সাম্য ও ন্যায়ের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো

সাম্য ও ন্যায়ের আন্তঃসম্পর্ক
কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সর্বপ্রথম সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাটা জরুরি। স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বকে ন্যায় অখণ্ডতা প্রদান ও ঐক্যবদ্ধ করে। অধ্যাপক ল্যাস্কি মনে করেন, আধুনিক রাষ্ট্রে বৈষম্যকে বজায় রেখে কখনোই প্রকৃত ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেমন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে, তেমনই আইন প্রণয়ন করে। এর ফলে আইনের চোখে সকলে সমান ও আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষণ নীতি গৃহীত হয় এবং আইনসংগত ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। আইনের অনুশাসন নীতি রাজনৈতিক ন্যায়কে সুনিশ্চিত করে। অন্যদিকে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে হয়।
সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত
সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাঁদের মতামত পেশ করেছেন, যথা
(i) প্লেটোর অভিমত: প্লেটো-র মতে, নৈতিক ভাবনারূপে ন্যায়ের সঙ্গে কর্তব্যের বন্ধন থাকলেও সাম্যের তত্ত্ব এখানে সরাসরি আসেনি। সাম্যের মাধ্যমে ন্যায়ের মানবিক ভাবনার প্রচার ঘটেনি। তাঁর ভাবনায় শ্রেণির পার্থক্য, ক্ষমতার শ্রেণিগত সুবিধার কথা প্রাধান্য পেয়েছে।
(ii) বার্কারের অভিমত: সাম্য ও ন্যায়কে একসূত্রে বাঁধার প্রচেষ্টা সর্বপ্রথম অধ্যাপক বার্কার-এর আলোচনায় পরিলক্ষিত হয়। বার্কার সাম্য ও ন্যায়কে পরস্পরের পরিপূরক ধারণা হিসেবে দেখেছেন, তাঁর মতে- (a) সাম্যভিত্তিক সমাজই ন্যায়নির্ভর সমাজের উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করতে পারে, শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যমূলক সমাজে ন্যায়ের কোনো স্থান নেই। (b) আইনগত সাম্যকে কেন্দ্র করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজের সূত্রপাত ঘটে।
(iii) ল্যাস্কির অভিমত: অধ্যাপক ল্যাস্কিও ন্যায় ও সাম্যের সম্পর্কের মধ্যে কোনো বিভেদ করেননি। তিনি বলেছেন যে, সমাজের উদ্বৃত্ত উৎপাদন যদি সকলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হয়, তাহলে সাম্যের সঙ্গে ন্যায়ের কোনো পার্থক্য দেখতে পাওয়া যাবে না।
উপরোক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনা ছাড়াও সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ককে অন্য প্রেক্ষিতেও বিশ্লেষণ করা যায়-
সামাজিক মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে সাম্য ও ন্যায়
সাম্যের ধারণাটি একটি গতিশীল ধারণা। কোনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক মূল্যবোধ সেই সমাজের সাম্যের ধারণাটি নির্মাণ করে। একইভাবে, ন্যায়ের ধারণাটিও একটি সচল ধারণা যা সংশ্লিষ্ট সমাজে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধগুলির দ্বারা নির্ধারিত হয়। সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটলে সংশ্লিষ্ট সমাজের সাম্য ও ন্যায়ের ধারণাটিও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
বণ্টনমূলক ন্যায় ও আনুপাতিক সাম্য
অ্যারিস্টট্ল বণ্টনমূলক ন্যায় এবং আনুপাতিক সাম্যের কথা প্রচার করেছিলেন। বণ্টনমূলক ন্যায়ের ধারণা অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজের প্রতি যে অবদান রাখবে তার ভিত্তিতেই সে তার প্রাপ্য লাভ করবে। এখানে আনুপাতিক সাম্যের নীতিও রয়েছে কারণ, বণ্টনমূলক ন্যায়ে স্বীকৃত যে, যারা সমান তাদের প্রাপ্যও হবে সমান। আবার যারা অসমান, তাদের প্রাপ্যও হবে অসমান।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায়, সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্কে তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, মূল কথা হল সাম্য ও ন্যায় একে অপরের পরিপূরক একটি ধারণা। তাই রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও বিন্যাস হিসেবে সাম্য ও ন্যায়ের ভাবনা দুটি পাশাপাশি অবস্থান করছে।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর