশ শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সরকারের বিভিন্ন রূপ অধ্যায়ের বড়ো প্রশ্ন উত্তর শেয়ার করা হলো। প্রতিটি প্রশ্নের মান: ৬ // Class 11 Second Semester Political Science Question Answer // sorkarer bivinn rup question answer
সরকারের বিভিন্ন রূপ বড়ো প্রশ্ন উত্তর ক্লাস 11 সেকেন্ড সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান
প্রশ্নমান: ৬
1. গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা
মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের মতে গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য জনগণের শাসন (Government of the people, by the people and for the people)। লিংকনের এই সংজ্ঞাটির ব্যাখ্যা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সুইজি ও অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, লিংকনের দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে জনগণের শাসন বলতে বোঝায় যে, জনগণ হল সমগ্র শাসনব্যবস্থার মূল উৎস এবং জনগণ ও সরকার পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। অন্যদিকে, জনগণের দ্বারা শাসন বলতে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। জনগণের জন্য শাসনের অর্থ হল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আপামর জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করবে।
গণতন্ত্রের অর্থ
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
প্রাচীন গ্রিসে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির প্রথম প্রয়োগ ঘটে। ‘ডিমোস’ এবং ‘ক্রেটোস’-এই দুটি গ্রিক শব্দ নিয়ে ‘ডেমোক্রেসি’ শব্দের উদ্ভব হয়। ‘ডিমোস’ শব্দটির অর্থ হল ‘জনগণ’ আর ‘ক্রেটোস’ শব্দটির অর্থ হল কর্তৃত্ব বা শাসন। এককথায়, গণতন্ত্র শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল জনগণের শাসন।
সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থ
সাধারণভাবে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি ‘সংকীর্ণ’ ও ‘ব্যাপক’ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র বলতে এমন এক আদর্শ সমাজব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক-প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বার্নস গণতন্ত্রকে এমন এক আদর্শ সমাজব্যবস্থারূপে অভিহিত করেছেন যেখানে সবাই সমান না হলেও সমমর্যাদার অধিকারী। প্রতিটি মানুষ সমাজের অবিচ্ছেদ্য এবং অপরিহার্য অঙ্গ। অন্যদিকে, সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে বোঝায়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বা গণতান্ত্রিক সরকার। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বা সরকার বলতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রগুলিতে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। আধুনিককালে রাষ্ট্রের পরিধি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বদলে পরোক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
আধুনিক অর্থ
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘গণতন্ত্র’-কে নিছক একটি আদর্শ বা তত্ত্ব হিসেবে দেখতে চাননি। তাঁরা গণতন্ত্র বলতে একটি জীবনধারাকে বুঝিয়েছেন। মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, যে সমাজব্যবস্থায় ধনবৈষম্য বিরাজ করছে সেখানে কখনও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ল্যাস্কির বক্তব্য হল, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ব্যতীত রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন।
গণতন্ত্রের প্রকৃতি
গণতন্ত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি দিক বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে-
[1] সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন
অধ্যাপক ডাইসি এবং লর্ড ব্রাইসের মতো আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা লিংকনের দেওয়া সংজ্ঞার মতো গণতন্ত্রকে এত সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। ডাইসি জনগণের অধিকাংশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণকে গণতন্ত্র আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনই হল গণতন্ত্র। লর্ড ব্রাইসের বক্তব্য হল, জনগণের সকলের হাতে শাসনক্ষমতা থাকলেও গণতন্ত্র আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন।
[2] জনগণ কর্তৃক শাসনক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ
সাম্প্রতিককালের সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে কার্ল পপার, রবার্ট ডাল, জোসেফ স্যুম্পিটার প্রমুখ গণতন্ত্রের অত্যাধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কার্ল পপারের মতে, গণতন্ত্র হল এমন একধরনের প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে জনগণ শাসকদের নিয়ন্ত্রণ করতে, এমনকি প্রয়োজনে ক্ষমতাচ্যুত করতেও পারে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থাই হল গণতন্ত্র।
[3] সাম্য নীতির অনুসরণ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সাম্য নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন। গণতন্ত্রে জাতি- ধর্ম-স্ত্রী-পুরুষ-ধনী-দরিদ্র-শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আপামর জনগণ সমঅধিকার ও সমমর্যাদা ভোগ করে থাকেন। গণতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার চূড়ান্ত অধিকারী হল জনগণ।
[4] জনমত-চালিত শাসনব্যবস্থা
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রকে জনমতচালিত শাসনব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের মতে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভিমত এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটে জনমতের মাধ্যমে। নির্বাচনে জনগণের রায়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বলে গণতান্ত্রিক সরকার জনবিরোধী কোনো নীতি বা আইন পাস করা থেকে বিরত থাকে।
[5] শাসিতের সম্মতিনির্ভর
গণতন্ত্রকে শাসিতের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে শাসিতের সম্মতির প্রতিফলন ঘটে।
[6] বিশেষ জীবনধারা
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রকে নিছক একটি আদর্শ বা তত্ত্ব হিসেবে দেখেননি। তাঁরা গণতন্ত্র বলতে একটি বিশেষ জীবনধারাকে বুঝিয়েছেন। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, আচার- আচরণ, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, পারস্পরিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতি, পারস্পরিক মতবিনিময় ও আলাপ-আলোচনা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে এই জীবনধারা গড়ে ওঠে।
উপসংহার
গণতন্ত্র একটি চিরায়ত আদর্শ। প্রাচীন গ্রিসে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সূচনা লগ্ন থেকে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক উদারনৈতিক গণতন্ত্র পর্যন্ত আজও এর কোনো বিকল্প নেই। মার্কসবাদীদের অভিমত হল, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে কখনোই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাঁদের মতে, অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাজনৈতিক সাম্য অলীক কল্পনামাত্র।
2. গণতন্ত্রের বিভিন্ন ধরন বা প্রকারভেদগুলি ব্যাখ্যা করো।
গণতন্ত্রের বিভিন্ন ধরন বা প্রকারভেদ
গঠনগত ও তত্ত্বগত দিক থেকে বিচার করে গণতন্ত্রকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
গঠনগত দিক: গঠনগত বা পরিচালনগত দিক থেকে সাধারণভাবে গণতন্ত্রকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল-
[1] প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
সংজ্ঞা: যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি এবং সক্রিয়ভাবে শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলে।
প্রকৃতি: খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিসের এথেন্সে পেরিক্লিসের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের নীতি অনুসারে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে নাগরিকরা একত্রিত হয়ে আইন প্রণয়ন, প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণ, সরকারি আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, বিদেশনীতি, যুদ্ধ ও শান্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এমনকি বিচারের কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকে। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনগত সার্বভৌমত্ব এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় এই শাসনব্যবস্থা সুইটজারল্যান্ডের কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্যান্টনে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে প্রচলিত রয়েছে। আধুনিক বিশ্বে বৃহৎ জনগোষ্ঠী সংবলিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অবাস্তব হয়ে পড়েছে।
[2] পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র
সংজ্ঞা : পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে সেই গণতন্ত্রকে বোঝায় যেখানে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে দেশ-শাসনের কাজে অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিলের বক্তব্য অনুসারে, যে শাসনব্যবস্থায় সমস্ত জনগণ বা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনক্ষমতাকে ব্যবহার করে থাকেন তাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়।
প্রকৃতি: পরোক্ষ গণতন্ত্রে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের যাবতীয় কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। পরোক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ রাজনৈতিক দিক থেকে সার্বভৌম শক্তিরূপে স্বীকৃত হয়। এখানে সরকারের অস্তিত্ব জনগণের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল। পরোক্ষ গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব এবং আইনগত সার্বভৌমত্বের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পরোক্ষ বা প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি-শাসিত বা মন্ত্রীপরিষদ-চালিত হতে পারে। রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি জনগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দেশের প্রকৃত শাসক হিসেবে কাজ করেন। এর উদাহরণ হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, মন্ত্রীপরিষদ-চালিত শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত শাসক হল মন্ত্রীপরিষদ। মন্ত্রীপরিষদ-চালিত শাসনব্যবস্থায় একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক বা আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন, যেমন-ভারতের রাষ্ট্রপতি বা ব্রিটেনের রানি। মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। মন্ত্রীপরিষদ-চালিত শাসনব্যবস্থার উদাহরণ হল ভারত, গ্রেট ব্রিটেন প্রভৃতি।
তত্ত্বগত দিক: তত্ত্বগত বা শ্রেণিগত দিক থেকে গণতন্ত্রকে আবার অন্য দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। সে সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হল-
[1] উদারনৈতিক গণতন্ত্র
সংজ্ঞা: উদারনৈতিক গণতন্ত্র এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উদারনৈতিক দর্শনের বাস্তবায়ন এর লক্ষ্য। শাসনব্যবস্থায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাবসাবাণিজ্যের অবাধ স্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকারের গুরুত্ব, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি, নির্বাচন ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি নীতি রূপায়ণ এই প্রকার গণতন্ত্রের লক্ষ্য।
প্রকৃতি: মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দীতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সূচনা হয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা করাই হল উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য। শাসিতের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এজন্য সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারা আইনকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন। চিন্তা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি ব্যক্তিগত স্বাধীনতাগুলিকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে অবাধ বাণিজ্যের নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, বহুদলীয় ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি প্রভৃতি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যরূপে বিবেচিত হয়।
[2] সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র
সংজ্ঞা: মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের ওপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। একে ‘বৈপ্লবিক গণতন্ত্র’ বা ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে, পুঁজিবাদী সমাজের ধ্বংসের পর সর্বহারাদের একনায়কত্বের অধীনে প্রতিষ্ঠিত প্রলেতারীয় গণতন্ত্র হল সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের এক মধ্যবর্তী পর্যায়। মার্কসবাদী ধারণায় সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ বিকশিত রূপ। লেনিন একে নতুন এবং উচ্চতর গণতন্ত্র বলে দাবি করেছেন।
প্রকৃতি: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে শাসনব্যবস্থা মুষ্টিমেয় জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হয় না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র সমগ্র জনগণের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল এমন এক সমাজব্যবস্থা যেখানে জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য সুনিশ্চিত থাকে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার বিলুপ্তি, সকলের জন্য সমানাধিকারের স্বীকৃতি, একদলীয় ব্যবস্থার উপস্থিতি, রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রম ও ভোগের নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রভৃতি।
3. গণতন্ত্রের গুণ বা সুবিধা আলোচনা করো।
গণতন্ত্রের গুণবা সুবিধা
গণতন্ত্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থারূপে গ্রহণ করা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এই কারণে গণতন্ত্রের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তির অবতারণা করা হয়। গণতন্ত্রের যেসব সুবিধা বা গুণের কথা বলা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] সার্বভৌমত্বের বাস্তবায়ন
গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ এখানে সমগ্র রাষ্ট্রক্ষমতার মূল উৎস। গণতন্ত্রে জনগণের সম্মতি নিয়ে সরকার গঠিত হয়। সরকার যাবতীয় কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে।
[2] স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বের রূপায়ণ
স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব (Natural Rights Theory) অনুসারে প্রতিটি ব্যক্তি তার জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার যে অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তা একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বাস্তবায়িত হতে পারে।
[3] আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ফাইনারের মতে, একমাত্র গণতন্ত্রে আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি ছাড়া ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করা যায় না।
[4] সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ
আদর্শবাদ অনুসারে গণতান্ত্রিক পরিবেশে ব্যক্তি তার আত্মবিকাশের সবচেয়ে বেশি সুযোগ পায়। অন্যদিকে, হিতবাদী তত্ত্বের মূলনীতি-সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপায়িত হয়।
[5] স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিস্থতি
গণতন্ত্রের একটি বড়ো গুণ হল এখানে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের অস্তিত্ব বজায় থাকে। সংবিধানের রক্ষাকর্তা ও ব্যাখ্যাকর্তা এবং নাগরিক অধিকারের সংরক্ষক হিসেবে বিচার বিভাগ গণতন্ত্রে এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে।
