স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করো

স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করো
স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করো

স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্ব

প্রচলিত অর্থে স্বাধীনতা বলতে বোঝায় অপরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ও স্ব-অধীনে থাকা এবং এই অবস্থায় নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করা। কিন্তু স্বাধীনতা সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার সঙ্গে প্রচলিত ধারণার কোনো সামঞ্জস পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার ধারণা বিষয়ে এঙ্গেল্স তাঁর Anti-Duehring নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, “Freedom is therefore the mean between judgement and impulse, reason and unreason, and its degree in each individual case can be determined on the basis of experience by a personal equation, to use an astronomical expression.” তবে মার্কসীয় আলোচনায় স্পিনোজা ও হেগেলের প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগা।

স্পিনোজা ও হেগেলের প্রভাব

স্পিনোজা মনে করেন যে, মানুষ তার জ্ঞানের অনুসন্ধান করে প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের জনা এবং এর থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, বিষয়গত পরিস্থিতির মধ্যেই মানুষ তার স্বাধীনতাভোগের সুযোগ করে নেয়। অর্থাৎ মানুষ তার জ্ঞানের উপযোগিতার ভিত্তিতেই কাজের স্বাধীনতার সম্ভাব্যতা আছে বলে মনে করে। আবার হেগেল মনে করেন, মানুষের ইচ্ছা ইতিহাসনির্ভর, তা স্বয়ম্ভূত কোনো বিষয় নয়। মানুষের ইতিহাসই তার স্বাধীনতার বস্তুগত রূপটিকে বুঝিয়ে দেয়। অতএব দেখা যায় যে, স্পিনোজা ও হেগেল উভয়ই তাঁদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত আলোচনায় যে জ্ঞান অন্বেষণের কথা বলেছেন, তা তাৎপর্যমন্ডিত। কারণ মার্কসবাদের আলোচনায় এই দার্শনিকদের প্রভাব ছিল বিভর। জোন ও স্বাধীনতার বিষয়টি যে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত, তা মার্কসবাদকে প্রভাবিত করে।

স্বাধীনতা সম্পর্কে লেনিনের অভিমত

লেনিন তাঁর ‘মেটিরিয়ালিজম অ্যান্ড ইম্পিরিও-ক্রিটিসিজ’ নামক গ্রন্থে স্বাধীনতাকে চারটি সূত্রের দ্বারা প্রকাশ করেছেন। যথা- 

[1] বস্তুজগৎ সম্পর্কিত জ্ঞান: 

লেনিন মনে করেন স্বাধীনতা এবং আমাদের চারপাশে যে বস্তুজগৎ সম্পর্কিত জ্ঞান রয়েছে, তাদের উত্তয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই বস্তুজগৎ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব থাকলে তা স্বাধীনতার বিরোধী বলে পরিগণিত হবে। এর কারণ হল বাস্তি যেহেতু বস্তুজগতের নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ, যেহেতু এই নিয়মের বাইরে গিয়ে ব্যক্তি তার স্বাধীনতার প্রকাশ ঘটাতে পারে না, অতএব, ব্যক্তি বস্তুজগৎকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই নিজেকে স্বাধীন বলে মনে করতে পারে। বস্তুজগতের নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে রূপান্তরের জ্ঞানলাভের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেই তা সম্ভব হবে।

[2] বস্তুজগতের ওপর ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছার নির্ভরতা: 

ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা বস্তুজগতের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। যদিও ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাই প্রধান নয়, তা গৌশ। মুখা হল বস্তুজগতের প্রয়োজনীয়তা। বস্তুজগতের ওপর ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা নির্ভর করে বলেই সে চায় বস্তুজগৎকে পরিবর্তন করতে এবং এর ফলে সে লাভ করে স্বাধীনতার মূল সুর। অপর দিকে বস্তুজগতের ওপর ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা নির্ভর না করে যদি বস্তুজগৎই ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত, তাহলে ব্যক্তির পক্ষে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া সম্ভব হত না।

[3] জ্ঞানবিজ্ঞানের চেতনা ও সামাজিক অগ্রগতি: 

জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে স্বাধীনতার পরবর্তী স্তরটি একীভূত থাকে। কারণ বস্তুজগৎ সম্পর্কে যখনই জ্ঞানের মাত্রা বাড়ে, তখনই স্বাধীনতার সম্পর্কেরও প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ বস্তুজগৎ সম্পর্কিত মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানের চেতনা এবং সামাজিক অগ্রগতি পারস্পরিকভাবে বাড়ে। একইসঙ্গে স্বাধীনতার ধারণাটির অগ্রগমনও সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়। অর্থাৎ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটলে সমাজের অগ্রগতিও তার পূর্ণাঙ্গ রূপটি তুলে ধরতে পারে। অতএব বলা যায় যে, স্বাধীনতার বাস্তব রূপ হল সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা-যা শোষণহীন একটি সমাজের জন্ম দেবে।

[4] মানুষের সচেতন কার্যপ্রণালী দ্বারা স্বাধীনতার বাস্তবায়ন: 

জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষকে স্বাধীনতার দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করালেও, মানুষের সচেতন কার্যপ্রণালীই স্বাধীনতাকে বাস্তবায়িত করে। অর্থাৎ বলা যায় মানুষ বস্তুজগৎ সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞানলাভের পর স্বাধীনতার জনাই সচেতনভাবে তার প্রয়োগ ঘটায়। আবার যখনই সে বস্তুজগৎকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়, তখনই সে স্বাধীনতাকে লাভ করতে পারে। তাই সচেতন অন্বেষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ক্রিয়াকলাপের সংযুক্তিতে স্বাধীনতাও একান্তভাবে যুক্ত।
মার্কসবাদ মনে করে শোষণহীন সমাজই স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিতে পারে। এই অর্থে স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয় হল-[1] স্বাধীনতার ব্যাপকতার সঙ্গে শ্রমমুক্তির বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কারণ মানুষ যখন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটানোর জন্য নিজেকে প্রকৃতিজগৎ থেকে আলাদা করে ভাববে এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতাটিও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে, তখন স্বাধীনতারও আবির্ভাব ঘটবে। [2] একদিকে মানুষ যেমন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে তার শ্রমক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে স্বাধীন সৃজনমূলক সত্তাকে উপস্থাপন করতে পারে, তেমনই তাকে স্বাভাবিক নিয়ম সম্পর্কে জ্ঞানও অর্জন করতে হয়।

Leave a Comment