|  | 
| সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা রচনা | 
ভূমিকা
‘আয় আরো হাতে হাত রেখে/আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’-কবির এই উক্তিটি সাম্প্রদায়িকতাকে দূর করার ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ হল ভারতের মূল সুর। কারণ ভারতবর্ষে ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’ কিন্তু মহান এই ভারতবর্ষে কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র বারবার দেশের পবিত্র মাটিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে করেছে কলঙ্কিত। কিছু মৌলবাদী শক্তি তাদের পৈশাচিকতার রক্তে নিজেদের হাতকে করেছে কালিমালিপ্ত। তবুও ভারতবর্ষের মানুষ কোনোদিন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেয়নি। ছাত্রসমাজের উচিত পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে তাদের উদার মনোভাব গ্রহণ করে সাম্প্রদায়িকতার বীজ তুলে ফেলা। ছাত্র-যুবসমাজই পারে সাম্প্রদায়িকতাহীন নতুন ভারত গড়তে।
সাম্প্রদায়িকতা
সম্প্রদায় থেকে ‘সাম্প্রদায়িক’ (সং সম্প্রদায় ইক্) শব্দের উৎপত্তি। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতা হল সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তা ও কর্মের ফলশ্রুতি। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে ঘৃণার চোখে দেখবে, পরস্পর পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণু হবে-এটা কোনো সম্প্রদায়ের কাছে কাম্য নয়। শুধু তাই নয়, ধর্মকে অস্ত্র করে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা, ক্রোধ ও বিদ্বেষ সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপকে উস্কে দেয়। ফলে শুরু হয় মার-দাঙ্গা, হানাহানি-যা মনুষ্যত্বের পক্ষে অপমানজনক।
উৎস
কারো কারো মতে, ভারতের সাম্প্রদায়িকতার উৎস হল দেশবিভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ। একথা অনেকাংশে সত্য হলেও সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ বঙ্গভঙ্গের সময় সাম্প্রদায়িকতা বা হিন্দু-মুসলমান বিরোধের ক্ষেত্রে লর্ড কার্জনকে দায়ী করা হত। তাহলে লর্ড কার্জন চলে যাওয়ার পর কিম্বা ইংরেজ দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর দেশে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ফিরে আসত। তা তো হয়নি। আসলে বহুদিন ধরে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও অসহিষুতা বর্তমানের সাম্প্রদায়িকতার মূলে।
কারণ
ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় আদর্শ। সে কারণেই ধর্মে-ধর্মে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন দেখা দেয়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বলিষ্ঠতা, অধিকারের একচেটিয়া রূপ নেওয়ায় সাম্প্রদায়িকতা দেখা দিল। দ্বিতীয়ত, ধর্মের অপব্যাখ্যা সাম্প্রদায়িকতার প্রধান হাতিয়ার। মানুষ ভুলে গেল ধর্মের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ধর্ম। মানবধর্মের থেকে কোনো ধর্ম যে বড় নয়-এই বোধ থেকে বিচ্যুতি মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে তুলল। তৃতীয়ত, আমাদের দেশ যেহেতু গণতান্ত্রিক দেশ, তাই ক্ষমতা দখলের জন্য সোজা পদ্ধতি হল তথাকথিত ধর্মের নামে সুড়সুড়ি দেওয়া। তাতে যথার্থ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত মানুষ বেশি সাড়া দেয়। রাজনৈতিক নেতাদের সেই বুদ্ধি আছে। তাই তারা নির্বিবাদে ছিন্নমস্তার মতো একে অপরকে উস্কে দিয়ে মনুষ্যত্বের অবমাননা করে। এমনকি এক রাজনৈতিক দল কোনো সম্প্রদায়ের সমর্থক হলে বিরোধী দল অন্য সম্প্রদায়ের পক্ষ গ্রহণ করে-প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। ফলে সাম্প্রদায়িকতার একটা রাজনৈতিক মেরুকরণ হওয়ায় তার পরমায়ু