[6] সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার নীতি অনুসরণ
গণতন্ত্রে প্রত্যেকের সমানাধিকারের নীতি তত্ত্বগতভাবে ও বাস্তবে স্বীকৃত হয়। স্ত্রী-পুরুষ-জাতি- ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান চোখে দেখা হয় এবং আইনের দ্বারা সবাই সমানভাবে সংরক্ষিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
[7] ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা
একমাত্র গণতন্ত্রেই ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। প্রকৃত ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও ভাবের আদান-প্রদান, যা শুধু গণতন্ত্রেই সম্ভব।
[৪] মানুষের মর্যাদা
গণতন্ত্রে প্রতিটি মানুষকে মর্যাদা দেওয়া হয়। মানবিক মর্যাদার এই স্বীকৃতি প্রকৃত গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো শাসনব্যবস্থায় সম্ভব নয়।
[9] ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগ থাকায় তাদের মানসিক উৎকর্ষসাধন ও ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব হয়।
[10] রাজনৈতিক চেতনার বৃদ্ধি
গণতন্ত্রে দেশের শাসনকার্যে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় এবং সভাসমিতিতে রাজনৈতিক দলগুলি কর্তৃক সভাসমিতির প্রকাশ্য আলোচনার ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।
[11] স্বৈরাচারের সম্ভাবনা হ্রাস
গণতন্ত্রে জনগণের মতামতই চূড়ান্ত বলে এখানে শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না। কারণ, কোনো শাসকগোষ্ঠী যদি জনগণের মতামতের বিরুদ্ধাচরণ করে তবে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক তাদের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
[12] বিপ্লবের শঙ্কা হ্রাস
সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে বলে কোনো জনবিক্ষোভ বা রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের সম্ভাবনা গণতন্ত্রে দেখা যায় না। নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনগণের ভোটের মাধ্যমে অতিসহজেই সরকার পরিবর্তন করা যায়।
4. গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধা আলোচনা করো।
গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধা
গণতন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত শাসনব্যবস্থা নয়। গণতন্ত্রের অসুবিধার দিকগুলি হল-
[1] দরিদ্র, অজ্ঞ ও অযোগ্যদের শাসনব্যবস্থা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লেকি গণতন্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, গণতন্ত্র হল সবচেয়ে দরিদ্র, অজ্ঞ ও অযোগ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা। কারণ গণতন্ত্রে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
[2] উৎকর্ষের পরিবর্তে সংখ্যার প্রাধান্য
গণতন্ত্র সংখ্যা-গরিষ্ঠের শাসন হওয়ায় এখানে গুণের তুলনায় সংখ্যার প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। এখানে গুণগত উৎকর্ষ গুরুত্বহীন।
[3] সরকারের স্থায়িত্বহীনতা
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের বিভিন্ন রকমের স্বার্থ, জাতপাতের বৈষম্য, গোষ্ঠীগত, আঞ্চলিক এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতা ইত্যাদি পরস্পরবিরোধী বিষয় সক্রিয় থাকায় সরকারের স্থায়িত্ব ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
[4] রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা
সমালোচকদের মতে, গণতন্ত্র যেহেতু মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের শাসন, তাই এই ধরনের শাসনব্যবস্থাকে রক্ষণশীল বলা যায়। কারণ মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো প্রগতিশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটে না। তারা সবসময় কিছু করার বিরোধী।
[5] দলীয় স্বার্থের প্রাধান্য:
রাজনৈতিক দলগুলির অস্তিত্ব ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনা করা যায় না। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে যেভাবে দলীয় সংঘর্ষের সূচনা হয়, তার ফলে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিছক তত্ত্বকথায় রূপান্তরিত হয়।
[6] ব্যয়বহুল
গণতন্ত্রে দেশের সাধারণ এবং অন্তর্বর্তী নির্বাচনগুলিতে সরকারকে যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় তা অনেক সময় অপচয়ের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্যয়ভার প্রকারান্তরে সাধারণ নাগরিকদেরই বহন করতে হয়।
[7] আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আপামর জনগণের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যোগ্য ও সৎ প্রার্থীর চেয়ে অসৎ এবং অযোগ্য প্রার্থীরাই নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকারি ক্ষমতা দখল করে। এই ধরনের অজ্ঞ নেতারা প্রশাসন পরিচালনা করার ব্যাপারে অদক্ষ হওয়ায় তাঁরা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী বা আমলাদের ওপর অত্যধিক পরিমাণে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এভাবে গণতন্ত্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে আমলাদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।
[৪] সংখ্যালঘুর স্বার্থকে উপেক্ষা
গণতন্ত্র মানেই সংখ্যা-গরিষ্ঠের শাসন, তাই সংখ্যালঘুরা এখানে উপেক্ষিত হন এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
[9] জরুরি অবস্থায় অনুপযুক্ত
সমালোচকরা মনে করেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জরুরি অবস্থার পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাংবিধানিক নিয়মকানুনের প্রাধান্য থাকায় জরুরি বা সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
মন্তব্য: গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ধরনের সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, এর কোনো বিকল্প নেই। ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজও বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা।
5. গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি উল্লেখ করো।
গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি
গণতন্ত্র একটি উন্নততর শাসনব্যবস্থারূপে পরিগণিত হলেও, এর সাফল্যের জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। শর্তগুলি হল-
[1] গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ
গণতান্ত্রিক চেতনা জনগণকে সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে অংশ নিতে উৎসাহিত করে। এই সচেতনতার ভিত্তিতে জনগণ সরকারের কাজকর্মের ত্রুটিবিচ্যুতির সমালোচনা করে জনস্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নেয়।
[2] গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলা
গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারগুলির যথাযথ স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ একান্ত জরুরি। এইভাবে নাগরিকদের মধ্যে সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটলে ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিবেশ রচিত হয়। এই পরিবেশ গণতন্ত্রের সাফল্য আনতে সক্ষম।
[3] অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা
অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, শুধু রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি স্বীকৃত হলে গণতন্ত্রের সাফল্য আসে না, তার জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। যে সমাজে দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির নিয়ন্ত্রণাধীন, সেখানে জনগণ কখনও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক জীবনযাপন করতে পারে না।
[4] শিক্ষার ব্যাপক প্রসার
গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন হওয়ায় জনগণের গরিষ্ঠ অংশ যদি অশিক্ষিত থাকে তাহলে গণতান্ত্রিক শাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল এই কারণে মন্তব্য করেছেন, সর্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতির আগে সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
[5] পরমতসহিষুতা
গণতন্ত্রে জনগণের বাক্ ও মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে, যার ফলে বহুমতের সৃষ্টি হয়। সেজন্য এখানে ভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তিদের মধ্যে, সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে সহিষু মনোভাব থাকা প্রয়োজন।
[6] ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসরণ
গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। এর সাহায্যে জনগণ সক্রিয়ভাবে প্রশাসনিক কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়, তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়।
[7] লিখিত সংবিধানের উপস্থিতি
হেনরি মেইন, লেকি প্রমুখের বক্তব্য হল, গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সংবিধান লিখিত হওয়া আবশ্যক। সংবিধান লিখিত থাকলে জনগণ সরকারের ক্ষমতার সীমা ও নিজেদের অধিকার এবং কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকতে পারে। এই সচেতনতা সরকারকে স্বৈরাচারী হতে বাধা দেয়।
[৪] প্রশাসনিক কর্তব্যপরায়ণতা
গণতন্ত্রে প্রশাসনিক দায়িত্ব জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকলেও বাস্তবে স্থায়ী সরকারি কর্মচারীরা প্রশাসন পরিচালনার কাজে নিযুক্ত থাকেন। এই সরকারি কর্মচারীরা সৎ, সুদক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ না হলে গণতান্ত্রিক সরকার তার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারে না।
[9] ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রনেতার উপস্থিতি
স্যুম্পিটারের মতে, গণতন্ত্রের সাফল্য অনেকটাই রাষ্ট্রনৈতিক নেতৃবৃন্দের ন্যায়নীতি ও বিবেকবোধের ওপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে এইসব গুণের ঘাটতি হলে গণতন্ত্র আদর্শভ্রষ্ট হয়।
[10] সুযোগ্য বিরোধী দলের উপস্থিতি
অধ্যাপক আইভর জেনিংসের মতে, বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকে না। বিরোধী দলের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতাই সরকারকে সদাসতর্ক রাখে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করে। হার্ভে এবং বেথারের মতে, বিরোধী দল জনগণের স্বাধীনতার প্রতীক।
[11] সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা
জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের উপযুক্ত ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সরকার গঠিত হয়। এখানে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভোটের কোনো মূল্য থাকে না। তার ফলে জনগণের একটি অংশ সরকারি সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়ায় ভাগ নিতে পারে না। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের যথাযথ ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।
[12] সদাজাগ্রত জনমত
সুস্থ, সবল ও সদাজাগ্রত জনমত গণতন্ত্রের সাফল্যের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে। শক্তিশালী জনমত সরকারি স্বৈরাচারিতাকে রোধ করতে সক্ষম হয়। জনমতকে সুসংহত করে তুলতে রাজনৈতিক দল এবং গণমাধ্যমগুলির ইতিবাচক ভূমিকা অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়।
[13] জাতীয় সংহতি
মিলের মতে, জাতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন গণতন্ত্রের বিকাশের পক্ষে জরুরি। জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ না থাকলে গণতন্ত্র সাফল্যমন্ডিত হয় না। সামাজিক ঐক্যবোধের জন্য জাতিভেদ প্রথা-সহ অন্যান্য সামাজিক বৈষম্যের বিলুপ্তি প্রয়োজন।
[14] স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি
অনেকে আবার গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতির কথা বলেন। বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ না হলে জনগণ ন্যায়বিচার পেতে পারে না এবং তা গণতন্ত্রের সাফল্যের পথে প্রধান অন্তরায়।
[15] সুনাগরিকত্ব
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি মানুষের সবরকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সুনাগরিক হিসেবে জাতীয় কর্তব্য পালনে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা, বিচ্ছিন্নতা, ধর্মান্ধতা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। তাই গণতন্ত্রে নাগরিকদের এসব থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।
মন্তব্য: গণতন্ত্রের সাফল্য কেবল জনগণের সচেতনতার ওপর নির্ভর করে না, শাসকশ্রেণির সদিচ্ছার ওপরেও তা নির্ভরশীল।
6. গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি ভারতে আছে কি? আলোচনা করো।
ভারতে গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলির উপস্থিতি
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত। সংবিধান অনুসারে ভারতে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃত। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাই ভারত রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা পরোক্ষভাবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এ ছাড়া মৌলিক অধিকার, নির্দেশমূলক নীতির উল্লেখ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, বহুদলীয় ব্যবস্থার অস্তিত্ব ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবুও, সমালোচকরা মনে করেন গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত ভারতে নেই। তাঁদের যুক্তিগুলি হল-
[1] সর্বজনীন শিক্ষার অভাব
ভারতে সর্বজনীন শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেনি। অথচ, ভোটাধিকারের সার্থক প্রয়োগের জন্য যথার্থ শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন।
[2] অর্থনৈতিক বৈষম্য
ভারতে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লয়েড জর্জ বলেছেন, গণতন্ত্র যদি মানুষের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করতে না পারে, তাহলে সেই গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না।
[3] যোগ্য ও উপযুক্ত রাষ্ট্রনেতার অভাব
ভারতে ন্যায়নীতিনিষ্ঠ, বিচক্ষণ, আদর্শবাদী রাষ্ট্রনেতার অভাব রয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি লক্ষ করা যায়।
[4] শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব
ভারতে বিরোধী দলগুলি সংখ্যায় বেশি এবং তাদের আদর্শ ও কর্মসূচির মধ্যে ব্যবধানও প্রচুর। ফলে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব রয়েছে।
[5] জনমতের হতাশাজনক ভূমিকা
ভারতে সুস্থ, সবল, সুচিন্তিত ও সচেতন জনমতের অভাব দেখা যায়। জনমত সৃষ্টির বাহনগুলির দায়িত্বশীল ভূমিকার অভাব দেখা যায়।
[6] দুর্নীতির অস্তিত্ব
ভারতে উচ্চস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি গণতন্ত্রের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[7] ঐক্য ও সংহতির অভাব
ভারতে আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জাতীয় ক্ষেত্রে ঐক্য ও সংহতির অভাব দেখা যাচ্ছে।
[৪] জনপ্রতিনিধিদের অশোভন ভূমিকা
রাজনৈতিক নেতা, এমনকি জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের অভাব, পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি, অশোভন উক্তি গণতন্ত্রের সাফল্যের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায়।
[9] নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি
নির্বাচনে অর্থবল, পেশিশক্তির ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ ও নানান দুর্নীতি গণতন্ত্রের পথে বাধাস্বরূপ হয়ে উঠেছে।
মন্তব্য: গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক শর্ত ভারতে নেই। তবুও ভারতে যে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, তা বলা ঠিক নয়। ভারতের জনগণ দরিদ্র ও অশিক্ষিত হলেও রাজনৈতিক চেতনাহীন নয়। ভারতের গণতন্ত্র এখনও চূড়ান্ত পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়ে চলেছে একথা বলা চলে।
ক্লাস 11 সেকেন্ড সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নমান : ৬
7. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝ? প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী?
