সিসেরোর রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি উল্লেখ করো

ভূমিকা
প্রাচীন কালে রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃত সূত্রপাত ঘটে গ্রিসে। প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল প্রমুখ চিন্তাবিদদের হাত ধরেই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে তাঁদের এই রাষ্ট্রচিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন পাশ্চাত্যের বহু রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রখ্যাত রোমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ মার্ক তুল্লি সিসেরো (১০৬-৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, এবং আইনজ্ঞ। রোমান আইন ও রাষ্ট্রনীতি চর্চার বিকাশে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।
রাষ্ট্রনীতি শীর্ষক গ্রন্থ
সিসেরো রাষ্ট্রনীতি ও দর্শন সম্পর্কে যেসকল গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল- ‘De Republica’ (The Republic), ‘De Legibus’ (The Laws) । এই গ্রন্থ দুটিতে আইনের আলোচনার পাশাপাশি রাষ্ট্র, সরকার, নাগরিকতা, ন্যায়বিচার প্রভৃতি রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
সিসেরোর রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিক
(1) উৎস: সিসেরোর রাষ্ট্রচিন্তার উৎস ছিল প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রদর্শন। রাষ্ট্রচিন্তা গঠনের ক্ষেত্রে তিনি প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল, পলিবিয়াস প্রমুখ গ্রিক চিন্তাবিদদের রাষ্ট্রচিন্তা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। গ্রিক স্টোয়িক দর্শনও তাঁর দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
(2) রাষ্ট্র সম্পর্কে তত্ত্ব: প্রাচীন রোমের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, প্যাট্রিসিয়ান-প্লেবিয়ান দ্বন্দু, দাসবিদ্রোহ, গৃহযুদ্ধ, জুলিয়াস সিজারের হত্যা, প্রভৃতি নানা রাজনৈতিক উত্থানপতনের সাক্ষী ছিলেন সিসেরো। এই ঘটনাগুলি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সিসেরো রাষ্ট্রকে আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি ‘সামাজিক সংগঠন’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর ‘De Republica’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “রাষ্ট্র হল একটি প্রাকৃতিক ও নৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে গড়ে উঠেছে”। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্র ও ব্যক্তি উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
(3) আইন সম্পর্কে তত্ত্ব: সিসেরো ছিলেন প্রাচীন রোমের একজন প্রখ্যাত আইনজ্ঞ। তাই তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল আইনবিধি। তিনি দুইপ্রকার আইনের কথা উল্লেখ করেছেন- (i) প্রাকৃতিক আইন এবং (ii) রাষ্ট্রীয় আইন।
- প্রাকৃতিক আইন: প্রাকৃতিক আইন বলতে বোঝায় সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত প্রাকৃতিক নিয়মকানুন। সিসেরো বলেছেন- “প্রাকৃতিক আইন হল সর্বজনীন, অপরিবর্তনশীল ও চিরন্তন।” প্রাকৃতিক আইনকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। তাই এই আইনের প্রতি রাষ্ট্রের প্রত্যেক ব্যক্তির একান্তভাবে অনুগত থাকা উচিত।
- রাষ্ট্রীয় আইন: রাষ্ট্রীয় আইনগুলি ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের উদ্দেশ্যে মানুষ সৃষ্টি করেছে। সিসেরো বলেছেন, রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও সুস্থভাবে প্রশাসন পরিচালনার স্বার্থে দুই ধরনের আইনকেই ব্যক্তির মেনে চলা উচিত।
(4) সরকার: সিসেরো গ্রিক চিন্তাবিদদের অনুসরণ করে মূলত তিনপ্রকার সরকার বা শাসনব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। যথা-(i) রাজতন্ত্র, (ii) অভিজাততন্ত্র, (iii) গণতন্ত্র। তবে সিসেরো মনে করতেন যে, এই তিন ধরনের সরকারেরই কিছু দোষ-ত্রুটি আছে। তাই এই তিন ধরনের সরকারের ভালো দিক বা গুণগুলির সমন্বয়ে একটি মিশ্র শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠলে তা হবে জনগণের পক্ষে মঙ্গলকর। তিনি অবশ্য আজীবন প্রজাতন্ত্রের স্বপক্ষেই লড়াই করেছেন।
(5) বিশ্ব নাগরিকতা: প্রাচীন রোমের সাম্রাজ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। সিসেরো সর্বজনীন নাগরিকত্বের ধারণাকে তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে তুলে ধরছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সমগ্র পৃথিবী হল একটি কমনওয়েলথ বা রাষ্ট্র সমবায়, যেখানে সকল মানুষ সমান। সকলেই নাগরিকত্ব ভোগের অধিকারী তিনি নাগরিক অধিকার সম্প্রসারণের পক্ষপাতী ছিলেন।
(6) সাম্যনীতি: সিসেরোর রাষ্ট্রদর্শনে সাম্য বা সমতার নীতি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি মানুষে-মানুষে সমতার কথা বলেছেন। তিনি ক্রীতদাস প্রথার বিরোধী ছিলেন। সাম্যনীতিকে তিনি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের এক অপরিহার্য শর্ত বলে উল্লেখ করেন।
(7) ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণের আদর্শ : সিসেরো তাঁর ‘De Republica’ গ্রন্থে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জনকল্যাণের আদর্শের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, ন্যায়বিচার ব্যক্তির নিরাপত্তা ও অধিকারকে সুরক্ষিত করে। তাঁর ধারণা একমাত্র জনকল্যাণকর রাষ্ট্রেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
মূল্যায়ন
(1) ত্রুটি/সীমাবদ্ধতা: সিসেরোর রাষ্ট্রচিন্তা সমালোচনার ঊর্ধ্ব নয়। (i) গ্রিক চিন্তাবিদগণ ও স্টোয়িক দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই সিসেরোর রাষ্ট্রচিন্তা তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। তাই অধ্যাপক ম্যাক্স, স্যাবাইন, গেটেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন, তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে কোনো মৌলিকত্ব নেই। (ii) তাঁর কল্পিত মিশ্র শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বাস্তবে অসম্ভব। (iii) অনেকেই বলেছেন, সিসেরোর বিশ্বজনীন নাগরিকতার ধারণা আকাশকুসুম কল্পনামাত্র।
(2) অবদান : সিসেরোর রাষ্ট্রচিন্তায় কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে তাঁর অবদানকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। তাঁর প্রাকৃতিক আইনের ধারণা এবং সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আদর্শ পরবর্তীকালে রোমসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের আইনবিধি রচনায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল বলা যায়। তা ছাড়া তাঁর কমনওয়েলথ বা বিশ্বজনীন রাষ্ট্র সমবায় গঠনের ভাবনা পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন দিক উন্মোচিত করে।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর