স্বাধীনতার সংজ্ঞা নিরূপণ করো এবং এর প্রকারভেদ আলোচনা করো

স্বাধীনতার সংজ্ঞা নিরূপণ করো এবং এর প্রকারভেদ আলোচনা করো

স্বাধীনতার সংজ্ঞা নিরূপণ করো এবং এর প্রকারভেদ আলোচনা করো
স্বাধীনতার সংজ্ঞা নিরূপণ করো এবং এর প্রকারভেদ আলোচনা করো

স্বাধীনতার সংজ্ঞা

স্বাধীনতা বিষয়ে গৃহীত সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায়, স্বাধীনতা হল অধিকারের ফল। অতি শাসনের বিপরীত অবস্থাই হল স্বাধীনতা। বিনা বাধায় নিজ ব্যক্তিত্ব বিকাশ করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠে স্বাধীনতার সংজ্ঞাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু সংজ্ঞা নিম্নে আলোচনা করা হল-

জন স্টুয়ার্ট মিল

জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ‘On Liberty’ শীর্ষক গ্রন্থে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা হল ব্যক্তির চিন্তাধারার অব্যাহত প্রকাশ।

রুশো

রুশো স্বাধীনতা বলতে বুঝিয়েছেন সেই রাজনৈতিক পরিবেশ, যা মানুষকে সরল ও সীমাবদ্ধ জীব থেকে উন্নত, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীবে পরিণত করে।

বার্কার

অধ্যাপক বার্কার তাঁর ‘Political Thought in England’ 1848-1914 শীর্ষক রচনায় স্বাধীনতাকে একটি আইনগত ধারণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা ভোগকে নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির কাজকর্মের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকাটা দরকার। তিনি স্বাধীনতাকে একটি নীতি হিসেবে দেখেছেন, যার মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তির সামর্থ্যের সর্বাধিক বিকাশ ঘটানো।

ল্যাস্কি

অধ্যাপক ল্যাস্কি নেতিবাচক অর্থে স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, স্বাধীনতা হল সমাজের বিশেষ কিছু অবস্থার উপর থেকে বিধিনিষেধের অপসারণ ঘটানো। অপরদিকে ইতিবাচক অর্থে তিনি বলেছেন, স্বাধীনতা বলতে এমন এক পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণকে বোঝায়, যেখানে ব্যক্তি তার আত্মবিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ ভোগ করতে পারে।

গ্রিন

গ্রিন ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতার ধারণটি বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা হল চরম উৎকৃষ্টতা যা কোনো কিছু সম্পাদন করা বা যা আমরা একযোগে অপরের সঙ্গে সম্পাদন করতে পারি।

স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ বা প্রকারভেদ

প্রাকৃতিক স্বাধীনতা

রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বাবস্থায় মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করে যে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত, তাকে প্রাকৃতিক স্বাধীনতা বলা হয়। তবে বাকুনিন-এর মতো নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকরা প্রাকৃতিক স্বাধীনতাকে অবাস্তব কল্পনা বলে অভিহিত করেছেন।

জাতীয় স্বাধীনতা

জাতীয় স্বাধীনতার অর্থ হল, যেসকল দেশ অন্য কোনো রাষ্ট্রের অধীনে নয়, সেই সকল দেশ জাতীয় স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। জাতীয় স্বাধীনতা বলতে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার স্বাধীনতাকে বোঝায়। এইরূপ স্বাধীনতা সকল প্রকার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত।

সামাজিক স্বাধীনতা

সামাজিক স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, মানুষ সমাজে স্বাধীনভাবে বাস করবে এবং তার চলাফেরার উপর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ বা বাধানিষেধ থাকবে না। মূলত রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্য দিয়ে সামাজিক স্বাধীনতা রক্ষিত হয়।

আইনসংগত স্বাধীনতা

রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত, সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে আইনসংগত স্বাধীনতা বলা হয়। প্রকৃতিগত বিচারে এইরূপ স্বাধীনতা সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট এবং সুনিয়ন্ত্রিত। আইনসংগত স্বাধীনতাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা-

(i) ব্যক্তিগত স্বাধীনতা: ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অর্থ হল নিজেদের দ্বারা শাসিত হওয়া, ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণ এবং আত্মবিকাশের সর্বপ্রকার সুযোগ লাভ করা। আসলে গ্রিক দার্শনিকরা সম্প্রদায়গত স্বাধীনতার আলোকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে বিচার করেছেন।

(ii) রাজনৈতিক স্বাধীনতা: রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে তথা রাজনৈতিক কাজে সাধারণ জনগণের সাবলীল অংশগ্রহণের জন্য বেশ কিছু সুযোগসুবিধার উপস্থিতি আবশ্যক। আর এসকল সুযোগসুবিধাই রাজনৈতিক স্বাধীনতা নামে পরিচিত। যেমন-ভোটাধিকার, সকল প্রাপ্তবয়স্ক ও মানসিকভাবে সুস্থ নাগরিকের নির্বাচিত হওয়ার অধিকার।

(iii) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: সমাজে বসবাসকারী মানুষের বাঁচার জন্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা সামাজিক স্বাধীনতা ভোগই যথেষ্ট নয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও আবশ্যক। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অর্থ হল-অভাব, দারিদ্র ও বেকারত্ব থেকে মুক্তি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। এ ছাড়াও আর একটি উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা হল-নৈতিক স্বাধীনতা। নৈতিক স্বাধীনতার অর্থ হল ব্যক্তির নৈতিক বিচারবুদ্ধি ও চেতনার স্বাধীনতা। ইংরেজ আদর্শবাদী দার্শনিক টি এইচ গ্রিন এবং বোসাংকেত প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নৈতিক স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তারা মনে করেন যে, নৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। অপরদিকে তাঁরা এও বলেন যে, নৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment