হেরোডোটাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও এবং তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ে আলোকপাত করো

হেরোডোটাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও এবং তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ে আলোকপাত করো

দলের গ্রিসের ধ্রুপদি যুগের দুই বিখ্যাত ঐতিহাসিক হলেন হেরোডোটাস (Herodotus) ও থুকিডিডিস (Thucydides)। এঁরা সরাসরি রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেননি। তবে এঁদের ইতিহাস রচনার ধারা ও বিষয়বস্তু থেকে রাষ্ট্রতত্ত্ব বিষয়ে গ্রিক মননের একটা সম্ভাবনার উল্লেখ মেলে।

হেরোডোটাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

ইতিহাস রচনাশৈলী নির্মাণে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতকের চিন্তাবিদগণের চিন্তাশীল মনন। এইরকম গুরুত্বপূর্ণ এক কালপর্বে আবির্ভূত হন গ্রিসের ধ্রুপদি যুগের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হেরোডোটাস। রোমান দার্শনিক সিসেরো হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক আখ্যা দিয়েছেন। আনুমানিক ৪৮৪/৪৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিসের হ্যালিকারনাসাস (Halicarnassus) নামক শহরে জন্ম হয় তাঁর। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, জীবনের প্রথমদিকে হ্যালিকারনাসাসের একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থানজনিত কারণে তিনি নির্বাসিত হন এবং বেশকিছু সময় অতিবাহিত করেন স্যামস (Samos) দ্বীপে ও পরে এথেন্সে। ভ্রমণপিপাসু হেরোডোটাস কোনও একটি স্থানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেননি। ভ্রমণের পাশাপাশি বক্তৃতা প্রদানের উদ্দেশ্যে তিনি মিশর, ব্যাবিলন, ক্রিট প্রভৃতি স্থানে যাত্রা করেছিলেন। বলাবাহুল্য এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন স্থানের অধিবাসীদের সম্পর্কে নানান তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং তার প্রকৃতি সম্পর্কিত বহু তথ্য ও জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৩ অব্দে ইটালির অন্তর্গত গ্রিক উপনিবেশ থুরিতে (Thuri) উপস্থিত হন হেরোডোটাস। পরবর্তীকালে এই থুরিতেই আনুমানিক ৪২৫/৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই প্রখ্যাত গ্রিক ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদের মৃত্যু হয়।

উল্লেখযোগ্য কীর্তি

বিখ্যাত গ্রিক পণ্ডিত হেরোডোটাসের উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল তাঁর রচিত Historia/Histories গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল ৪৯৯ – ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘটিত গ্রিক-পারসিক যুদ্ধ।

হেরোডোটাসের রাষ্ট্রচিন্তা

হেরোডোটাসের ইতিহাস রচনার সূত্র ধরেই তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব বা দর্শন বিষয়ে একটা সূক্ষ্ম ধারণা লাভ করা যেতে পারে।

Historia/Histories-গ্রন্থে প্রতিফলিত রাষ্ট্রদর্শন

হেরোডোটাসের কাছে ইতিহাস হল প্রকৃত ও যথার্থ অনুসন্ধানের ফল। তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বিষয়ের বা ঘটনার যথাযথ উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা প্রদান। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁর নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই অবাক করার মতো। তাঁর গ্রন্থের পরিধি বিপুল বটে, কিন্তু সাবলীল ভাষায় তিনি গ্রিক ও পারসিকদের সংগ্রামকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই গ্রন্থের শেষ ভাগটিতে গ্রিসের প্রাচীন কালের রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, কেবলমাত্র ইতিহাসের ঘটনা বর্ণনার পরিবর্তে হেরোডোটাস ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার অন্তর্নিহিত মূলস্রোত নিয়েও আলোচনা করেছেন, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে।

হেরোডোটাস মনে করতেন যে, মানুষ বা জাতি নিজের সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ। গ্রিক-পারসিক যুদ্ধ নিছক একটি সামরিক সংঘাত নয়। এই সংগ্রাম আসলে দুটি আলাদা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের লড়াই। হেরোডোটাস একে পারসিক রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গ্রিসের উদার ও উন্নত সংস্কৃতির সংঘাত বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ, তিনি স্বৈরাচারী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে স্বাধিকার ও স্বাধীন মানুষের জয়গান করেছেন। হেরোডোটাস মনে করতেন যে, মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিক মনন রাষ্ট্রকে শক্তিশালী এবং উদ্যোগী হতে সাহায্য করে। এথেন্সকে কেন্দ্র করে ধ্রুপদি গ্রিসের উদার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থন হেরোডোটাসের ইতিহাসে পাওয়া যায়।

হেরোডোটাসের ইতিহাস রচনা ও তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব বিষয়ে কিছু সমালোচনা আছে। তা সত্ত্বেও তৎকালীন সময়ের নিরিখে শুধুমাত্র মৌখিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং ভ্রমণ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে যে ইতিহাসগ্রন্থ তিনি রচনা করে পরবর্তী প্রজন্মকে দান করেছেন তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

আরও পড়ুন – গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

Leave a Comment