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি শাসনকার্যে অংশ নেয়, তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলে। গ্রিসের ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রে এই শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
[1] জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ শাসনকার্যে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এখানে শাসনকার্য পরিচালিত হয় না। এই কারণে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে জনগণের শাসন বলে অভিহিত করা হয়।
[2] প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয়। এই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলি হল যথাক্রমে-গণভোট (Referendum), গণ-উদ্যোগ (Initiative), পদচ্যুতি বা প্রতিনিধি প্রত্যাহার (Recall)। শাসনকার্যের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণ যখন ভোটের মাধ্যমে তাদের মতামত জানায় তখন তাকে ‘গণভোট’ বলা হয়। এ ছাড়া জনগণ বা নির্বাচকমণ্ডলী যখন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাকে ‘গণ-উদ্যোগ’ বলে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, নির্বাচিত হওয়ার পরে কোনো প্রতিনিধি জনগণের মতামত বা নির্দেশ অনুযায়ী কাজ না করলে জনগণ যখন সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে পদচ্যুত বা প্রত্যাহার করে তখন তাকে পদচ্যুতি বা প্রতিনিধি প্রত্যাহার বলা হয়। বস্তুত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে জনগণ শাসনব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কার্যকর করতে সক্ষম হয়।
[3] সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠের সম্মিলিত সরকার
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সরকার হল সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠের সম্মিলিত সরকার। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে শাসনকার্য পরিচালনায় সকলেই সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ বলে কোনো বিভাজন এখানে করা হয় না।
[4] আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা মুক্ত সরকার
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সরকার আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে মুক্ত। শাসনকার্যে জনগণের সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকার ফলে এখানে আমলাতন্ত্রের প্রভাব বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
[5] জনগণের দায়বদ্ধতা
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ নিজেরাই শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং শাসন-বিষয়ক যাবতীয় কাজকর্মের দায়দায়িত্ব নিজেরাই বহন করে। কোনোরকমের প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে না থাকায় জনগণ নিজেরাই যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে।
[6] স্বৈরাচারমুক্ত সরকার
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সরকার যেহেতু জনগণের সরকার, তাই এই ধরনের সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ক্ষমতার অপব্যবহার, দলতন্ত্র, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি ইত্যাদির সম্ভাবনা থেকেও সরকার এখানে মুক্ত থাকে।
8. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের গুণ আলোচনা করো।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের গুণ
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সুবিধা বা গুণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] প্রকৃত গণতন্ত্র
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র হল প্রকৃত গণতন্ত্র, কারণ এখানে জনগণ সরাসরি নিজেরাই সমগ্র শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে।
[2] রাজনৈতিক চেতনা বিকাশে সহায়ক
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে বলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও দেশাত্মবোধের বিকাশ ঘটে।
[3] বিপ্লবের সম্ভাবনাহীন
যেহেতু জনগণ নিজেরাই যাবতীয় শাসনকার্য পরিচালনা করে, তাই কোনো বিক্ষোভ বা বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে না।
[4] আমলাতন্ত্রের প্রভাবহীন
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে আমলাতন্ত্রের কোনো প্রভাব দেখা যায় না।
[5] ব্যয়বহুল নয়
সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা না থাকায় এবং শাসনপদ্ধতি সরল প্রকৃতির হওয়ায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ব্যয়বহুল নয়।
[6] আইন প্রণয়নের সরল পদ্ধতি
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের ব্যাপারটি অনেক সহজ-সরল হওয়ায় সময়ের অপচয় হয় না।
[7] সরকারের স্বৈরাচারিতা প্রতিরোধ
জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না।
[৪] জনগণের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশ নেয় বলে দেশ ও সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ও কর্মনিষ্ঠা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
9. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ আলোচনা করো। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিলুপ্তির দুটি কারণ লেখো।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় নিম্নলিখিত অসুবিধা বা ত্রুটি লক্ষ করা যায়-
[1] বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে অনুপযুক্ত
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বৃহৎ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। একটি বিশাল দেশে সমস্ত জনগণ একত্রিত হয়ে আইন প্রণয়ন করবে, এমনটা কল্পনা করা কষ্টসাধ্য।
[2] মতবিরোধ সৃষ্টি
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণে জনগণের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে।
[3] উপযুক্ত রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব
যেহেতু রাষ্ট্রপরিচালনার মতো জটিল কাজে সবার উপযুক্ত রাজনৈতিক জ্ঞান ও বিচক্ষণতা থাকে না, তাই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
[4] জরুরি অবস্থায় অনুপযুক্ত
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র জরুরি অবস্থার পক্ষে উপযুক্ত নয়। জরুরি অবস্থায় যেভাবে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দরকার হয়ে পড়ে, সাংবিধানিক জটিলতার জন্য তা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সম্ভব হয় না। কারণ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সমগ্র জনগণের রায়ের ভিত্তিতে গণভোটের আয়োজন করতে হয়। এটি একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
[5] অদক্ষ শাসনব্যবস্থা
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে, কারণ রাষ্ট্রপরিচালনায় সমান দক্ষতা সবার থাকে না।
মন্তব্য: পরিশেষে বলা যায়, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বস্তুত একটি প্রাচীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলেও এর কিছু গুরুত্ব আছে। এই ধরনের ব্যবস্থার কিছু মৌলিক উপাদান আজও টিকে রয়েছে। এগুলি হল গণভোট, গণ- উদ্যোগ ইত্যাদি।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিলুপ্তির কারণ
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিলুপ্তির দুটি কারণ হল- [1] বর্তমানে রাষ্ট্রের আকৃতির বদল এবং বিপুল জনসংখ্যাবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে অনুপযুক্ত করে তুলেছে এবং [2] মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে প্রত্যক্ষ মনোনিবেশে অনাগ্রহী করে তুলেছে।
10. পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে তুমি কী বোঝ? পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী?
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র
জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, যে শাসনব্যবস্থায় সমস্ত জনগণ বা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনক্ষমতাকে ব্যবহার করে থাকেন, তাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়।
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
[1] জনগণের পরোক্ষ অংশগ্রহণ
পরোক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ শাসনকার্যে সরাসরি অংশগ্রহণ করে না। এখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণ পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশ নিয়ে থাকে।
[2] রাষ্ট্রপতি-শাসিত অথবা মন্ত্রীপরিষদ-চালিত শাসনব্যবস্থা
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রপতিশাসিত বা মন্ত্রীপরিষদ-চালিত হতে পারে। রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি জনগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি দেশের প্রকৃত শাসক হিসেবে কাজ করেন। অন্যদিকে, মন্ত্রীপরিষদ-চালিত শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত শাসক হল মন্ত্রীপরিষদ, কিন্তু এখানে একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসকেরও অস্তিত্ব থাকে। এক্ষেত্রে মন্ত্রীপরিষদ বা দেশের প্রকৃত শাসক জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, নিয়মতান্ত্রিক শাসক জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থার একটি উদাহরণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, মন্ত্রীপরিষদ- চালিত শাসনব্যবস্থার উদাহরণ হল ভারত, গ্রেট ব্রিটেন প্রভৃতি।
[3] সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে মন্ত্রীপরিষদ-চালিত শাসনব্যবস্থায় আইনসভার নির্বাচিত সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট কার্যকালের মেয়াদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠন করে থাকেন। এই কার্যকালের মেয়াদ শেষ হলে পুনরায় সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য বিশেষ কারণে কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
[4] প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার
পরোক্ষ গণতন্ত্রে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার প্রথা চালু রয়েছে।
[5] জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা
পরোক্ষ গণতন্ত্রে সরকার তার যাবতীয় কাজকর্মের জন্য নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে দায়বদ্ধ থাকে। [6] একাধিক দলের উপস্থিতি: পরোক্ষ গণতন্ত্রে একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য।
[7] গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা
পরোক্ষ গণতন্ত্রে গণ-সার্বভৌমিকতার আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য গণভোট, গণ-উদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে পারে।
11. প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণগুলি কী?