বেড়ে যায়, আর বেঘোরে প্রাণ হারায় বা প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হয় কিছু নিরপরাধ মানুষ। চতুর্থত, ধর্মীয় নেতাদের অপরিণামদর্শিতা ও স্বার্থপরতা সাম্প্রদায়িকতার পেছনে ক্রিয়াশীল। তাঁদের শিক্ষা বা অনুগামীদের বোঝানো উচিত কোনো ধর্মই বড়ো বা ছোটো নয়, সব ধর্মই সমান। ধর্মের নামে ভণ্ডামি কোনো ধর্মের মূল নীতি নয়। পঞ্চমত, সহিষ্কৃতা যে মানুষের একটা বড়ো গুণ, তা আজ তারা ভুলতে বসেছে। ভুলতে বসেছে প্রত্যেক ধর্মের রীতিনীতিগত পার্থক্য থাকবেই। তাই বিসদৃশের মধ্যে সদৃশকে খুঁজে নেবার মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি ছাত্র সমাজের পশ্চাদপদতা এবং অশিক্ষাও সাম্প্রদায়িকতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। ছাত্রসমাজ হবে উদার মানসিকতাসম্পন্ন, তারা সমস্ত কুসংস্কার ও মৌলবাদকে দূরে সরিয়ে রেখে মহান মানবধর্মে দীক্ষিত হবে। অজ্ঞানতার আবরণ থাকলে সাম্প্রদায়িকতা থাকবেই।
প্রতিকার
মানবতাবাদী ভারত সাধকেরা এই সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে অহিংস পথের নিদর্শন রেখেছেন। তাঁরাই শিখিয়েছেন পরমত সহিষ্কৃতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা, অমোঘ শক্তি অর্জনের মন্ত্র। সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে আপামর মানুষদের। দ্বিতীয়ত, যাঁরা শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্মীয় শিক্ষা দেন, তাঁদেরকে উপলব্ধি করতে হবে যে, এই বিশ্বায়নের বাজারে শুধু ধর্মীয় শিক্ষায় কিছু হবে না, অন্যান্য শিক্ষাও গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, মানুষের জন্য ধর্ম-একথাটি ভুললে চলবে না। সবই এক ঈশ্বরের সন্তান। আল্লাহ, ভগবান, গড সবই তো একাকার। শ্রীরামকৃষ্ণের মতে সবাই পানাপুকুরের বুদ্বুদ, জলই আসল সত্য। জলকে পানি বল, ওয়াটার বল আর জলই বল তাতে গুণের কোনো রকমফের হয় না। তেমনি জগদীশ্বরকে ভগবান, আল্লাহ, গড় যেই নামে ডাকা হোক্ না কেন তাতে তাঁর কোনো হানি হয় না।
ছাত্রদের করণীয়
ছাত্ররাই পারে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষার মিথ্যা মোহ মুছে ফেলে নিজস্ব গণ্ডীর বাইরে এসে মানবাত্মার নামে শপথ গ্রহণ করতে। বিদ্যালয়ে ছাত্র-যুবকদের জন্য সংহতি কমিটি গঠন করে, স্বার্থান্বেষীদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। ছাত্রদের বিভিন্ন মনীষীদের আদর্শকে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদেরকে মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করা-যাতে তারা সর্বমানবিক কল্যাণবোধের আদর্শে দীক্ষিত হতে পারে। কোনো সুবিধাবাদী নীতি নয়, যথার্থ আদর্শ বোধ-ই হবে ছাত্রদের মূল লক্ষ্য। এজন্য ব্যাপক প্রচার ও প্রতিবাদী মানসিকতাও দরকার—যাতে তারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং সকলকে সচেতন করতে পারে। রাজনৈতিক নেতাদের ভোটের ঝুলি ভরানোর জন্যে সাম্প্রদায়িক তাস খেলার কূট অভিসন্ধিকে নস্যাৎ করে দিতে হবে ছাত্র সমাজকে। কেননা সাম্প্রদায়িকতা মানবতার চিরশত্রু।
উপসংহার
আজকের দিনে সর্বাগ্রে যে বিষয়টির প্রয়োজন তা হল-ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও সহিমুতা। রবীন্দ্রনাথ প্রতিকারের উপায় হিসাবে বলেছেন, ‘মনের পরিবর্তনে, যুগের পরিবর্তনে তা সম্ভব।’ আর্থিক সম্পদের সুষম বণ্টন করে, যথার্থ শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে, মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করতে হবে। তাছাড়া যদি ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে ভারতের অখণ্ডত্ব তথা জাতীয় সংহতির ধারণাকে তুলে ধরা যায় তাহলে আমরা নিশ্চয়ই কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে পারব-‘রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন?’