স্বাধীনতা ও সাম্য কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত তা আলোচনা করো

স্বাধীনতা ও সাম্য কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত তা আলোচনা করো
স্বাধীনতা ও সাম্য কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত তা আলোচনা করো।

স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক

স্বাধীনতা ও সামোর মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের সমস্যাটি মূলত ইতিহাসগত। কারণ প্রতিটি সমাজব্যবস্থাতেই স্বাধীনতা একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে লালিত হয়েছে। স্বাধীনতার সব সুবিধাটুকু ওই বিশেষ শ্রেণিই ভোগ করে এসেছে। প্রতিটি সমাজব্যবস্থাতেই স্বাধীনতাকে একটি বিশেষ শ্রেণি এমনভাবে ভোগ করে এসেছে যে তারা এ কথা কখনও মনে করেনি যে, সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব নয়। তাই সাম্য ও স্বাধীনতার সামঞ্জস্যবিধানের ক্ষেত্রে দুটি পরস্পরবিরোধী মত দেখা যায়।

স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরবিরোধী

স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে। এই ধারণায় যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-ডি টকডিল, লর্ড অ্যাক্টন, হার্বাট স্পেন্সার, লেকি প্রমুখ। এঁদের অভিমত হল-

[1] সম্পত্তি ও ক্ষমতা অর্জন: 

ব্যক্তির সম্পত্তি ও ক্ষমতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তিই যদি স্বাধীনতা হয়, তাহলে তা অবশ্যই সাম্যের বিরোধী হয়ে উঠবে। স্বাধীনতা ও সামোর মধ্যে এখানে দেখা দেবে চরম বিরোধ।

[2] স্বাভাবিক স্বাধীনতা: 

এঁদের মতানুসারে, সমাজে যখনই স্বাধীনতা প্রযুক্ত হয়েছে, তখনই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ববিকাশের স্বাধীনতা তথা স্বাভাবিক স্বাধীনতা ব্যাহত হয়েছে এবং সমাজকাঠামোতে দেখু দিয়েছে বিশৃঙ্খলা।

[3] স্বাধীনতা বাধাস্বরূপ: 

লর্ড অ্যাক্টন উল্লেখ করেছেন যে, সাম্য স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার আগমনকে বাস্তবায়িত হতে দেয় না। সাম্য স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা তাই বাধাস্বরূপ।

[4] নিয়ন্ত্রণের কঠোরতা: 

এই ধারণার সমর্থকদের মতে, সাম্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ জড়িত। নিয়ন্ত্রণের কঠোরতা ছাড়া সাম্য স্থাপন করা যায় না। নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্ত হলে স্বাধীনতা অস্বীকৃত হবে। তাই তাঁরা মনে করেন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে গেলে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা প্রয়োজন, যেখানে সামোর অনুপস্থিতিই কাম্য।

[5] সাম্য গণতন্ত্রবিরোধী: 

লেকি তাঁর ‘Democracy and Liberty’ নামক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, স্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটি বিরোধী ধারণা। কারণ তা গণতন্ত্রের শ্রেণিবিন্যাসের ভারসাম্যকে ধূলিসাৎ করে।

[6] পারস্পরিকতা: 

সাম্যের ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করলে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যক্তির ক্রিয়াকর্ম আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, ফলে স্বাধীনতার ধারণাটি বাধাপ্রাপ্ত হবে।।

স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান

সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের প্রচেষ্টা প্রথম পরিলক্ষিত হয় ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে। সামন্ততান্ত্রিকতা ও রাজশক্তির বিরুদ্ধে এইসময় সকল সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা ও সাম্যের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল।

[1] ল্যাস্কির বক্তব্য: 

অধ্যাপক ল্যাঙ্কি সাম্য ও স্বাধীনতাকে আলাদাভাবে দেখতে চাননি। তিনি মনে করেন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ববিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন। এই পরিবেশের জন্য সকলেই সামা ও স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টিকে নজরে রাখে। তিনি স্বাধীনতা ও সাম্যকে একই আদর্শভিত্তিক বলে মনে করেন। 

[2] রুশোর বক্তব্য: 

ফরাসি দার্শনিক রুশো স্বাধীনতা ও সামোর মধ্যে কোনো বিরোধ দেখেননি। বরং তাঁর ধারণায় স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরের পরিপূরক। সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা অস্তিত্ববিহীন।

[3] স্টুয়ার্ট মিলের মন্তব্য: 

জন স্টুয়ার্ট মিল মনে করেন যে, সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। স্বাধীনতার বিকাশের জন্য অর্থনৈতিক সাম্যের প্রয়োজন।

[4] উনির মন্তব্য:

টনি (RH Tawnay) মনে করেন যে, সাম্য স্বাধীনতার বিরোধী নয়, বরং স্বাধীনতা বজায়। রাখতে গেলে অধিক পরিমাণে সাম্যের প্রয়োজন আছে। সাম্যহীন স্বাধীনতা হতে পারে না। ক্ষমতার বৈষম্য, সামাজিক সম্পদের বৈষম্য, আইনের বৈষম্য প্রভৃতিকে দূর করে সাম্য মানুষের স্বাধীনতাকে বিকশিত হওয়ার পথ করে দেয়। স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলে, ব্যক্তি লাভ করে বস্তুগত স্বাধীনতা ও বৌদ্ধিক নিরাপত্তা।

[5] মার্কসবাদীদের বক্তব্য: 

মার্কসবাদী লেখকগণও সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্কের কথা বলেছেন। [ তাঁরা সামাকে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত বলে মনে করেন। যতদিন সমাজে শ্রেণিবিভাজন থাকবে, ততদিন স্বাধীনতাও বাধাপ্রাপ্ত হবে। সামাজিক অসাম্যের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বিকাশ ঘটতে পারে না।। মার্কসবাদীদের মতে, সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে ধনতান্ত্রিক আস্ফালন বিলুপ্ত হবে এবং শ্রেণিবিরোধের অবসান ঘটবে। এরূপ সমাজেই স্বাধীনতার যথার্থ প্রয়োগ সম্ভব হবে। সুতরাং বলা যায় যে, সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা থাকতে পারে না।

উপসংহার: 

আইনের দৃষ্টিতে সাম্য কথাটি স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে আইন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না-তা সকলের। রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও অনুরূপ কথা প্রযোজ্য। কোনো শাসকগোষ্ঠীর সামান্য কিছু এলিট যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে, তাহলে সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। একইভাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, যদি সমাজে মুষ্টিমেয় মানুষ ধনসম্পদের অধিকারী হয় ও এর সুযোগসুবিধা লাভ করে, তাহলে বেশিরভাগ মানুষ হবে বিপদগ্রস্ত। এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হল সাম্যপ্রতিষ্ঠা। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য থাকবে না, প্রভু-ভৃত্যের মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটবে।

Leave a Comment