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণসমূহ
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংস্থান রাখা হয়েছে। সেই পদ্ধতিগুলি হল-
[1] গণভোট
আইনসভার খসড়া বিলকে আইনে পরিণত করার আগে সম্মতি আদায়ের জন্য জনসাধারণের কাছে পেশ করার পদ্ধতিকে গণভোট বা গণনির্দেশ বলা হয়। এক্ষেত্রে জনসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভোটের মাধ্যমে আইনসভার খসড়া বিলকে সম্মতি দিলে তা আইনে পরিণত হয়, নতুবা তা বাতিল বলে গণ্য হয়। গণভোেট সাধারণত দু-রকমের হতে পারে, যেমন- (i) বাধ্যতামূলক এবং (ii) ঐচ্ছিক গণভোট। যেক্ষেত্রে আইনসভায় গৃহীত আইনের খসড়া বিলকে জনসাধারণের সম্মতির জন্য পাঠানো হয়, তাকে বাধ্যতামূলক গণভোট আখ্যা দেওয়া হয়। অন্যদিকে, যেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটদাতাদের আবেদনে আইনসভার কোনো খসড়া বিলকে জনগণের সম্মতির জন্য গণভোটে পেশ করা হয় তাকে ঐচ্ছিক গণভোট বলে।
[2] গণ-উদ্যোগ
যেক্ষেত্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত আইনসভা কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়নে অসমর্থ হয়, সেক্ষেত্রে জনগণ যদি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা নেয়, তাকে গণ-উদ্যোগ বলা হয়। গণ-উদ্যোগ সাধারণত দু-রকম হতে পারে- (i) সুগঠিত এবং (ii) অগঠিত। যেক্ষেত্রে ভোটদাতারা নিজেরাই কোনো আইনের সম্পূর্ণ খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে সেক্ষেত্রে তাকে সুগঠিত গণ-উদ্যোগ নামে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, যে ক্ষেত্রে কোনো অসম্পূর্ণ খসড়া প্রস্তাবকে ভোটদাতারা সম্পূর্ণ করার জন্য আইনসভাকে অনুরোধ করে, সেক্ষেত্রে তাকে অগঠিত গণ-উদ্যোগ বলা হয়।
[3] গণ-অভিমত
স্ট্রং-এর বক্তব্য অনুসারে, গণ-অভিমত কথাটির অর্থ হল জনগণের আদেশ। প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে জনগণের মতামত গ্রহণকে গণ-অভিমত বলা হয়। গনভোট এবং গণ- অভিমতের মধ্যে পার্থক্য হল, কোনো আইন-সংক্রান্ত প্রস্তাবের ক্ষেত্রে গণভোট নেওয়া হয়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য গণ-অভিমত গ্রহণ করা হয়।
[4] পদচ্যুতি
গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল পদচ্যুতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধিকে তার জনস্বার্থবিরোধী কাজের জন্য নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই পদচ্যুত করা যেতে পারে।
মূল্যায়ন
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে যেসব প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লিখিত হল তা কিন্তু কয়েকটি শর্তের ওপর নির্ভর করে। এই শর্তগুলির মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রের আয়তন, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতালব্ধ সচেতন ও শিক্ষিত জনসাধারণ, ক্ষুদ্র জনসমষ্টি ইত্যাদি।
12. পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের গুণাগুণ বা সুবিধা-অসুবিধাগুলি আলোচনা করো।
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের গুণাগুণ বা সুবিধা- অসুবিধা
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের যেমন কিছু গুণ বা সুবিধা রয়েছে, তেমনি বেশ কিছু দোষ বা অসুবিধা রয়েছে।
গুণ বা সুবিধা
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের সুবিধাগুলি হল-
[1] রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি
গণতান্ত্রিক দেশে শাসনকার্যে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া যায় বলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।
[2] জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ প্রতিরোধ
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের অস্তিত্ব বজায় থাকলে সরকারের পক্ষে জনস্বার্থবিরোধী কাজ করা সম্ভব হয় না। সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম এক্ষেত্রে জনগণের সম্মতিক্রমে পরিচালিত হয়।
[3] গণতান্ত্রিক নীতির বাস্তবায়নে সহায়তা
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনসাধারণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় কর্তব্য পালনের ব্যাপারে সজাগ করে দিয়ে গণতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শের বাস্তবায়নে সহায়তা করে থাকে।
[4] জনস্বার্থ রক্ষা
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ফলে জনস্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে সরকারি নীতি নির্ধারণ করা হয়।
[5] স্বৈরাচার রোধ
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ চালু থাকলে শাসকের স্বৈরাচার রোধ করা সম্ভব হয় বলে অনেকে মনে করেন। কারণ, স্বৈরাচারী প্রতিনিধিকে নির্ধারিত কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই পদচ্যুত করার ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে।
দোষ বা অসুবিধা
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের অসুবিধাগুলি হল-
[1] জনবহুল রাষ্ট্রের পক্ষে অকার্যকরী
জনবহুল রাষ্ট্রে ভোটদাতার সংখ্যা বিপুল হওয়ায় এখানে কোনোভাবেই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে কার্যকর করা যায় না।
[2] রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবে ব্যর্থতা
জটিল রাজনৈতিক সমস্যাবলির সুষ্ঠু সমাধানের জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক জ্ঞান ও দূরদর্শিতা থাকা দরকার তা জনসাধারণের মধ্যে দেখা যায় না। এই কারণে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায়।
[3] সুষ্ঠুভাবে আইন প্রণয়ন অসম্ভব
অনেকে মনে করেন, প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের দ্বারা জনগণ অহেতুক আইনসভার কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করে বলে সভার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে আইন প্রণয়নের কাজ করা সম্ভব হয় না।
[4] জরুরি অবস্থায় অকার্যকর
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ জরুরি অবস্থায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে কার্যকরী হয় না।
[5] গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত হল, অনেক সময় স্বার্থান্বেষী নেতৃবৃন্দের দ্বারা জনগণ বিপথে চালিত হয়। সেক্ষেত্রে জনকল্যাণের নামে যেসব আইন প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তৈরি হয় তা গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী হয়ে পড়ে।
[6] জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা হ্রাস
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ চালু থাকার ফলে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা হ্রাস পায় বলে অনেকে মনে করেন। এই ব্যবস্থার ফলে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয় যে তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয়, জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নমান : ৬
13. গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
রাষ্ট্রচিন্তায় আদর্শ শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের স্থান সবার ওপরে। প্রাচীন গ্রিসে সাম্য ও স্বাধীনতার দাবিতে যে গণতান্ত্রিক ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল আধুনিক একবিংশ শতাব্দীতে তা এক মহান আদর্শে রূপান্তরিত হয়েছে।
গণতন্ত্রের সংকট
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, বিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। আধুনিক যুগকে এই কারণে গণতন্ত্রের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। অবশ্য বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গণতন্ত্র এক ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি হয়। জার্মানি ও ইতালির দুই রাষ্ট্রনায়ক যথাক্রমে হিটলার ও মুসোলিনি গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধ্বংস করার জন্য নাৎসিবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রবর্তন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও ইতালির পরাজয় ঘটলেও নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের পরিসমাপ্তি ঘটেনি। এই সময় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে নয়া নাৎসিবাদ এবং নয়া ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে।
গণতন্ত্রের অপূর্ণতা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, গণতন্ত্র এখনও তার পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের যে প্রত্যাশা, তা এখনও অপূর্ণ থেকে গেছে। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এখানে মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তির করায়ত্ত। এর ফলে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই
তবে প্রশ্ন হল, জনগণের শাসন হিসেবে গণতন্ত্রের কি কোনো বিকল্প আছে? অনেকে বলেন যে, গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হারানো জনগণের প্রতি বিশ্বাস হারানোর সমার্থক। বার্নসের মতে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ত্রুটি অস্বীকার করা যাবে না এ কথা সত্যি, তবে এজন্য প্রাচীন পরিত্যক্ত শাসনব্যবস্থাগুলিকে আঁকড়ে ধরে থাকা ঠিক নয়। এই কারণে আজও গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই।
গণতন্ত্রের অগ্রগতি
গণতন্ত্র আধুনিক একবিংশ শতাব্দীতে তার জনপ্রিয়তা হারায়নি। সাম্প্রতিককালে নয়া উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করেছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নাগরিক বা পুর সমাজের (Civil Society) কাজকর্ম বেড়ে চলেছে। গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে নাগরিক সচেতনতা অধিকতর মাত্রায় সম্প্রসারিত হচ্ছে।
তৃতীয় বিশ্বে গণতন্ত্র
উন্নত দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলির সমস্যা এবং উন্নয়নশীল দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলির সমস্যা এক নয়। বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে এই কারণে মেলানো যায় না। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, লিঙ্গবৈষম্য, কুসংস্কার, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দুনিয়ায় গণতান্ত্রিক দেশগুলি এখনও গণতন্ত্রের সুফল অর্জন করতে পারেনি। বিশ্বায়ন ও উদার অর্থনীতির প্রচলনের ফলে ভারতবর্ষের মতো গণতান্ত্রিক দেশে আর্থিক স্বচ্ছলতা এখনও মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণির করায়ত্ত থেকে গেছে। এর ফলে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের কাছে তেমন কোনো সুফল পৌঁছে দিতে পারেনি। তবুও একথা বলা যায় যে, জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে গণতান্ত্রিক পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। অদূর ভবিষ্যতে নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক বিশ্বের জনগণ একদিন নিশ্চিত উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে সমান তালে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাবে।
14. সর্বাত্মকবাদের সংজ্ঞা, উদাহরণ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
সর্বাত্মকবাদের সংজ্ঞা
সর্বাত্মকবাদ হল এক ধরনের সামগ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুসারে, সর্বাত্মকবাদ সরকারের এমন একটি রূপ যা দেশের নাগরিকদের জীবনের ওপরে সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়।
সর্বাত্মকবাদ এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বর বা বিরোধী রাজনৈতিক দল বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি কিছুই থাকবে না। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমস্ত রকম বিরোধী শক্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সর্বাত্মকবাদে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একজন স্বৈরাচারী শাসকের হাতে কুক্ষিগত থাকে। এই স্বৈরাচারী শাসক তাঁর অবাধ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের জাতীয় রাজনীতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন অন্যদিকে তেমনই দেশের জনগণের ব্যক্ত জীবন তথা সমাজ জীবনকেও নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে আসেন।
সর্বাত্মকবাদের উদাহরণ
ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি ১৯২০-এর দশকের প্রথম দিকে ইতালির নতুন ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ‘টোটালিটিরিও’ (Totalitario) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘সবকিছুই রাষ্ট্রের মধ্যে, রাষ্ট্রের বাইরে কিছু নেই। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কিছু নেই’ (Everything within the state, Nothing out- side the state, Nothing against the state.)।
সর্বত্মক রাষ্ট্রীয় শাসনের যে মতাদর্শ সর্বাত্মবাদ গড়ে তোলে তার ঐতিহাসিক উদাহরণ হল হিটলারের নাৎসি জার্মানি (১৯৩৩-১৯৪৫), স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯২৪-১৯৫৩), মুসোলিনির ইতালি (১৯২২-১৯৪৩), মাও জে দঙের চিন (১৯৪৯-১৯৭৬) এবং নে উইনের বার্মা (১৯৬২-১৯৮৮)। বর্তমান সময়ে সর্বাত্মব্বাদের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল কিম জং উন-এর উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থা।
সর্বাত্মকবাদের বৈশিষ্ট্য
সর্বাত্মকবাদের কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এই বৈশিষ্ট্যগুলির বিশ্লেষণের মাধ্যমে সর্বাত্মকবাদের স্বরূপ বা প্রকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] সর্বাত্মক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা
সর্বাত্মকবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা শুধু আইন, শাসন ও বিচারের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সীমিত থাকে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এখানে জনগণের ব্যক্তিজীবন বা সমাজজীবনকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন জীবনযাপন, স্বাধীন মতপ্রকাশ সব কিছুই ব্যাহত হয়। পিন
[2] রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্যে রাষ্ট্র নয়
সর্বাত্মকবাদে রাষ্ট্র আগে, ব্যক্তি পরে। এখানে রাষ্ট্রের জন্যে ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্যে রাষ্ট্র নয়। এজন্য সর্বাত্মকবাদে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়নি। সর্বাত্মকবাদ মনে করে রাষ্ট্র যেহেতু জনগণ তথা জাতির বিবেক তাই ব্যক্তির ভালোমন্দের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করাও রাষ্ট্রের কাজ।
[3] একদলীয় ব্যবস্থা
সর্বাত্মকবাদে যে দলব্যবস্থাকে অনুমোদন করা হয়, তা হল একদলীয় ব্যবস্থা। সর্বগ্রাসী মতাদর্শ বহুদলের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। এজন্য স্বৈরতন্ত্রী শাসকের দল ছাড়া বিরোধী কোনো দল বা বিরোধী সংগঠন বা বিরোধী কণ্ঠস্বরের এখানে কোনো জায়গা নেই। যদি কোনো বিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তবে তাকে সমূলে বিনাশ করা হয়। এভাবেই জার্মানিতে হিটলার নাৎসি পার্টির বিরোধী কোনো শক্তিকে জমিয়ে উঠতে দেননি।
[4] গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতি
সর্বাত্মকবাদে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দেয় না। এজন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই জনগণ দেশের শাসনকার্যে অংশ নিতে পারে না। গণতন্ত্রে যেরকম ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেশের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করেন তা সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে কল্পনাও করা যায় না।
[5] গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ
সর্বাত্মকবাদে গণমাধ্যম অর্থাৎ টিভি, ইনটারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। সর্বাত্মক রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন মত প্রচার করাই ছিল গণমাধ্যমের প্রধান কাজ। গণমাধ্যম বা মিডিয়া এখানে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীনে থেকে কাজ করে।
[6] পুলিশি নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস
সর্বাত্মকবাদ যে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গড়ে তোলার পক্ষপাতী সেখানে সব কিছুই পুলিশি নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনা হয়। এজন্য সারাদেশে জনগণের উপরে নজরদারি চালিয়ে যাওয়ার জন্য গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এই গুপ্তচর বাহিনীর রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বিচারে গ্রেফতারি, ধরপাকর, নির্যাতন, দমনপীড়ন চালিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কায়েম করা হয়। এভাবে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
[7] সহিংসতা
সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সহিংসতা একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে স্বৈরাচারী শাসক বিরুদ্ধ মতামতের মানুষজনকে দমনপীড়ন করতে হিংসার আশ্রয় নিতে দ্বিধা করে না। এমনকি রাষ্ট্রের এই সহিংস কার্যকলাপকে তারা ন্যায়সংগত বলেও দাবি করে থাকে। স্বৈরাচারী শাসক রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে হিংসার আশ্রয় নেওয়ার মধ্যে অন্যায় কিছু দেখতে পায় না। এভাবে হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে এবং স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে যথাক্রমে ইহুদি এবং কুলাকদের (রাশিয়ান ধনী কৃষকদের) নির্বিচারে নিপীড়ন ও নিধন করা হয়।
[৪] অতিমানব তত্ত্ব
সর্বাত্মকবাদে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেখানে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ককে ‘অতিমানব’ বলে তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ সর্বগ্রাসীবাদ রাষ্ট্রনায়কের এমন একটা ইমেজ তৈরি করে দেয় যেন তিনি সাধারণ মানুষ নন, তিনি একজন অতিমানব। সমগ্র জাতির তিনি ভাগ্যনিয়ন্তা। সেই সঙ্গে এই ইমেজও খাড়া করা হয় যে, অতিমানব কোনো ভুল করতে পারেন না। তিনি সমস্ত রকম ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে। ইতালিতে মুসোলিনি, জার্মানিতে হিটলারের এরকম অতিমানব ইমেজ গড়ে তোলা হয়।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায় সর্বাত্মকবাদ মানবসভ্যতা পরিপন্থী। এটি একটি নিকৃষ্ট ধরনের অগণতান্ত্রিক ও মানবতাবিরোধী মতাদর্শ ছাড়া আর কিছুই নয়।
15. সর্বাত্মকবাদের গুণ বা সুবিধাগুলি আলোচনা করো।
সর্বাত্মকবাদের গুণ বা সুবিধা
সর্বাত্মকবাদ হল এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বিরোধী, রাজনৈতিক দল ও বিরোধী মতামত সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকে। এ হল এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একজন স্বৈরাচারী শাসকের হাতে কুক্ষীগত থাকে যিনি সেই সর্বগ্রাসী ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের মানুষদের জীবন ও স্বাধীনতাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। সর্বাত্মকবাদের গুণ হিসেবে যে বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয় তার মধ্যে রয়েছে-
[1] দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ ও রূপায়ণের ক্ষমতা
সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে যে কোনোরকম সরকারি নীতি, কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনোরকম দেরি হয় না। কোনো প্রশাসনিক বিষয়ে বা কোনো প্রশাসনিক সমস্যার নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় এবং সেই সিদ্ধান্তকে দ্রুত বাস্তবায়িত করা হয়।
সর্বাত্মবাদে রাষ্ট্রনায়কের মতামতের উপরে কেউ থাকে না বলে তার নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তকে রূপায়িত করতেও কোনো দেরি হয় না।
[2] সংকটকালীন সময়ের উপযোগী
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, অথবা বৈদেশিক আক্রমণ ইত্যাদি সংকটকালীন সময়ে রাষ্ট্রনায়ক সমস্যাসমাধানে জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়কের একক সিদ্ধান্তই যেহেতু চূড়ান্ত তাই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।
[3] আর্থিক বিকাশ
সর্বাত্মক রাষ্ট্রে শিল্পায়ন এবং আর্থিক বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক তাড়াতাড়ি সাফল্য পাওয়া যায়। সারা দেশের জন্য একক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলে সর্বাত্মক রাষ্ট্রে সরকারি অফিসারদের আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন চালানোর কোনো সুযোগ থাকে না। এর ফলে সর্বাত্মক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কের উন্নয়নমূলক কর্মসূচির রূপায়ণে কোনোরকম বাধা-বিপত্তি না থাকায় শিল্পায়ন ও আর্থিক বিকাশের হার অনেক দ্রুত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে স্ট্যালিনের রাষ্ট্রসর্বস্ববাদী শাসনে এমনটা দেখা গেছে।
[4] একক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ
সর্বাত্মক রাষ্ট্রের প্রশাসনে সারা দেশে একক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নিয়ন্ত্রণের কোনো অস্তিত্ব এখানে থাকে না। এই অবস্থায় প্রশাসনিক কর্মকান্ড রূপায়ণের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়।
[5] সামাজিক শৃঙ্খলা ও কঠোর অনুশাসন
সর্বাত্মক রাষ্ট্রে আইনের অনুশাসন অনেক কঠোর হওয়ায় কোনোরকম সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না। সারা দেশে আইনের যে কঠোর অনুশাসন বলবৎ হয়, তার ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় থাকে।
[6] জাতীয় ঐক্যবোধ
সর্বাত্মক রাষ্ট্রে শুধু যে রাষ্ট্রনায়ককে অতিমানব [ মনে করা হয় তা-ই নয়, রাষ্ট্রকেও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। এর ফলে জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের যে ধারণা গড়ে ওঠে তা জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
16. সর্বাত্মকবাদের দোষ বা অসুবিধাগুলি আলোচনা করো।
সর্বাত্মকবাদের দোষ বা অসুবিধা
সর্বাত্মকবাদের প্রধান দোষগুলি হল-
[1] ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী
সর্বাত্মকবাদে ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনো জায়গা নেই। এটি এমন একটি মতাদর্শ যেখানে রাষ্ট্র আগে ব্যক্তি পরে। সর্বাত্মক মতাদর্শে এজন্য বলা হয় রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়। এককথায় সর্বাত্মকবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
[2] অগণতান্ত্রিক
সর্বাত্মকবাদ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি মতাদর্শ। গণতন্ত্র হল জনগণের শাসন, অন্যদিকে সর্বাত্মকবাদ হল স্বৈরাচারী শাসকের শাসন। সর্বাত্মকবাদে শাসকের কথাই শেষ কথা। এখানে সর্বাত্মক রাষ্ট্রনায়কই হল রাষ্ট্র।
[3] একদলীয় শাসন
সর্বাত্মকবাদে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে, অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব এখানে কল্পনাও করা যায় না। এর ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে না, সেই সঙ্গে একদলীয় যাবতীয় সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
[4] ব্যক্তি পরিসরে রাষ্ট্রের প্রবেশ
সর্বাত্মক রাষ্ট্রের সবচাইতে বড়ো ত্রুটি হল ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। এমনটা আর কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমনকি একনায়কতন্ত্রেও দেখা যায় না। সর্বাত্মক রাষ্ট্র এজন্যই সর্বাত্মক যে সব কিছুই সে গ্রাস করতে চায়। ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন জীবনযাপন, স্বাধীন উদ্যোগ সব কিছুকেই গ্রাস করতে চায় রাষ্ট্র। এ এক দমবন্ধ করা পরিবেশ যেখানে ব্যক্তিজীবনের নাভিশ্বাস ওঠে।
[5] সৃজনশীলতার চরম শত্রু
সর্বাত্মক রাষ্ট্রকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির নতুন উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার চরম শত্রু বলে মনে করা হয়। এখানে সব কিছুই যেহেতু, সর্বাত্মক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাই শিল্পসাহিত্যকেও রাষ্ট্রসর্বস্ব করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো ও স্ট্যালিনের শাসনকালে এমনটাই দেখা গেছে। এর ফলে অনেক ব্যবধানশীল মানুষকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে কারাবাস, এমনকি প্রাণ বিসর্জনও দিতে হয়েছে।
সবশেষে বলা যায়, সর্বগ্রাসীবাদ শুধু যে মানবতার শত্রু তা-ই নয় মানবসভ্যতারও শত্রু।
17. সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ
অধ্যাপক অ্যালন বল, ফাইনার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সর্বাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি রূপ বলে মনে করেন। সর্বাত্মক রাজনৈতিক মতবাদ রাষ্ট্রের সার্বিক প্রাধান্যের কথা প্রচার করে; যেখানে ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের জন্যই ব্যক্তি। অধ্যাপক কোকার বলেছেন যে, সর্বাত্মক রাষ্ট্র যে-কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার তুলনায় অধিক স্বৈরাচারমূলক রাষ্ট্র। সর্বাত্মক রাষ্ট্র হল এমন একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা, যেখানে কোনোপ্রকার বিরোধিতা বা সমালোচনা সহ্য করা হয় না, যেখানে শিল্প-বাণিজ্য প্রভৃতি সকল বিষয়ই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে এবং যে শাসনব্যবস্থায় উগ্র জাতীয়তাবাদ ও কমিউনিস্ট বিরোধিতা প্রাধান্য পায়। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে চরম প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই সর্বাত্মক রাষ্ট্রবাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
এই তত্ত্বটি যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা রাষ্ট্র-দার্শনিকদের হাত ধরে বিকশিত হয় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-জার্মান দার্শনিক ট্রিস্কে, নিট্রেট্স; ইতালির দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্রেজোলিনি, জিওভিন্নি, জেন্টাইল, গ্যাব্রিয়েল ডি অ্যানানজিও প্রমুখ।
রাষ্ট্র সম্পর্কিত এই মতবাদ রাষ্ট্রের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন (totalitarian) বৈশিষ্ট্যটিকে তুলে ধরতে চায়। এই মতাদর্শ অনুসারে সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধানকল্পে যে সংহতি গড়ে তোলার কথা বলা হয়, সেখানে অন্য কোনো মতের গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়। অর্থাৎ, সর্বাত্মক মতই শ্রেষ্ঠ ও চূড়ান্ত বলে এই মতবাদ মনে করে। তারা চেয়েছে দেশের সবরকম পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সবই হবে ফ্যাসিস্ট মতানুসারে। এই কারণে তাদের কাছে যা প্রতিষ্ঠা করা চিন্তার বাইরে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বলপ্রয়োগেও তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। দ্বিতীয় কোনো মতপ্রকাশের এখানে কোনো সুযোগ নেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিপুল জনসমর্থন আদায়ের ফলস্বরূপ সর্বাত্মকবাদের আবির্ভাব ঘটে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতিবৈষম্য, ইহুদি বিদ্বেষ, বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রভৃতি সর্বাত্মকবাদ উদ্ভবের সময় বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। তা ছাড়া তীব্র মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, পুঁজিবাদী অর্থনীতির নগ্ন প্রতিযোগিতা, পুঁজিতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রভৃতি মিলিয়ে ইউরোপ তথা ইতালি ও জার্মানিতে মানুষের মধ্যে এক বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়, যার ফলস্বরূপ জন্ম নেয় রাষ্ট্রীয় সর্বাত্মকবাদ।
সর্বাত্মকবাদ মনে করে, সব কিছুই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক- তাই রাষ্ট্র-বহির্ভূত কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। এখানে হেগেলীয় দর্শনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। কারণ রাষ্ট্রকে হেগেল এমন একটি স্বাধীন সত্তা বলেছেন, যার আছে ‘real will’ বা ‘প্রকৃত ইচ্ছা’, যা গণতান্ত্রিক ইচ্ছাকে প্রকাশ করে না। সর্বাত্মকবাদ রাষ্ট্রনৈতিক সর্বনিয়ন্ত্রণবাদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। এই ব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের কথা বলা হয়। সর্বাত্মকবাদ রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্য কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। সর্বাত্মকবাদ চায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগের দ্বারা নাগরিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে সীমাবদ্ধ করতে।
এই মতবাদ অনুসারে কোনো রাষ্ট্রে সর্বাত্মকবাদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম পদ্ধতি হল হিংসার আশ্রয়গ্রহণ। সর্বাত্মকবাদের ক্ষেত্রে তাঁদের মতাদর্শের বিরোধী ব্যক্তিদের উচ্ছেদ-একটি ঘোষিত নীতি। সর্বক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রসৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য হল হিংসা প্রকাশের সুযোগ। সর্বাত্মক মতবাদ যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলে, তা হল নৈতিক ও আদর্শগত বা ভাবগত অস্তিত্বসম্পন্ন রাষ্ট্র।
সর্বাত্মক রাষ্ট্রে নারীস্বাধীনতা সংকুচিত। হিটলার মনে করেন, নারীদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কেবল জার্মান যোদ্ধার জন্মদান। তাই, তিনি নারীদের অর্থনৈতিক কাজ থেকে বঞ্চিত করে গৃহবন্দি করে রাখার কথা বলেন। অর্থাৎ নারীস্বাধীনতায় সর্বাত্মকবাদের আস্থা ছিল না; বরং নারীজাতির প্রতি সর্বাত্মকবাদ অনাস্থা প্রকাশ করেছিল।
সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থা তার প্রচারকার্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ (recism)-কে কাজে লাগিয়ে ঘৃণা, সন্ত্রাস ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার সৃষ্টি করে। এর মধ্য দিয়ে উদারনীতিবাদ, প্রগতিবাদ, মুক্ত অর্থনীতি প্রভৃতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। ট্রিস্কে রাষ্ট্রকে ‘শক্তির প্রতীক’ বলেছেন। অর্থাৎ, এই মতবাদ ক্ষমতাকে পূজ্য বিষয় বলে মনে করে। এই মতানুসারে ক্ষুদ্র বা ছোটো রাষ্ট্র হল পাপের প্রতীক। তাই রাষ্ট্র বিস্তারের জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে যুদ্ধকে কোনো অন্যায় কাজ হিসেবে গণ্য হয় না।
সর্বোপরি, সর্বাত্মক মতবাদ গণতন্ত্রের কথা বললেও তা ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে জনসাধারণের আনুগত্য প্রার্থনা করে এবং তাদের ওপর বিপ্লবী পন্থায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিস্থাপনে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে।
18. কর্তৃত্ববাদের সংজ্ঞা, উৎস, উদাহরণ এবং প্রকারভেদগুলি আলোচনা করো।
কর্তৃত্ববাদের সংজ্ঞা
কর্তৃত্ব বা কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের মতাদর্শ হল কর্তৃত্ববাদ। কর্তৃত্ববাদের উপরে ভিত্তি করেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সেখানে যারা রাষ্ট্রের শাসক তাদের কর্তৃত্বই (Authority) সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রক। গণতন্ত্রের একটি সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শ হল কর্তৃত্ববাদ।
কর্তৃত্ববাদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকারের কোনো মূল্য নেই। কর্তৃত্ববাদে রাষ্ট্রের শাসক বা কর্তৃপক্ষই সর্বেসর্বা। গণতন্ত্রের মতো এখানে জনগণ শেষ কথা বলে না, শেষ কথা বলে রাষ্ট্র কর্তৃত্বের অধিকারী কর্তৃপক্ষ বা শাসক। এই শাসকের কর্তৃত্বের ঊর্ধ্বে কেউ নেই। এখানে সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একজন রাষ্ট্রনায়ক বা গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষীগত থাকে।
কর্তৃত্ববাদের উৎস
কর্তৃত্ববাদের উৎস হিসেবে যে মতবাদের কথা বলা হয় তা হল ঊনবিংশ শতাব্দীর ভাববাদ বা আদর্শবাদ। আদর্শবাদে দেখানো হয়েছে আগে রাষ্ট্র, পরে ব্যক্তি। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি তার অস্তিত্বকে কল্পনা করতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। এজন্য রাষ্ট্রবিরোধী কোনো অধিকার নাগরিকদের থাকবে না। শুধু তা-ই নয়, আদর্শবাদ একথাও মনে করে যে, রাষ্ট্রের ইচ্ছার মধ্যেই ব্যক্তির ইচ্ছা নিহিত থাকে। এমনকি আদর্শবাদের প্রধান প্রবক্তা হেগেলের মতে, রাষ্ট্র কোনো দোষ করতে পারে না। রাষ্ট্র হল সর্বদোষমুক্ত একটি শক্তি। কাজেই রাষ্ট্র কর্তৃত্ব যাই আদেশ দিক তা নাগরিকদের মেনে চলতে হবে। যদি কোনো নাগরিক তার ব্যক্তিস্বাধীনতার অজুহাত দেখিয়ে রাষ্ট্রের আদেশকে অমান্য করতে চায় তাহলে বুঝতে হবে সেই নাগরিক সব বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের পুতুলে পরিণত করে আদর্শবাদ রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদের পথ প্রশস্ত করে।
কর্তৃত্ববাদের উদাহরণ
কর্তৃত্ববাদী শাসনের উদাহরণ হিসেবে স্পেনে ফ্রাঙ্কো’র শাসনের (১৯৩৯) কথা, কম্বোডিয়ায় কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির শাসনের (১৯৭৯) কথা, আর্জেন্টিনায় জুয়ান পেরনের শাসনের (১৯৭৬) কথা, ইজিপ্টে প্রেসিডেন্ট নাসের-এর শাসনের (১৯৫৬) কথা উল্লেখ করা যায়।
কর্তৃত্ববাদের প্রকারভেদ
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কর্তৃত্ববাদের কয়েকটি প্রকারভেদের বা শ্রেণিবিভাগের কথা উল্লেখ করেছেন। বারবারা গেডেসের মতে, কর্তৃত্ববাদকে ৭টি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে, এগুলি হল: ① প্রভাবশালী দলের দলীয় শাসনের কর্তৃত্ববাদ ② সামরিক শাসনের কর্তৃত্ববাদ ও ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসনের কর্তৃত্ববাদ ④ রাজতান্ত্রিক শাসনের কর্তৃত্ববাদ অভিজাততান্ত্রিক শাসনের কর্তৃত্ববাদ⑥ পরোক্ষ সামরিক শাসনের কর্তৃত্ববাদ⑦ উদারনৈতিক বা মিশ্র গণতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদ।
Class XI Second Semester
রাষ্ট্রবিজ্ঞান সরকারের বিভিন্ন রূপ ৬ নম্বরের প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নমান : ৬
19. কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।
কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য
কর্তৃত্ববাদের কতকগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করলে কর্তৃত্ববাদের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
[1] সীমিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা
কর্তৃত্ববাদ নাগরিকদের যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেয় তা হল সীমিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় নাগরিকরা দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য বাক্ স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতা, নির্বাচনে ভোট দেওয়ার স্বধীনতা প্রভৃতি সব কিছুই সীমিত আকারে ভোগ করে থাকেন।
[2] নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় গণমাধ্যম বা মিডিয়া সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকে। এখানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো মিডিয়ার স্বাধীনতা থাকে না। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা অনেকসময় তাদের স্বপক্ষে জনমত গঠনের জন্য গণমাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করে থাকেন।
[3] কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় যাবতীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী নেতা বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাঁরা তাঁদের খেয়ালখুশিমতো স্বেচ্ছাচারীভাবে প্রয়োগ করেন।
[4] বহুত্ববাদের প্রত্যাখ্যান
কর্তৃত্ববাদে বহুত্ববাদের কোনো জায়গা নেই। গণতন্ত্রে বহুদলের বহু মত ও পথকে নিয়ে যে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ গড়ে ওঠে, কর্তৃত্ববাদে তাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। কর্তৃত্ববাদে বিরোধী রাজনৈতিক দল একেবারে থাকে না তা কিন্তু নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দল বা সংগঠন থাকলেও তাদের কাজকর্মের ওপরে নানান বিধিনিষেধ আরোপ করে তাকে সীমিত করে রাখা হয়।
[5] নামমাত্র গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান
কর্তৃত্ববাদ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলেও একে কিন্তু কোনোভাবেই একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেওয়া যাবে না। কর্তৃত্ববাদ এমন এক ব্যবস্থা যার মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিও থাকে, যেমন-বিরোধী রাজনৈতিক দল বা সংগঠন, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম ইত্যাদি। তবে এদের ভূমিকাকে কর্তৃত্ববাদী শাসকরা নিয়ন্ত্রণ করেন বলে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করতে পারে না।
[6] কৃত্রিম গণতান্ত্রিক আকৃতি
কর্তৃত্ববাদের একটি কৃত্রিম গণতান্ত্রিক চেহারা রয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করেন, এমনকি জনপ্রিয় নেতা বলেও দাবি করেন। এই দুই পরিচয় ব্যবহার করে তাঁরা নিজেদের ইচ্ছামতো প্রশাসন পরিচালনা করে থাকেন। অনেক সময় দেশের আইনসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তাঁরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো আইন তৈরি করেন বা প্রয়োজন মনে করলে সংবিধান সংশোধন, এমনকি সংবিধান পালটে ফেলার কাজও করেন।
20. কর্তৃত্ববাদের গুণ বা সুবিধাগুলি আলোচনা করো।
কর্তৃত্ববাদের গুণ বা সুবিধা
কর্তৃত্ববাদ বলতে বোঝায় এমন এক মতাদর্শ যেখানে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একজন নেতা বা গোষ্ঠীর কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণে কুক্ষীগত থাকে। এই নেতা বা গোষ্ঠী দেশের সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো সেচ্ছাচারীভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে কর্তৃত্ব বজায় রাখে। কর্তৃত্ববাদের উল্লেখযোগ্য গুণগুলি হল-
[1] দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা
কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে জরুরি বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দেশ যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা সংকটের মধ্য পড়ে তখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
[2] রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
কর্তৃত্ববাদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা স্থায়িত্ব দেখা যায়। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের রাজনৈতিক অস্থিরতা এখানে চোখে পড়ে না। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা দেশে একটা স্থায়ী সরকার গড়ে তুলতে পারে।
[3] দ্রুত উন্নয়ন
কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন একক নেতৃত্বের পরিচালনায় চালিত হয় বলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক বাধা বা জটিলতা থাকে না। এর ফলে দ্রুত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয় এবং চালু প্রকল্পগুলির দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়।
[4] সুস্পষ্ট দিশা
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার একটি সুস্পষ্ট দিশা বা পথ নির্দেশনা থাকে। এর ফলে উন্নয়নমূলক কাজকর্মের রূপায়ণ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির বাস্তব রূপায়ণ অনেক সহজ হয়।
21. কর্তৃত্ববাদের দোষ বা অসুবিধাগুলি আলোচনা করো।
কর্তৃত্ববাদের দোষ বা অসুবিধা
কর্তৃত্ববাদের প্রধান দোষগুলি হল-
[1] স্বাধীনতার অভাব
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় সীমিত রাজনৈতিক অধিকার ভোগের সুযোগ থাকে বলে এখানে নাগরিকদের স্বাধীনতা অনেকটা সীমিত আকারে থাকে। নাগরিকরা তেমন সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে না তাই কর্তৃত্ববাদী শাসকের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। এই সীমিত স্বাধীনতা শুধু যে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের পথ প্রশস্ত করে তা-ই নয়, এর ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।
[2] দুর্নীতি
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও কাজের জন্য জবাবদিহির অভাব কর্তৃত্ববাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনকে তার কাজের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। অন্যদিকে এখানে সমস্ত ক্ষমতাই কর্তৃত্ববাদী শাসক বা তার গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এর ফলে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়।
[3] স্বৈরাচারের আশঙ্ক
কর্তৃত্ববাদে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক বা গোষ্ঠীর কুক্ষীগত থাকে বলে তা স্বৈরাচারের চেহারা নিতে পারে-একথা অনেকে মনে করেন। যেহেতু কোনো বিরোধী দল বা বিরোধী শক্তি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় তেমন সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে না, তাই কৃর্তত্ববাদী শাসকের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে।
[4] সীমিত উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অত্যন্ত সীমিত করে রাখে বলে নাগরিকদের মধ্যে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটার কোনো সুযোগ থাকে না। এর ফলে একটা দমবন্ধ করা পরিবেশের সৃষ্টি হয়, যা সৃজনশীল নাগরিকদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠে।
[5] সামাজিক অস্থিরতা
কর্তৃত্ববাদে যেভাবে ভিন্নমতকে দমন করা হয়, তার ফলে জনগণের মধ্যে সামাজিক অস্থিরতা ও অসন্তোষ দেখা দেয় বলে অনেক মনে করেন। শিক্ষিত সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃত্ববাদী শাসকের মতকে মেনে নিতে পারে না। কর্তৃত্ববাদী শাসক নিজের মতকে যেভাবে সবার ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে তাকে মেনে নেওয়াটা সচেতন নাগরিকদের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা ও অসন্তোষ প্রবল আকার ধারণ করে।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে কর্তৃত্ববাদ কখনোই সুশাসন দিতে পারে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বহুত্ববাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে কর্তৃত্ববাদ যেভাবে ক্ষুণ্ণ করে তা সভ্যতার অগ্রগতির পথে এক অন্তরায় ছাড়া আর কিছুই নয়।
22. কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।
কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
কর্তৃত্ববাদের মূল কথা হল চরম রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যে-সমস্ত সরকার এই ধরনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দাবিদার অথবা যে-সমস্ত সরকারের মধ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অস্তিত্ব বিরাজমান, সেই সরকার হল কর্তৃত্ববাদী সরকার। কর্তৃত্ববাদে আইনের বৈধতা বিষয়ক কোনোরকম ক্ষমতা ও অধিকার থাকে না। তা ছাড়া কোনোরকম রাজনৈতিক বিরোধিতাও এখানে অনুপস্থিত। রাজনৈতিক বিরোধিতা কর্তৃত্ববাদে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ নামে পরিচিত। তাই কর্তৃত্ববাদে রাজনৈতিক বিরোধিতাকারীকে চরম নিপীড়নমূলক শাস্তি পেতে হয়।
কর্তৃত্ববাদের দৃষ্টিতে দেশের নাগরিকরা শাসক ও শাসিত-এই দু-ভাগে বিভক্ত। এখানে শাসক নিজেকে ‘I am the State’ নামে অভিহিত করে। তাই এরূপ ব্যবস্থায় শাসক বা সরকার এবং রাষ্ট্রের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করা হয় না। কোনো বিরোধী দল বা শক্তি কোনোরকমভাবে যাতে প্রচারে শামিল হতে না পারে, কর্তৃত্বমূলক সরকার সেদিকে সদা দৃষ্টি রাখে। সরকার এখানে চেষ্টা করে যে, শাসিত জনগণ তাদের মতামতকে যেন কোনোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে। এরূপ ব্যবস্থায় গণসার্বভৌমিকতার ধারণাটির অবসান ঘটে।
কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোনোরূপ সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। মূলত এই ব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যবস্থা হল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যবস্থা। কাজেই কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে বিষয়গুলি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল-কোনো রকম রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, অতিরিক্ত মাত্রায় বলপ্রয়োগ, ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, সামরিক এলিটদের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ প্রভৃতি। কাজেই কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার কতকগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন-
[1] নিয়ন্ত্রণ আরোপ
কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অবাধ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলে না। কর্তৃত্ববাদী শাসক এক্ষেত্রে বাধানিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। কাজেই নির্বাচনের সময় এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের মতো রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা চলে না।
[2] অবাধ অধিকার
কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থায় শাসক বা গোষ্ঠী নিজেদের ‘রাষ্ট্র’ বলে মনে করে। এরূপ ব্যবস্থায় শাসক চূড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ওপর একচেটিয়া বা অবাধ অধিকার আরোপ করে থাকে।
[3] আনুগত্য
কর্তৃত্ববাদী শাসক জনগণের আনুগত্য আদায়ের জন্য বলপ্রয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করে না। কাজেই এই ব্যবস্থায় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে জনগণের উপর সরাসরি আরোপ করা হয়। সরকারের উদ্দেশ্য জনগণের নিকট থেকে আনগুত্য আদায়।
[4] গণমাধ্যম
কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় গণমাধ্যম বা মিডিয়াসমূহের নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা থাকে না। এগুলির ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। বলা যায়, গণমাধ্যমগুলি সরকারের কুক্ষিগত থাকে এবং সরকার কর্তৃক এগুলি নিয়ন্ত্রণ হয়।
[5] মতাদর্শ
কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থায় শাসক দল জনগণের সামনে একটি মতাদর্শ উপস্থিত করে। ক্ষমতাসীন দল যে মতাদর্শ উপস্থাপন করে তা আসলে একটি মনগড়া মতাদর্শ। এরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনের অনুশাসন থাকে না। কাজেই স্বৈরীশাসন কায়েম করার ক্ষেত্রে কোনো বাধাও থাকে না।
[6] বিচারব্যবস্থা
কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগ তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারে না। কারণ এই ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে, এরূপ ব্যবস্থার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল শাসক কর্তৃক বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ।
[7] সামরিক শাসন
কোনো কোনো দেশে সামরিক বাহিনীর প্রধানের দ্বারা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয়। গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে কায়েম হয় কর্তৃত্বমূলক সামরিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এরূপ ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না-বরং বলা যায় যে, নির্বাচনের প্রহসন হয় এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা বিরাজ করে।
[৪] সামরিক প্রবর
কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থায় সামরিক প্রবর বা এলিটদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সমাজে তাদের প্রভাব কার্যকর হলে সামাজিক ব্যবস্থায় অনাবস্থা সৃষ্টি হয়। তারাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
[9] গণতন্ত্র বিরোধী
কখনো-কখনো কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক গৃহীত হলেও, আসলে তা বিরোধী দলগুলির শক্তিকে পরখ করার এবং তাকে দমন করার একটি কৌশল মাত্র।
পরিশেষে, কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় তিনটি রাজনৈতিক ধারার মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। যেমন-সামরিক শাসন, আধা-সামরিক শাসন এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এ ছাড়া কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুটি রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। যথা-একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা।
23. ভারতীয় সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি আলোচনা করো।
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি/ভারতের সংবিধান গঠনগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয়, কার্যত এককেন্দ্রিক-স্বপক্ষে যুক্তি
কাঠামোগত দিক থেকে ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র অথচ সংবিধানের কোথাও ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র বলা হয়নি। বলা হয়েছে, রাজ্যসমূহের ইউনিয়ন (union of states)। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, ভারত কি প্রকৃতই যুক্তরাষ্ট্র?
মূলত, তিন দিক থেকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি বিচার করা যায়- [1] ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত কিছু যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য, [2] ভারতের সংবিধানে অনুপস্থিত কোনো কোনো যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য, [3] ভারতীয় শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি।
[1] ভারতের সংবিধানে’ স্বীকৃত কিছু যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য
সংবিধানে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র বলা না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের মৌল বৈশিষ্ট্যগুলির অস্তিত্ব ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় দেখা যায়। যেমন-
i. দ্বৈত সরকার
যুক্তরাষ্ট্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলির সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। বর্তমানে 2৪টি অঙ্গরাজ্য এবং ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠিত।
ii. লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন- ব্যবস্থার চাহিদা অনুযায়ী ভারতে একটি লিখিত এবং আংশিক দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান রয়েছে।
iii. ক্ষমতা বণ্টন
সংবিধানের সপ্তম তপশিলে তিনটি তালিকার (কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও যুগ্ম) মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলির মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
iv. সংবিধানের প্রাধান্য
সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ মৌলিক আইনের মর্যাদা দিয়ে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। সর্বস্তরের শাসন কর্তৃপক্ষকে সংবিধান মান্য করেই দায়দায়িত্ব সম্পাদন করতে হয়।
v. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের দায়িত্ব পালন করে। সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা ও রক্ষাকর্তা এবং কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধের নিষ্পত্তিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
vi . দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মতোই ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা (পার্লামেন্ট) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, যার উচ্চকক্ষে (রাজ্যসভা) রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়েছে।
vii. স্বতন্ত্র রাজস্বব্যবস্থা
সংবিধানে কেন্দ্র-রাজ্য স্বতন্ত্র রাজস্বব্যবস্থা উল্লিখিত হয়েছে। ফলে কেন্দ্র বা রাজ্য কোনো সরকারকে আর্থিক কারণে অন্য সরকারের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় না।
[2] ভারতের সংবিধানে অনুপস্থিত কয়েকটি যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি মৌল বৈশিষ্ট্য ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় নেই। সেজন্য অনেকে ভারতকে একটি পূর্ণাঙ্গ যুক্তরাষ্ট্র বলে অভিহিত করতে চাননি। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
i. আংশিক দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান
ভারতীয় সংবিধান সম্পূর্ণ দুষ্পরিবর্তনীয় নয়। পার্লামেন্ট সংবিধানের মূল কাঠামো ছাড়া অন্য যে-কোনো অংশের পরিবর্তন করতে সক্ষম।
ii. আইনসভার উচ্চকক্ষে রাজ্যগুলির সমপ্রতিনিধিত্বের অস্বীকৃতি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষে অঙ্গরাজ্যগুলির সমান প্রতিনিধিত্ব স্বীকৃত হয়নি। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিসংখ্যা নির্ধারিত হওয়ায় আইনসভার উচ্চকক্ষে বড়ো ও জনবহুল রাজ্যগুলির থেকে বেশি সংখ্যক এবং ছোটো ও অপেক্ষাকৃত কম জনসংখ্যাবিশিষ্ট রাজ্যগুলি থেকে কম সংখ্যক প্রতিনিধি প্রেরিত হয়।
iii. সুপ্রিমকোর্টের সীমাবদ্ধতা
মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের মতো ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি (অর্থাৎ আইনের গুণাগুণ বিচার) অনুসারে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারে না। তা ছাড়া পার্লামেন্ট ইচ্ছা করলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের রায়কে অকার্যকরী করতে সক্ষম।
iv. রাজ্যগুলির আংশিক স্বাধিকার
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যগুলির স্বাধিকার পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি। পার্লামেন্ট আইন করে যে-কোনো রাজ্যের নাম, সীমানা ইত্যাদি পরিবর্তন করতে পারে।
v. দ্বৈত নাগরিকত্বের অস্বীকৃতি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির অধিবাসীদের আলাদা কোনো নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। ভারতে দ্বৈত নাগরিকত্বের নীতি স্বীকৃত হয়নি।
vi . রাজ্যগুলির স্বতন্ত্র সংবিধানের অনুপস্থিতি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইটজারল্যান্ডের মতো ভারতে অঙ্গরাজ্যগুলির স্বতন্ত্র কোনো সংবিধান নেই। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় শাসনব্যবস্থাই একটিমাত্র সংবিধানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
vii. স্বতন্ত্র রাজ্য বিচারব্যবস্থার অস্বীকৃতি
ভারতের বিচার- ব্যবস্থা এক ও অখণ্ড। স্বতন্ত্র রাজ্য বিচারব্যবস্থা এখানে স্বীকৃত হয়নি।
[3] ভারতীয় শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি
ভারতীয় শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে কেন্দ্রিকতার প্রতি একটা প্রবল ঝোঁক লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই কেন্দ্রপ্রবণতা সুস্পষ্ট।
i. গঠন: গঠনগত দিক থেকে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, একত্রীকরণ বা বিভক্তিকরণ-এই দুটি পদ্ধতির কোনোটির মাধ্যমেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়নি।
ii. আইন: কেন্দ্রীয়-তালিকা, রাজ্য-তালিকা এবং যুগ্ম- তালিকা- ক্ষমতা বণ্টনের এই তিনটি তালিকার বাইরে অবশিষ্ট ক্ষমতাগুলি এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এ ছাড়া-
① যুগ্ম-তালিকাভুক্ত বিষয়গুলিতে রাজ্যের কোনো আইন কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হলে রাজ্যের আইনের অসংগতিপূর্ণ অংশ বাতিল বলে বিবেচিত হয়।
② রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে রাজ্যগুলির একক ক্ষমতা স্বীকৃত হলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইনসভা বা সংসদের রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রয়েছে।
③ রাষ্ট্রপতি কোনো রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থা ঘোষণা করে সেই রাজ্যের আইনসভার ক্ষমতা সংসদের হাতে দিতে পারেন [356 নং ধারা]।
④ রাজ্যপাল মনে করলে রাজ্য আইনসভায় গৃহীত কোনো বিলকে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারেন। এ ছাড়া কেন্দ্রের নির্দেশে রাজ্যপাল বিলে স্বাক্ষর দিতে অসম্মতি জানিয়ে বা পুনর্বিবেচনার জন্য সেটিকে আইনসভার কাছে ফেরত পাঠিয়ে রাজ্য আইনসভার কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন।
iii. প্রশাসন
① 256 নং ধারা: সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে সংসদীয় আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রশাসন পরিচালনা করতে হয়।
② 257 (1) নং ধারা: সংবিধানে বলা হয়েছে যে রাজ্যগুলিকে এমনভাবে শাসনক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে যাতে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়ে পড়ে।
③ 257 (2) ও (3) নং ধারা: জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য বা সামরিক কারণে কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রাজ্যের অন্তর্গত রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশ দিতে পারে।
④ 258 (1) নং ধারা: সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের সম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপতি শর্তসাপেক্ষে বা শর্তহীনভাবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার বা রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের ওপর বিশেষ কয়েকটি কাজের দায়িত্ব দিতে পারেন।
⑤ 262 নং ধারা: আন্তঃরাজ্য নদী এবং নদী উপত্যকাগুলিকে নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিরোধ বাধলে, কেন্দ্রীয় আইনসভা আইন প্রণয়ন করে তার নিষ্পত্তি করতে পারে।
⑥ 263 নং ধারা: প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সহযোগিতার জন্য রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন মনে করলে আন্তঃরাজ্য পরিষদ গঠন করতে পারেন।
⑦ 312 নং ধারা: সংবিধান অনুসারে সমগ্র দেশের জন্য পদস্থ প্রশাসনিক কর্মচারী (IAS) এবং পদস্থ পুলিশ কর্মচারী (IPS) নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে।
⑧ 352 নং ধারা: সমগ্র দেশে বা দেশের কোনো অংশে জরুরি অবস্থা জারি হলে, রাজ্যের যাবতীয় প্রশাসনিক কাজকর্ম কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
⑨ 356 নং ধারা: সংবিধানের 356 নং ধারা অনুসারে কোনো রাজ্য সরকার কেন্দ্রের নির্দেশ যথাযথভাবে মেনে না চললে, রাষ্ট্রপতি ‘শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা’ জারি করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের শাসনভার সরাসরি নিজের হাতে অথবা রাজ্যপাল বা অন্য কোনো শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে দিতে পারেন।
⑩ রাজ্যপালদের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ: রাষ্ট্রপতি রাজ্যগুলির প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে রাজ্যপালকে নিয়োগ করেন। রাষ্ট্রপতির পরামর্শদাতা হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা রাজ্যপালের নিয়োগ ও অপসারণের ব্যাপারে ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
iv. আর্থিক বিষয়
আর্থিক বিষয়েও কেন্দ্রের প্রাধান্য দেখা যায়। যেমন-
① রাজ্য ও কেন্দ্রীয় তালিকা-বহির্ভূত বিষয় সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন দুটি পৃথক তালিকায় করা হলেও দুটি তালিকার বাইরে অবশিষ্ট ক্ষমতাগুলি কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত হয়েছে।
② অর্থ কমিশন নিয়োগের ক্ষমতা: প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি অর্থ কমিশন গঠন করেন। অর্থ কমিশন সম্পূর্ণরূপে একটি কেন্দ্রীয় কমিশন হওয়ায় এক্ষেত্রে কেন্দ্র পরোক্ষভাবে রাজ্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়।
③ আর্থিক জরুরি অবস্থায় রাজ্যের আর্থিক নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা: সংবিধানের 360 নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রাজ্য সরকারগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নীতি অনুসরণের নির্দেশ দেন।
④ রাজ্যগুলির হিসাবনিকাশ পরীক্ষার ক্ষমতা: রাজ্য সরকারগুলির আয়ব্যয় ও লেনদেনের হিসাব পরীক্ষার জন্য অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল এবং কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। এ ছাড়া কেন্দ্র কর্তৃক যোজনা কমিশন (Plan- ning Commission) গঠন, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর আর্থিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রপ্রাধান্যের ইঙ্গিত দেয়।
মন্তব্য
এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত শক্তিশালী এবং রাজ্যগুলির ক্ষমতা বিশেষভাবে সীমিত। এই কারণে অনেকে মনে করেন, ভারতের সংবিধান গঠনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কিন্তু কার্যত এককেন্দ্রিক। অধ্যাপক কে সি হোয়ার ভারতকে একটি আধা-যুক্তরাষ্ট্র (Quasi-Federal) বলে অভিহিত করেছেন। তবে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতিকে সহযোগিতামূলক বা সমবায়িক যুক্তরাষ্ট্র বলে অভিহিত করাই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর